অনলাইন ডেস্ক : রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ভুগছে পুরো বিশ্ব। মহামারি পরবর্তী যুদ্ধ বিগ্রহে আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে। এর ফলে কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। তাই যুদ্ধ নয়, পৃথিবীতে নেমে আসুক শান্তি। তাতে অবগাহন করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক সম্প্রীতি- এমন কামনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কলি ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ আজ শুক্রবার। অতীতের গ্লানি, দুঃখ, জরা মুছে অসুন্দর ও অশুভকে পেছনে ফেলে নতুন কেতন উড়িয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০-কে বরণ করে নিয়ে চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রা শাহবাগ মোড় হয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়। তবে রমজান মাস হওয়ায় এবারের পয়লা বৈশাখের সকালে পান্তা-ইলিশের আয়োজন হয়নি।

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে বলেন, প্রত্যাশা ও সফলতার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য। এটি ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছে।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এখন এটি ওয়ার্ল্ড মেমোরি অব হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। ফলে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এটি অসাধারণ সম্পদ। সেটির রক্ষণাবেক্ষণ, সেটি সংরক্ষণ ও সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া এখন সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব এবং এটি অন্তর্ভুক্তমূলক দৃষ্টি ও দর্শনের প্রতিফলন। এটির মাধ্যমে এটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার বার্তা সময়ে সবসময়ই দিয়ে থাকে। যে আতঙ্ক ছিল সেটির প্রতিবাদে সকল মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সকল ধরনের সকল উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এটি একটি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক আহ্বান।

এবারের শোভাযাত্রায় প্রধান আকর্ষণ দুই মোটিফ হলো- মায়ের কোলে শিশু এবং নীলগাই। মায়ের কোলে সন্তান যেমন নিরাপদ, প্রতীকীভাবে বৈশ্বিক শান্তির বার্তা রয়েছে সেখানে। এ ছাড়া বিপন্ন হারিয়ে যাওয়া প্রাণীদের প্রতীকী হিসেবে রাখা হয়েছে নীলগাই। এছাড়া আরও চারটি মোটিফ শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত হয়। সেগুলো হলো বাঘ, ময়ূর, ভেড়া ও হরিণ।

প্রতিপাদ্যের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নববর্ষ উদযাপন কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও উপ-উপাচার্য ( প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বরিষ ধরার মাঝে শান্তির বারি অর্থাৎ সুষ্ঠু পৃথিবীর জন্য তুমি পানি বর্ষণ কর। যাতে এই উত্তপ্ত বসুন্ধরা স্নিগ্ধ হয়, শান্ত হয়, মনোরম হয়, সুন্দর হয় এবং ফুলে ফলে ভরে উঠে।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের সদস্যসহ সকল স্তরের মানুষ। শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসা নারীদের অনেকের পরনে শাড়ি আর মাথায় নানা রঙের ফুলের সমন্বিত টায়রা। পুরুষদের পরনে পাঞ্জাবি। সবারই চোখে-মুখে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।

শোভাযাত্রাকে ঘিরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই পুরো ক্যাম্পাস এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মোতায়েন আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। কড়া নিরাপত্তায় উৎসবের আনন্দ ছিল বাঁধভাঙা। শোভাযাত্রা শেষে প্রদর্শিত মোটিফগুলো চারুকলা অনুষদে রাখা হয়। সেখানে যাওয়ার পর ঢাকের তালে উচ্ছ্বাসে মাতেন শিক্ষার্থীরা। মোটিফগুলোর সঙ্গে ছবি সেলফি তুলে আনন্দকে ফোনে ধারণের চেষ্টা করেন দর্শনার্থীরা।

চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে দর্শনার্থী পুতুল সরকার বলেন, এবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতস্ফুর্ত। এটা দেখে খুব ভালো লাগছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।

নিরাপত্তা বিষয়ে কেএম খালিদ বলেন, আমরা দেখেছি জোট সরকারের সময় রমনার বটমূলে বোমা হামলা হয়েছে। বোমা হামলাকে তাদের সরকারের একটি অংশ ছিল। এক সাথে ৬৪ জেলায় বোমা হামলা হয়েছিল। আপনারা জানেন হুমকিও এসেছে, একজন আইনজীবী হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত করেছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করার জন্য। সেই জায়গাটি থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে নিরাপত্তা বেষ্টনী যেটা দেখছেন, আগেও এটা ছিল।

গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অন্ধকার ঘোচানোর আহ্বানে পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। এটিই পরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে। ২০১৬ সালে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় এই শোভাযাত্রা। সেই সময় থেকে চারুকলা অনুষদের নেতৃত্বে প্রতিবছর উদযাপিত হয় এই উৎসব।

গত ১৯ মার্চ শিল্পী রফিকুন নবী মাছরাঙা পাখি এঁকে উদ্বোধন করেন শোভাযাত্রা প্রস্তুতি পর্বের। এরপরই দীর্ঘমাস জুড়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মুখোশ, সরা, আর ছবি আঁকেন। জয়নুল গ্যালারির পাশেই এ সব শিল্পকর্ম বিক্রি করা হয়। আয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে সম্পৃক্ততা থাকলেও শিক্ষার্থীরা চান নিজেদের মতো শিল্পকর্ম তৈরি করে সেসব বিক্রির মাধ্যমে আয়োজন করতে। এসব শিল্পকর্ম বিক্রি করে শোভাযাত্রার খরচ বহন করা হয়। এবারে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছেন চারুকলার ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।