কানাডা’র টরন্টো বাংলা বইমেলার আয়োজক ‘অন্যমেলা’ গত ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর ৭ দিনব্যাপী বাংলাদেশের ৪৯তম মহান বিজয় দিবসের উৎসব ’স্মৃতি-শিখা অর্ণিবান’ আয়োজন করে। ডেনফোর্থের অন্যমেলা প্রাঙ্গনে ৬ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, গান, কবিতা, চারুকলা, সাহিত্য ও নাটকসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তাগণ আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন। ১০ ডিসেম্বর প্রথমদিন জাতীয় সংগীত ও শহীদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিরবতা পালন করে আহŸায়ক সাদী আহমদের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান শুরু করেন মূখ্য আলোচক একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কবি আসাদ চৌধুরী।

প্রথম দিনের নির্ধারিত আলোচক শহীদ খন্দাকার টুকু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘২৫ মার্চ রাতের ভয়াল চিত্র ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’র প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা করেন এবং কানাডা আওয়ামী লীগ’র প্রাক্তন সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সালাম শরীফ ‘কোলকাতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার’ বিষয়ে আলোচনা করেন । আবৃত্তিতে ছিলেন খ্যাতিমান নৃত্য ও আবৃত্তি শিল্পী অরুণা হায়দার ও গান এ বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নার্গিস চৌধুরী।

১১ ডিসেম্বর ২য় দিনের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা নূর মোহাম্মদ কাজী ও ঢাকা চারুকলার চারনশিল্পী তাজ উদ্দিন আহমেদ। তাঁরা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করেন ‘৬৯’র গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের ভ‚মিকা’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধে চারুকলা’র ছাত্র’।

১২ ডিসেম্বর ৩য় দিন আলোচনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামীমা নাসরীন শাহেদ, তিনি ‘২৫ মার্চ কালরাত্রি ও গণহত্যা’র প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দেন। তিনি তাঁর বর্ণনায় বলেন হত্যাকান্ড চলাকালীন সময়ে ঘাতকদল আকাশে হেলিকপ্টার নিয়ে চক্কর দিয়ে ক্যাম্পাসের ছাদেও তলাশী চালায়। মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আশরাফ আলী স্পর্শকাতর স্মৃতিচারণ করেন ‘শরণার্থী শিবিরের দিনগুলি’। আবৃত্তিতে অংশ নেন কবি মৌ মধুবন্তীও বাচিক শিল্পী শিল্পী হোসনে আরা জেমি। পরে কানাডা সফররত ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ওমর ফারুক অতিথি বক্তা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্কুল পর্যায়ে বর্তমান বিশেষ প্রকল্পের উপর আলোকপাত করেন।

১৩ ডিসেম্বর ৪র্থ দিন সেলিনা সিদ্দিকী শুশু ‘মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল’, এ পর্যয়ে তিনি কাদেরিয়া বাহিনীর কর্মযজ্ঞের অনেক অজানা তথ্য তুলে আনেন। অন্যদিকে চারনশিল্পী লায়লা শারমীন ‘মুক্তিযুদ্ধের চারুকলা’ বিষয়ে আলোচনা করেন। এদিন দেশাত্বক গান করেন শিশু শিল্পী উলফাৎ মুরতাজা।

১৪ ডিসেম্বর ৫ম দিন ছিলো ‘শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস’, সেদিনের আলোচনায় ছিলেন ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও জাতিসংঘের প্রতিনিধি ড. জহির সাদেক। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যা ও বর্তমান সময়ে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের অবমাননার উপর আলোকপাত করেন। এর পরপরই সংস্কৃতিসেবী ও লেখক জামানা হাসিনা ‘মুক্তিযুদ্ধে কবি ও কবিতা’ বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তারপরে মুক্তিযুদ্ধের গানে ও কবিতায় ছিলেন স্থানীয় বিশিষ্ট শিল্পী সুমন মালিক ও মার্জিয়া মৌ। ১৫ ডিসেম্বর ৬ষ্ঠ দিনের আলোচনায় অংশ নেন লেখক-সাংবাদিক জসিম মল্লিক, তাঁর বিষয় ছিল ‘সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ’। এরপর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নার্গিস চৌধুরী উপস্থাপন করেন খুলনার ’চুক নগর গণহত্যা’র বর্ণনা’ যা প্রাথম পর্যায়ে বাংলাদেশের গণহত্যার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি।
ঐদিনের শেষ আলোচনায় কবি মেহরাব রহমান আলোচনা করেন ’কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’। পরিশেষে দেশাত্ববোধক ও স্বাধীন বাংলা বেতারের গান করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী চিত্রা সরকার ও এ প্রজন্মের শিল্পী আসিফ চৌধুরী। জ্যাকলিন রোজারিও, উর্মি রহমান ও নুসরাত জাহান চৌধুরী আবৃত্তিতে অংশ নেন।

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আরও বড় পরিসরে স্থানীয় মিজান কমপেক্স বিজয়ের শুভেচ্ছা ও সংশিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন অনুষ্ঠানের আহŸায়ক, সম্পাদক ও উপস্থাপক সাদী আহমেদ, শহীদ খন্দকার টুকু’র গান ও কবি মেহরাব রহমানের ছড়া কবিতা ‘স্বাধীনতার কড়চা’ দিয়ে। যথারীতি প্রতিদিনের মুখ্য আলোচক বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরী তাঁর শেষ বক্তব্যে ’অন্যমেলা’র ভ‚য়সী প্রশংসা করে বলেন- ‘দেশের বাইরে এত বিষয়ে তথ্য ভিত্তিক দীর্ঘ আলোচনা আমার ধারণার অতীত ছিল, অনেক নতুন অজানা তথ্য ও জ্ঞান আহরণ করেছি এবং এ থেকে অভিবাসী বাংলাদেশীগণও উপকৃত হয়েছে’।
সর্বশেষে অনুষ্ঠানের নির্ধারিত বিষয় ‘মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মঞ্চ নাটক’ নিয়ে আলোচনা ও বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভের সৌজন্যে তথ্যচিত্র পরিবেশনা করেন পদাতিক নাট্যসংসদ-বাংলাদেশ’র দলনেতা ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কেন্দ্রিয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিম শামসুল হুদা চৌধুরী। শেষে বড় পর্দায় প্রদর্শিত হয় পদাতিক নাট্যসংসদ-বাংলাদেশ’র ৩১তম প্রযোজনা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মঞ্চনাটক “পোড়ামাটি”। নাটকটি রচনা করেছেন ড.বাবুল বিশ্বাস ও নির্দেশনা দিয়েছেন ড. আইরীন পারভীন লোপা। অনুষ্ঠানটি প্রতিদিন অন্যমেলা ফেইসবুক পেইজ এ (anyamela Facebook page) লাইভ ছিল। স্থানীয় বাংলাদেশী মালিকানাধীন পিঠাঘর’র সৌজন্যে বিজয়ের এ দিনে দর্শকশ্রোতাদের মিস্টিমুখ করানো হয়।
অনুষ্ঠানটির সার্বিক পরিকল্পনা ও শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন সেলিম শামসুল হুদা চৌধুরী।