অনলাইন ডেস্ক : কূটনীতিকদের কেনাকাটায় ভ্যাট ফেরত নিয়ে জটিলতার কারণে জার্মানিতে ৩০ লাখ ইউরো ক্ষতির মুখে পড়ছে বাংলাদেশ। ভিয়েনা কনভেনশন এবং দুই দেশের পারস্পরিক সমঝোতায় দীর্ঘকাল ধরে উভয় দেশ দূতাবাসের সব রকম কেনাকাটায় ভ্যাট রেয়াত পেলেও ২০১৬ সাল থেকে কূটনীতিকদের সেই সুবিধা বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ। বিষয়টি সহজভাবে নিতে না পেরে ২০২১ সালে বাংলাদেশের কূটনীতিকদেরও এই সুবিধা বাতিল করে জার্মান সরকার।
শুধু তাই নয়, জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সব কেনাকাটায় ভ্যাট ফেরত সুবিধাও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। এর ফলে বার্লিনে দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন নির্মাণকাজে বাংলাদেশ বিপুল অঙ্কের কর ফেরত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে পাঠানো এক চিঠি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় সাধারণ কূটনৈতিক সুবিধার অংশ হিসেবে যে কোনো দেশে আরেক দেশের দূতাবাস, জাতিসংঘ ও এর সহযোগী সংস্থা এবং বিশেষায়িত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা পণ্য ও সেবার বিপরীতে কেটে রাখা ভ্যাটের টাকা ফেরত দিতে হয়।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর ৭১ ধারায় বাংলাদেশে বলবৎ কোনো কনভেনশন বা অনুরূপ কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির অধীন ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত সরবরাহ বা বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক বা কনস্যুলার মিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য পূরণকল্পে প্রদত্ত সরবরাহের ওপর পরিশোধিত কর ফেরত দেওয়ার বিধান রয়েছে। ভিয়েনা কনভেনশন ও বাংলাদেশের আইন অনুসারে সাধারণভাবে কোনো কূটনীতিক বা দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কেনা পণ্য বা সেবার বিপরীতে দেওয়া ভ্যাট ফেরত পাওয়া যায় না।
তবে পারস্পরিক সুবিধা প্রদানের নীতির ভিত্তিতে ঢাকায় জার্মান দূতাবাস ও বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রয়োজনীয় ক্রয়ের পাশাপাশি কূটনীতিকদের ব্যক্তিগত কেনাকাটায় ভ্যাট বাবদ পরিশোধ করা অর্থ ফেরত দেওয়া হতো।
সম্প্রতি জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বার্লিনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে মৌখিকভাবে জানিয়েছে, তারা বার্লিনে এই সুবিধা অব্যাহত রাখলেও ঢাকায় জার্মান দূতাবাস তা পাচ্ছে না। ঢাকায় জার্মান দূতাবাস এবং সেখানে কর্মরত কূটনীতিকরা ভ্যাট ফেরতের জন্য এনবিআরের শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তরে ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অনেক আবেদন করেছে। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে দুই বছর ধরে মাত্র একটি ছাড়া আর কোনো আবেদন আমলে নেয়নি সংস্থাটি। এ বিষয়ে জার্মান দূতাবাস থেকে বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগ করলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এনবিআরকে দেওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি বলছে, ২০২১ সালের নভেম্বরে শুল্ক, রেয়াত ও প্রত্যর্পণ অধিদপ্তরে ব্যাখ্যা দেয় যে, কূটনীতিকদের ব্যক্তি পর্যায়ে ভ্যাট ফেরত সুবিধা প্রযোজ্য নয়। বিষয়টি জার্মান সরকার সহজভাবে নেয়নি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানিতে বাংলাদেশি কূটনীতিকদের সব কেনাকাটায় ভ্যাট প্রত্যর্পণ সুবিধা বাতিল করা হয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রাতিষ্ঠানিক কেনাকাটায় ভ্যাট ফেরত সুবিধাও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়।
বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, এটি জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবন নির্মাণের ১ কোটি ৬০ লাখ ইউরোর প্রকল্পে ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, অবকাঠামো খাতে জার্মান সরকারকে ভ্যাট দিতে হয় ১৯ শতাংশ। জার্মান সরকার বাংলাদেশ দূতাবাসের ভ্যাট ফেরত সুবিধা স্থগিত রাখায় ভবন নির্মাণে ভ্যাট বাবদ প্রায় ৩০ লাখ ইউরো গচ্চা দিতে হচ্ছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের বিদেশি সব মিশন রিফান্ড সুবিধা পাচ্ছে। জার্মান দূতাবাসের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। এই চিঠিতে নীতিমালার বিষয়ে বলা হয়েছে, নীতিমালা তৈরি করার কাজ শুরু করেছি। আর বিদেশি সব মিশনের মতো জার্মান দূতাবাসও রিফান্ড সুবিধা পাচ্ছে। তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করে আমরা ছাড় করছি। আর এনবিআরের প্রজ্ঞাপনের ব্যক্তি কেনাকাটার বিষয়ে রিফান্ড দেওয়ার সুযোগ না থাকায় আমরা দিতে পারছি না। বিষয়টি এনবিআরকে অবহিত করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে জার্মান কূটনীতিকদের ভ্যাট ফেরত দেওয়া হলেও এরপর থেকে তা বন্ধ রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আবেদন পড়লেও আমলে নেয়নি শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর। সর্বশেষ দুই বছরে মাত্র একটি আবেদন আমলে নিয়েছে এনবিআরের এই সংস্থাটি।
জানা গেছে, জার্মানিতে প্রতিটি পণ্যে ভ্যাট রয়েছে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিটি পর্যায়ে মোটা অঙ্কের ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। সব মিলিয়ে অর্থনীতিরে চলমান সংকটে জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসকে বৈদেশিক মুদ্রায় বড় অঙ্কের ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।
অথচ কোন কোন বিষয় ভ্যাট প্রত্যর্পণ সুবিধার আওতায় থাকবে, তা উল্লেখ করে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা তালিকা তৈরির জন্য জার্মান দূতাবাস এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছে। এ কাজে সহায়ক হিসেবে জার্মান সরকারের এ সম্পর্কিত একটি নীতিমালার কপিও সরবরাহ করেছিল দূতাবাস। এ বিষয়ে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং মিনিস্টার (রাজনৈতিক) একাধিকবার এনবিআরে লিখিতভাবে যোগাযোগ করলেও কোনো প্রতিউত্তর পায়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
বার্লিনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দুই বছর আগে জার্মানে থাকাকালীন কেনাকাটায় আমরা ভ্যাট রেয়াত সুবিধা পেয়েছি। তবে বর্তমানে এই সুবিধা কী অবস্থায় আছে, তা বর্তমান রাষ্ট্রদূত বলতে পারবেন।’
শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর বলছে, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে বাংলাদেশে অবস্থানরত সব বিদেশি দূতাবাস ও সংস্থা ভ্যাট রিফান্ড পাচ্ছে। জার্মানের কিছু আবেদন ব্যাক্তিগত কেনাকাটায় হওয়ায় দিতে পারছে না এই পরিদপ্তর। কারণ হিসেবে সরকারি এই পরিদপ্তর বলছে, ২০২০ সালের এনবিআরের জারি করা এই প্রজ্ঞাপণে দূতাবাস ও সংস্থার সেবা গ্রহণ এবং কেনাকাটার ভ্যাট রিফান্ড দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও ব্যক্তিগত কেনাকাটায় রিফান্ড দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ নেই। যে কারণে শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর রিফান্ড দিতে পারছে। মূলত আইনি জটিলতার কারণে ব্যক্তিগত কেনাকাটায় এই সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা।