ফরিদ আহমদ
গল্পকার এবং ঔপন্যাসিকদের কল্পনাশক্তি প্রখর থাকে। সে কারণে কল্পনা করে অনেক ঘটনা তারা লেখেন। সেগুলোকে আমরা গল্প, কিংবা উপন্যাস হিসাবে পড়ি। তবে, সব সময় যে তাঁরা কল্পনা থেকে লেখেন এমন নয়। নিজের জীবনের ঘটা কিংবা অন্যের কাছ থেকে শোনা ঘটনাকেও তারা একই রকমভাবে বা কিছুটা ভিন্ন আকার দিয়ে গল্প উপন্যাসে ঢুকিয়ে দেন। বুদ্ধদেব বসুর ‘অন্য কোনখানে’ বইটা পড়লে যেমন মনে হয় উপন্যাস নয়, লেখকের ছেলেবেলার ঘটনাই যেনো পড়ছি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও একই কাজ করেছেন। তাঁর শ্রীকান্ত উপন্যাসতো একেবারেই তাঁর আত্মজীবনী। তবে, আজ শ্রীকান্ত উপন্যাস নয়, তাঁর অন্য একটা গল্পে বাস্তব ঘটনাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা নিয়েই বরং কথা বলি। এটা একটা বিখ্যাত ছোট গল্প। নাম ‘বিলাসী’। অনেকেই এই ছোটগল্পটি পড়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের সময়ে ইন্টারমিডিয়েটে এটা পাঠ্য তালিকায় ছিলো।
বিলাসী গল্পে তিনি যে কাহিনিটি বলেছেন, সেটার কথা আগে উল্লেখ করি। তাঁর ভাষাতেই,
“এক আত্মীয়ের মৃত্যুকালে আমি উপস্থিত ছিলাম। ঘরের মধ্যে শুধু তার সন্ত-বিধবা স্ত্রী, আর আমি । তার স্ত্রী তো শোকের আবেগে দাপ-দাপি করিয়া এমন কাণ্ড করিয়া তুলিলেন যে, ভয় হইল তাহারও প্রাণটা বুঝি বাহির হইয়া যায় বা। কাঁদিয়া কাঁদিয়া বার বার আমাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় যখন সহমরণে যাইতে চাহিতেছেন, তখন সরকারের কি? তায় যে আর তিলান্ধ বাঁচিতে সাধ নাই, এ কি তাহারা বুঝিবে না? তাহাদের ঘরে কি স্ত্রী নাই? তাহারা কি পাষাণ? আর এই রাত্রেই গ্রামের পাঁচজনে যদি নদীর তীরের কোন একটা জঙ্গলের মধ্যে তার সহমরণের যোগাড় করিয়া দেয় তো পুলিশের লোক জানিবে কি করিয়া? এমন কত কি! কিন্তু আমার ত আর বসিয়া বসিয়া র্তার কারা শুনিলেই চলে না। পাড়ায় খবর দেওয়া চাইÑ অনেক জিনিস যোগাড় করা চাই। কিন্তু আমার বাহিরে যাইবার প্রস্তাব শুনিয়াই তিনি প্রকৃতিস্থ হইয়া উঠিলেন। চোখ মুছিয়া বলিলেন, ভাই, যা হবার সে ত হয়েছে, আর বাইরে গিয়ে কি হবে? রাতটা কাটুক না। বলিলাম, অনেক কাজ, না গেলেই যে নয়। তিনি বলিলেন, হোক কাজ, তুমি বস। বলিলাম, বসলে চলবে না, একবার খবর দিতেই হবে, বলিয়া পা বাড়াইবা মাত্রই তিনি চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ওরে বাপ রে! আমি একলা থাকতে পারব না। কাজেই আবার বসিয়া পড়িতে হইল। কারণ তখন বুঝিলাম, যে-স্বামী জ্যান্ত থাকিতে তিনি নির্ভয়ে পঁচিশ বৎসর একাকী ঘর করিয়াছিলেন, তার মৃত্যুটা যদি বা সহে, তার মৃতদেহটা এই অন্ধকার রাত্রে পাঁচ মিনিটের জন্যও সহিবে না।”
শরৎচন্দ্র এই গল্পটি নিয়েছেন তাঁর এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা থেকে। তখন তিনি রেঙ্গুনে এক মেসে থাকেন। মেসের পাশেই তাঁর এক বিবাহিত বন্ধু থাকে। বন্ধুটির স্ত্রী ছিলো খুবই রূপবতী নারী। ফলে, বন্ধুটি শুধুমাত্র অফিস করা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা বাড়িতেই কাটাতো। সুখের জীবন তাদের। কিন্তু, এই সুখ বেশিদিন সইলো না। বন্ধুর স্ত্রীটি কঠিন অসুখ বাঁধিয়ে বসলো।
অসুখ আর সারে না, দিন দিন তা বাড়তে লাগলো। বন্ধুটি স্ত্রীর সেবা করার জন্য অফিস থেকে ছুটি নিলো। শরৎচন্দ্র খুব কাছাকাছি থাকায় রোগীর সেবার-শুশ্রæষার দায়িত্ব তাঁর ঘাড়েও গিয়ে পড়লো কিছুটা। শহরের সব বড় বড় কবিরাজ, ডাক্তার দেখানো হলো। বউয়ের শোকে বন্ধুটা প্রতিদিনই কান্নাকাটি করে। মাঝে মাঝে শরৎচন্দ্রে হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলে, “বন্ধু, কিছু একটা করো। ও আমার সব। ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।”
ডাক্তার, কবিরাজ, শরৎচন্দ্র, কেউ-ই কিছু করতে পারলো না। একদিন রাত এগারোটার সময় শরৎচন্দ্রে বন্ধু পতœীটি মারা গেলো। স্ত্রীকে হারিয়ে বন্ধুটি শোকে উন্মাদ হয়ে গেলো। মৃত স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদছে শুধু। আর দাপাচ্ছে।
শরৎচন্দ্র দেখলেন, এই লাশ যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ বন্ধুর শোককে সামাল দেওয়া যাবে না। বরং উত্তরোত্তর তা শুধু বাড়বেই। কাজেই, মৃতদেহের দ্রুত সৎকার করা প্রয়োজন। তিনি বন্ধুকে বললেন, “ভাই, তোমার স্ত্রীর প্রতি যেমন ভালোবাসা আছে, তেমনি কিছু কর্তব্যও আছে। তোমার স্ত্রীর মৃতদেহ সৎকার করতে হবে। আমি বেরুচ্ছি। কিছু লোকজন জোগাড় করে নিয়ে আসি।”
শরৎচন্দ্রের এই কথাতেই তাঁর বন্ধুর শোক উবে গেলো। শোকের বদলে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেলো মুখ। এক লাফে এগিয়ে এসে শরৎচন্দ্রের হাত চেপে ধরলো বন্ধুটি। বললো, “ভাই, এই রাত দুপুরে আমাকে মরার সঙ্গে একলাটি ফেলে যেও না। তুমি গেলে আমি থাকতে পারবো না। ফিরে এসে দেখবে আমি হার্টফেল করে মরে গেছি।”
“একটু আগেই না বলেছিলে ওকে ছাড়া তুমি এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবে না। ফুরিয়ে গেলো তোমার ভালোবাসা।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভয়ে আতংকিত বন্ধু শুধু বলে চলেছে, “যা করার কাল করো ভাই। আজ রাতে আমাকে মরার সাথে একলা রেখে যেও না। তুমি চলে গেলে আমি বাঁচবো না।”