ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪৫তম ভার্চুয়াল আসরটি জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এই আসরে জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের লোকভাষ্যকার খনা ও খনার বচন নিয়ে আলোচনা করেন ‘’কিংবদন্তির খনা ও খনার বচন” বইয়ের লেখক, বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত সুপরিচিত কথাসাহিত্যিক পূরবী বসু।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি কে?
বাংলার প্রথম নারী কৃষিবিদ কে?
বাংলার প্রথম জ্যোতিষবিদ্যা ও গণিতে পারদর্শী নারী কে?
কে বাংলার প্রথম নারী পরিবেশবিদ?
কার কথিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রখরতায় ঈর্ষান্বিত শ্বশুর ও স্বামী নিজেদের অধঃস্তনতা ও হীনমন্যতা আড়াল করতে প্রাজ্ঞ নারীর জিভ কেটে দিয়েছিলেন?
কার সুলিখিত ছড়া এক বিশেষ ঘরানার লোকশাস্ত্রের জন্ম দেয়, যা বচনাকারে এই কৃষিপ্রধান দেশের সাধারণ মানুষকে কৃষি, স্বাস্থ্য, আবহাওয়া, পশুপালন, পরিবেশ, গৃহনির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান উপদেশ ও ভবিষ্যদ্বাণী প্রদান করে; যে বচনগুলো বাংলার প্রাচীন লোকশাস্ত্রের নমুনা হিসেবে বংশপরম্পরায় আবহমান বাংলার জনজীবনে মিশে আছে?

সব কটি প্রশ্নের উত্তর:
খনা (লীলাবতী)।
খনা বলে কেউ কখনো ছিলেন কি ছিলেন না, বা থাকলে কবে, কোথায় তাঁর জন্ম হয়েছিল, কর্মক্ষেত্রই বা কোথায় এসব নিয়ে নানা মত ও কিংবদন্তি থাকলেও একটি বিষয়ে কারও কোনো মতান্তর নেই, আর তা হলো সময় দ্বারা পরীক্ষিত ও উত্তীর্ণ ‘খনার বচন’-এর অস্তিত্ব ও গুরুত্ব।
বাংলা, উড়িষ্যা, আসাম, বিহারসহ ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে, নেপালে ও তিব্বতে, বিশেষ করে গ্রামীণ লোকজনের কাছে, খনার বচন অত্যন্ত পরিচিত ও আদৃত। এত প্রাচীন হওয়া সত্তে¡ও খনার বচনে ধর্ম, ঈশ্বর ও অলৌকিকতা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। অনুপস্থিত নারী-নিন্দা ও নারীর অবমূল্যায়ন।
খনা নিয়ে আগ্রহ, লেখালেখি চলছে অনেককাল ধরেই। গ্রামসমাজে খনা ছিলেন-আছেন কৃষকের সহায় হয়ে, আছেন মানুষের প্রাত্যহিকতায়। তবে নারী অধিকার বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে, কৃষিতে অধিক শস্য ফলাবার নামে পরিবেশ-প্রতিবেশ অবান্ধব পদ্ধতির কুফল দৃশ্যমান হবার সাথে সাথে, খনা নিয়ে গত কয়েক দশক ধরে নাগরিক আগ্রহ তৈরি হয়েছে দৃশ্যমানভাবে। খনাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে-হচ্ছে নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র। খনাকে প্রান্তিক করে রাখার রাজনীতি, উপস্থাপনের রাজনীতি সহ শ্রেণিগত দ্বা›িদ্বক জায়গা থেকে খনাকে নিয়ে হচ্ছে নানারকম লেখা-আলোচনা।
পাঠশালার এ আসরে আলোচক পূরবী বসু ও সঞ্চালক ফারহানা আজিম শিউলীর মধ্যে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাকৃতজনের কণ্ঠস্বর কিংবদন্তির খনা ও খনার বচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কয়েকটি ভাগে আলোচনা হয়। আলোচনায় “কিংবদন্তির খনা ও খনার বচন” বইটি সহ বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক তথ্য-উৎস থেকে আলোচনা হয়। “কিংবদন্তির খনা ও খনার বচন” ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় “অন্যপ্রকাশ” থেকে প্রকাশিত হয়।

ফারহানা আজিম শিউলী: আমরা জানি, খনা নিয়ে লিখিত কোনো ইতিহাস নেই। খনা ঐতিহাসিক না বরং কিংবদন্তির চরিত্র। তাহলে খনা কে? খনা নামটি কোত্থেকে এসেছে? এবং খনাকে নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তিগুলোই বা কী বলে? এই আখ্যান বা কিংবদন্তিগুলো কিন্তু একভাবে ক্ষমতার রাজনীতি ও ইতিহাসের বৈষম্যের ব্যাকরণকেও স্পষ্ট করে।

পূরবী বসু: বাংলা অভিধানে খনা বলতে বিশেষ্য হিসেবে জ্যোতিষ ও গনিতশাস্ত্রে পারদর্শিনী প্রাচীন বাংলার প্রখ্যাত নারী, মিহিরের স্ত্রী, বরাহের পুত্রবধূকে বোঝায়। আবার বিশেষণ হিসেবে খনা বলতে নাকি সুরে কথা বলাকে বোঝায়।
খনা বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি প্রাচীন বিদূষী এক বাঙালি নারীকে, যিনি ছিলেন একাধারে জ্যোতিষবিদ, গনিতজ্ঞ ও কবি। বাংলা অঞ্চলে কথিত আছে, শুভক্ষণে জন্ম নেওয়ার কারণে তিনি ক্ষণা বা খনা। আবার উড়িয়া ভাষায় খনা বা খোনা মানে বোবা। উড়িষ্যায় প্রচলিত আছে, জিভ কেটে মিহির লীলাবতীকে খোনা করে দেওয়ায় লীলাবতীর নাম হয় খোনা অথবা খনা। আবার কোনো কোনো পÐিতের মতে, খনার বচনগুলোর সঙ্গে যেহেতু দিনক্ষণের একটা সম্পর্ক আছে, সেখানে ‘ক্ষণ’ ত্থেকে ‘খন’ হয়ে ‘খনা’ শব্দটি এসেছে। খনা নিয়ে লিখিত কোনো ইতিহাস নেই। খনার বচন যে খনা না¤œী কোনো নারীরই রচিত লোকশাস্ত্র তার স্বপক্ষেও কোনো জোরালো প্রমাণ নেই। খনাকে জানার জন্য ইতিহাস নয়, ঐতিহ্যের মুখাপেক্ষী হতে হয় আমাদের।
খনার জন্ম ও শিশুকাল নিয়ে মতানৈক্যে ভরা অজস্র কিংবদন্তি আছে, যদিও তাঁর বিয়ে, কর্মজীবন ও মৃত্যু নিয়ে তেমন মতভেদ নেই। খনা ও মিহিরকে নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে:

কিংবদন্তি এক: খনার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসত থানার দেউলি গ্রামে। বাবার নাম অটনাচার্য। খনার একটি বচনে আছে – “আমি অটানাচার্যের বেটি, গনা-বাছায় কারে বা আঁটি।” খনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলার চন্দ্রকেতু গড়ের রাজা ধর্মকেতুর রাজত্বে। বারাসতের অদূরে চন্দ্রগড়ে মাটি খনন করে অতি প্রাচীন যে নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে তা রাজা চন্দ্রকেতুর আমল ও খনার যুগের বলে স্থানীয় লোকেরা মনে করে। এমনকি সেখানে একটি উঁচু পাকা স্থাপনাকে খনা-মিহিরের ঢিবি বা ঢিপি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো কোনো পÐিত অবশ্য এই পুরাকির্ত্তীকে আরো অনেক আগের গুপ্ত যুগের মনে করেন। চব্বিশ পরগণার সেই খননকাজ এখনো চলছে এবং “খনা-মিহিরের ঢিপি”র কারণে জায়গাটি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে। ড. দীনেশচন্দ্র সেন অবশ্য বলেছিলেন, খনার স্বামী মিহির চন্দ্রপুরে দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন। চন্দ্রপুর ছিল চন্দ্রকেতু রাজ্যের একটি গড়।

কিংবদন্তি দুই: খনা সিংহলরাজের মেয়ে। উজ্জয়নীর রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহ। বরাহ তাঁর পুত্রের জন্মকোষ্ঠি গণনা করে পুত্রের আয়ূ মাত্র এক বছর দেখতে পেয়ে শিশুপুত্র মিহিরকে একটি তাম্রপাত্রে বিদ্যাধরীর জলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌঁছালে সিংহলরাজ শিশুটিকে উদ্ধার করে লালনপালন করে, পরে কন্যা লীলাবতীর (খনা) সঙ্গে বিয়ে দেন।

কিংবদন্তি তিন: রাক্ষসরা রাজা-রাণিকে মেরে রাজকন্যা লীলাবতীকে লালনপালন করে লঙ্কা নামের রাক্ষস দ্বীপে। এই রাক্ষসেরাই মিহিরিকেও উদ্ধার করে লালনপালন করে পরে লীলাবতীর সঙ্গে বিয়ে দেয়। পরে লীলাবতী ও মিহির বরাহের কাছে ভারতে চলে আসে। বাকি কাহিনি সব কিংবদন্তিরই মোটামুটি একইরকম।
কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, আর্যরা বহুদিন পর্যন্ত বাংলায় আসতে না-পেরে ক্ষোভ থেকে বাংলার মানুষকে তাঁদের সাহিত্যে ও রচনায় রাক্ষস-বানর-দানব ইত্যাদি নাম দিয়েছে। তাই মিহির-লীলাবতীকে পালন করা রাক্ষসেরা লঙ্কা না, “বংগ-রাক্ষসৈঃ।” পরদেশীরা শুধু লঙ্কাকে না, বাংলাকেও রাক্ষসের দেশ আখ্যা দিয়েছিল। ফলে খনা বঙ্গীয় কোনো দ্বীপবাসিনীও হতে পারেন।

কিংবদন্তি চার: মেহেরপুর শহরের ইতিহাস অনুযায়ী বরাহ, মিহির ও খনা তাঁদের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় মেহেরপুরে বাস করেন। মিহিরের নামানুসারে এই শহরের আদি নাম ছিল মিহিরপুর, যা কালে মেহেরপুরে রূপান্তরিত হয়েছে। অমিত বসুর “বাংলায় ভ্রমণ” বইয়েও আছে মিহির ও খনা এই শহরে বাস করতেন। অবশ্য আরেকমতে, ষোড়শ শতাব্দীতে মেহের আলী নামে এক বুজুর্গ দরবেশ মেহেরপুর শহর স্থাপন করেন। তাঁর নামেই জায়গাটির নাম হয়েছে মেহেরপুর।

কিংবদন্তি পাঁচ: আনুমানিক একাদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ভাস্করানন্দের মেয়ে লীলাবতীও ছিলেন বিদূষী নারী যিনি স্বনামে গণিতের বই লেখেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল করে দুই লীলাবতীকে এক করে ফেলা হয়েছে।
প্রচলিত কিংবদন্তিগুলো একসাথে করে তাহলে দেখা যাচ্ছে, খনার জন্ম – বাংলা (বারাসাত) কিংবা সিংহল। বেড়ে ওঠা – বারাসত (আচার্যের মেয়ে), সিংহল (সিংহলের রাজকন্যা) অথবা রাক্ষসদের রাজত্বে (সিংহল কিংবা বাংলার কোনো দ্বীপে)।
আলোচনার এই পর্যায়ে খনা-মিহিরের ঢিবির স্থিরচিত্র দেখানো হয়। এই জায়গায় এসে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে ইতিহাসের অংশ।

ফারহানা আজিম শিউলী: খনাকে নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তিগুলো শুনে বলা যায়, তাঁর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনায় “জন্মরহস্য” বলে একধরনের “দক্ষিণ এশীয় ফ্যান্টাসি” তৈরি করা হয়। অধিপতি জ্ঞানকাণ্ডের খনা-ভাবনায় খনা ও খনার বচনকে “লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ কৃষিসমাজের বিষয়” হিসেবে এক প্রশ্নহীন অপরত্বের মোড়কে রেখে দেওয়া হয়। এবং দেখা যায় ক্ষমতাবানদের রচিত ইতিহাসে শুধু খনা না, উলগুলান বা মুণ্ডা বিদ্রোহের কারিগর বীরসা মুÐা কিংবা হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ফুলমণি মুর্মুদেরও এভাবেই “অপর” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
খনাকে যেভাবে আমরা বইয়ের মলাটে দেখি, তা নিয়ে প্রতিচিন্তায় “খনার বিজ্ঞান-দর্শন” শিরোনামের লেখায় পার্থ পাভেল লিখছেন, “খনার বচন বিষয়ক প্রতিটি বইয়ের মলাটে প্রচ্ছদের ধরন একই রকম। গ্রামবাংলার কৃষিজীবনের ছবি, বৃষ্টিমুখর দৃশ্য, ধানজমিন, কৃষক-কৃষাণী জমিনে কাজ করছে, কোনো গণক-পুরুষ গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটছে। এসবের ভেতর একজন নারীর ছবি তুলনামূলকভাবে বড় আকার ও জায়গা জুড়ে থাকে। উপস্থাপনে বোঝা যায়, তিনি বাঙালি সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বী বিবাহিত নারী। স্বাস্থ্যবতী ও হাস্যোজ্জ্বল এই নারীর চুল কালো ও দীর্ঘ। সব ছবিতেই এই নারী তাঁর ডান হাত আশীর্বাদদানের মুদ্রা নিয়ে উপস্থাপিত। রংতুলিতে আঁকা এই নারীই খনা। সব ছবিতেই খনাকে একটি বৃত্তের ভেতর আঁকা হয়েছে। কোথাও এই বৃত্তকে পৃথিবী এবং কোথাও সৌরমÐল হিসেবে দেখানো হয়েছে। আমরা জানি, প্রতিটি দৃশ্যমানতাই রাজনৈতিক। খনা বিষয়ে নি¤œবর্গের চিন্তাজগতে যে রূপ তৈরি হয়েছে, তাই উপস্থাপিত হচ্ছে এসব চিত্রের ভেতর। কিংবা অন্যভাবে দেখলে খনার এই চিত্র আমাদের নি¤œবর্গের খনাবিষয়ক এক রূপকল্প। শ্রেণীবিভাজিত সমাজে নি¤œবর্গ তার প্রান্তিকতার জায়গা থেকে খনাকে গ্রহণ করেছে আপন লড়াইয়ের ময়দান হিসেবে। তাই অধিপতি ধারার বিরুদ্ধে খনার এই রূপচিত্র হয়তো নি¤œবর্গের আরেক পাল্টা আওয়াজ।”
তাহলে খনার কাল কী দাঁড়ালো?

পূরবী বসু: অনুমান করা হয়, খনার কাল ৮০০-১১০০ খৃষ্টাব্দ। কিন্তু ঐতিহাসিক চরিত্র বরাহ (৫০৫-৫৮৭) যদি খনার শ্বশুর হয়ে থাকেন তাহলে খনার জীবনকাল ৮০০-১১০০ খৃষ্টাব্দের চেয়ে আরো কয়েকশ বছর আগের। ওদিকে বচনের ভাষা, আঙ্গিক ও বাক্য গঠনের রীতি দেখে ভাষা বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই বচনগুলোর বয়স ৪০০ বছরের বেশি না। তবে বচনগুলো মৌখিকভাবে কিংবা অন্য কোনো ভাষায় রচিত হয়ে পরে পুনর্নিমিত, লিখিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে। ধীরে ধীরে ভাষান্তরিত হয়েছে। কিছু বচন হয়তো প্রক্ষিপ্তও হয়েছে।
বচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বচনগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষির সময়ে লিখিত, যখন কৃষি ও গো-পালনের সমগুরুত্ব ছিল। ড. নওয়াজ বলেন, “খনার বচনে কৃষির প্রাথমিক সূত্রাদি বর্ণিত।” ফলে খনার বচন ৭ম শতাব্দীর আগে, পরে না, গুপ্তযুগে। তাই বিক্রমাদিত্যের নবরতেœর অন্যতম বরাহের পুত্রবধূ হতেই পারেন খনা।
খনার বচনে মহিষ ও মোরগের উল্লেখ না-থাকায় মনে করা হয়, বচন সম্ভবত গুপ্ত রাজত্বের সময়ের।
খনার বচনে বাংলা মাসের নাম অনেক ব্যবহার হলেও বাংলা মাস দিয়ে খনার বচনের প্রাচীনত্বের হিসাব করা যায় না, কারণ শকাব্দ শুরু হয়েছে অনেক অনেক আগে, ৭৮ খৃষ্টাব্দে।
খনার বচনের প্রাচীনত্বের আরেকটি চিহ্ন হচ্ছে সমুদ্রতীরে জন্ম নেওয়া প্রাচীন ফল তাল ও নারিকেলের উল্লেখ।
প্রাচীনকালের ভারতবর্ষের অধিকাংশ সাহিত্য বা শাস্ত্রীয় রচনা ধর্ম ও ঈশ্বর দ্বারা ছিল আগাগোড়া প্রভাবিত, কিন্তু খনার বচন তা থেকে প্রায় পুরোপুরি মুক্ত। কৃষকের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সমস্যা নিয়েই এই বচনগুলো রচিত। খনার স্বাস্থ্য-বচনেও কোনো কুসংস্কার নেই। ফলে বলা যায়, খনার কালে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিস্তার ছিল না।
খনার বচনে বিস্ময়করভাবে নারী নিন্দা বা নারীর অধস্তনতা কিংবা নারী নির্যাতন বা অবদমনের ইঙ্গিত অথবা পৌরুষত্বের আস্ফালনের প্রকাশ অনুপস্থিত। ফলে বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী, নারীর প্রতি সংবেদনশীল চার্বাক বা অন্য কোনো লোকায়ত দর্শন দ্বারা খনা প্রভাবিত এ কথা বলা যেতে পারে। চার্বাকদের ধর্ম অনেক পুরোনো। খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে। বৈদিক ধর্মের প্রসারে চার্বাকদের উৎখাত করা হয়। কোনো চিহ্নই রাখা হয়নি তাঁদের। পরে চার্বাকরা আবার সংগঠিত হয় ৮ম শতকে। যেহেতু খনার বচনের রচনাকাল ও খনার জীবন ৮০০-১১০০ সালের মধ্যে বলে স্বীকৃত, খনার পক্ষে চার্বাক দর্শনের অনুরাগী হওয়া স্বাভাবিক। ড. আলি নওয়াজ “খনার বচন: কৃষি ও কৃষ্টি” বইয়ে লিখেছেন, খনা চার্বাক কিংবা কোনো লোকজ ধর্মের সমর্থক হতে পারেন। আবার খনার বচনে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ দেখে মনে হয়, হিন্দু পুনর্জাগরণের গুরু শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০) আগে ছিল খনার কাল। তাহলে হয়তো খনার বচন লেখা হয়েছিল ৬ষ্ঠ বা ৭ম শতাব্দীতে যখন বৌদ্ধ, জৈন, শাক্ত, সহজিয়া, বাউল সহ নানারকম মতবাদের সহাবস্থান ছিল। হোরা ও জ্যোতিষশাস্ত্রের মতে দিন, বার বা মাসকে সুদিন কুদিনে ভাগ আর টিকটিকির শব্দের সঙ্গে সত্য-মিথ্যা কিংবা শুভ-অশুভের যোগসূত্রের মতো অবৈজ্ঞানিক ধারা ছাড়া খনার বচনে কুসংস্কারও খুব কম। ৩০০টি প্রচলিত খনার বচনের মধ্যে মাত্র ১টিতে ঈশ্বরের নাম আছে – “আল্লায় দিয়া ধন দেখে মন, কাইড়া নিতে কতক্ষণ।” কিন্তু খুব টেনেটুনে খনার কালকে ৫০০-১১০০ খৃষ্টাব্দ ধরলেও দেখা যায়, খনার জীবদ্দশায় এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম আসেনি। অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ উল্লেখ করেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ বেশ কিছু পÐিতের মতে, “প্রায় নয়শ বছর আগে অত্র অঞ্চলে মুসলমানদের রাজ্যজয়ের আগে থেকেই কিছু কিছু খনার বচন প্রচলিত ছিল।” ফলে এই বিশেষ বচনটি হয় পুনর্লিখিত বা অনূদিত কিংবা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। আরেকটি বচনে আছে – “স্বর্গে দেখি কোদাল কোদাল, মধ্যে মধ্যে আইল, ভাত খাইলাও শ্বশুর মশায়, বৃষ্টি হইবে কাইল।” তবে এখানে আকাশ অর্থে স্বর্গকে বোঝানো হয়েছে।
খনার বচনের মাত্র দুটিতে নারী-অবমাননাকর কথা আছে। “ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন, যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ” আর “হোলা গোশশা অইলে বাশশা, মাইয়া গোশশা অইলে বেইশশা।” কাজেই বলা যায় ১) খনা নারীই। ২) খনার বচন রচনাকালে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল না। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে নারীকে অবগুণ্ঠিত করে রাখা হয় ও তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। খনার অন্যতম নারীবাদী বচন – “আগে খাবে মায়ে, তবে পাবে পোয়ে।” আরেকটি বচন চার্বাকদের মতো জাগতিক – “ধার করে হলেও ঘি খাও” (চার্বাক), “সোমে ও বুধে না দিও হাত, ধার করিয়া খাইও ভাত (খনা)।”

ফারহানা আজিম শিউলী: এবারে খনার বিয়ে প্রসঙ্গ…
পূরবী বসু: রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার অন্যতম নবরতœ প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্র মিহিরকে খনার স্বামী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অনেক জায়গায়। আবার কোনো কোনো কিংবদন্তি অনুসারে, বরাহ ও মিহির একজনই যিনি ছিলেন বিক্রমাদিত্যের সভার নবরতœদের একজন। কিন্তু অধিকাংশ কিংবদন্তি অনুসারে বরাহের পুত্র মিহির যাকে বরাহ জন্মের পর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি পরে খনার স্বামী হয়। খনা সহ মিহির উজ্জয়নীতে ফিরে এলে একপর্যায়ে মিহিরও বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় যোগ দেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, একজন বরাহ-মিহিরই ছিলেন সভায়। আবার খনার বচনে মিহিরকে স্বামী ও বরাহকে শ্বশুর বলে উল্লেখ আছে।

ফারহানা আজিম শিউলী: আমরা জানি, খনা গণিতজ্ঞ ছিলেন, কৃষিকাজে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান এবং ছিলেন জ্যোতিষবিজ্ঞানে পারদর্শী। বিক্রমাদিত্যের নবরতœ সভার দশম রতœ হবার প্রস্তাব পান তিনি। খনার কর্ম নিয়ে শোনা যাক।
পূরবী বসু: খনার আসল নাম লীলাবতী। উদ্ধার করা গণিত শাস্ত্রের অনেক বইয়ে খনার বচনের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। ছোট ছোট সূত্রে তিনি গণিতের মূল কথাগুলো বলেছিলেন। তাঁর একটি মৌলিক সূত্র হলো “অঙ্কস্য বামা গতি” অর্থাৎ অঙ্ক ডান থেকে বামদিকে গণনা করতে হবে। তবে খনা বচনের জন্যই সুপ্রসিদ্ধ। কোনো কোনো ভাষ্যমতে, খনা ও মিহির দুজনই জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। একসময় মিহির ও খনা জ্যোতিষ-গণনার মাধ্যমে বরাহের পরিচয় ও খোঁজ পান। তখন তাঁরা বরাহের খোঁজে উজ্জয়নী আসেন। কৃষিকাজে লীলার ছিল অগাধ জ্ঞান আর জ্যোতিষবিদ্যায় অপরিসীম দক্ষতা। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমৎকার পূর্বাভাষ দিতে পারতেন তিনি। উজ্জয়নীর কৃষকরা খুব উপকৃত হতো তাতে। এ ছাড়া জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর রাজা বিক্রমাদিত্যের নানা কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিতে পারায়, বিক্রমাদিত্য খুব খুশি ছিলেন খনার ওপর। একবার বিক্রমাদিত্য আকাশে কত তারা জানতে চাইলে খনাই শুধু উত্তর দিতে পারেন। সবমিলিয়ে রাজা খনাকে রাজসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁকে নবরতœসভার দশম রতœ করার প্রস্তাব করেন। তবে বরাহ ঐতিহাসিক চরিত্র এবং বিক্রমাদিত্য ও তাঁর নবরতœ সভাও ঐতিহাসিক। কিন্তু বরাহ, কালিদাস বা বিক্রমাদিত্যে কারো লেখায়ই লীলাবতীর নাম নেই। তাই লীলাবতীর সব তথ্যই ঐতিহ্য-আশ্রয়ী, ইতিহাস দ্বারা যাচিত না।
আলোচনার এ পর্যায়ে খনার সভায় যোগদান নিয়ে বরাহের ঈর্ষা ও প্রাকৃতজনদের খনাকে বরণ করে নেবার একটা ভিডিওক্লিপ দেখানো হয় বাংলাদেশের নাট্যদল বটতলার “খনা” মঞ্চ-নাটক থেকে। বটতলার “খনা” প্রথম মঞ্চে আসে ২০১০ সালে। নাটকটি লিখেছেন সামিনা লুৎফা নিত্রা এবং নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী হায়দার। নাটকটিতে খনাকে জ্ঞান ও সত্যের এক অসাধারণ নারী সাধক ও সমকালীন বিদূষী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যাঁর আরেক নাম লীলাবতী।
অনেক কিংবদন্তি অনুসারে, উজ্জয়নীর রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার রাজজ্যোতিষী পণ্ডিত বরাহ-বরাহ মিহির, যাঁর পুত্রবধূ খনা। বরাহ ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু বটতলার নাটকে আমরা উজ্জয়নীর রাজসভা না, বরং পশ্চিমবঙ্গের বারাসতের দেউলনগরের রাজা ধর্মকেতুর রাজসভার সভাজ্যোতিষ হিসেবে পাই বরাহ-মিহিরকে, যেখানে আছে খনা-মিহিরের ঢিবি। ভারতের চব্বিশ পরগনার চন্দ্রকেতু গড়ের খনাকে নিয়েই কাহিনি এগিয়েছে। সামিনা লুৎফা নিত্রা “খনা” নামে নাটকের একটি বইও লিখেছেন।

ফারহানা আজিম শিউলী: এবারে খনার মৃত্যু এবং বহুলশ্রুত খনার জিহŸা-কর্তন প্রসঙ্গ। এই জিহŸা কর্তন নিয়েও নানা আখ্যান-কিংবদন্তি আছে এবং জিহŸা কাটার কারণ দেখলে সেই সমাজের লিঙ্গীয় বৈষম্য, শ্রেণিগত বৈষম্য এবং বর্ণ-জাত প্রথার একটা চিত্রও পাওয়া যায়। “কিংবদন্তির খনা ও খনার বচন” বইতে খুব চমৎকারভাবে বিষয়গুলো এসেছে।
পূরবী বসু: রাজা বিক্রমাদিত্য খনার জ্যোতিষি-প্রজ্ঞায় ও গণিতের জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে খনাকে রাজসভায় যোগ দেবার আহŸান জানালে, বরাহ প্রবল ঈর্ষায় পুত্র মিহিরের সাহায্যে খনার জিভ কেটে দেন যাতে লীলাবতী আর কথা বলতে না-পারে। সম্ভবত প্রবল রক্তপাতে লীলাবতীর মৃত্যু হয়। উড়িষ্যাতেও একই কিংবদন্তি প্রচলিত। সেখানের কিংবদন্তি অনুসারে লীলাবতীর জিভ কেটে তাঁকে খোনা বা খনা করে ফেলা হয়। আরো জানা যায়, জিভ কাটার আগে খনা অনুমতি নিয়ে সাতদিন সাতরাত ক্রমাগত প্রাকৃতজনদের তাঁর বচন ও সেসবের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেন এবং সেই বচনগুলো অনেকে শ্রুতিতে ধরে রেখে প্রচার করে, কেউ কেউ লিখে রাখে।
প্রতিটি কিংবদন্তিতেই খনার জিহŸা-কর্তনের উল্লেখ আছে। তবে কে জিহŸা কেটেছেন তা নিয়েও অনেক কিংবদন্তি আছে, মতভেদ আছে। বলা হয়, শ্বশুর বরাহ নিজেই কেটেছেন কিংবা বরাহ ও মিহির দুজনে মিলে কেটেছেন কিংবা বরাহের আদেশে মিহির কেটেছেন কিংবা শ্বশুর-স্বামীর সম্মান রক্ষার্থে খনা নিজেই কেটেছেন। কোথাও আছে, বউ শাশুড়ির দ্ব›েদ্ব শাশুড়ি খনার জিভ কেটেছেন।
শ্রেণিসংগ্রামের দিকটি টেনে বলা হয়, খনা কৃষকদের প্রতিনিধি, অন্যদিকে বরাহ ও মিহির রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি। ফলে রাজতন্ত্রের আজ্ঞায় প্রজা বা কৃষকের প্রতিনিধি খনা জিভ হারান।
এক ভাষ্যমতে, অব্রাহ্মণদের বেদ পাঠ বা পুজোর পৌরোহিত্য গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হতো তখন। খনা অনার্য, অব্রাহ্মণ হয়েও সাধারণ মানুষদের শিক্ষা দিতেন বলে তাঁর জিভ কেটে ফেলা হয়। খনা নিজে উঁচু বর্ণের-অভিজাত পরিবারের হয়েও সাধারণ কৃষকদের কৃষিকাজ, স্বাস্থ্যরক্ষায় ছিলেন নিবেদিত। প্রাণখুলে মিশতেন সাধারণের সঙ্গে। এটিও বরাহ-মিহিরের জাত্যাভিমানে লাগে।
আরেক ভাষ্যে বলা হয়, পুরুষতন্ত্রের শিকার খনা। বুদ্ধিমতী, সরব ও প্রতিবাদী নারীর জিভ কেটে দিয়ে তাঁকে পুরুষের কাছে নমনীয় ও বিনীত করে রাখা তখনকার দিনে বিরল কোনো ঘটনা ছিল না। তখন মৌখিকভাবেই সাহিত্যরচনা ও শিক্ষাদান করা হতো। তাই পুরুষতন্ত্রের প্রতিভ‚ বরাহ ও মিহির জিভ কেটে দেন খনার।
কিংবদন্তি থেকে আরো জানা যায়, খনার কর্তিত জিহŸাটি এক টিকটিকি খেয়ে ফেলায় টিকটিকিও প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠে। তাই বলা হয়, কেউ কোনো কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে টিকটিকি টিক টিক টিক করে তিনবার ডেকে উঠলে কথাটির সত্যতা সমর্থিত হয়।

ফারহানা আজিম শিউলী: আরো বলা যায়, খনা বরাহের মতো পÐিতের ভুল ধরেছেন। সন্তান মিহিরের জন্মকোষ্ঠি গণনায় বরাহের ভুল নিয়ে বচন লিখেছেন – জন্ম মৃত্যু বিবাহ, তিন না জানে বরাহ। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধেও খনা ছিলেন সোচ্চারকণ্ঠ। তাঁর এক বচনে আছে – বামুন বাদল বান, দক্ষিণা পেলেই যান। আর সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো, কিংবদন্তি অনুসারে খনা হয় আচার্যের মেয়ে, না হয় রাজকন্যা। অথচ তিনি প্রাকৃতজনদের সাথে মিশেছেন, তাদের হয়ে কথা বলেছেন, তাদের স্বার্থ দেখেছেন এবং শেষমেশ তাদেরই অর্থাৎ প্রাকৃতজনদের কণ্ঠস্বর হয়েছেন।
আলোচনার এই পর্যায়ে “খনা-বরাহ” চলচ্চিত্র থেকে একটি ভিডিওক্লিপ দেখানো হয়। ১৯৮১ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রের কাহিনি নাট্যকার মন্মথ রায়ের। অভিনয়ে উত্তম, সন্ধ্যা রায়। বিজয় বসুর পরিচালনা। গীত গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সংগীত পরিচালক শ্যামল মিত্র। গেয়েছেন – হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও আরতি মুখোপাধ্যায়।
এই চলচ্চিত্রে খনা সিংহল দ্বীপের রাজকন্যা। বাঙালি রাজা বিজয় সিংহের মেয়ে লীলাবতী। সিংহলের রাজজ্যোতিষী (রক্ষক‚লের) মিহিরকে পালন করেছেন যিনি খনা ও মিহির দুজনেরই শিক্ষক। খনা-মিহির পরে বরাহের খোঁজে ভারতের উজ্জয়নীতে আসেন।
ভিডিওক্লিপের এই অংশটিতে দেখা যায়, বরাহের সনাতন জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী খনার জ্যোতিষবিদ্যাকে বলা হচ্ছে অশাস্ত্রীয়।
এরপর খনার বরাহের গণনা ভুল ধরা এবং খনার কৃষকের ও সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা বরাহ কীভাবে দেখতেন তা নিয়ে বটতলার “খনা” নাটক থেকে দুটো ভিডিওক্লিপ দেখানো হয়।
ফারহানা আজিম শিউলী: খনার বচনের ভাষায় আসা যাক এবার। বচনগুলো কি মৌখিকভাবে তৈরি হয়ে, মুখে মুখে প্রবাহিত হয়ে পরে লিখিত হয়েছিল? লেখা হলে কোন ভাষায়?
পূরবী বসু: মনে করা হয়, খনা গনিতশাস্ত্রের বইতে যেভাবে ছোট ছোট সূত্র তৈরি করেছিলেন, সেভাবেই সংস্কৃততে বচনগুলো রচনা করেছিলেন। পরে সেগুলো বাংলায় অনুবাদ হয়। বাংলায় অনুবাদ চর্যাপদের আগেই হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। তবে এখনকার বাংলা থেকে তা আলাদা ছিল হয়তো। বরাহের জীবনকাল ছিল ষষ্ঠ শতাব্দীতে। কিন্তু খনার বচনের ভাষা দেখে ৪০০ বছরের বেশি মনে হয় না। আবার খনার জীবনকাল বলা হয় ৮০০-১১০০ খৃষ্টাব্দ। তাহলে বরাহের পুত্রবধূ হন কেমন করে? অনেকে বলেন, খনা অষ্টম না বরং কালিদাস, বরাহ, বিক্রমাদিত্যদের সমসাময়িক।
খনার সময়ে ভাবক ও লক্ষ্ণী নামে আরো দুজন নারী কবি ছিলেন যাঁদের বচনের সঙ্গে খনার বচন একাকার হয়ে যাওয়াও অসম্ভব না।
খনার জন্ম ৮০০-১১০০ খৃষ্টাব্দ হলে, সে সময়টা বাংলা ভাষার শুরুর কাল বা তারও আগের সময়। তখন বাংলা ভাষার বুনন এমন আধুনিক ছিল না।
তবে খনা লিখে না-রেখে তখনকার দিনের চল অনুযায়ী মুখে মুখে বলতেন বলেই হয়তো তাঁর আঙুল না-কেটে জিহŸা কাটা হয়েছিল।
মোটের ওপর বলা যায় যে, খনার বচনের ভাষা অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এর ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে মূল সুর ও অর্থ অবিকৃত রেখে। মৌখিকভাবে প্রবাহিত হওয়ায় কিছু বচন প্রক্ষিপ্ত হওয়াও বিচিত্র কিছু না।
খনার মূল বচনগুলো (খনার কিংবা সমষ্টিগতভাবে একদল মানুষ দ্বারা রচিত) খুব সম্ভবত সংস্কৃত, হৃদি বা এই ধরনের তখনকার দিনে চালু কোনো ভাষায় লেখা হয়ে, পরে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।
খনা সিংহলের রাজকন্যা, যার কর্ম ও বিবাহিত জীবন কেটেছে উজ্জয়নীতে, তিনি কী করে এমন সাবলীল বাংলায় ছড়া লিখলেন? এর উত্তরে আছে বিভিন্ন মতামত: ১) সিংহলে একসময় বাঙালি রাজার রাজত্ব ছিল। খনার জন্ম সেই সময়। ফলে সিংহলে জন্ম হলেও খনা বাঙালিই। ২) বচনগুলো তখনকার দিনে প্রচলিত হৃদি বা সংস্কৃত বা দেবনাগরি হরফে লেখা হয়েছিল, পরে বাংলায় রূপান্তরিত হয়। ৩) এক ভাষ্যমতে, ৭ম শতাব্দীর আগে সারা বাংলায় সংস্কৃত ভাষায় লেখা কোনো বই ছিল না। তাই বাংলার সাথে মিল মগধী ভাষায় বচনগুলো লেখা হয়েছে সম্ভবত। ৪) বচনগুলো প্রথমে মৌখিকভাবে রচিত হয়ে পরে স্থানীয় ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য (বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার, আসাম, কেরালা, কর্ণাটক, নেপাল) তা রূপান্তরিত হয়।
আরেকটি কথাও বলা দরকার, উজ্জয়নী মধ্যপ্রদেশে হলেও এখনকার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল আগে নানা জায়গায় ছড়ানো ছিল। তাই উজ্জয়নীতে খনা থাকলেও তিনি বঙ্গের লোকজনের আবাসেই ছিলেন।

ফারহানা আজিম শিউলী: খনার কিংবদন্তিতে লঙ্কার সঙ্গে বঙ্গের যোগসূত্র নিয়ে নওয়াজ (১৯৮৯) লিখেছেন, একটি প্রাচীন সিংহলি পালি গ্রন্থে পাওয়া যায়, লীলাধিপতি অর্থাৎ রাঢ?াধিপতি সিংহবাহুর পুত্র বিজয়সিংহ পিতৃপরিত্যক্ত হয়ে তৎকালীন বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র সিংহলে বাণিজ্য করতে গিয়ে ক্রমে দারুণ প্রতিপত্তিশালী হয়ে সিংহলের অধিপতি হয়ে বসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ সিংহলে বহু শতাব্দী রাজত্ব করে। অতঃপর গণ-অভ্যুত্থানে এ রাজবংশের অবসান ঘটে। হতে পারে খনা সে বংশেরই দুর্ভাগা রাজকুমারী ছিলেন। এবং সে কারণেই তৎকালীন বাংলাদেশের ভাষা ছিল তার মাতৃভাষা। বাংলা ভাষার সঙ্গে সিংহলি ভাষার মিলও দেখা যায়।
আর যেহেতু খনার সময়ে একক ভাষা হিসেবে বাংলা চালু হয়নি, লেখ্য বাংলার চল তো আরো পরে। ছিল অপভ্রংশ-প্রাকৃত ও মাগধীর মিশেল। তাই সেইসব ভাষায়ই বচন রচিত হবার সম্ভাবনা বেশি।
খনার বচন যে মুখে মুখে তৈরি এবং প্রবাহিত হয়েছে এবং বেশিরভাগ মানুষ এখনও মুখে মুখেই বচনগুলো যে জানে, সেটির স্বপক্ষে ড. নওয়াজের গবেষণার কথা উল্লেখ করা যায়। কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার সাহেবাবাদ, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার কাজীর শিমলা, রুদ্রগ্রাম ও পীরধানীখোলা ও দিনাজপুর জেলার সেতাবগঞ্জের মাধবপুর ও বোগদাইরহাট এ ছয়টি গ্রামে নির্ধারিত প্রশ্নমালার মাধ্যমে বিধিবদ্ধ নমুনা জরিপ চালিয়ে নওয়াজ (১৯৮৯) জানান, তিনটি জেলার মাত্র শতকরা ৯ জন পল্লীবাসী পড়ে খনার বচন জেনেছে, অথচ খনার বচন সম্পর্কে জানে শতকরা ৯৭ জন। তিনটি জেলার শতকরা ৮৯ জন জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে খনার বচন দ্বারা পরিচালিত।
খনার একই বচন দেশের নানান অঞ্চলে নানানভাবে বর্ণিত হয়। ভাষা, বলার ভঙ্গি ও কায়দায় স্থানীয় আমেজ থাকলেও বচনের অর্থ বদলে যায় না তাতে। খনার বচন যে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষান্তরিত হয়েছে তার উদাহরণ হিসেবে খনার একটি বচনের কথা বলা যায়। কিতা করঅইন হউর লেখালেখি/ মেঘই বুঝঅইন পানির আঁকি/ কোদাল কোপা মেঘের গাও/ আড়ি সারি বয় বাও/ কিষান কামলা বান্ধো আইল/ আইজ কিংবা অইবো কাইল। (মৌলভীবাজার অঞ্চল)
কি কর শ্বশুর লেখাজোখা/ মেঘেই বুঝবে জলের রেখা/ কোদালে কুড়ুলে মেঘের গা/ এধ্যে মধ্যে দিচ্ছে বা/ কৃষককে বলোগে বাঁধতে আল/ আজ না হয় হবে কাল। (মৌলভীবাজার অঞ্চল)
কি কর শ্বশুর লেখা জোখা/ মেঘেই বুঝব জলের রেখা/ মেঘ হয়েছে কোদাল কাটা/ বাতাস দিচ্ছে লাটাপাটা/ কি করিস চাষা বাঁধগে আল/ আজ না হয় ত হবে কাল। (রংপুর অঞ্চল)
কোদালে কুড়লে মেঘের গা/ এলোমেলো বহে বা/ চাষীকে বলো বাঁধতে আল/ আজ না হয় হবে কাল। (চট্টগ্রাম অঞ্চল)”
কোদলা কোদলা মেঘের গা/ এ্যাঝে মাঝে দিচ্ছে ঘা/ কৃষক ভাই বান্ধো আইল/ আইজ না হইলে হইব কাইল/ (নেত্রকোনা অঞ্চল)
কোদালে কুড়ালে মেঘের গা/ উল্টাপাল্টা বহে বা/ খনা বলে বাঁধ আল/ আজ না হয় বৃষ্টি হবেই কাল। (বগুড়া অঞ্চল)
কি কর শ্বশুর লেখাজোখা/ মেঘেই বুঝবে জলের রেখা/ কোদালে কুড়লে মেঘের গা/ এধ্যি মধ্যি দিচ্ছে ঘা/ বলগে চাষায় বাঁধতি আল/ আজ না হয় হবি কাল। (যশোর অঞ্চল) (সূত্র: খনার বিজ্ঞান-দর্শন, পাভেল পার্থ।)
খনার বচনগুলো কি খনা একাই লিখেছেন নাকি অনেকের লেখাই এতে ঠাঁই পেয়েছে?

পূরবী বসু: সমস্ত খনার বচনের রচয়িতা যে একজন না, তা অনেক গবেষকই আজ স্বীকার করেন। ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, “লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে একজন কিছু একটা শুরু করেন। যেমন খনার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে। খনা হয়তো শুরু করেছেন। তারপর এ সম্পর্কিত আরো যা এসেছে সেগুলো খনার নামেই পরিচিতি পেয়েছে।” তবে ড. আলি নওয়াজ বলেন, “খনা যে প্রাচীন বাংলাদেশের একজন বিদূষী খ্যাতনামা জ্যোতিষী ছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।”
রণদীপম বসু বলেন, “খনা নামের আড়ালে আমাদের লোকায়ত জনভাষ্যগুলোই প্রকাশিত হয়েছে। ৃখনার বচনের রচয়িতা যদি হয় আমাদের কৃষিভিত্তিক প্রাচীন বাংলার ধারাবাহিক লোকসমাজ, যাদেরকে আমরা বলি শ্রুতি ও স্মৃতিনির্ভর নিরক্ষর লোক-মানস, তাহলেই যুক্তি মিলে যায়।”
আজকের যুগে সব দেশেই কুম্ভীলকদের অস্তিত্ব দেখা যায় যারা পরের লেখা নিজের নামে চালান। কিন্তু প্রাচীন ভারতবর্ষে লেখকদের মধ্যে কুম্ভীলকের বিপরীতই বেশি দেখা যেত। নামকরা কোনো লেখকের লেখার ভেতর নিজের লেখা বা লেখার অংশবিশেষ ঢুকিয়ে দিতে পারলে ধন্য হতেন উঠতি লেখকরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যাস রচিত মহাভারতের কথা যাতে অনেকের লেখাই স্থান পেয়েছে। আরেকটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মনসামঙ্গলের গীতিকার ও কবি দ্বিজ অংশীদাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী (বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি) ও তার প্রেমিক জয়ানন্দ গীতিকাব্য লিখতে দ্বিজকে সাহায্য করতেন মাঝে মাঝে তাঁর নামে বিভিন্ন কবিতা লিখে দিয়ে। কাজেই আজ যা কুম্ভীলকবৃত্তি নামে অপরাধ, আগেরকালে সেটিই পারষ্পরিক সহযোগিতা এবং বড়ো লেখকদের দ্বারা নতুন লেখকদের লেখার স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার প্রকাশ বলে মনে করা হতো।

ফারহানা আজিম শিউলী: খনার বচনে সামষ্টিক অংশগ্রহণের স্বপক্ষে একটি বচনের কথা উল্লেখ করা যায়। “বলে গেছে বরাহের পো/দশটি মাস বেগুন রো/ চৈত্র-বৈশাখ দিবে বাদ/ ইথে নাই কোনো বিবাদ/ পোকা ধরলে দিবে ছাই/ এর চেয়ে ভালো উপায় নাই/ মাটি শুকালে দিবে জল/ সকল মাসেই পাবে ফল/ পৌষে গরমি বৈশাখে ঝাড়া/ পয়লা আষাঢ?ে ভরবে গাড়া/ খনা বলে শোন হে স্বামী/ শাওন ভাদ্রে নাইকো পানি/ ডাক দিয়ে বলে রাবণ/ না রুবে কলা আষাঢ? শ্রাবণ।” খনার বচন হিসেবে পরিচিত এই বচনটি খেয়াল করলে দেখা যায়, বচনের ভাষ্য অনুযায়ী একটি বচন খনার, একটি বরাহের পুত্র মিহিরের এবং আরেকটি রাবণের। এভাবেই হয়তো খনার অনেক বচন যেমন অনেকের নামে মিশে গেছে, আবার অনেকের অনেক সূত্র ও বচনও হয়তো খনার বচন নামে বিনির্মিত হয়েছে। (সূত্র: খনার বিজ্ঞান-দর্শন, পাভেল পার্থ।)
এ পর্যায়ে বটতলার “খনা” নাটক থেকে পরপর ৩টি ভিডিওক্লিপ দেখানো হয়। এই ভিডিওক্লিপগুলোতে দেখা যায়, জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী খনা স্থানীয় কৃষকদের সাথে মিশে তাদের স্থানীয় জ্ঞান আহরণ করছেন। কৃষকদের ভাষা রপ্ত করছেন। অর্থাৎ একটা বিনিময়ের জায়গা দেখা যায়। এবং খনা তাঁর কালের বিখ্যাত জ্যোতিষী হলেও বাংলা বা উজ্জয়নীর ফুল-ফসল-লতার জ্ঞান তাঁর থাকার কথা না। কাজেই তিনি কৃষকদের সঙ্গে মিশে শিখেছেন তাঁদেরই কাছ থেকে। বটতলার “খনা”য় এভাবেই বিষয়টা উপস্থাপিত হয়েছে।
এবার আসা যাক “খনার বিজ্ঞান” প্রসঙ্গে…

পূরবী বসু: খনার বচন লোকশাস্ত্র। গ্রামীণ সাধারণ মানুষের জন্য কৃষিসংক্রান্ত দরকারি উপদেশসমূহ। কিন্তু খনার বচন কি বিজ্ঞান এ প্রশ্নটা এখন আসছে সামনে। অরূপ রাহী বলেন, “খনা বিজ্ঞান এইজন্য যে তার চর্চার একটা বিকাশশীল পদ্ধতি আছে। খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তা সামান্য ও বিশেষ সত্য উৎপাদন করে।”
একজন বিজ্ঞানীর নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে বলতে হয়, খনার বচনের মধ্যে বুদ্ধির ঝিলিক, নিগূঢ় বাস্তব অভিজ্ঞতা, গভীর পর্যবেক্ষণ, প্রজ্ঞা, পরিণতমনস্কতা লক্ষ্য করলেও সবটাতেই শক্ত ও মজবুত বিজ্ঞানের ভিত্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। বিশেষ করে জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক নিয়ে তাঁর অনেক বচনকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা কঠিন। খনার জ্যোতিষ ও হোরাশাস্ত্রের বচনগুলোকে অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে মনে হয়। যে শাস্ত্রে জাতক, জন্ম, যাত্রা, লগ্ন, গ্রহ-ফলাফল, কোষ্ঠীবিচার, শকুনবিদ্যা ইত্যাদি বিবেচিত হয়, তার নাম হোরাশাস্ত্র। এছাড়া খাদ্যের আচার সম্পর্কে কিছু কিছু বচন মোটেও বিজ্ঞানসম্মত না। তারপরও এটা সত্যি, গ্রামবাংলায় খনার বচনই ‘কৃষিদর্শন’ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। বাংলার কৃষকেরা খনার দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ফসল বোনেন, লাগান ও কাটেন। ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও দিনাজপুরের বেশ কিছু জায়গায় গবেষণা করে অধ্যাপক আলি নওয়াজ জানান, গ্রামবাংলার কৃষি ঐতিহ্য ও জীবনাদর্শ আজও খনার বচন দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত।
ড. শাহেদের মতে, দর্শন এবং বিজ্ঞান আবিষ্কারের আগে থেকেই মানুষ লোকদর্শন আর লোক-প্রযুক্তির ব্যবহার করতো। শহুরে মানুষ মেঘ দেখে কিছু বোঝে না কিন্তু একজন কৃষক মেঘ দেখে বলতে পারে কখন বৃষ্টি হবে বা আদৌ হবে কিনা। খনার বচনেও দীর্ঘদিনের লোক-অভিজ্ঞতার প্রসার ঘটেছে।

ফারহানা আজিম শিউলী: পাভেল পার্থ “খনার বিজ্ঞান-দর্শন”-এ লিখেছেন, খনা একটি অধিপতিশীল সমাজকাঠামোয় নি¤œবর্গের বিজ্ঞানচৈতন্য ও নিরীক্ষাকে যেভাবে জনভাষ্যে পরিণত করার সাহস দেখিয়েছেন, তা কোনোভাবেই স্বীকার করা হয় না। শেষমেশ খনাকে কেবল ‘গ্রামের লোকদের চাষ-বাস করার কিছু নির্ঘণ্ট ও নির্দেশিকার’ লোক-রচয?িতা হিসেবেই সবার সামনে উপস্থাপন করা হয়।
খনা বারবার প্রতিষ্ঠিত অধিপতি জ্ঞানকাÐকে প্রশ্ন করেছেন। খনা তাঁর একাধিক বচনেও বারবার প্রশ্ন করেছেন, কি কর শ্বশুর মতিহীন, কি কর শ্বশুর লেখাজোখা? এভাবে খনা তাঁর দর্শনকে এক নি¤œবর্গীয় ময়দান থেকে একটি সংঘবদ্ধ ডিসকোর্সে রূপ দিয়েছেন।
বন্দ্যোপাধ্যায় ও চক্রবর্তী বাংলার কৃষি বিস্তারে খনার বচনের ভ‚মিকা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, কৃষিবিজ্ঞান দীর্ঘ সময়ের আঞ্চলিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে। খনার বচনও দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীনকালের এক কৃষিবিজ্ঞান।
বিজ্ঞান নির্ভেজাল বস্তুতান্ত্রিক। খনার বচন সম্পূর্ণতই যাপিতজীবনের বস্তুবাদিতা ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। খনার এমন কোনো বচন নেই, যেখানে তা ধর্মের আশ্রয়ে আশ্রিত হয়েছে বা স্থানীয় কোনো বিমূর্ত রূপ প্রকাশ করেছে। খনার বচন কোনোভাবেই হিন্দু কিংবা মুসলমান, বাঙালি কিংবা আদিবাসীর আখ্যান হয়ে দাঁড়ায়নি। এটি এ দেশের নি¤œবর্গের বহমান বিজ্ঞানসূত্র, যা বচনের ভেতর দিয়ে এক বস্তুবাদী দার্শনিকতার পাটাতন প্রস্তুত করেছে। অবস্তুবাদী কোনো সূত্র কিংবা প্রত্যয় খনার বিজ্ঞান-দর্শনের বিষয় হতে পারেনি।
নওয়াজের (১৯৮৯) লেখা থেকে পাই, “খনার বচন আজ আর কোনো ব্যক্তিসত্তার সাক্ষ্য নয়, বরং বাঙালি জাতি তথা পল্লিবাসীদের নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহ্য।” খনা কিংবা খনার বচন তাই আর কোনো ব্যক্তির বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, এটি একটি তত্ত¡ ও দর্শন-প্রক্রিয়াকে সামনে নিয়ে এসেছে। উপস্থিত করেছে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিরীক্ষা ও চর্চার বিজ্ঞানকে।
বিজ্ঞান যখন এলোই, তখন আরেকটি বিষয় নিয়ে আলাপ হোক। জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান এখন দুটো স্বতন্ত্র অধ্যয়নের বিষয়। আমরা এখানে জ্যোতিষবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের তর্কে যাচ্ছি না এবং খনার জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানও যথেষ্ট ছিল, এমনটাও হয়তো ঠিক। কিন্তু সেক্ষেত্রে খনাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী লেখাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?

পূরবী বসু: জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উৎস এক হলেও অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে দুটো পরিষ্কারভাবে আলাদা হয়ে গেছে। জ্যোতির্বিদ্যা পরিপূর্ণ বিজ্ঞান কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রকে বলা হয় ছদ্মবিজ্ঞান। খনার জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকলেও, পাল্লা বিচারে তাঁকে জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী লেখাটাই সমীচিন।

ফারহানা আজিম শিউলী: খনাকে বাংলার প্রাচীনতম নারী কবি বলা হয় কেন?
পূরবী বসু: সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি খনা, দ্বিতীয় নারী কবি রামী বা রজকিনী, তৃতীয় নারী কবি মাধবী। বাংলা সাহিত্যের চতুর্থ নারী কবি ও বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি নেত্রকোনার চন্দ্রাবতী। খনা যে জন্যে কবি, তা হলো তাঁর বচনসমূহ যা সামগ্রিকভাবে ‘খনার বচন’ বলে পরিচিত তা প্রধানত ছড়া আকারে রচিত। আর যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলার লোকশাস্ত্রের প্রাচীনতম ধারাটি কী এবং কে বা কারা তার রচয়িতা? তাহলে বলতেই হবে, ধারাটি ছড়া। আর প্রাচীনতম লোকশাস্ত্র প্রণেতাদের মধ্যে খনার বচন ও ডাকের বচনের রচয়িতারা নিঃসন্দেহে স্বীকৃত এবং অনেকের মতে তাঁদের অবস্থানই সর্বাগ্রে।

ফারহানা আজিম শিউলী: আমরা জানি, খনার বচন বাংলা ছাড়াও নানা জায়গায় ব্যাপ্তৃ
পূরবী বসু: খনার বচন বাংলা ছাড়াও উড়িষ্যা, আসাম, বিহার, কেরালাসহ ভারতের প্রায় সব রাজ্যে প্রচলিত। প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলে বচনগুলোর আঞ্চলিক সংস্করণ আছে। এছাড়া তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও খনার বচন অনূদিত ও জনপ্রিয়। তবে খনার বচনের সবচেয়ে বড়ো ও ব্যাপক প্রতিপত্তি বাংলায় ও উড়িষ্যায়।

ফারহানা আজিম শিউলী: খনার বচনের সংখ্যা আনুমানিক কতো হতে পারে?
পূরবী বসু: খনার জীবনের মতোই বচনের সংখ্যা নিয়েও কিংবদন্তি আছে। অতি প্রাচীনকালে এবং বহুকাল লোকমুখে উচ্চারিত হয়ে শ্রবণের মাধ্যমেই শুধু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসায় খনার বচনের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব না। সাধারণ ক্ষেত্রে এক থেকে দুইশত খনার বচন সম্পর্কে লোকে জ্ঞাত। তবে গবেষক আলি নওয়াজের মতে, এই সংখ্যা কয়েক হাজার পর্যন্ত হতে পারে যা বিচ্ছিন্নভাবে বহু জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ডাঃ আব্দুল গফুর সিদ্দিকীর উল্লেখ করে নওয়াজ জানান, এই সংখ্যা দেড় লক্ষের মতোও হতে পারা আশ্চর্যের কিছু না।

ফারহানা আজিম শিউলী: খনার বচনগুলো মূলত কোন কোন বিষয়ের ওপর রচিত?
পূরবী বসু: খনার অনেক কিছু নিয়ে নানা মত থাকলেও তাঁর বচনের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব নিয়ে কোন মতানৈক্য নেই। দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনের বহু বিষয়ের ওপর লেখা হলেও খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত¡ভিত্তিক ছড়া। তবে খনার বচনের রূপান্তর যেমন হয়েছে, তেমনি প্রক্ষিপ্তও হয়েছে কিছু বচন। কৃষিভিত্তিক ও জ্যোতিষ-হোরাশাস্ত্রীয় খনার বচনগুলোর বিষয়বস্তু মূলত: ১) কৃষিকাজের প্রথা ও পশুপালন ২) কৃষিকাজ ও ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র ৩) দিন/মাস ও আবহাওয়ার জ্ঞান ৪) শস্যের যতœ-সম্পর্কিত উপদেশ ও ৫) হোরাশাস্ত্র ও ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র।
বিভিন্নরকম ফসল ও ফলের চাষের এবং পশুপালনের ব্যাপারে পরামর্শ দিলেও ধান ও কলা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি উপদেশ দিয়েছেন খনা। কারণ এ দুটিই বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল ছিল সেইসময়। ধান ও কলাকে সোনা-রূপার চেয়েও মূল্যবান মনে করা হতো, অথচ চর্যাপদের যুগে সবচেয়ে দামি ছিল সোনা-রূপা। খনার একটি বচন আছে, “ধান ধন বড়ো ধন আর ধন নাই, সোনা রূপা কিছু কিছু আর সব ছাই।” ফলে খনার বচন যে চর্যাপদের আগে রচিত হয়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ধান ও কলা ছাড়াও অন্যান্য ফসল ও গাছ বিশেষ করে হলুদ, নারকেল, পান, বাঁশ, লাউ, কুমড়া, শসা এবং গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরুর রক্ষণাবেক্ষণের কথা বহুভাবে লেখা হয়েছে খনার বচনে।
এছাড়া আছে স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টিবিষয়ক খনার বচন। এদের অধিকাংশই বিজ্ঞানসম্মত ও যৌক্তিক। তবে একবিংশ শতকের জ্ঞান ও আবিষ্কারের আলোকে তখনকার সীমিত জ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের সীমাবদ্ধ পরিধির অনেককিছুই ততোটা বিজ্ঞানসম্মত মনে নাও হতে পারে। খনার স্বাস্থ্যবচনে চিকিৎসাপদ্ধতি না বরং রোগ প্রতিরোধ করার কথা বলা হয়েছে। এসব বচন মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানোর পদ্ধতি, দীর্ঘায়ু, দৈহিক-মানসিক সুস্বাস্থ্য লাভের সহজ উপায় ও কৌশলের সন্ধান দেয়।
এ পর্যায়ে আলোচক পূরবী বসুর লেখা “কিংবদন্তির খনা ও খনার বচন” বই থেকে কৃষি, ঋতু, আবহাওয়া, যাত্রা, স্বাস্থ্য-খাদ্য-পুষ্টি ও বিবিধ বিষয়ে খনার কয়েকটি বচন পাঠ করে শোনানো হয় ও এদের সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক আলোচনা হয়। বচনগুলো হচ্ছে:

“আউশ ধানের চাষ, লাগে তিন মাস।”
“আগে বাঁধবে আইল, তবে রুবে শাইল।”
“আশ্বিনের উনিশ কার্তিকের উনিশ, বাদ দিয়ে যত পারিস মটর কলাই বুনিস।”
“উঠান ভরা লাউ শসা, ঘরে তার লক্ষ্ণীর দশা।”
“কার্তিকের ঊনজলে, খনা বলে দুনো ফলে।”
“খনা বলে চাষার পো, শরতের শেষে সরিষা রো।”
“চালায় চালায় কুমুড় পাতা, লক্ষ্ণী বলেন আছি তথা।”
“ছায়ার ওলে চুলকায় মুখ, কিন্তু তাতে নাইকো দুখ।”
“পটল বুনলে ফাগুনে, ফলন বাড়ে দ্বিগুণে।”
“পশ্চিমের ধনু নিত্য খরা, পূর্বের ধনু বর্ষে ঝরা।”
“পূর্ব আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়, সেই বৎসর বন্যা হয়।”
“ব্যাঙ ডাকে ঘনঘন, শীঘ্র হবে বৃষ্টি জানো।”
“যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুন্যি দেশ।”
“রোদে ধান, ছায়ায় পান।”
“শ্রাবণ ভাদ্রে বহে ঈষাণ, কাঁধে কোদাল নাচে কৃষাণ।”
“ষোল চাষে মুলা, তার অর্ধেক তুলা, তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।”
“আগায়ে দিয়া দক্ষিণ পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।”
“অধিক খেতে করে আশ, এর নাম বুদ্ধি নাশ।”
“আগে তিতা, শেষে মিঠা।”
“আলো হাওয়া বেঁধ না, রোগ ভোগে মরো না।”
“আঁতে তিতা দাঁতে নুন, উদর ভরো তিন কোণ।”
“আম নিম জামের ডালে, দাঁত মাজো কুতুহলে।”
“উনা ভাতে দুনা বল, অতি ভাতে রসাতল।”
“কলা-রুয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।”
“খেয়ে মুতে হেগে খায়, তার বাড়ি বদ্যি না যায়।”
“খেয়ে হাগে রাত জাগে, সে মানুষ কোন কাজে লাগে?”
“খেয়ে উদাইম্যা ভাত, শইল করে উৎপাত।”
“তাল তেঁতুল দই, বৈদ্য বলে ওষুধ কই?”
“দখিন দুয়ারী ঘরের রাজা, পুব দুয়ারী তাহার প্রজা। পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই, উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।”
“নিত্যি নিত্যি ফল খাও, বদ্যি বাড়ি নাহি যাও।”
“বেল খেয়ে খায় জল, জির যায় রসাতল।”
“ভোরের হাওয়া, লাখ টাকার দাওয়া।”
“মাংসে মাংস বৃদ্ধি, ঘৃতে বৃদ্ধি বল। দুগ্ধে বীর্য বৃদ্ধি, শাকে বৃদ্ধি মল।”
“মুড়ি আর ভুড়ি, সকল রোগের গুড়ি।”
“সকাল শোয় সকাল ওঠে, তার কড়ি না বৈদ্যে লোটে।”
“একে তো নাচুনী বুড়ি, তার উপর ঢোলের বারি।”
“কপালে নাই ঘি, ঠকঠকালে হবে কি!”
“কালো ধানের ধলা পিঠা, মা’র চেয়ে মাসি মিঠা।”
“খাঁদা নাকে আবার নথ!”
“চাষি আর চষা মাটি, এ দুয়ে হয় দেশ খাঁটি।”
“চোরের মার বড়ো গলা, লাফ দিয়ে খায় গাছের কলা।”
“তেলা মাথায় ঢালো তেল, শুকনো মাথায় ভাঙো বেল।”
“দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।”
“না পাইয়া পাইছে ধন, বাপে পুতে কীর্তন।”
“নিজের বেলায় আঁটিগাটি, পরের বেলায় চিমটি কাটি।।
“পরের বাড়ির পিঠা, খাইতে বড়োই মিঠা।”
“ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল দেবার গোঁসাই।”
“বিপদে পড় নহে ভয়, অভিজ্ঞতার হবে জয়।”
“মিললে মেলা, না মিললে একলা একলা ভালা।”
“যদি থাকে বন্ধুরে মন, গাঙ সাঁতরাইতে কতক্ষণ!”
“যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নয়জন।”
“যা করিবে বান্দা তাই পাইবে, সুঁই চুরি করিলে কুড়াল হারাইবে।”
“যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে।”
“সমানে সমানে দোস্তি, সমানে সমানে কুস্তি।”
“সাত পুরুষে কুমারের ঝি, সরা দেইখা কয় এইটা কী।”
“সূর্যের চেয়ে বালি গরম, নদীর চেয়ে প্যাঁক ঠাÐা!”
“গাঙ দেখলে মুত আসে, নাঙ দেখলে হাস আসে।”
“ঘরের কোনে মরিচ গাছ লাল মরিচ ধরে, তোমার কথা মনে হলে চোখের পানি পড়ে।”
“ফুল তুলিয়া রুমাল দিলাম যতন করি রাখিও, আমার কথা মনে ফইল্লে রুমাল খুলি দেখিও।”
“ভরা হতে শূন্য ভাল যদি ভরতে যায়, আগে হতে পিছে ভালো যদি ডাকে মায়।
মরা হতে তাজা ভালো যদি মরতে যায়, বাঁয়ে হতে ডাইনে ভালো যদি ফিরে চায়।
বাঁধা হতে খোলা ভালো মাথা তুলে চায়, হাসা হতে কাঁদা ভালো যদি কাঁদে বাঁয়।”

ফারহানা আজিম শিউলী: এবারের প্রসঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে খনার নবরূপায়ণ ও বর্তমানে খনার উপযোগিতা। অন্যভাবে বলা যায়, সার্বিকভাবেই খনাকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
পূরবী বসু: নারী অধিকার সচেতনতা উত্তরোত্তর যত বাড়ছে, পুরুষ দ্বারা নারীর অবদমন ও বন্দিদশা সচেতন মানুষকে যতো আলোড়িত করছে, খনার প্রতি উৎসাহ, কৌতূহল ও শ্রদ্ধা ততোই যেন দিন দিন বেড়ে চলছে বাঙালি সমাজে। আজ বিশ্ব নারী দিবসে বাংলাদেশে খনা নিয়ে নাটক প্রদর্শিত হয়, সেমিনার হয়, প্রকাশনা হয়। বলাবাহুল্য, উড়িষ্যাতেও খনা ও খনার উপকথা সমান বা বাংলার চেয়েও বেশি জনপ্রিয়।
কবি আল মাহমুদ তাঁর বিখ্যাত কবিতা “সোনালি কাবিন”এ খনার কথা উল্লেখ করেছেন। “প্রকৃতির ছদ্মবেশে যে মন্ত্রেই খুলে দেন খনা, একই জাদু আছে জেনো কবিদের আত্মার ভিতরে।”
১৯৯৭ সালে প্রকাশিত “কথামানবী” কাব্যগ্রন্থের “খনাজন্ম” কবিতায় নারীবাদী কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখছেন, “বেঁচে থাক তুমি বরাহ, বেঁচে থাক ন্যায়দÐ, মেয়েদের কথা বলবার অধিকার কেড়ে নিও না, আমাদের নারী-জিহবা মাঠে পড়ে আজও কাঁদছে।” একই কবি “আমরা লাস্য আমরা লড়াই” কাব্যগ্রন্থের “খনার গান” কবিতায় খনাকে প্রথম বাঙালি নারী কবি হিসেবে শনাক্ত করেছেন।
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা ১০০টি খনার বচন নিয়ে পকেট বইয়ের মতো ছোট্ট আকারের মনোরম একটি বই প্রকাশ করে নব্বইয়ের দশকে।
হরিপদ দত্তের উপন্যাস “দ্রাবিড় গ্রাম” ও সাদ কামালীর উপন্যাস “লীলাবতী”তে বর্তমান প্রেক্ষাপটে চিরায়ত খনার উপস্থিতি দেখতে পাই আমরা। হুমায়ুন আহমেদের “লীলাবতী”তেও তাই।
বাণী বসু তাঁর “খনা মিহিরের ঢিপি” উপন্যাসে সমকালীন এক খনার গল্প করেছেন যিনি ইতিহাসের অধ্যাপিকা।
বাংলাদেশের নারী লেখকদের গল্প নিয়ে একটি নারীবাদী গল্প-সংকলনের নাম “কাটা জিহŸার গল্প।”
কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও অজস্র নাটক, টিভি ধারাবাহিক নাটক ও চলচ্চিত্রেও প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে খনা।
বাংলাদেশের তিনটি মঞ্চনাটক হয়েছে খনা নিয়ে – সামিনা লুৎফা নিত্রার লেখা বটতলা নাট্যদলের “খনা,” সেলিম আল দীনের লেখা “কিংবদন্তি খনা” ও নাসরিন মুস্তফা রচিত লোকনাট্যদলের “লীলাবতী আখ্যান।” খনার জীবন ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে রচিত এই মঞ্চনাটকগুলোতে নারী-পুরুষের ও সমাজের শ্রেণিভেদের দ্ব›দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে।
ড. আলি নওয়াজ জানান, একসময় ময়মনসিংহ ও সিলেটের করিমগঞ্জে খনার বচন তবলার সঙ্গে গীত হয়েছে।
ফারহানা আজিম শিউলী: দৃশ্যমানতার বা উপস্থাপনের রাজনীতির প্রসঙ্গ আজ এসেছে। সমসাময়িক খনাকে কিন্তু অন্যভাবে আমরা দেখতে পাই এখন। যেমনঃ মঞ্চ নাটকে খনার পোশাক, সাজসজ্জা। প্রকৃতির কন্যা খনার পোশাক আমরা সবুজ দেখতে পাই। সাদা শাড়ি পরিহিতা খনার দৃশ্যায়নও সময়ের সঙ্গে বদলেছে।
নাগরিক জীবনে আরো নানাভাবে খনা আসছেন। এখন বিভিন্ন উৎসব পার্বণে পোশাক-আশাক সাজ সজ্জায় খনা উপস্থিত হচ্ছেন। শাড়ি, পাঞ্জাবি, কানের দুল, গলার মালা ইত্যাদিতে আজকাল খনার বচন শোভা পায়।
এ পর্যায়ে খনার জিহŸা কাটার আদেশ এবং তারপরের খানিকটা অংশ বটতলার “খনা” নাটক থেকে ভিডিওক্লিপের মাধ্যমে দেখানো হয়।

ফারহানা আজিম শিউলী: প্রাচীনকালের অপালা, বাক, গার্গী, মৈত্রেয়ী এঁদের ধারাবাহিকতায় আরও একটি স্মরণীয় অসাধারণ নাম খনা। কোনো কোনো বিদূষী নারীর অবদানকে ইতিহাসে যেমন মান্য করা হয়েছে, আবার অনেকের অবদানকে অস্বীকারও করা হয়েছে। কৃষিকাজ সংক্রান্ত নির্দেশাবলী একজন নারীর – এটি মেনে নেওয়া, স্বীকার করার পেছনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এবার আলোচনা হোক।
পূরবী বসু: প্রাচীনকালে শস্য ও শস্য ফলাবার কর্ত্রী উভয়কেই শক্তিশালী নারী দেবতা হিসেবে গণ্য করা হতো। এমনকি প্রকৃতিকেও নারী হিসেবেই দেখার রেওয়াজ ছিল। সেই ধারা অনুসরণ করে কৃষি সম্পর্কে উপদেশাবলী নারী রচিত বলে আখ্যায়িত হওয়াই স্বাভাবিক। প্রাচীনকালে প্রকৃতি-নারীকে কেবল আদ্যাশক্তি এই বিবেচনাতেই সম্মান করা হতো না, কৃষিকাজ যে নারীদেরই আবিষ্কার এবং সভ্যতার প্রথম মৌসুমে নারীর হাতেই যে ছিল কৃষির চাবিকাঠি এটাও ঋদ্ধ সত্য যা অনেকেই আজ ভুলে যেতে বসেছেন। পরিবার, ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তির সাথে সাথে নারীর সেই জায়গা হাতছাড়া হয়ে পুরুষের কাছে চলে যায়। তারপরেও চাষবাসের প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষিতে নারীর অসামান্য ভ‚মিকা থাকার কারণেই কৃষিসংক্রান্ত এইসব উপদেশাবলী ও ভবিষ্যদ্বাণীর বচনকে নারী-রচিত অর্থাৎ খনার বচন বলে মেনে নিতে এবং প্রচার করতে দ্বিধা করেনি পুরুষসমাজ। তা নইলে যে সময় নারীদের কোনো অর্জনকেই স্বীকার করা হতো না, তখন একজন ব্যক্তি নারীর এতখানি স্বীকৃতি সত্যি অভাবনীয়।

ফারহানা আজিম শিউলী: খনার বচন প্রতিবেশঘনিষ্ঠ জ্ঞান-প্রক্রিয়া। খনার প্রতিবেশঘনিষ্ঠ কয়েকটি বচন হচ্ছে, “কচু বনে ছড়ালে ছাই, খনা বলে তার সংখ্যা নাই,” “লাউ গাছে মাছের জল, ধেনো মাটিতে ঝাল প্রবল,” “শোনরে বাপু চাষার পো, সুপারি বাগে মান্দার রো, মান্দার পাতা পচলে গোড়ায়, ফড়ফড়াইয়া ফল বাড়ায়” ইত্যাদি। এবারে ইকো-ফেমিনিজিম বা প্রতিবেশ-নারীবাদ ও খনা – এই ব্যাপারে শুনে নেওয়া যাক।
পূরবী বসু: প্রতিবেশনারীবাদীরা সব ধরনের কর্তৃত্ব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। বহুপাক্ষিক সম্পর্ক এবং শ্রেণিহীন দুনিয়াতে বিশ্বাসী এই মতবাদ কোনো ধরনের কর্তৃত্ব ছাড়া মানুষকে প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত হওয়ার আহবান জানায়।
যন্ত্রনির্ভর কৃষিকাজ ও রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারে ফলন বাড়লেও মানুষ ও প্রকৃতির মৃত্যু ডেকে আনছে। খনার বচন এই ধরনের কৃষিকাজকে সমর্থন করে না। মুনাফার লোভে কৃষি বিপ্লবের নামে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রকৃতির ওপর যে জবরদস্তি তা নিয়ে আছে হরিপদ দত্তর উপন্যাস ও ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন মার্চেন্ট এর বই Nature, Women, Ecology and the Scientific Revolution.

ফারহানা আজিম শিউলী: বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোতে কর্তৃত্ব এবং বলপ্রয়োগের জায়গায় নারীবাদীরা নারী, শিশু, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং প্রকৃতিকে নিকট সম্পর্কিত এবং পারস্পরিক আহাজারির ভেতর দিয়ে ঐক্যবদ্ধ মনে করেন। পরিবেশ ডিসকোর্সে নারীবাদীদের এই চিন্তা স¤প্রতি প্রতিবেশনারীবাদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এসব বিবেচনায় খনার বচন আমাদের সামনে প্রতিবেশ-রাজনীতির এক লড়াকু ডিসকোর্সও হাজির করে আপন কায়দায়।
তাহলে সবশেষে আমরা বলতে পারি – খনা-মিহির-বরাহের বাস কোন যুগে, বিক্রমাদিত্যের রাজসভা নাকি চন্দ্রকেতুর পিতামহ ধর্মকেতুর রাজজ্যোতিষী এই ত্রয়ী এসব নিয়ে কিংবদন্তির অভাব নেই, অভাব নেই পরষ্পরবিরোধী মতেরও। কিন্তু সেই সব অমিল থেকে খনার সবচেয়ে চেনা বা জরুরি চেহারাটা সামনে আনা দরকার এবং আলোচক পূরবী বসু সেটাই করেছেন তাঁর মূল্যবান আলোচনার মাধ্যমে।
খনার বচন কৃষি-দর্শন ও কৃষি নির্দেশনামা। সাহিত্য বিচারে খনার বচন প্রাচীন বাংলার লোকশাস্ত্র ও লোকচর্চার সম্মিলিত কণ্ঠ। এছাড়াও প্রাচীনকালে ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্রও হোরাশাস্ত্রের ওপর লিখিত সাধারণ মানুষের বোধগম্য এক দলিলও বটে।
খনা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা এক নারী। ১৪০০-১৫০০ বছর আগেই খনা হয়ে উঠেছেন লিঙ্গীয় বৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার কণ্ঠ। খনা নতুনের আবাহনের প্রতীক। খনা অচলায়তনের বিরুদ্ধে এক সাহসী উচ্চারণ। খনা ব্রাহ্মণ্য আচার সর্বস্বতার বিপরীতে প্রাকৃত লোকাচারের ভাষ্যকার।
খনা শ্রেণীখারিজের লড়াই করেছেন। তিনি বারবার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপদ্ধতি ও বিদ্যায়তনিক বলপ্রয়োগকে প্রশ্ন করেছেন। তিনি প্রবল পুরুষতন্ত্র ও পরিবারকাঠামোর অন্যায় শাসনকে জ্ঞান-প্রক্রিয়ার সত্য দিয়ে প্রশ্ন করেছেন।
খনার বচন প্রতিবেশঘনিষ্ঠ জ্ঞান-প্রক্রিয়া। খনার বচন আমাদের সামনে প্রতিবেশ-রাজনীতির এক লড়াকু ডিসকোর্সও হাজির করে আপন কায়দায়।

খনা যদি না-ও থেকে থাকেন, তবু তাঁর বচনের মূল্য বা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায় না। মহামতি খনা তাঁর অমর সৃষ্টি খনার বচনের ভেতর দিয়েই আমাদের ইতিহাসে জোরদার দৃশ্যমানতা তৈরি করেছেন। খনার বচনগুলো মানুষের, ব্রাত্যজনের, অভাজনের জীবনের গান। সেই কণ্ঠস্বর কতটা সত্যিই খনার, সে প্রশ্ন তাই অপ্রাসঙ্গিক। এখানে লড়াইটাই আসল।
সম্মানিত আলোচক পূরবী বসুর বিশেষায়িত ও জ্ঞানঋদ্ধ আলোচনা ও এর ফাঁকে ফাঁকে স্থিরচিত্র ও নাটক-চলচ্চিত্রের ভিডিও প্রদর্শন দর্শক-শ্রোতারা নিবিষ্টমনে উপভোগ করেন ও মন্তব্য করে সক্রিয় থাকেন। আলোচক সহ এ আসরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে, খনাকে আরো বেশি করে আবিষ্কার করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে পাঠশালার এ আয়োজনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা হয়।