খুরশিদ শাম্মী : জীবনের প্রয়োজনে মানুষ দেশান্তরিত হয়ে ভিন্ন দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে ঠিকই, কিন্তু প্রতিটি মানুষের মনের গহীনে সুপ্ত থাকে মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি অদৃশ্য টান। আর সে কারণেই অধিকাংশ অভিবাসী যার যার নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করতে চেষ্টা করে অক্লান্তভাবে। টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও সকল প্রতিক‚লতা উপেক্ষা করে চেষ্টা করে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখতে। তারা কামনা করে নিজের সংস্কৃতি বিকশিত হোক এই বিদেশ বিভুঁইয়ে।

হ্যাঁ, টরন্টো প্রবাসী সকল বাংলাদেশিদের এমনই এক মনোবাসনা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সাত বছর পূর্বে একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন কয়েকজন টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশি। তাঁদের স্বপ্নটি ছিল খুব স্বচ্ছ, টলটলা জলের মতো, টরন্টোতে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ, যেখানে মিলেমিশে আছে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষার ইতিহাস, মাতৃভাষার অধিকার। হ্যাঁ, স্বপ্ন দেখে তাঁরা থেমে থাকেননি একদিনও। সেদিন থেকেই তাঁরা কাজ করে গেছেন অক্লান্তভাবে। টরন্টো সিটির নিয়মানুযায়ী কাজটি যথাযথ পদ্ধতিতে করার অভিপ্রায়ে প্রথমেই তাঁরা তৈরি করেন ঙঞওগখউ ওঘঈ. (অর্গানাইজেশন ফর টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে মনুমেন্ট ইনক্)। তারপর থেকে শুরু হয় নির্ধারিত গন্তব্যের পথে যাত্রা। যাত্রা পথে কত ধরণের ঝড় যে এসেছে, তা মোকাবিলা করেছেন তাঁরা দৃঢ় চিত্তে। বারবার আঘাত পেয়েও ক্ষান্ত দেয়ার কথা ভাবেননি একবারও তাঁরা, বরং প্রতিবারই আরো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আঘাতগুলো কখনো মচকিয়ে দিয়েছে, কখনো ভেঙে দিয়েছে, তবুও তাঁরা আবার উঠে চলতে শুরু করেছেন। তাঁদের সাথে ছিল বাংলা কমিউনিটি।

বিনা পারিশ্রমিকে সংস্থার পরিচালকমণ্ডলী এই বিদেশের মাটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরে পর বছর কাজ করেছেন। দাতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে তাঁরা অর্থ সংগ্রহ করেছেন। ওটিআইএমএলডি ইনক্ এর উদ্দেশ্য, প্রতিশ্রুতি ও পরিচালকমণ্ডলীদের আন্তরিকতায় কেবল টরন্টো প্রবাসী বাংলাদেশিরাই অনুপ্রাণিত হননি, অনুপ্রাণিত হয়েছেন টরন্টোর অন্যভাষার জনগণ, অন্য দেশে বসবাসরত বাঙালিরাও এবং তাঁরাও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। তাঁদের সম্মিলিত মেধা, পরিশ্রম ও প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির জোরে তাঁরা সাত বছর শেষে এসে পৌঁছেছেন নির্ধারিত গন্তব্যের খুব কাছাকাছি। হ্যাঁ, সিটির মেয়রের উপস্থিতিতে নভেম্বর ৭, ২০২০ তারিখ ড্যানফোর্থ বাংলা শহরের কাছাকাছি ডেন্টোনিয়া পার্কে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে চলছে তা সঠিক গতিতে। গত মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৮, ২০২০ কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। নিয়মানুযায়ী গত শুক্রবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২০ সিটির ইন্সপেক্টর এসে নির্মাণাধীন প্রকল্প পরিদর্শন করে গেছেন এবং তাঁরা কাজ ও কাজের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সংস্থার প্রেসিডেন্ট ম্যাক আজাদকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, নির্মাণ কাজ আগাচ্ছে কাক্সিক্ষত গতিতে। এখনও ইন্টারলকিংসহ বাকি আছে আরো কিছু কাজ। মার্বেল পাথর আসছে ইতালি থেকে। আবহাওয়া অনুক‚লে থাকলে আশা করা যায় এবছরেই কাজ সম্পূর্ণ করা যাবে। ২০২১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে স্থায়ী শহীদ মিনারে টরন্টোর বাংলাদেশি কমিউনিটিসহ সকলেই শহীদ দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে পারবেন। সর্বশেষে তিনি টরন্টোর স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ কাজের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত সকলকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি আরো বলেন, বিদেশের মাটিতে শহীদ মিনার নির্মাণ যেমন আমাদের পুরো বাংলা কমিউনিটির গর্ব, তেমন আমাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ।