অনলাইন ডেস্ক : সায়রা আহমাদি (৩০) একজন আফগান নারী। ২০১৮ সাল থেকে কানাডার টরন্টো এলাকাতে বসবাস করছেন। আফগানিস্তানে তালেবানরা তার মা-বাবা স্বামীকে হত্যা করেছে। ২০১৬ সাল থেকেই পুরো পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অবশেষে ৬ বছর পর গত বুধবার টরন্টোতে সায়রার সাথে তার ৬ ভাই-বোনের পুনর্মিলন হয়েছে। সায়রা বলেন, তালেবানদের অত্যাচারে অন্য অনেক পরিবারের মতো আমাদের পরিবারটিও ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ২,১৯০ দিন পর আমি আবার আমার ভাইবোনদের জড়িয়ে ধরতে পারলাম। মাঝের এই সময়টা আমাদের জন্য ছিল খুবই কঠিন একটা সময়। তারপরও আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ যারা আমার ভাই বোনদের এখানে আসতে সহায়তা করেছে, আমাদের পরিবারের পুনর্মিলনে সহায়তা করেছে। সত্যিই আজ আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ২০১৮ সালে কানাডায় আসার পর থেকেই সায়রা গ্রেটার টরন্টো এলাকার সমর্থকদের সহায়তায় তার ভাইবোনদের এখানে আনার চেষ্টা শুরু করেন। সায়রার পরিবারের রয়েছে দুই দশকের নির্যাতন আর সংগ্রামের গল্প। জন্মভ‚মি আফগানিস্তান ছাড়াও এই গল্পের সাথে জড়িয়ে আছে ভারত ও তাজিকিস্তানের নাম। পৃথক ঘটনায় তালেবানরা হত্যা করেছে সায়রা আহমাদির মা-বাবা ও স্বামীকে। নতুন করে জীবন শুরুর আশায় কানাডায় চলে এলেও সায়রার মনে সব সময়ই চিন্তা হত তার বাকি ভাই-বোনদের নিয়ে। সর্বদাই দুশ্চিন্তা হত নতুন করে আবার না কোন ট্রেজিডি আঘাত হানে তাদের পরিবারে।

সায়রাকে এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে টরন্টোতে গড়ে ওঠে একটি সমর্থক গোষ্ঠি। তারা তার ভাই-বোনদের কানাডায় আনতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তহবিল সংগ্রহ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত এবং সবকিছু সমন্বয়ের পর অবশেষে গত বুধবার গভীর রাতে তারা আবার একত্রিত হয়।

সায়রার ৬ ভাই বোনদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তারা হলো- মুরসাল, ঈদ মোহাম্মদ, আলী, মুর্তজা, ফাহিম ও সামি।

পেছনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে সায়রা বলেন, ২০০৯ সাল থেকেই তাদের পরিবারে দুর্ভোগের শুরু। ওই বছর তালেবানদের বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় তাদের বাড়ি। হত্যা করা হয় তাদের মা ও এক ভাইকে। এরপর থেকে শুরু হয় তাদের উদ্বাস্তু জীবন। ২০১৬ সালে সায়রা বিয়ে করেন এজাতুল্লাহ নামে এক যুবককে। তিনি আফগানিস্তানে কানাডিয়ান বাহিনীর সাথে অনুবাদকের কাজ করতেন। কানাডা যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই দম্পতি ২০১৮ সালে নয়াদিল্লিতে গমন করেন। কিন্তু এজাতুল্লাহ তার বাবার অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে কাবুলে ফিরে যান। ফলে সায়রা একাই কানাডা যাত্রা করেন। ওই বছর ১৭ মার্চ তিনি টরন্টোতে পৌঁছান। তিনি আশা করছিলেন তার শ্বশুর কিছুটা সুস্থ্য হলেই তার স্বামী কানাডায় চলে আসবেন। কিন্তু ২৮ মার্চ সায়রা জানতে পারেন কাবুলে তালেবানদের গাড়ি বোমা হামলায় তার স্বামী নিহত হয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর শোক শেষ না হতেই আফগানিন্তানে সায়রাদের গ্রামের বাড়িতে তালেবানদের হামলায় তার বাবা ও ভাইসহ ৭২ জন নিহত হওয়ার খবর আসে। তার অন্য ভাই বোন ও সৎ মা প্রাণ বাঁচাতে তাজিকিস্তানে পালিয়ে যান। একের পর এক স্বজনদের মৃত্যুর খবরে কানাডায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন সায়রা। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পুরো ১ দিন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন তিনি। সায়রা বলেন, এখনো আমার সে দিনগুলোর কথা মনে হলে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ভয় আর উৎকণ্ঠা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। রাতে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি না।

সায়রার ওই দুঃসময়ে যারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল তাদের একজন রুথ কেসিডি ও তার স্বামী। ফেসবুকে এদের সাথে সায়রার পরিচয়। কেসিডি বলেন, আমরা তার গল্প শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি। তাই তার জন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু তাজিকিস্তান থেকে সায়রার সৎ মা ও অন্য ভাইদের কানাডায় আনা সহজ ছিল না। তার পরও আমরা একটি সমর্থক গোষ্ঠি তৈরি করে সবকিছু রেডি করছিলাম। তহবিল গঠন, স্পন্সরশিপসহ সমস্ত কার্যক্রম সঠিক পথেই এগুচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই খবর আসে তাজিকিস্তানে সায়রার সৎ মা হৃদরোগে মারা গছেন। কাগজ পত্র সব উনার নামেই হচ্ছিল। তাই সেগুলো সব বাতিল হয়ে যায়। আমরা হতাশ হলেও দমে যাই নি। সায়রার ভাই মুরসালের বয়স ১৮ হওয়ার পর তার নামে নতুন করে আবেদন করি। অবশেষে আমরা সায়রার কাছে তার ভাইবোনদের এনে দিতে সক্ষম হই। কেসিডি বলেন, এটি কোন একক প্রচেষ্টা নয়। আমরা সায়রার মুখে হাসি ফোটাতে একটি ‘স¤প্রদায়’ হিসেবে কাজ করেছি।
সায়রা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, টরন্টোতে থাকার জন্য আমরা একটি এপার্টমেন্ট পেয়েছি। কোন দিন ভাবিনি এভাবে আবার এক ছাদের নিচে সবাই একত্রে বসবাস করতে পারব। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। জীবনে নতুন আশা, নতুন আলো দেখতে পাচ্ছি। এখন সবাইকে সাথে নিয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে চাই। সূত্র : সিবিসি