অনলাইন ডেস্ক : দেশে নাচের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর যারা ভালো করতেন, তাদের পাঠানো হতো দুবাইয়ে। দুবাইয়ের নাইট ক্লাবে আগন্তুকদের মনোরঞ্জন করাই ছিল বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া তরুণীদের একমাত্র কাজ। ক্লাবে আসা অতিথিরা ড্যান্স করতে বললে তাদের সঙ্গে ড্যান্স করতে হতো, গাইতে বললে গাইতে হতো। একপর্যায়ে যৌন পেশায় বাধ্য করা হতো। প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ মৃদু আপত্তির চেষ্টা করলে হাত-পা কেটে রক্তাক্ত জখম করা হতো। তাই পাচার হওয়া তরুণীরা পুতুলের মতো শুধু হুকুম পালন করতেন। বিনিময়ে থাকা আর খাওয়ার সুযোগ মিললেও কোনো পারিশ্রমিক পেতেন না।

দুবাইয়ে পাচার হওয়া তিন তরুণী সদ্য দেশে ফিরে এভাবেই জানিয়েছেন তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও নির্যাতনের কথা। তাদের কাছ থেকেই সিআইডি জানতে পেরেছে আজম খানের পাচার চক্রের আদ্যপান্ত। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা এই আজম খান হাজার কোটি টাকার মালিক। দুবাইয়ে তিনটি ফোর স্টার এবং একটি থ্রি স্টার মানের হোটেল ও ড্যান্স ক্লাব রয়েছে তার। ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল ফরচুন গ্র্যান্ড ও হোটেল রয়েল ফরচুন ফোর স্টার মানের। আর হোটেল সিটি টাওয়ার থ্রি স্টার মানের। সবগুলোতেই নাইট ক্লাব চলে। সেখানেই নাইট ক্লাবে আসা অতিথিদের মনোরঞ্জনের কাজে লাগানো হতো বাংলাদেশ থেকে নেওয়া তরুণীদের। শুধু নিজের নাইট ক্লাবেই নয়, অন্য নাইট ক্লাবেও পাঠানো হতো এই তরুণীদের। আজম খানের নির্দেশ পালনই ছিল তরুণীদের একমাত্র কাজ।

তরুণীদের যেভাবে নেওয়া হতো দুবাইয়ে

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫০ হাজার টাকা বেতনে ক্লাবে নাচের কথা বলেই তরুণীদের নেওয়া হতো দুবাইয়ে। এর জন্য দেশে ফ্রি প্রশিক্ষণেরও সুযোগ মিলত। এমনকি পাসপোর্ট-ভিসাও ফ্রি। এমন তরুণীকে তারা পছন্দ করত, যার ওপর নির্ভরশীল পুরো পরিবার। চেহারাও একটু ভালো। কিন্তু দুবাইয়ে নেওয়ার পর বেতন দেওয়া হতো না। সূত্র জানায়, দেশ জুড়েই ছড়িয়ে আছে আজম খানের দালাল চক্র। এই দালালেরা তরুণীদের জড়ো করে নিয়ে আসত নাচের প্রশিক্ষক আলামিন হোসেনের কাছে। তিনি তরুণীদের নাচ শেখানোর পর যারা ভালো নাচ করতে পারেন তাদের ভার্চুয়ালি ভিডিও কনফারেন্সে দুবাইয়ে অবস্থান করা আজম খানের মুখোমুখি করা হতো। সরাসরি ভাইবা নিতেন আজম খান। পাশ করলেই দুবাইয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু। পাসপোর্ট করার পর সবাইকে ট্যুরিস্ট ভিসায় নেওয়া হতো। ভিসার মেয়াদ তিন মাস।

মূলত দুবাইয়ে নেওয়ার পর তিন মাস ঘরে বসিয়েই খাওয়ানো হতো। টুকটাক কাজ কাউকে দিত, কাউকে দিত না। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেই আজম খানের আসল রূপ সামনে আসত। এরপর তরুণীদের নেওয়া হতো নাইট ক্লাবে। কেউ যেতে রাজি না হলে তার ওপর চলত বর্বর নির্যাতন। হাত-পা কেটে দেওয়া হতো, ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তরুণীরা রাজি হতেন। তখন তরুণীদের আজম খান নিজেই ধর্ষণ করতেন। পরে পাঠানো হতো নাইট ক্লাবে। সেখানেই মনোরঞ্জন করতে হতো আগন্তুকদের। এ পর্যন্ত আজম খান দুবাইয়ে পাচার করেছেন ১ হাজারেও বেশি নারীকে। দুই-এক জন ফিরে এলেও অধিকাংশই সেখানে আছেন। দুবাইয়ে আজম খানকে সহযোগিতা করেন তার দুই ভাই নাজিম খান ও এরশাদ খান। মূলত হোটেল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের। তারাও সিআইডির মামলায় অভিযুক্ত।

মামলায় নির্যাতনের বর্ণনা

গত ২ জুলাই সিআইডির এএসপি মৃণাল কান্তি সাহা বাদী হয়ে লালবাগ থানায় যে মামলা দায়ের করেছেন, সেখানে আজম খান এবং আরো আট জনকে আসামি করা হয়েছে। ড্যান্সের প্রশিক্ষক আলামিনকে প্রধান করে আজম খানকে করা হয়েছে ৩ নম্বর আসামি। মামলায় তার নাম মো. আজম বলে উল্লেখ রয়েছে। মামলায় দুবাই থেকে ফেরা তিন তরুণীর নাম উল্লেখসহ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বর্ণনাও করা হয়েছে। এই তিন তরুণীর এক জনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, প্রথমে রাজি না হওয়ায় ঐ তরুণীকে আজম খান নিজে ধর্ষণ করেন। পরে অন্য লোক দিয়েও ধর্ষণ করিয়েছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি। দুই তরুণী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামি আজম খান ও আলামিন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, নির্যাতিত যে তরুণীরা দেশে ফিরেছেন, তাদের অনেকেই সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আজম খানের সহযোগী দালালদের ধরার চেষ্টা চলছে। তরুণীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং ঢাকার বাইরে থাকায় তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সিআইডি। তিনি বলেন, দুই জন যে ১৬৪ ধারায় স্বাকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, চার্জশিট দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট।

যেভাবে ফেঁসে গেলেন ধূর্ত আজম খান

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুবাইয়ে প্রতিদিন যৌন ব্যবসায় প্রায় অর্ধকোটি টাকা আয় হতো আজম খানের। সম্প্রতি কয়েক জন তরুণী হোটেল থেকেই বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলে তার পাসপোর্ট বাতিল করে দেয় দুবাই কর্তৃপক্ষ। পরে এক্সিট পাশ নিয়ে দেশে আসেন আজম খান। এর মধ্যে দূতাবাসের সহযোগিতায় তিন তরুণী দেশে ফিরে আসেন। সিআইডির কাছে বর্ণনা করেন নিজেদের ওপর নির্যাতনের আদ্যপান্ত। দেশে এসে আজম খানও নতুন করে পাসপোর্ট তৈরি করে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। তার আগেই সিআইডির হাতে গ্রেফতার হন।