Home কলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে পাকিস্তানের গণহত্যার অভিযোগ

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে পাকিস্তানের গণহত্যার অভিযোগ

সোনা কান্তি বড়ুয়া : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আনেন। একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচার চেয়েছে বাংলাদেশের মানুষ! বাংলাদেশের মানুষের অভিযোগ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হলো না কেন? ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে। বাঙালি জাতির হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানের ধর্মান্ধ ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ সেনাবাহিনীর সাথে এই দলের সদস্যরা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকজনকে জোড়পূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হলো।

ধর্মব্যবসায়ীদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘বাংলার ইতিহাস- এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে হিন্দু বৌদ্ধ রাষ্ঠ্রদ্বয় (ভারত ও ভুটান) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে! গোটা দেশ সেই সমস্ত বীর, সাহসীদের আত্মত্যাগের প্রতি সবসময় ঋণী থাকবে এবং “দুঃখের তপস্যা আজ ও হয়নি সমাপন।” পাকিস্তানী রাজনীতির মাফিয়া চক্রে ধর্মের মস্তক বিক্রয়। জয় সত্য ও মানবতার জয়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে পাকিস্তানের গণহত্যার অভিযোগ ও বিচার প্রসঙ্গ! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে ঘোষণা করেন: “কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।

বাংলার ইতিহাস- এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো।”

জয় বাংলার ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোকের বিশাল জমায়েতে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে যুগ সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। পাকিস্তানের ধর্মান্ধ রাজনীতির আক্রমণের শিকার বাংলাদেশ কেন? পাকিস্তানের গণহত্যার বিচার প্রসঙ্গ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ব্যর্থ সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আনেন। বক্তৃতার শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন: ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।

তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবিলা করতে হবে… মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে অভিযোগ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হলো না কেন? ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ঠ পাকিস্তান কি ভাবে বাংলাদেশ কে অন্তর্ভুক্তু করলেন? সালে ১৯৭১ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে।

১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যকান্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে এবং এসব অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতাকর্মীকে মৃত্যুদন্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে! ২৫ মার্চ রাতে সংঘটিত অপারেশন সার্চলাইট এর ছয় দিন পর গোলাম আযম ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি ভারতের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।… আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের নিকট হতে কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।”

১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল, শুক্রবার, জুমার নামাজের পর পাঞ্জাবি-টুপি পরে শান্তি কমিটির ব্যানারে পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে রাজপথে মিছিল বের করেছিল এই উগ্রবাদী ধর্মব্যবসায়ীরা। ধর্মীয় আবেগ ব্যবহারের নিখুঁত পরিকল্পনায় অংশ হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিল মুসলিমদের ধর্মীয় ছুটির দিন শুক্রবারকে। মিছিল শুরুর স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছিল বৃহত্তর মসজিত বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটকে। সময়টাও ছিল ঠিক নামাজের পর। এরপর ইসলাম রক্ষার ছদ্মবেশে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিতে চেয়েছিল এই স্বাধীনতাবিরোধীরা। ধর্মব্যবসা থামেনি। এরা এখনও ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ষড়যন্ত্রের দুর্ভেদ্য প্রাচীর বিদীর্ণ করে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীনতা দিবস! নয়া দিন নয়া রাতের দিন বদলের যুগে সুবর্ণজয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে রবিবার (5 th Dec. 2021) দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে আয়োজিত অনুষ্ঠান ছিল তারই প্রতিফলন। একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচার চেয়েছে স¤প্রতি ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে।
তাই দেশের জন গণ মনের প্রতিবাদী কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়
কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল, করবে লোপাট রক্ত জমাট
শিকল পূজোর পাষানদেবী।
ওরে ও তরুন ঈশান,
বাজা তোর প্রলয় বিষান
ধ্বংস নিশান,
উড়ুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি।”

১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট ইসলাম ধর্মের নাম দিয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করলেন! ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে পাকিস্তান ইসলামের নাম দিয়ে বাংলাদেশে “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে বাংলাদেশে পাকিস্তান রাজনীতির হত্যাযজ্ঞ ইসলাম ধর্মকে তলোয়ার বানিয়ে অপব্যবহার করে ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী মানুষ হত্যা, ২ লক্ষ মা-বোনকে ধর্ষণ এবং বুদ্বিজীবি হত্যা করেছিল! এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতদিন এভাবে চলবে? মানব জাতির মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়াটাই পাকিস্তানের ধর্মান্ধ রাজনীতি! পাকিস্তানের ধর্মান্ধ অন্যায় ন্যায় হল, সত্য হল অসত্য, অসত্য হল সত্য, অধর্ম যুদ্ধ হল ধর্ম যুদ্ধ! বাংলাদেশের স্বাধীনতার কাছে পরাজিত পাকিস্তানের ধর্মান্ধ রাজনীতি! বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যার বিচার প্রসঙ্গ! স্বাধীনতা দিবসে অভিযোগ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হলো না কেন?

রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। “এবারেরর সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ :
ভায়েরা আমার,
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন’ দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।
আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস- এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন- আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো।
আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রæয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন- জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য সি’র প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
কি পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রæর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।

ভায়েরা আমার, ৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।
এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত- করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।

আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত- অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা,,ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।

২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু – আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাঁদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো।

যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই ৭ দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছাইয়া দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয় , খাজনা – ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। শুনেন, মনে রাখবেন, শত্রæ বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্বকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও -টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাঁদের মাইনা পত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।
টেলিফোন-টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেস্টা করা হয়- বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুল। এবং তোমাদের যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
মনে রাখবা, “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’”। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
“জয় বাংলা।”

মুক্তিযুদ্ধের মহান ইতিহাসকে এই প্রজন্মের কাছে তাদের মতো করে ফুটিয়ে তুলতে ‘আপনার শিশুকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে উৎসাহিত করুন। আগামীর চোখে বাংলাদেশ’। আমার চোখে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের বিজয় হয়!
লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), বিবিধ গ্রন্থ প্রণেতা, কলামিষ্ট এবং মানবাধিকার কর্মী। সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!

Exit mobile version