ফরিদ আহমেদ : বয়স বেড়ে গিয়েছে গিয়েছে বলেই কিনা জানি না, এখন গল্প-উপন্যাস পড়তে খুবই কষ্ট হয় আমার। ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারি না। কবিতাতো সেই তরুণ বয়স থেকেই কম পড়ি। এখন আরও পড়া হয় না। প্লেনের মধ্যে নন-ফিকশন চেয়ে ফিকশনই ভালো হবে, হালকা বই পড়তে পড়তে সময়টা দ্রুত চলে যাবে, এই বিবেচনায় শেষ মুহূর্তে ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য লস্ট সিম্বল’ বইটা তুলে নিয়েছিলাম ব্যাগে।

টরন্টো থেকে ক্যালগারি প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার ফ্লাইট। আশা করেছিলাম এর মাঝে বেশি খানিকটা শেষ করে ফেলতে পারবো আমি। বইটা নিয়ে খুলেও বসেছিলাম। কিন্তু, খুব বেশি পড়া হয়নি। ভ্রমণ করার সময় আমার স্ত্রী আন্নার একটা বদ অভ্যাস আছে। ঘুমনোর সময় বালিশ হিসাবে আমার কাঁধকে ব্যবহার করে সে। আবহাওয়ার বৈরিতায় পাঁচটার ফ্লাইট ছেড়েছিলো সাড়ে নয়টায়। এমনিতে ক্লান্ত ছিলো বেচারি। প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝে ফেললো সে। এর আগে অল্প কয় পৃষ্ঠা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। ওর অসুবিধা হবে ভেবে পড়া বন্ধ করে দেই আমি। পড়তে গেলে পাতা উল্টাতে হয়। আর পাতা উল্টাতে গেলে কাঁধও নাড়াতে হয় সামান্য হলেও।

এই কয়েক পৃষ্ঠা পড়াটাই কাল হয়ে গেলো আমার জন্য। শুরু থেকেই এতো রোমাঞ্চকর এবং গতিশীল বইটা যে এর পরের পৃষ্ঠায় কী হচ্ছে, সেটা জানার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করতে থাকে। প্লেনের মধ্যে না পারলেও, গত কয়েকদিনে বইটা শেষ করে ফেলেছি আমি।
বইটার শুরু হয়েছে ম্যাসন নামের একটা গ্রুপের লুকিয়ে রাখা গোপন রহস্য রক্ষা করার পরিস্থিতি দিয়ে। ম্যাসন গ্রুপটা অতি প্রাচীন এবং শক্তিশালী একটা রহস্যময় গ্রুপ। এর সদস্য হিসাবে সমাজের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লোকেরা থেকেছে নানা সময়ে। এরা তাঁদের সেই গোপন রহস্যকে লুকিয়ে রেখেছে ওয়াশিংটন ডিসির কোথাও, এমন কথা নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে। বইয়ের ভিলেন চাইছে অতি প্রাচীন সেই রহস্যকে উদ্ধার করতে। কারণ, রহস্য উদ্ধার করলেই সে অসীম শক্তির অধিকারী হবে। অসংখ্য কোড, প্রতীক, আর ধাঁধার মাঝখানে দিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই রহস্য। রহস্য ভেদ করার জন্য যে যোগ্যতা থাকা দরকার, সেটা ভিলেনের নেই। স্বাভাবিকভাবেই সে অত্যন্ত চতুরতার আশ্রয় নিয়ে দৃশ্যপটে নিয়ে আসে হার্ভার্ডের শিক্ষক সিম্বলোজিস্ট রবার্ট ল্যাংডনকে। এই রহস্যের ধারক যিনি, তিনি রবার্ট ল্যাংডনের বন্ধু। তাঁকে আটকে ফেলে ব্লাকমেইলিং করা হয় রবার্ট ল্যাংডনকে রহস্য উদ্ধারের জন্য। ল্যাংডন একা নয়, রহস্য উদ্ধার এবং রক্ষার জন্য একই সময়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে আরো অনেক মানুষ এবং সংস্থা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিআইএ এর এর ডিরেক্টর স্যাটো।

বইয়ের কাহিনি বলার কোনো ইচ্ছা আমার এখানে নেই। সেটা বলছিও না। এই বই হচ্ছে আঠার মতো লেগে থাকার বই। রিয়েল পেইজ টার্নার বলতে যা বোঝায়, এটা সে ধরনের বই। এর প্লট অসম্ভব গতিময়, একই সাথে রয়েছে অসংখ্য অপ্রত্যাশিত টার্ন এবং টুইস্ট। এগুলোর কারণে এক অধ্যায়ের পরে আরেক অধ্যায়ে না গিয়ে পারা যায় নায়। এর সাথে ড্যান ব্রাউনের যে বৈশিষ্ট্য, প্রচুর পরিমাণে তথ্য ঢেলে দেওয়া হয়, সেটারও কোনো কমতি নেই বইতে।

সব টার্ন এবং টুইস্টই যে অপ্রত্যাশিত এবং অবোধগম্য ছিলো, তা অবশ্য নয়। যেমন, বইতে ড্যান ব্রাউন খুব সুচতুরভাবে চেষ্টা করেছিলেন ভিলেনের পরিচয় গোপন রাখতে। তাঁর ইচ্ছা ছিলো একেবারে শেষে গিয়ে পাঠককে চমকে দেবেন। এই চমক আমাকে দিতে পারেন নাই তিনি। আমি শুরু থেকেই সেটা ধরে ফেলেছিলাম। ড্যান ব্রাউন ঠিক কী কারণে ভিলেনের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছিলেন, সেটাও আমার কাছে বোধগম্য হয়নি। ভিলেনের পরিচয় আগে থেকে জানা থাকলেও বইয়ের স্বাদের কোনো পরিবর্তন হতো না বলেই আমার ধারণা।
আবার, এর বিপরীতে গিয়ে একটা জায়গায় আমি নিজেই চমকে গিয়েছি। বইয়ের এক পর্যায়ে গিয়ে একটা কফিন ধরনের বাক্সের মধ্যে আটকে রাখা হয় রবার্ট ল্যাংডনকে। সেই বাক্সে নল দিয়ে পানি ঢুকিয়ে পূর্ণ করে ফেলা হয়। ভয়ংকর এই ভীতিকর অত্যাচার করে রবার্ট ল্যাংডনের কাছ থেকে রহস্য ভেদ করার চাবিকাঠি নিয়ে যায় ভিলেন। তবে, রহস্য উদ্ধারের চাবিকাঠি নিলেও, রবার্ট ল্যাংডনকে মুক্তি দেয় না সে। পানিতে ডুবে মারা যায় রবার্ট ল্যাংডন। বাক্সের উপরের অংশের কাঁচের ছোট্ট জানালা দিয়ে তাঁর নিথর দেহ ভাসতে দেখা যায়। তাঁকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায় ভিলেন। এই বাক্স অনেক পরে উদ্ধার করা হয়। এই দীর্ঘ সময় বাক্স ভর্তি পানির ভিতরে রবার্ট ল্যাংডনের বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু, উপন্যাসের নায়ক যেহেতু মারা যায় না বেশিরভাগ সময়ে, অন্তত রহস্য উপন্যাসের ক্ষেত্রেতো নয়ই, আমি আশা করছিলাম রবার্ট ল্যাংডনও বেঁচে থাকবে। দেখার আগ্রহ ছিলো ঠিক কোন উপায়ে তাঁকে বাঁচিয়ে দেয় লেখক। যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে ড্যান ব্রাউন তাঁকে বাঁচান, সেটা এতোইটা অপ্রত্যাশিত ছিলো যে আমি নিজেও চমকে গিয়েছি সেই ব্যাখ্যা শুনে।
এতো তীব্র গতিময় একটা উপন্যাসের শেষটা অবশ্য ভালো হয়নি, অন্তত আমার কাছে ভালো লাগেনি। বইটা পাঁচশো নয় পৃষ্ঠার। এর চারশো ষাট পৃষ্ঠা পর্যন্ত এই গতি এবং শিহরণ অব্যাহত রয়েছে। এই পৃষ্ঠায় খলনায়ক মালাকের মৃত্যু হয়। এর পরে বাকি ঊনপঞ্চাশ পৃষ্ঠায় আর কোনো গতি নেই, নেই কোনো রোমাঞ্চ। মনে হয় যেনো প্রাণহীন কোনো প্রবন্ধ পড়া হচ্ছে। বাইবেলের গুণগান দিয়ে এই পৃষ্ঠাগুলো ভরে ফেলেছেন লেখক। বইতে এই পৃষ্ঠাগুলো বাহুল্য হয়ে এসেছে। না আছে এর কোনো আবেদন, না আছে কোনো প্রয়োজন। আমি জোর করে পড়ে গিয়েছি শেষে কোনো অপ্রত্যাশিত বাঁক আছে কিনা সেটা ভেবে। এই পড়াটাই আমার জন্য সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। এইটুকু বাদ দিলে অসম্ভব সুখপাঠ্য এবং শিহরণ জাগানো বই এটা।