Home কলাম বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও সংগীত (পর্ব-২)

বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও সংগীত (পর্ব-২)

ভজন সরকার : রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা ও গান বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয় ছিল। বিশেষ করে গীতাঞ্জলির অনেক কবিতাই বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ছিল। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য থেকে “বিপদে মোরে রক্ষা করো” কবিতাটি বঙ্গবন্ধু প্রায়ই উদ্ধৃতি দিতেন।

স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ডাক থেকে বিজয় দিবস সবখানে যাঁর নামে যুদ্ধ হয়েছিল, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সশরীরে যুদ্ধের ময়দানে না থাকলেও তাঁর নেতৃত্বে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। সেই বঙ্গবন্ধু মুজিব ভালোবেসেছিলেন বাংলার মানুষ, প্রকৃতি-খাল-বিল-নদী নালা। আর তার উপকরণ পেয়েছিলেন রবীন্দ্র-নজরুলসহ বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের কাছ থেকে। বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলার মানুষেরও রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের সাহিত্যের প্রভাব বেশ স্পষ্ট। তাই তো যুদ্ধের ময়দানেও মুক্তিযোদ্ধারা গান শুনতেন-কবিতা পড়তেন। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা যেমন অনুপ্রাণিত করতো, ঠিক তেমন করে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশের গানও একই রকমভাবে প্রাণিত করতো মুক্তিযোদ্ধাদের।
লাহোরের জেলে বসে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগহীন এবং বিচ্ছিন্ন থেকেও বঙ্গবন্ধু জানতেন এ সব। কারণ তিনি বাঙালিকে চিনতেন। তাই তো স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণের প্রথম লাইনেই রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাষণে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন-

“বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালী যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে।”

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন থেকে দিল্লীতে যাত্রাবিরতি করে ঢাকা ফিরেন সেদিনই। প্রাথমিকভাবে কথা ছিল দিল্লী থেকে ঢাকা আসার পথে কলকাতায় আরেকবার যাত্রা বিরতি করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাবেন বঙ্গবন্ধু। কলকাতার দমদম বিমান বন্দরসহ অন্যান্য প্রটোকলও প্রস্তত রাখাই ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আকাশপথ থেকেই বার্তা দিলেন, তিনি ঢাকাতেই ফিরবেন। ফলে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ এ পশ্চিমবঙ্গে আর নামা হয়নি তাঁর।

কিন্তু দেশে ফিরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়ভার গ্রহণ করার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বিদেশ সফর করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৭২ সালের ফেব্রæয়ারি ৬ তারিখ থেকে শুরু করা ৩ দিনের সফরে বঙ্গবন্ধু ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। লোক সমাগমের দিক থেকে সে জনসমুদ্রের আয়তনের রেকর্ড আজ পর্যন্ত অক্ষুন্ন আছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গরদের শাড়ি পড়ে তাঁর ভাষণের অনেকখানিই বাংলায় করেছিলেন সেদিন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শুরু করেছিলেন এই বলে ‘…আপনাদের এই দান পরিশোধের সাধ্য আমাদের নেই। কবিগুরুর ভাষায় বলতে পারি,
“নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি
দেবার কিছু নাই,
আছে শুধু ভালোবাসা,
দিলাম আমি তাই।”
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শত্রæ সাম্রাজ্যবাদীদের লক্ষ করে কবিগুরুর কবিতার লাইনে উচ্চারণ করে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন,
“নাগিণীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শান্তির ললিতবাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।
যাবার বেলায় তাই ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।’
কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের প্রান্তিক কাব্যগ্রন্থ থেকে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

আকাশবাণী ও দূরদর্শণ থেকে বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরার জনসভার ধারাবিবরণীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মহালয়া- পাঠখ্যাত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পঙ্কজ সাহা এই তিনজনকে। কবি, ধারাভাষ্যকার ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ সাহা এক সাক্ষাৎকারের সেদিনের সে জনসভার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে যে,
“শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃতি দিলেন। তারপর জনতার সে বিশাল স্রোতের মধ্যে থেকে একটু পরপর আরো কবিতা পড়ার অনুরোধ করা হচ্ছিল শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব জনতার সে অনুরোধে একের পর এক রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে কিছু কিছু অংশ পাঠ করে শোনাতে লাগলেন। আমরা সবাই আশ্চর্য হয়ে শেখ মুজিবের রবীন্দ্র কবিতাপ্রীতি দেখে বিস্মিত হচ্ছিলাম। কলকাতা ব্রিগেড প্যারাড গ্রাউন্ডের সে ঐতিহাসিক জনসভা নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে কিন্তু রবীন্দ্রভক্ত শেখ মুজিবের কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি”।

একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতো করেই বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে চিনেছিলেন। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানে এসে কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় বঙ্গবন্ধু ভীষণ বিরক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,
“পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’।” (পৃষ্ঠা নম্বর ৪৭ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।)

জানি না, বঙ্গবন্ধু নিজের রক্ত দিয়ে বিশ্বাসঘাতক এবং পরশ্রীকাতর বাঙালি জাতির আত্মসম্মানবোধকে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন কিনা? কিন্তু এটা তো সত্যি যে দেশে-প্রবাসে যে যেখানেই থাকি, বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে আমাদের যে বুক ফুলানো গর্ববোধ তার নেপথ্যের নায়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী । হ্যামিল্টন, কানাডা)

Exit mobile version