Home কলাম বাংলা নববর্ষ ১৪২৭- বয়ে আনুক এক আলোকিত ভোর

বাংলা নববর্ষ ১৪২৭- বয়ে আনুক এক আলোকিত ভোর

খুরশীদ শাম্মী : যতগুলো উৎসব আমি পালন করি, তারমধ্যে বাংলা নববর্ষ আমার সব থেকে প্রিয়। বাংলা নব্বর্ষ আমার প্রাণের উৎসব,আমার শেকড়ের উৎসব, আমার অস্তিত্বের উৎসব। এই উৎসবে আমি খুঁজে পাই আমার নিজের অস্তিত্ব। সেই শৈশবে পিরোজপুর শহরের বলাইয়ের দোকানের রসগোল্লা, খোলা মাঠে ছোট্ট মেলায় ঘুরে ঘুরে মাটির হাতি-ঘোড়া-বাঁশি, বাতাসা, মোয়া কেনা দিয়ে ১লা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হলেও প্রবাসী জীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও এইদিনটি আমি উপভোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি; মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করি, মেলায় যাই, অনুষ্ঠানগুলোতে যাই, নিজে বাংলা সাজে সাজি। শুধু আমি না, বয়স, ধর্ম, গোত্র, লিঙ্গ ভেদে আমার চারপাশের সকল বাঙালিকেই দেখি এইদিন থাকেন উৎসবমুখর। বিভুঁইয়ে বাংলা কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে যে আমাদের একটা যোগসূত্র আছে এইদিন খুব অনুভব হয়।

এর ব্যতিক্রম হচ্ছে এ বছর। বাংলা ১৪২৭ সালের শুরু, ইংরেজি ২০২০ সালের এপ্রিল মাস। কোভিড ১৯-করোনা ভাইরাসের কবলে আমরা গৃহবন্দী প্রায় এক মাস। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ভুলেই যাচ্ছি, বন্ধুদের রঙিন চুল, গালের তিল, ঠোঁটের কোণের টোল, কাজল আঁকা আঁখি, চোখের ভাষা, ইত্যাদি। ভালোবেসে গালটাও দেয়া হয় না প্রিয় বন্ধুকে অনেকদিন। দুই মিটার বা ছয় ফুটের বাক্স জীবন ধার্য করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবুও কি বাঙালীরা চুপ করে ঘরে বসে থাকবে নববর্ষের দিন?

না। তা হতেই পারে না। তবে, এ বছর সমস্ত বিশ্বের বাঙালীরা বাংলা নব্বর্ষ উদ্‌যাপন করবে কেবল প্রযুক্তির মাধ্যমে, ঘরে বসে সবাইকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে। খুব কাছের মানুষদের ফোন করে দু’মিনিট কথা বলে। ফেসবুকে ইতোমধ্যে দেখছি নব্বর্ষের শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে গেছে, নিউজফিডে ভেসে বেড়াচ্ছে শুভ নববর্ষ লেখা কার্ড, সাথে যোগ হয়েছে নববর্ষ লেখা মাস্ক। কিন্তু অপূর্ণ থেকে যাবে পরাণের গহীনে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেগুলো। হবে না আলিঙ্গন, চুমু খাওয়া, হবে না নিজের হাতে বাংলা রান্না প্রিয় মানুষদের খাইয়ে আনন্দ ভাগ করে নেয়া, হবে না সাদা-লাল-রঙিন পোশাকে সেজে শোভাযাত্রায় যাওয়া। হবে না ঢোলের বাজনা আর বাউল গানের সুরে একত্রে দলবেঁধে নেচে নেচে পিছনের বছরের কষ্টগুলো মুছে ফেলা।

তবে, ফেসবুকের লাইভে এসে গান, কবিতা শুনিয়ে যাবেন আমাদের প্রিয় শিল্পীবৃন্দ, নাচের ভিডিও হয়তো আপলোড করবেন নৃত্যশিল্পীরা। টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো দেখাবে রেকর্ড করা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নাটক, সিনেমা। নতুন কবিতা, গল্প পোস্ট করবেন কবি-লেখকগণ, টকশোতে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্টজনেরা।

এভাবে বৈশাখ উদ্‌যাপনে আমাদের অনেকেরই প্রাণ শান্তি পাবে না, শতভাগ তৃপ্ত হবে না মন। তবুও, প্রকৃতি মায়ের চলার পথে এটাই এখন বাস্তবতা। টুপটাপ হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন। আপনজন হারিয়ে বিশ্ব জুড়ে শোকে পাথর হয়ে আছে লক্ষাধিক পরিবার। তাদের কথা একবার স্মরণ করলে, আমাদের অতৃপ্ত মন উদ্ধত হবে না জানি, বরং নত হবে শির। আমরা প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির এমন আচরণ খুব একটা দীর্ঘায়িত হবে না। আম্রকাননে মুকুল এসেছে, বিলের শাপলাগুলো বৈশাখী ঝড়ের অপেক্ষায়, জল ও বাতাস পেলেই হেলেদুলে কেমন নাচিয়ে তুলবে প্রকৃতিকে। কেটে যাবে আঁধার, সূর্যোদয়ে শুরু হবে নতুন ভোর। প্রণত হৃদয়ে আমি সেই ভোরের অপেক্ষায়, বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ বিশ্ব জুড়ে বয়ে আনুক এক নতুন আলোকিত ভোর। থেমে থাকা জীবন থেকে আমরা মুক্ত হই, শুরু করি চলমান জীবন। সবাইকে বাংলা নব্বর্ষের শুভেচ্ছা ও আমার আন্তরিক শুভ কামনা।
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও

Exit mobile version