সাজ্জাদ আলী : কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেখি কঙ্কাবতী সাজুগুজু করে দাঁড়িয়ে। টুকটাক কিছু কাজের জন্য আজকের সকালটা বরাদ্দ রেখেছি। এই যেমন কাপড় লন্ড্রিতে দেওয়া, জামার বোতাম লাগানো, ফোনের সিম কেনা ইত্যাদি সব কাজ। দরজায় চাবি ঢুকাতে ঢুকাতে বললাম, কঙ্কাজী এটুকু কাজ তো আমি একাই করে আসতে পারতাম, তুমি না হয় এ বেলা বিশ্রাম নাও। পাত্তাই দিলো না আমার কথার, বললো আমি তো মোটেই ক্লান্ত না। বের হও তো আর কথা বাড়িও না। কোন দুঃখে একা ঘরে থাকবো বলোতো? তাছাড়া তোমার সাথে মন খুলে কথা বলা যায়, তুমি ভাল শ্রোতা। আজ তোমাকে হাঁটাতে হাঁটাতে নিয়ে যাবো দিল্লি’র গাছ তলার দোকানগুলোতে। আশ্চর্য হয়ে বললাম, গাছতলার দোকান মানে! সে কি রকম? বাম হাতের কুনুই আমার পিঠে ঠেকিয়ে ঠেলে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বললো, চলই না দেখবেক্ষণ।

দিল্লিতে এক মাসের জন্য কঙ্কাবতী আমার বাড়িওয়ালী এবং গাইড। মাত্র সপ্তাহ খানেকের পরিচিতির মধ্যেই কখন যেন সে অভিভাবকও বনে গিয়েছে। ছোটখাট অনেক বিষয়েই আমার হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই যেমন গাড়ি নিয়ে বেরুবো হবে নাকি মেট্রোরেলে, স্ট্রীট ফুডের দোকান থেকে কোন আইটেমটা খাওয়া চলবে, লালকেল্লা আগে দেখবো না কি কুতুবমিনার, রাতে ক’টা নাগাদ বাসায় ফিরবো ইত্যাদি মেয়েলী ধরনের মোড়লীপনাগুলো করে সে বিপুল আনন্দ পাচ্ছে। আমিও তার এই খবরদারীগুলো বেশ উপভোগ করছি। দিল্লি এবং উত্তর প্রদেশের বর্ডার এলাকায় কঙ্কাবতীর তিনতলা ভবনে মোট ৬টি ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় তলার যে ফ্ল্যাটটিতে সে নিজে থাকে, ঠিক তার উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে আমার আপাতঃ আবাস। তৈজসপত্র ও আসবাবপত্রে সুসজ্জিত এপার্টমেন্টটি যে কোন পাঁচতারকা খচিত হোটেল কক্ষের সাথে তুলনীয়। আর সুবিধাদির বিপরীতে খরচ অর্ধেক।

প্রথম দুদিনে আমাকে ৫ বার ট্যাক্সি ডাকতে দেখে কঙ্কা বললো, কানাডার মানুষ তুমি গাড়ি চালাতে জানো নিশ্চয়ই? আমার গাড়িখানা তো পড়েই থাকে, তুমি চাইলে চালাতে পারো। কিছু একটা ভাড়া না হয় দিয়ে দিয়ো। আঁৎকে উঠে বললাম, না গো না তোমার শহরে আমি গাড়ি চালাতে পারবো না! কেউ এখানে রাস্তার আইন মানে না! আমার সাথে তোমার গাড়িখানারও সহমরণ হবে। এমন জবাবেরই যেন অপেক্ষায় ছিলো সে। টগবগিয়ে বলে উঠলো, তা হলে আমিই তোমাকে গাড়ি চালিয়ে সবখানে নিয়ে যাবো। তুমি রাজিতো, বলো? ওর উচ্ছ¡ল মুখাবয়াবের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবি, আমি কি বৈরাগী যে তোমার মতো মনোহরিনীর আহ্বানে নিথর থাকবো। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। আর মনের মাঝারে গুঞ্জরিত হলো রবি কবি রচিত সেই প্রিয় গানটি,
“তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে
আমায় শুধু ক্ষণেক-তরে।
আজি হাতে আমার যা-কিছু কাজ আছে
আমি সাঙ্গ করব পরে।”

মস্ত এক ছাতিম গাছের তলায় বেশ লম্বা একখানা টেবিল পেতে বলবীর সিং ধোপার দোকান খুলে বসেছে। দোকানের সামনে দিয়ে ৬ লেনের প্রশস্ত রাস্তা। অসংখ্য গাড়ি ভেপু বাজিয়ে সে রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। দিল্লি’র রাস্তাঘাট নোংরা ও ধুলিময়। দূর থেকে আঙ্গুল উঁচিয়ে কঙ্কাবতী বলবীর সিংয়ের দোকানটি দেখালো। দোকানে কোন খরিদ্দার দেখা যাচ্ছে না। পথের দুটো কুকুর জড়াজড়ি করে টেবিলের নিচে ঘুমিয়ে, আর স্বাস্থ্যবতী তিনচারটা দুধেল গাভী কাছাকাছি চরে বেড়াচ্ছে। ফুটপাথ ফাঁকা, শীতের সকালে পায়ে হাঁটা লোক নেই বললেই চলে। খানিকটা দূরের একটি গ্যারেজ থেকে বিজলীর তার টেনে টেবিলের উপর কাপড় ইস্ত্রি চলছে। সিংজী দোকানের সামনে ও পাশের খানিকটা জায়গায় জল ছিটিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নিয়েছে। ইস্ত্রি করা কাপড়গুলো টেবিলের এক কোণে পলিথিন পেপারে ঢেকে রাখা। দোকানের এমন আটপৌঢ়ে দশা দেখে কঙ্কাকে বললাম, আমার শার্ট-জ্যাকেটগুলোতো ড্রাই ক্লিন করা দরকার, ওরা নষ্টভষ্ট করে না ফেলে! হাত উঁচিয়ে আশ্বস্ত করলো সে। বলবীরের ড্রাই ক্লিনিং প্লান্ট আছে, সেখান থেকে ধুয়ে কাল এ রকম সময়ের মধ্যে কাপড়গুলো বাসায় ডেলিভারী করবে সে।

নেপালী কন্যা কঙ্কাবতী হিমালয়ের পাদদেশে বেড়ে উঠেছে। দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুল শেষ করে চিনের পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে প্রত্নতত্ত¡ বিজ্ঞানে এমএস ডিগ্রী নিয়েছে। চমৎকার স্কটিশ ধাঁচে ইংরেজি বলে, আর হিন্দি তার মাতৃভাষা। ৫ ফিটের মতো লম্বা হবে, মাঝারী গড়ন। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং, সামান্য নখের আচড়েই চামড়ার নিচে রক্তের দাগ দেখা যায়। ভীষন বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া, আর স্মার্ট মুখশ্রী তার। কথা বলার সময় মাথার সামান্য দুলুনিতে ওর রেশমী চুলের গোছা মুখখানা ঢেকে দেয়! চপলা, চঞ্চলা সে, এক মুহূর্তও স্থির থাকতে পারে না। বিদ্যা এবং বুদ্ধির তুলনায় আচরণ চটুল। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ খবরের কাগজের বেতনভুক নিবন্ধ লেখক সে, ভারতবর্ষের পুরাকীর্তি নিয়ে প্রতি সপ্তাহে লিখছে। খানিকটা গা ঘেষা স্বভাবের, মানুষ পছন্দ হলে একেবারে মিলেমিশে একাকার। তার দ্বিতীয় স্বামী ৪ বছর আগে গত হয়েছেন। কঙ্কা’র ভাষায়, “একাকিত্ব বিরক্তিকর! প্রতিদিনই সঙ্গী খুঁজতে বের হই, আর হতাশ হয়ে ঘরে ফিরি।”

ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কঙ্কা ভারতবর্ষে ঘোরী রাজবংশ, খিলজী সালতানাত, তুঘলকি শাসনামল, মুঘল সাম্রাজ্য, বৃটিশ উপনিবেশবাদ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দিল্লির ভৌগোলিক গুরুত্ব আমাকে বুঝিয়ে বলছিল। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, আজ ডিনারে তোমাকে নিজে রেঁধে খাওয়াবো। আমি পিৎজা বানাতে পারি, চিকেন ফ্রাই, নুডুলস, আর ফ্রায়েড রাইসটা বেশ ভালই পারি। কি খাবে বলো? বললাম, কঙ্কাজী গত কয়েক রাতেইতো খাবারের বিল তুমি দিচ্ছো, আজ আবার নিজে চুলা জ্বালাবে কেন! আজ না হয় ডিনারটা আমিই খাওয়াই তোমাকে, কোন রেঁস্তোরায় কি খেতে চাও বলো। ওর রাঙ্গা মুখখানা মলিন করে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো, আচ্ছা তুমি যে “কঙ্কাজী কঙ্কাজী” বলে চলেছো, তার কারণটা কি? আমি কি অন্তর খুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়াইনি? দেখ যে ক’টা দিন আমাদের একসাথে কাটবে তার মধ্যে কোন ব্যবধান রেখ না প্লিজ। আমি তো তোমার নাম ধরেই ডাকছি। তবে তুমি কেন দূরত্ব বজায় রাখবে? কথাগুলো বলতে বলতে তার মুখাবয়াব ভারী হয়ে উঠলো। সঙ্গী-কাঙ্গাল এই মানুষটির জন্য অন্তরাত্মা ব্যথিত হলো। আমার ডান হাতের তর্জনী ওর ওষ্ঠে চেপে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ছোট্ট করে বললাম, আচ্ছা কঙ্কা অমনটা আর হবে না।

জোড়া দেওয়া টুকরো মুহূর্তগুলোই জীবনের গাঁথুনি। ক্ষণিকের ভাল লাগাগুলো মনপ্রাণ আন্দোলিত করে। জগৎ সংসারের সুখকর ক্ষণগুলোর আঘ্রান পেতে চাই আমি। উচিত/অনুচিতের জাগতিক বেড়াজাল বেজায় অসহ্য। মাঝেমাঝেই মনে হয় যেন সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড আমার ভাললাগার বিরুদ্ধচারণ করছে। জীবনের এই ‘বেঠিক’ সময়ে কেন যেন ‘সঠিক’ মানুষগুলোর দেখা পাই। ফুটপাথের উপরে দাঁড়িয়ে আনমনে এমনি কত কি যেন ভাবছিলাম। তাড়া দিলো কঙ্কা, চলো এগুই। বললাম, আর হাঁটতে পারছি না যে, ট্যাক্সি রিক্সা একটা কিছু ডাকো তো। কি যে বলো ইয়াং ম্যান, ওই যে বটগাছটা দেখছো ওর ছায়াতেই সোলেমান দর্জ্জির দোকান। এটুকু হাঁটা তোমার জন্য কোন ব্যাপারই না। পা চালাও তো।

লোহার ফ্রেমের একখানা চেয়ারে বসে টেবিলমেশিনে একটা ব্লাউজ শেলাই করছিলেন বৃদ্ধ। দূর থেকে দেখেই গলা উঁচিয়ে হিন্দিতে বলে উঠলেন, আসুন আসুন কঙ্কাজী, কেমন আছেন? অনেক দিন পরে এলেন? আমাকে তার বন্ধু বলে কঙ্কা পরিচয় করালো। কুশল বিনিময় পর্ব সেরে হাতের কাজটি বাদ রেখেই সোলেমান মিয়া আমার জামার বোতামটি সেলাই করে দিলো। সুঁইয়ে সুতো ভরতে ভরতে বৃদ্ধ জানতে চাইলো কানাডায় হালাল মাংস পাওয়া যায় কিনা, আর জুম্মার নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ আছে কিনা। আমার জবাব বলা শেষ হবার আগেই কঙ্কা কথা বলে উঠলো। আসলে অন্যের কথা শোনা কঙ্কাবতীর অভ্যাস না, সে শুধু বলতেই চায়। আমাকে প্রশ্ন করলো, অ্যাই তুমি কি কোন ধর্মের অনুসারী? এমন প্রশ্ন এড়িয়ে চলাই সঙ্গত। হাসতে হাসতে বললাম, মনস্বীনি এ মুহূর্তে তুমিই আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার; ধর্মচিন্তা মাথায়ই আসছে না।

দিল্লির একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিত্যদিন আমার হাজিরা দেয়া কর্তব্য। বেলা ৩টা থেকে ৪টা অবধি ওখানটায় দর্শনার্থীরা যেতে পারে। সারাদিন আমরা একসাথে কাটালেও শুধু এই সময়টাতেই কঙ্কাকে সাথে নেই না। সে পার্কিংলটে গাড়িতে বসে থাকে। বিষয়টা নিয়ে তার কৌতুহলের শেষ নেই। নীতিগতভাবে পারিবারিক বিষয়াবলি বন্ধুদের কাছে মেলে ধরাটা আমি পছন্দ করি না। আবার কঙ্কাকে এ নিয়ে অখুশি করতেও চাই না। আজ ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে সেবাকেন্দ্রের বিষয়টি আবারো জানতে চাইলো। পরম মমতায় ওর ঘাড়ের উপরের সিল্কি চুলে আঙ্গুলের বিলি কাটতে কাটতে বললাম, কঙ্কাবতী ওটি আমার পারিবারিক ব্যাপার। বিষয়টি তোমার জন্য মোটেও প্রাসঙ্গিক নয়। আর আমাদের দুজনের মধুময় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমিই তোমার কাছে সত্য, আর তুমি আমার কাছে। অন্য কোন সত্য খোঁজার আমাদের প্রয়োজন কি? অপ্রয়োজনীয় বিষয়াবলিতে তুমি অহেতুক কৌতুহল রেখ না প্লিজ।

আরো প্রায় ২০/২৫ মিনিট হাঁটিয়ে কঙ্কা মস্ত একটা ইউক্লিপটাস গাছের তলার চায়ের দোকানে নিয়ে এলো। এলাকাটিকে একটি অফিস কমপ্লেক্স বলেই মনে হলো। ৪ খানা জলচৌকি পাশাপাশি পাতিয়ে বিপিন মুখুজ্জে চায়ের দোকান খুলেছে। কঙ্কা বললো দোকানী কিন্তু বাঙ্গালীবাবু। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কঙ্কার সাথে ইংরেজিতে চালিয়ে যাই বটে, কিন্তু বাকিদের সাথে আমার ভঙ্গুর হিন্দি সদা কাঁতরাতে থাকে। নমস্কার বিপিন দা, কেমন আছেন আপনি? ব্যাস, আর বলতে হলো না! বাংলা বলার ঢং শুনে বিপিনবাবু বলে উঠলো, দাদাতো দেখছি বাঙ্গাল! শুরু হয়ে গেল তার কথার ফুলঝুরি। চা পান করতে করতে মন খুলে বাংলা বলছিলাম তার সাথে। বরিশালের মানুষ আমি দাদা, কীর্তনখোলার জলে সাঁতরিয়ে বড় হয়েছি। ইলিশ খাই না বছর কুড়ি হবে, দিল্লিতে আশার পরে ও সব স্বাদ ভুলেই গেছি। বলে চলেছে বিপিন মুখুজ্জে। কখনো সে উচ্ছল, কখনও বা বিষন্ন। মানুষ দেশ ছাড়লেও দেশ যে তাকে ছাড়ে না, সে আমার থেকে আর ভাল কে বোঝে!

একপাল গরু এসে বিপিনদার দোকান ঘিরে দাঁড়ালো। মস্ত এবং স্বাস্থ্যবান সব পশুগুলো, সংখ্যায় ২০/২২টা হবে। তবে গরুগুলোর সাথে কোন রাখাল নেই, ওরা স্বইচ্ছায় চরে বেড়াচ্ছে। গরুর পাল এসে দাঁড়াতেই খরিদ্দাররা সবাই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালো। কেউ কেউ দোকান থেকে কলা পাউরুটি নিয়ে গরুগুলোর মুখের কাছে ধরে খাওয়াচ্ছে। বিপিনদাও কথা বন্ধ রেখে একপাত্র বিস্কিটের গুড়ি নিয়ে গরুগুলোর মুখের কাছে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় স্বীয় কর্তব্য বুঝে উঠছিলাম না আমি। কঙ্কাকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি বলোতো? গরুগুলোকে নিয়ে ব্যস্ত কেন সবাই? কন্ঠে একরাশ হতাশা ঢেলে কঙ্কা বললো, আর বলো না! গোমাতা এসেছেন দ্বারে, মাকে তুষ্ট করতে ব্যাস্ত সবাই। জানতে চাইলাম, গরুগুলোর মালিক কে? বললো, মালিক নেই ধর্মের গরু ওগুলো, নিজেরাই চরে বেড়ায়।

ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে বাসায় ফিরছি দুজনে। জানালার কাঁচ দু ইঞ্চি নামিয়ে বেশ খুশি খুশি মুডে চুপচাপ বাইরের দিকে চেয়ে আছে কঙ্কা। খানিক বাদে আমার ডান ঊরুতে বাম হাতখানা রেখে ভীষণ রোম্যান্টিক কন্ঠে বলে উঠলো, আজই প্রথম তুমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে ডিনারে আসছো, ভীষন ভাল লাগছে। কি জানো কতগুলো বছর হয়ে গেল ডিনার টেবিলে কারো জন্য আমি ক্যান্ডেল লাইট জ্বেলে অপেক্ষা করি না! তোমার জন্য অপেক্ষার সময়টুকুতে আমার হৃদকম্পনের প্রতিটি শব্দ আমি উপভোগ করবো। যদিও তুমি মুখে কিছু বলছো না, তবুও বেশ বুঝতে পারছি ভেতরে ভেতরে তুমিও আলোড়িত। তোমাকে ঘরে পাবার আনন্দমাত্রা কেমনে বোঝাই বলোতো! সে যেন পাহাড়ী বৃষ্টির জলে সাঁতার কাটার আনন্দ! চেরী ফুলের বাগানের মৌ মৌ গন্ধে ছুটে বেড়ানোর সুখ, কাঞ্চনজংঘার শিখরে উঠে সূর্যোদয় দেখার আনন্দসম! এত সব কথা সে বাইরের দিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে বলে গেল সে।

আরো কিছুক্ষণ বাদে আমার দিকে ফিরে বললো, এই দেখ এত্তসব বলে তোমার মনটা ভারী করে দিলাম নাকি? ওর চোখে চোখ রেখেই বললাম, না গো কঙ্কা মন ভারী-হালকা’র কথা না। ভাবছিলাম তোমার এই টইটুম্বুর আবেগপ্রবণতা তুষ্ট করার যোগ্য মানুষ তুমি কোথায় খুঁজে পাবে? খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে সে বললো, “খুঁজে পেয়েছি বটে, তবে স্থায়িত্ব বড়ই স্বল্প”। এ পর্যায়ে কঙ্কার আবেগ খানিকটা সংবরণ করানো দরকার মনে হলো। আমার সঙ্গ তাকে শুধুই আনন্দ দিক, কষ্ট নয় কিছুতেই; এই আমার একমাত্র চাওয়া। পরিবেশ হালকা করতে চটুল কন্ঠে বললাম, কঙ্কাজী রাতে আসবার সময় বালিস-কম্বল সাথে আনবো কি? রসিকা কঙ্কার ঠোটে জবাব যেন তৈরীই ছিলো। হেসে গড়িয়ে বললো সে, কিছুই সাথে আনতে হবে না। সজ্জা প্রস্তুত থাকবে, অতিথির সুখনিদ্রার আয়োজনে কোন ত্রুটি হবে না! পরীক্ষা প্রার্থনীয়!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)