অনলাইন ডেস্ক : করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো যশোরের মণিরামপুর উপজেলার পাড়িয়ালি বালিকা মাদরাসা ছুটি হয়ে গিয়েছিল। প্রায় আট মাস পর যখন অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার জন্য মাদরাসা খোলা হয়, তখন জানা গেল এ সময়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ২০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানেই না। করোনা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। নতুন আরেকটি বছর শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বলছে, করোনাকালে দেশে বাল্যবিয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।

বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়, করোনা মহামারির কারণে যা এখন প্রকট। এ ছাড়া বর্তমানে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ না করা ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি না করতে পারাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। আর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বাল্যবিয়ে নির্মূল করতে হবে ২০৪১ সালের মধ্যে। অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচে বাল্যবিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আর চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বাল্যবিয়ে বন্ধে অগ্রগতি গত দশ দশকের তুলনায় কমপক্ষে আট গুণ এবং এসডিজির লক্ষ্য পূরণের জন্য ১৭ গুণ দ্রুততর করতে হবে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে যে জরিপ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ১০৯টি বাল্যবিয়ের ঘটনা পত্রিকায় এসেছে। পরের বছর ৭০টি ঘটনার খবর আসে, যা আগের বছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম। কিন্তু করোনাকালে ২০২০ সালে আবার বেড়ে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১০১-এ, যা ২০১৯ সালের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি।

এর পাশাপাশি বেসরকারি এই সংস্থাটি গত বছর প্রথমবারের মতো বাল্যবিয়ে নিয়ে টেলিফোন জরিপ করেছে। সেখানে দেখা যায়, এ সময় ৯৩৫টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে, যেটি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। সব ঘটনা যেহেতু পত্রিকায় আসে না, এ জন্য বাস্তব প্রেক্ষাপটে করোনাকালে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি অনেক বেশি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, প্রাথমিকভাবে মা-বাবাদের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন, সেটি এখনো হয়নি। পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধের জন্য প্রতিটি উপজেলায় যে কমিটিগুলো আছে, তারা খুব বেশি সচল না।

জুন মাসে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ৬৫ শতাংশ বিয়ের নিবন্ধন করা হয় না। অনিবন্ধিত এসব বিয়ের বেশির ভাগই বাল্যবিয়ে।

ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি বলেন, তাঁদের জরিপে করোনাকালে ২৩ উপজেলার ৮১টি ইউনিয়নে প্রায় এক হাজার ২৭০টি বাল্যবিয়ের ঘটনা পাওয়া গেছে। বাস্তবে এ ঘটনা আরো বেশি।

ইউনিসেফের পাঁচ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বাল্যবিয়ে কমতির দিকে ছিল। দেশে বাল্যবিয়ের হার ছিল ২০১৫ সালে ৩৭.৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩৫.৭ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩৩.৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৩২.৩ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৩০.৮ শতাংশ। কিন্তু করোনাকালে রেকর্ডসংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়েছে।

ইউনিসেফের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসাইন বলেন, করোনাকালে ইউনিসেফের করা জরিপ ছিল খুবই সীমিত পরিসরে। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে করা এমন সীমিত জরিপেও দেখা গেছে, বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি। এটি দিয়ে বোঝা যায় করোনাকালে বাল্যবিয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ স্কুল বন্ধ হওয়া।

‘বাল্যবিয়ে কেবল গ্রাম অঞ্চলেই হয়’—প্রত্যেকেরই কমবেশি এমন ধারণা থাকে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, শহরে এখনো ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৪২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি শহরেও বাল্যবিয়ে সমানতালে বাড়ছে।

গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়েতে বিশ্বে শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে। দেশে বাল্যবিয়েতে শীর্ষে ঢাকা বিভাগ। জেলার মধ্যে শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সবচেয়ে কম বাল্যবিয়ে ছিল চট্টগ্রাম বিভাগে।

২০১৭ সালে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন পাস হয়। মা-বাবা আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তিস্বরূপ অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী/পুরুষ আইন লঙ্ঘন করলে অনধিক এক মাসের আটকাদেশ বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে বা কেউ মিথ্যা অভিযোগ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

আইন হলেও বাল্যবিয়ে কেন বন্ধ হচ্ছে না—এমন প্রশ্নের উত্তরে শাহীন আনাম বলেন, বয়স বাড়িয়ে বা অন্য স্থানে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা সেখানে যথাযথ নজরদারি নেই। আইনের বিধানও মানা হয় না। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেক তৎপর হতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক জলি বলেন, ‘আইন আছে কিন্তু দৃশ্যমান কোনো শাস্তি আমরা দেখি না।

ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের সমন্বয়হীনতা আছে।’

মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কাশেম বলেন, গত বছর মার্চ মাস পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। এপ্রিলের পর থেকে অর্থাৎ লকডাউনের পর বাল্যবিয়ে বেশি হয়েছে। এটি ২০২১ সালের মধ্যে এমন ঘটনা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা। তিনি বলেন, বাল্যবিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবার লুকিয়ে দেয়। মাঠপর্যায়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে।