Home কলাম বিশ্বের বিবেক

বিশ্বের বিবেক

হিমাদ্রী রয় : দোষ চাপানো বিদ্যা আগাছার মতো জন্ম লয়। বীজ বুনতে হয় না, আপনা আপনি বেড়ে উঠে। জীবনভর সুই হয়ে চালুনির পেছনে ঘুরছি। কমফোর্ট জোনের মধ্যে বসে চোখের উপর হাত রেখে সব আঁধার বলে চেঁচাই। কিন্তু হাত সরালেই যে প্রকাশ। আমরা ‘নিজের অক্ষমতার উপর দৃষ্টি দিই না, কেবল পরের উপর সকল দোষ নিক্ষেপ করি, প্রতিভা কতিপয় পুস্তক কন্ঠস্থে আর বিদ্যা চর্বিত চর্বণে’ কথাগুলো স্বামী বিবেকানন্দের।
যুবকদের বিবেক জাগ্রত করার প্রয়াসে ভগিনী নিবেদিতার প্রশ্নের জবাবে ১৯০১ সালে বিবেকানন্দের কিছু কথা উল্লেখ করছি।

‘হে আমার বন্ধুগণ হে আমার সন্তানগণ আমাদের জাতীয় তরণী লক্ষ লক্ষ মানবাত্মাকে জীবন সমুদ্র পারাপার করে দিচ্ছে। বহু গৌরবোজ্জ্বল শতাব্দী ধরে এই তরণী সঞ্চরণ করেছে, বহন করেছে লক্ষ লক্ষ মানবাত্মাকে ওপর পারে অমৃত লোকে। কিন্তু আজ আমাদের দোষেই হয়তো এই তরণীর কিছু ক্ষতি হয়েছে, দুই একটি ছিদ্র দেখা দিয়েছে, কেবল সেজন্য তাকে অভিশাপ দেবে, জগতের সর্বাপেক্ষা যা আমাদের অধিক কাজে লেগেছে তার উদ্দেশ্যে গরল বর্ষণ করবে? জাতীয় তরণীতে আমাদের এই সমাজে যদি ছিদ্র দেখা দেয় এসো সেই ছিদ্র বন্ধ করি, সেই কাজে সানন্দে বুকের রক্ত ঢেলে দেই। যদি ছিদ্র বন্ধ করতে না পারি, সেই চেষ্টায় যেন মরি।

হে আমার সন্তানগণ, আমি তোমাদের সঙ্গে আমার সকল পরিকল্পনার কথা বলতে এসেছি যদি সে কথা শোন আমি তোমাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে রাজি আছি। যদি না শোন যদি এমনকি পদাঘাতে আমাকে ভারত থেকে দূর করে দাও আমি আবার ফিরে আসবো ফিরে এসে বলবো আমরা সবাই ডুবছি। যদি ডুবি সবাই যেন একসঙ্গে ডুবি কোন অভিশাপ যেন উচ্চারণ না করি।

আমরা এখনো ডুবেই আছি, উদাসী সময় যেন ঢলতে চাইছেনা। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, দেশের পরিণতি নিয়ে ওকালতি করি নিজের ক্ষেত্রে বিচারক হয়ে বসে আছি। অভিবাসী আমি নিজেকে সান্ত¡না দেই এই বলে দেশ আমাকে কর্মক্ষেত্র দেয়নি; আমি নিজে আলস্যের গন্ডি পেরিয়ে কতটা খুঁজেছি সেই অক্ষমতার ভার কখনোই নিতে চাইবো না।

বিদেশে কমফোর্ট জোনে বসে কেউ হয়তো অতীত কর্মজীবনের অনিয়মের ফিরিস্তি দেই, কিন্তু সেইসময় দায়িত্ববোধ থেকে অনিয়ম রুখে দেয়ার জন্য আমরা কি করেছি? সুতরাং দায় কি শুধু সিস্টেমের? আমরা কি চায়ের মাঝে চিনির মতো মিশে যাই না?

গোঁড়ামি সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এখনো আমি-আপনি কতটা সোচ্চার, বক্তব্যে নয় হাতে কলমে কতটা হতে পেরেছি। আমরা সবাই কি মনে করিনা যে কেবল নিজের ঘড়িটাই ঠিক সময় দিচ্ছে। স্বামী বিবেকানন্দের পঙক্তি উচ্চারণ করি তবে আচরণে তার উপস্থিতি নেই।
স্বামী বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন জাত, পাত, ধনী, দরিদ্র সকল বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে নতুন ভারত হবে, চাষার ঘর থেকে, বুনা ওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি বেলুড় মঠে সাঁওতাল দের বসে খাইয়েছেন। বলেছিলেন আজ আমার সত্যিকারের দরিদ্র নারায়ণ সেবা হলো।

স্বামী ব্রম্মানন্দকে চিঠিতে লিখেছেন ‘রেখে দে ফিলোসোফি আর জপতপ, সারাজীবন শুধু একটা সত্য বুঝেছি, পৃথিবীতে একজনের মনে যদি একদিনের জন্য শান্তি আনতে পারিস সেটাই সত্যি’।

আমাদের স্বার্থপরতার জীবনে শান্তির ললিতবাণী শান্তি শান্তি বলে বাণিজ্যিকিকরণ করি বটে তবে বাতাবরণ তৈরি করতে চাই না, আজো করিনি।

রাম, রহিম, জনকে শান্তির শামিয়ানায় এনে সর্বজনীন ধর্মের সংগা দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ভিন্ন রুচির মানুষ কিন্তু হাঁটবে একপথে। যারা হবে সহনশীল, উদার ও অনন্ত বাহু বাড়ায়ে পৃথিবীর সকল মানুষকে আলিঙ্গন করবে যেখানে পরমত সহ্য করতে না পারা কিংবা উৎপীড়নের কান্না থাকবে না।

সে ধর্ম নিরামিষ আর একাদশীর ধর্ম নয়, শুধু মন্দিরে যাওয়ার ধর্ম নয়, রাস্তা বন্ধ করে জন দুর্ভোগ বাড়িয়ে কোন নির্দিষ্ট দিকে প্রার্থনার ধর্ম নয়, ক্রোড় কর্মী হয়ে ত্যাগের নামে নিষ্ঠুরতার ধর্ম নয়। তিনি চেয়েছিলেন শিব জ্ঞানে জীবকে সেবা, মানুষের চোখের জল মুছানোই হবে মানুষের ব্রত।

এই দর্শন অনুসরণ করলে আমাদের জীবন পাল্টে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেশ সমাজ পাল্টাতে চাই তবে নিজদের পাল্টাতে চাই না। হৃদয় ক‚পে বর্বর রাক্ষস হাঁকায় আমি শ্রেষ্ঠ, আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ।

ইতিহাস সাক্ষী যারাই সহনশীল হয়ে সহাবস্থানের কথা বলেছেন, প্রেম দেওয়া প্রেম নেওয়ার কথা বলেছেন সমাজের দ্বারা তারা আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। শ্রী চৈতন্যকেও মেরে ফেলা হয়েছিল।

শিকাগোয় আন্তর্জাতিক ধর্ম সম্মেলনের বিদায় ভাষণে, বীর সন্নাসী বিশ্ববিবেক জাগ্রত করেছিলেন।

পাশ্চাত্যকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন তোমরা পৌত্তলিকদের আত্মাকে উদ্ধার করার জন্য তাদের নিকট ধর্ম প্রচারক পাঠাতে খুব উদগ্রীব কিন্তু বল দেখি অনাহার, দুর্ভিক্ষের হাত হতে তাদের দেহগুলো রক্ষা করো না কেন? তোমরা শুধু গীর্জা নির্মাণ করো। কিন্তু প্রাচ্যে সর্বত্র অভাব ধর্মের নয়, ধর্ম তাদের প্রচুর আছে, সেখানে কোটি আর্তপীড়িত নরনারী কেবল দুমুঠো অন্ন চাইছে। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শুনানো কিংবা দর্শন শেখানো তাকে অপমান করা।
অজ্ঞানতার মোহনিদ্রা থেকে মানবজাতিকে জাগিয়ে তুলার জন্য যিনি চষে বেড়িয়েছেন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, ভারতের বাণীকে নিয়ে গিয়েছেন সুদুর আমেরিকায়, মাতৃভূমিকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে সেই মহাত্মনের মর্যাদাহানী করতে কম্পিত হননি দেশের বাঙলার কিছু মানুষ।

শিকাগো বিজয় করে আসার পর কলকাতা টাউন হলে স্বামীজিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সভায় গুরদাস মুখোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো, তিনি বললেন কায়েস্থের ছেলে কালাপানি পার হয়েছে নামের আগে স্বামী লাগিয়েছে, হিন্দু রাষ্ট্র হলে তাকে চাবুক মেরে ফেলা হতো। পিয়ারি মোহন মুখপাধ্যায় এই শর্তে রাজি হয়েছিলেন যে তিনি স্বামী শব্দের পরিবর্তে ব্রাদার বিবেকানন্দ বলবেন।

নটী বিনোদিনীকে আশ্রয় দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পতিতের পাবন হয়েছিলেন, কাছে টেনে নিয়েছিলেন পরম মমতায় বলেছিলেন আসল-নকল সবই দেখা হলো, থিয়েটার করবি বিনোদ এতে লোক শিক্ষে হয়। সেই রামকৃষ্ণ মিশনই কিনা ১৮৯৬ সনে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবে মন্দিরে পতিতাদের প্রবেশ নিশিদ্ধ করে।

রুখে দাঁড়ান স্বামীজি। কলঙ্কিত চরিত্রের নারীদের উপস্থিতে যারা সেদিন বিব্রত হয়েছিলেন তাদের অন্যতম রামদয়াল চক্রবর্তীকে চিঠি লিখে উত্তর দিলেন। ‘পতিতারা যদি দক্ষিণেশ্বরের মহাতীর্থে যাইতে না পায় কোথায় যাইবে? পাপীদের জন্য প্রভুর বিশেষ প্রকাশ যত, পুণ্যবানের জন্য তত নহে যাহারা ঠাকুরঘরে গিয়াও ঐ বেশ্যা, ঐ নীচ জাতী, ঐ গরিব, ঐ ছোটলোক ভাবে তাহাদের অর্থাৎ যাহাদের তোমরা ভদ্রলোক বলো, সংখ্যা যত কম হয় ততই মঙ্গল’। এর ফলে পরের বছর রামকৃষ্ণ জন্মোৎসবে যোগ দিতে গেলে এর পরদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সেবাইত ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস পত্রিকার মারফত জনসাধারণকে জানান যে- ‘বিদেশ প্রত্যাগত স্বামী বিবেকানন্দর দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে প্রবেশ অনভিপ্রেত ছিল ও এখন থেকে নিষিদ্ধ হল’।

আজো শিল্প সংস্কৃতির জগতে নারীদের সম্পর্কে আমাদের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মানসকিতা তিলমাত্র পরিবর্তন হয়নি, তাদের চরিত্রে কলঙ্কের স্ট্যাম্প বসিয়ে দেই; হালের পরিমনি তার প্রমাণ।

৩৯ বছরের জীবনে তিনি সর্বকালের বিবেকানন্দ হয়ে ১৯০২ এর ৪ঠা জুলাই বিদায় নেওয়ার পরও অপমানিত করা হয়েছে তাঁকে। অমৃতবাজার পত্রিকা লিখলো ‘বেলুড় মঠের মাংস ভক্ষণকারী সন্নাসী চলে গেছেন’। চন্দন কাঠের চীতায় পুড়ছিল ভারতের দর্শন, সভ্যতা, আর আমাদের পূর্বপুরুষদের অত্যাচারে যারা পশু পদবীতে উপনীত হয়েছিল সেই সব মানুষের প্রতিবাদ। গঙ্গা তার সাক্ষী হয়ে রইলো।

নিদ্রিত সভ্যতার কাছে আজো স্বামী বিবেকানন্দ জাগরণের মন্ত্র।
‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত’।

Arise! Awake! and stop not till the goal is reached.

জুলাই/০৯
তথ্যসূত্র -গবেষক তরুণ গোস্বামী।
The Master as I saw Him- Siater Nivedita
বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ-শঙ্করীপ্রসাদ বসু।
ইন্টারনেট।

Exit mobile version