মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীণ আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

নয়.
‘লা রেইল দ্যু জ্য’ ছবিটির কাহিনীতে রেনোয়ার সমাজ বাস্তবতাবোধের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা সত্যিই অপূর্ব। ছবির কাহিনীতে দেখা যায়, শহরের উপকণ্ঠের একটি বাগানবাড়ীতে দুই তিন দিনের কিছু ঘটনা, এতে আছে দুই শ্রেণীর চরিত্র। প্রথমটি উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পেতি বুর্জোয়া শ্রেণীর কিছু লোকজন। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাদের ভৃত্যস্থানীয় কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষ। আর তার সঙ্গে আছে এই দুই শ্রেণীর মানুষেদের সাথে জড়িয়ে পড়া একজন আগন্তক যে নিজেকে ঠিক কারো সাথে মানিয়ে নিতে পারে না। ছবির কাহিনী যখন এগুচ্ছে তখন দেখা যায়, প্রত্যেকেই খেলার নিয়ম ভঙ্গ করেছে এবং সবকটি চরিত্রই অল্প বিস্তর কিছু না কিছু স্বীকারোক্তি ঘোষণা করেছে। সংলাপ প্রধান এই ছবি সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় তাঁর একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘প্লট বলতে যা বোঝা যায় তা এতে নেই, তবে কাহিনীর একটি পরিণতি আছে, এবং কাহিনীর মধ্যে দিয়ে এই বিশেষ কয়েকটি শ্রেণী সম্পর্কে অসাধারণ তীক্ষ্ণ মন্তব্য আছে।’ পাশ্চাত্য সঙ্গীতে একাধিক চরিত্রের পরস্পরের সম্পর্কের মাধ্যমে যেমন একটা অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের সৃষ্টি হয়, তেমনি রেনোয়ার এই চলচ্চিত্রও সেই সংগীতের মতই এক অসাধারণ শৈল্পিক আলো তৈরী করে।

‘দি রিভার’ (১৯৫১) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে দুই শিশু শিল্পী রিচার্ড ফস্টার এবং নিমাই বারিক

১৯৪০ সালে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পর টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরী ফক্স কোম্পানীর প্রযোজনায় তিনি প্রথম ১৯৪১ সালে যে ছবিটি বানালেন তার নাম ‘সোয়্যাম্প ওয়াটার’। যুদ্ধের পটভূমিকায় ১৯৪৩ সালে আর কে ও রেডিও’র প্রযোজনায় তৈরি করলেন ‘দিস ল্যান্ড ইজ মাইন’ ছবিটি। তবে হলিউডে নির্মিত তাঁর ছবিগুলোর মধ্যে সব চেয়ে আলোচিত এবং মান এর দিক দিয়ে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে ‘দি সাদার্নার’ ছবিটি। দক্ষিণ আমেরিকার একটি কৃষক পরিবারের সাদাসিদে গল্প নিয়ে তোলা এই ছবিটির কাব্যগুণ এবং সহজ সরল চিত্রভাষা এটিকে একটি স্মরণীয় সৃষ্টি করে রেখেছে। এই ছবিতে সমাজ-বাস্তবতাকে যে রকম বিশ্বস্ততার সঙ্গে এবং শিল্পীজনোচিত নিরপেক্ষতা নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে যে রেনোয়া এতে প্রায়ই তাঁর সন্তষ্টি ও উৎফুল্লতা প্রকাশ করতেন। ‘দি সাদার্নার’ নির্মাণ করে রেনোয়া যে মানসিক তৃপ্তি পেয়েছিলেন, তা তিনি হলিউডের অন্য কোন ছবি তৈরি করে পাননি। ১৯৪৯ সালে ‘দি রিভার’ ছবির লোকেশন দেখার জন্য যখন রেনোয়া কোলকাতায় এসেছিলেন তখন গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেলে একদিন সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাঁর এই ছবিটি নিয়ে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় পরবর্তীতে বিভিন্ন লেখা এবং আলোচনায় এ বিষয়টি উল্লেখ করেন। রেনোয়ার সূত্র ধরে সত্যজিৎ রায় বলতেন, ‘প্রকৃত সদিচ্ছাও যে হলিউডে এসে ব্যর্থ হয়ে যায়, রেনোয়া মনে করেন তার জন্য দায়ী হলিউডের কতিপয় অচল পদ্ধতি, যেমন ওদের স্টার সিস্টেম, ফিল্মকে যান্ত্রিক উপায়ে প্রস্তুত করা এবং এটাকে একটা পণ্য দ্রব্য হিসাবে দেখার অভ্যাস। দৈবে কদাচি কোন ভাগ্যবান ডিরেক্টর মনের মতো কাহিনী, মনের মত অভিনেতা-অভিনেত্রী (স্টার’ নয়) আর মনের মতো ফিল্মকে স্বাধীনতা পেয়ে যান; ফলে যথার্থ ভালো একটি ফিল্ম হয়ে যায়। রেনোয়া নিজে হলিউডে একবার মাত্র এ ধরনের আদর্শ ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করতে পেরেছিলেন, ‘দি সাদার্নার’ ছবিটি নির্মাণের সময়। আমেরিকা বলতে কি বোঝায় তার কিছু নমুনা এই ছবিটিতে আছে। এই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোও আমাদের বাস্তব জীবন থেকে নেয়া হয়েছে।

‘দি সাদার্নার’ (১৯৪৫) চলচ্চিত্রটি হচ্ছে রেনোয়ার স্মরণীয় সৃষ্টি

বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের কাছে রেনোয়া তাঁর যে ছবির জন্য খুব শ্রদ্ধার আসনে আছেন, সেটা হচ্ছে ‘দি রিভার’। ছবিটি ১৯৫০ সালে তৈরি হলেও এর লোকেশন দেখার জন্য তিনি ১৯৪৭ সালে একবার কোলকাতায় এসেছিলেন। সেবার তিনি বর্তমান পশ্চিম বঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখেছিলেন ছবি শ্যুটিং এর স্থান ঠিক করার জন্য। মূলত এই ভূ-খণ্ডে গঙ্গা বা পদ্মার অববাহিকা অঞ্চল তিনি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। রেনোয়ার এই আসাতে সবচেয়ে উপকৃত হয়েছে বাংলার চলচ্চিত্র। তথাকথিত সেন্টিমেন্টাল চলচ্চিত্রের ধারা থেকে বের হয়ে বাস্তবতার নিরিখে ছবি তৈরির জন্য এবং বাংলা ছবিকে একটি মান এ পৌঁছে দেবার জন্য যেসব যুবকরা স্বপ্ন দেখছিল তারা রেনোয়াকে কাছে পেয়ে একজন যোগ্য পথ প্রদর্শকের সন্ধান পেয়েছিলেন। আর রেনোয়াও গভীর মমতায় এই সব যুবকদের তাঁর সঙ্গে নিয়ে সুস্থ সুন্দর চলচ্চিত্র জগতের দ্বার উম্মেচিত করে দিলেন। সেই রেনোয়াও বাংলাদেশের প্রকৃতির প্রেমেও অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।

ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম সংগঠক এবং জ্যঁ রেনোয়ার স্নেহধন্য চিদানন্দ দাশগুপ্ত বাংলাদেশে রেনোয়ার সময়টি বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর ‘রেনোয়ার চোখে বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাঙলাকে তিনি দেখলেন বিদেশীর চোখ দিয়েই, কিন্তু গভীরভাবে দেখলেন নদীই যেন তাঁর কাহিনীর কেন্দ্র হয়ে উঠল। চারিদিকে জন্ম মৃত্যু নিয়ে সংসারে বিচিত্র লীলা, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে বিরাট নদী, যার শেষ নেই। এর মধ্যে বিকশিত হচ্ছে একটি ছোট মেয়ের মন। এই তাঁর কাহিনী। এ কাহিনীর মূখ্য চরিত্রেরা ভারত-প্রবাসী ইংরেজ। ভারতের জলমাটির পরিবেশের স্পর্শ পেয়ে এ ইংরেজরা খাস ইংরেজীয়ানা থেকে অনেকখানি বিচ্যুত। খুঁটিনাটিতে হয়তো সেখানে সর্বত্র সমান নির্ভুলতা নেই, ভারতবর্ষের ব্যাপারে নানা ত্রæটি হয়তো আমাদের চোখে পড়বে, তবে তার মধ্যে মানুষ হিসেবে মানুষের পরিচয় আছে, হোক না সে বিদেশী, একটি এদেশী সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ মেয়েকে রেনোয়া তাঁর বিশেষ প্রিয় চরিত্রে অবতীর্ণ করিয়েছেন। ভারতবর্ষের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এই চরিত্রের পরিণতির মধ্যে উজ্জল।’

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে ১৯৬২ সালে তৈরী রেনোয়ার শেষ ছবি ‘ল ক্যাপোরাল এপ্যাঁগল্’

‘দি রিভার’ ছবিতে রেনোয়া ভারতের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নেন। তাদের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের রাধা এবং কোলকাতার শ্রীমতী সুপ্রভা মুখোপাধ্যায় ও সুব্রত মিত্র অন্যতম। ইংরেজিতে তোলা এই ছবিতে রেনোয়া বেশ কিছু বাংলা সংলাপ ব্যবহার করেছিলেন। আবহ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এদেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছেন, বাংলাদেশের প্রকৃতি, গঙ্গা নদীর সকাল সন্ধ্যার রূপ এবং কালী পুজা, চড়ক পুজা ও আরো কয়েকটি স্থানীয় উৎসবের যে চিত্র এই ছবিতে তুলে ধরা হয়েছিল তা ছিল স্নিগ্ধ গীতিকবিতার রসে সিঞ্চিত। ‘দি রিভার’ হচ্ছে রেনোয়ার প্রথম রঙীন ছবি।

‘দি রিভার’ ছবি শেষ করে রেনোয়া ইউরোপে ফিরে যান। তারপর ১৯৫২ সালে অষ্টাদশ শতাব্দীর পেরুর পটভ‚মিকায় এক অভিনেত্রীর প্রেমের কাহিনী নিয়ে তৈরি করলেন ‘ল ক্যারোস দ্য’। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নিয়ে তিনি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ছবি ‘ল দেজুনে সুর লার্ব’ বানালেন। এই ছবির কাহিনীর মূখ্য চরিত্র হচ্ছে একজন জীববিজ্ঞানীর। ছবিটি যদিও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, কিন্তু ছবিটিতে রেনোয়ার বিজ্ঞানের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্রƒপের মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছিল। বিজ্ঞানের শক্তির চেয়ে যে প্রকৃতির শক্তি অনেক বড় এটাই ছিল ছবির মূল বক্তব্য। কিছুটা প্রহসন, কিছুটা বিদ্রƒপ, কিছুটা কাব্যধর্মিতা এবং প্রকৃতি বন্দনা এই ছবিতে একসাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেইসাথে বলা হয়েছে প্রকৃতির কছে আত্মসমর্পনই মানুষকে প্রকৃত শান্তি দিতে পারে।
জ্যঁ রেনোয়া তাঁর জীবনের শেষ ছবিটি করেছিলেন ১৯৬২ সালে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি এই ছবির নাম রেখেছিলেন ‘ল ক্যাপোরাল এপ্যাঁগল্’। ছবির শুরুতে নাৎসীদের বোমা বর্ষণের কিছু কিছু নিউজ রীল ব্যবহার করা হয়েছিল যা দেখে প্রথম প্রথম মনে হয় এটি বোধহয় যুদ্ধ ও দেশপ্রেমের কাহিনী, কিন্তু গল্প যতই এগুতে থাকে ততই দেখা যায় যে যুদ্ধ এবং তার ভয়াবহ তাণ্ডবের কথা বলার চেয়ে সাধারণ মানুষের বন্ধুত্ব ও ঐক্যের বাণী উপস্থাপিত হয়েছে এই ছবিটিতে। ছবিতে দেখা যায়, একজন ফরাসী যুদ্ধবন্দী কর্পোরাল জার্মানদের বন্দিশিবির থেকে পালাতে গিয়ে পর পর ছয়বার ব্যর্থ হয় এবং তার জন্য সে কঠোর শাস্তি পায়। সপ্তমবারে কর্পোরালটি পালাতে সম হন এবং মুক্ত হয়ে প্যারিসের উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়। কর্পোরালের সপ্তম বারের পালানোর ঘটনাই হচ্ছে ছবির মূল বিষয়বস্তু।

তখন মাঝে মধ্যে রেনোয়ার নিজেকে কর্পোরালের মতই মনে হতো। মনে হতো, পুঁজিবাদী বিশাল মার্কিন সাম্রাজ্যে তিনিও এক ধরনের বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। যদিও হলিউড’ই তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল, অর্থ এনে দিয়েছিল আর তাঁর স্বপ্নের চলচ্চিত্রগুলি নির্মাণ করার সুযোগ করে দিয়েছিল, তারপরও এক ধরনের বন্দী চিন্তা সব সময়ই তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতো। লস এঞ্জেলস-এর বেভারলি হিল এ তাঁর প্রশস্ত খোলা বাড়িটাতো তিনি নিজের মন মতই তৈরি করেছিলেন। হলিউড’তো হচ্ছে মুক্ত মানুষের চারণক্ষেত্র। এটাতো বিশ্ব মানুষের! আর তিনিতো এই আমেরিকার একজন নাগরিক। আমেরিকাওতো তাঁর নিজের দেশ! তারপরও কেন যেন মার্কিন সাম্রাজ্যে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়িয়ে নিতে পারছিলেন না। ১৯৬২ সালে ‘ল ক্যাপোরাল এপ্যাঁগল্’ তৈরির পর ১৯৬৯ সালে টেলিভিশনের জন্য তিনি বানালেন ‘দ্য লিটল থিয়েটার অব জ্য রেনোয়া’।

দীর্ঘ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর এক নাগাড়ে ঊনচল্লিশটি ছবি করার পর তিনি থামলেন। তখন তাঁর শরীরে বার্ধক্য এসে ভর করছিল। শুটিং ইউনিট নিয়ে খুব বেশি ছুটোছুটি তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। জীবনের শেষ দিনগুলিতে রেনোয়া তাঁর বেভারলি হিলের বাড়ির খোলা লনে পাঁয়চারী করতেন। হয়তোবা সে সময়গুলোতে বারবার তাঁর মনসপটে ভেসে আসতো তাঁর বাবার ইম্প্রেশনিস্ট ধারার সব ছবিগুলোর ক্যানভাস, যেগুলোতে অদ্ভুতভাবে ফুতে উঠতো ফুল, পাতা, নৌকা আর নদীর ছবি।

নদীর কথা যখনই তাঁর মানসপটে ভেসে আসতো, তখনই তাঁর মন ছুটে যেতো প্যারিসের শীন নদীর তীরের অপূর্ব সেই প্রাকৃতিক জায়গায়, যেখানে এক বালক নিজের মত খেলা করছে আর একজন পিতা মগ্ন হয়ে এঁকে চলেছেন তাঁর মনোচেতনার সব ছবি। সেই সময়ে তাঁর জীবনে আরেকটি অদ্ভুত বিষয় ঘটতো, আর তা হচ্ছে, শীন ছাড়াও তাঁর মন প্রায়ই ছুটে যেত বাংলার গঙ্গার তীরে। তিনি ভেবে খুবই আনন্দ আর সুখ পেতেন, কি সরল সুন্দর সব মানুষ বাস করে প্রশস্ত নদীটির দু’ধারে! তাঁর প্রায়ই মনে পড়ে যেতো কলকাতার এক ঝাঁক চলচ্চিত্রপাগল যুবকের কথা। কত চমৎকার স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার, তাদের প্রায়ই সকলেই নিজের নিজের জায়গায় বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য শৈল্পিক কাজ করে যাচ্ছে। আর সেই চলচ্চিত্রপাগল স্বপ্ন দেখা যুবকদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা ‘মানিক’ অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় বাংলা আর ভারতের সীমানা ছেড়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। চলচ্চিত্রে এক নতুন সৌন্দর্য আর শৈলী এনে সে বারেবারে হতবাক করে দিচ্ছে পৃথিবীর সব বড় বড় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র সমালোচক আর দর্শকদের।

সেই ১৯৪৯ সালের কলকাতা আর গঙ্গার পাড় ছাড়াও আরো অনেকবার সত্যজিতের সাথে দেখা হয়েছে জ্য রেনোয়ার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। অদ্ভুত ব্যাপার, প্রতিবারই সত্যজিৎ সবার সামনে রেনোয়াকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘প্রিন্সিপাল মেন্টর’ হিসেবে। সেদিনের সেই যুবক ছেলেটার কৃতজ্ঞতাবোধ বারবারই রেনোয়াকে আবেগায়িত করে ফেলতো। ফলে যখনই সত্যজিতকে তিনি কাছে পেতেন, তখনই পরম ভালোবাসায় অনেকক্ষণের জন্য জড়িয়ে রাখতেন। তাঁর মনে হতো এ ভালোবাসা শুধু বহন করতে পারে যারা শীন আর গঙ্গা নদীর অপূর্ব সারল্য আর ভালোবাসা দেখেছে।

১৯৭৯ সালের শুরু থেকে রেনোয়া কিছুটা অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন শীন নদী আর তাঁর মাতৃভূমি ফ্রান্সের জন্য। বারবার শেষবারে মত যেতে চাইছিলেন প্যারিসে, তাঁর জন্ম শহরে। তিনি চাইছিলেন, জীবনের শেষ দিনগুলোয় সেই বালকবেলার মত শীন নদীর তীরে কাটাবেন। একেবারে নিজের মত নিষ্পাপ বালকের মত নদীর তীরে ছুটোছুটি করে।
১২ ফেব্রুয়ারির মাঝ রাতে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন স্ত্রী দিদো তখন ঘুমে। বিছানা থেকে উঠে এসে রেনোয়া দাঁড়ালেন বেভারলি হিলের বাসার দক্ষিণ দিকের ব্যালকনিতে। প্রশস্ত লনের ওপারে শহরের তন্দ্রাচ্ছন্ন ল্যাম্পপোস্ট থেকে মলিন বিষন্ন আলো ছড়িয়ে পড়ছে প্রশস্ত সব রাস্তায়। মাঝে মধ্যে সোঁ সোঁ শব্দে গাড়ি ছুটে চলেছে দিক-বিদিক বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই রাজধানীর রাস্তায়। হঠাৎ তাঁর হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠলো, তাঁর খুব বেশি ইচ্ছে করছিল তখনই প্যারিসের রাস্তায় ছুটে যেতে যেতে শীন নদীর পাড়ে গিয়ে বসতে। শীন নদীর পাড়ে বসে মাঝরাতে শীন নদীর দু’কুলের সোঁ সোঁ শব্দের হৃদয় জুড়ানো বাতাস গায়ে মেখে নিতে। পঁচাশি বছরের নদী পাগল বালক বয়সের বার্ধক্য ভুলে এক দৌড়ে শীন নদীর পাড়ে ছুটে যাবেন বলে কেবল এক ধাপ ফেলেছেন…। তারপর কিছুক্ষণ নিকষ কালো অন্ধকার! সেই অন্ধকারটা যখন একেবারে কেটে গেল, তখন তাঁর দেহমন আনন্দে জেগে উঠলো শীন নদীর প্রাকৃতিক আলোর বন্যায়।

জ্যঁ রেনোয়ার ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ফ্রান্সেই হল। তাঁর বাবার কবরের পাশেই… শীন নদীর কাছেই। (চলবে)