খুরশীদ শাম্মী : ওয়ার্ডওমিটারের তথ্য অনুসারে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৪,১৬,৪২৭ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৮১,৩২৫ জন। সুস্থ হয়েছেন ৩,০১,৩৯৮ জন। এখনও অসুস্থ হয়ে বাড়ি ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১০,৩৩,৭০৪ জন রোগী, যাদের ৯,৮৫,৭৭৯ জন রোগী মোটামুটি অবস্থায় এবং ৪৭,৯২৫ জন খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছেন। যতগুলো কেস সম্পূর্ণ হয়েছে তার মধ্যে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হার ২১.২৪৯% এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার হার ৭৮.৭৫০%।

এবার দেখি আমার দেশ কানাডার অবস্থা। প্রথমেই বলে নেই, কানাডায় বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় কম সংখ্যক লোক করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আজ পর্যন্ত মোট ১৭,৮৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ৩৭৫ জন মারা গেছেন এবং ৩,৯৩৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এখনও বাড়ি ও হাসপাতালে আছেন ১৩, ৫৩৭ জন রোগী, যার ১৩, ১১১ জন মোটামুটি অবস্থায় আছেন এবং ৪২৬ জন খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছেন। কানাডায় মৃত্যুর হার ৯%।

সিবিসি নিউজের কানাডার অভ্যন্তরীণ প্রদেশগুলোর করোনা আক্রান্ত রোগীর উপর ভিত্তি করে তৈরি গ্রাফ।

মার্চ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কানাডার করোনাভাইরাস আপডেট অনুসরণ করলে দেখা যাচ্ছে, বৃটিশ কলোম্বিয়া প্রদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কুইবেক ও অন্টারিও প্রদেশের থেকে কম। অথচ আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রথমদিকে বৃটিশ কলোম্বিয়া নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করেছিলাম। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম থাকার প্রকৃত কারণ এখনও জানি না। জানি, সেখানে অনেক চাইনিজ কানাডিয়ান বসবাস করে।

ইতালির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ইতালির কয়েকটি শহরের মধ্যে প্রাতো শহরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য শহর থেকে বেশি। প্রথম আলো’র খবর পড়ে জানলাম, সেখানে অনেক চীনের নাগরিক বসবাস করে। অথচ চীনা নাগরিকরা কেউ আক্রান্ত হয়নি। ধরে নিলাম, চাইনিজ নাগরিকরা তুলনামূলকভাবে খুব কম আক্রান্ত হয়েছে। আমার ছোট দেবর টিটু থাকে ইতালি। সেও একই মন্তব্য করলো চাইনিজদের ব্যাপারে, চাইনিজ নাগরিকেরা ভালো আছে। তারা করোনা দ্বারা আক্রান্ত হয়নি।

এবার আসি চায়নায়। একই অবস্থা। দাপ্তরিকভাবে তারা করোনাভাইরাসের উপস্থিতির কথা প্রকাশ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। তাদের খবর দেখে রীতিমত আতঙ্কিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই চায়না কতটা শক্তভাবে মোকাবিলা করেছে মহামারী, এখন তারা দৈনন্দিন কাজে ফিরে যাচ্ছে।

আমি বলছি না, আমার যুক্তি কিংবা ধারণাই সত্যি। তবে, এ থেকে ধারণা করছি, চীনের নাগরিকগণ সচেতন এবং তারা নিজেদের সুস্থ রাখার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র বিভিন্ন পরীক্ষামূলক বার্তা অনুসরণের পাশাপাশি তাদের নিজেদের সাধারণ জ্ঞানও কাজে লাগাচ্ছেন। নিজেদের সতর্ক রাখতে অন্ধের মতো কেবল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র পরীক্ষামূলক বার্তা চিবিয়ে খাচ্ছেন না। হ্যাঁ, তারা শুরু থেকে ঘরে ও বাইরে মাস্ক ব্যবহার করছেন, ঘরে থেকেছেন, নিজেদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এমনিতেও তারা প্রাকৃতিক উপকরণ থেকে বিভিন্ন উপায়ে দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে সদা তৎপর। হয়তো তারা এক্ষেত্রে আরো বেশি সক্রিয় হয়েছেন।

আমাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন পোস্ট দিচ্ছেন লেবু, ভিটামিন সি, গরম পানি, চা, হলুদ, মধু, কালিজিরা, ইত্যাদি খাওয়ার জন্য। যারা দিচ্ছেন, তারাও জানেন যে ওগুলো করোনাভাইরাস রোগ থেকে রগীকে সুস্থ করবে না, তবে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। আমি তাদের প্রতি বিরক্ত হচ্ছি না, কেননা সুস্থ থাকার জন্য দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই এবং তারা এমন বিশ্বব্যাপী মহামহামারীর মাঝে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ওখানে যত্ন, ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া যায়। সবাই বেঁচে থাকতে চায়। সবাই বেঁচে থাকার উপায় খুঁজছেন। আমি বিশ্বাস করি, যতদিন জীবন থাকে ততদিন স্বপ্ন থাকে, থাকে দায়ও। হয়তো সেরকম মনোভাব নিয়েই তারা বিভিন্ন পোস্ট দিচ্ছেন।

“বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত” সূত্র ধরে আমাদের আরেকদল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র বিভিন্ন বার্তাকে ভিত বানিয়ে আরো একটু কঠিন করে নানান পরামর্শ, উপদেশ, আদেশ দিচ্ছি রাতদিন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কারো বিরুদ্ধে লড়াই করছি না। কেননা, সবার চিন্তাভাবনা ও ভাবের প্রকাশ এক নয়। তবে ভয় হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী মহামারীর তৃতীয় পর্যায়ে কেউ আমাদের সেই পরামর্শ গ্রহণ করে আবার না ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আমি এভাবে ভাবি, যেখানে বড় বড় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনও ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে নির্দিষ্ট কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি, সেখানে পরীক্ষামূলক প্রচারপত্রের তথ্যের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞান ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝে কৌশল ব্যবহার করাও জরুরি। কেননা, সেক্ষেত্রে একজন হলেও অধিকসংখ্যক মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে, এমন কি অধিক মানুষ বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আমি এও বুঝি, একটু জোরালো বাক্য ব্যবহার করলে অনেকের কাছে তা আতঙ্ক মনে হয়। ওটা তাদের অপরাধ নয়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কোটি কোটি মনের অবস্থা, মানুষের বোধ-বুদ্ধি, চিন্তাভাবনা, গ্রহণ ক্ষমতাও ভিন্ন। খুব সাধারণ উপায়ে একটা বার্তা সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশ। সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী মহামারীর তৃতীয় পর্যায়ে এসে সতর্কবাণী সচেতনতা তৈরি করার পাশাপাশি সামান্য একটু ভীতিকর যদি হয়ও – হোক, তবুও তা মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে। কখনোই আতঙ্ক সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য নয়। আমরা যেন ভুলে না যাই, এই মানুষ তো আমরাই, আমাদেরই আপনজন। আজ একজন খানিক ভয় পেয়ে ঘরে থেকে যদি নিজে বাঁচে এবং অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করে, তা মানব জাতির জন্য কল্যাণকর। আমার সাথে অভিমান করেও যদি মানুষ বেঁচে থাকে, থাকুক। আমি মনে প্রাণে চাই, করোনায় আর একজন মানুষও যেন প্রাণ না হারায়। সেজন্য আমরা সকলে যেন পরিষ্কার মাস্ক- মাস্ক না থাকলে স্কার্ফ ব্যবহার করি, ঘরে থাকি, সামাজিক ও শারীরিক নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি, যেন যেখানে সেখানে ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লোবস, টিস্যু, থুথু-সর্দি-কাশি না ফেলি। ঘনঘন সাবান পানিতে হাত ধুই এবং বাইরে থেকে এসে কাপড়, জুতা, ফোন, চাবি সবকিছু পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করি। সবশেষে, নিজে সুস্থ থাকার চেষ্টা করি এবং অন্যকেও সুস্থ থাকার পরিবেশ করে দেই।
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও