Home কলাম মাইন্ড দ্যা গ্যাপ!

মাইন্ড দ্যা গ্যাপ!

ঋতু মীর : “The ability to love is the devine power of human”
১।
‘মাধবী এসেই বলে যাই’- কবিতার এই পঙতিতেই ভালোবাসার ফাঁদে পা দিয়েছিল সত্যবতী। বরাবর কবিতা বিষয়টা সে তেমন বোঝে না। আর দুনিয়ার তাবৎ কবিদেরই ‘ভূত-ভবিষ্যৎ’ নেই এমন আস্ত এক পাগলভাবে সত্যবতী। ‘কবি’ মানেই তার কাছে উরুখুরু চুল, ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেল, ঝুল পাঞ্জাবীর আড়ালে বিষণ্ণ এক সত্ত্বা। ঠিক যেন পোষায় না সত্যবতীর! ভিতরে যে গভীরতা থাকলে কবিতার ভাব হৃদয় উদ্বেলিত করে, গভীরতার সেই ভাবটাই বুঝি সত্যবতীর ছটফটে স্বভাবে অনুপস্থিত। বড়জোর কবিতার ছন্দ মিলানো সুরের ছন্দে বুঝে না বুঝেই তার ময়ুরী মন মাঝে মধ্যে পেখম তুলে নাচে- এইটুকুই যা! সহপাঠী, পাড়ার সমবয়সী বন্ধু, উদীয়মান কবি, আশেপাশে বড় ভাইদের চোখ তখন সত্যবতীর প্রতি প্রেম প্রেম ঘোর লাগা। সত্যবতীর উচ্ছ¡ল হাসির কাঁচ ভাঙ্গা শব্দ যৌবনের লাবন্য মাখা চিবুকে পিছলে পড়ে। চোখ যেন এক জলপাই সবুজ উড়াল পাখি! নীল আকাশে বিচরণের আনন্দে নিজের পরিপার্শ্ব ভুলে নিজের মধ্যেই মগ্ন। মুগ্ধ প্রেমিক অন্ধ ভালোবাসার উত্তাল সমুদ্রে জীবন বাজি রাখতে চায়। পতঙ্গের পাখার ঝাঁপটায় উড়ে উড়ে চলে সত্যবতী, কোন অনলেই ঝাঁপ দেয় না। গোধূলি লগ্নে তার মন কাউকে ভেবে রাঁধা রাঁধা ভাবে বিরহী হয় ঠিক, কিন্তু সকালের শুরুতেই গত সন্ধ্যার আবেগের সেই ব্যাপারটা অজানা কারণেই কেমন বিষ বিষ লাগে। নারী না পুরুষ – লিঙ্গভেদের এই অসাড় বিভাজনের সামাজিক ট্যাঁবু উপেক্ষা করার অদ্ভুত এক যাদুকরী ক্ষমতা ধারণ করে সত্যবতী। নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে কোন মহলেই মেলামেশায় সম্পর্কের যোজন দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে সে নিমেষেই। মানুষ! মানুষ! সম্পর্কে, বন্ধুত্বে, ভালোবাসা, মেলামেশার প্রশ্নে ‘মানুষ’ বিষয়টাই সত্যবতীর মাথায় জুড়ে বসে থাকে। অন্তরের নির্ভেজাল ভালোবাসার মঙ্গল উপহারে কাউকে ঠকায় না সত্যবতী। কেবল ভুল ভালোবাসায় পথ খুঁজতে যেয়ে ঠকে যায় কিছু প্রেমিক। সম্পর্কে পরিমিতির সীমানা লঙ্ঘন বিষয়টা বিপজ্জনকভাবেই ভুলের নানা উপাদানে ঠাসা থাকে। মনের অবিমিশ্র দ্বন্দ্বে তাই কখনো শামুকের খোলসে গুঁটিয়ে যেতে হয় সত্যবতীকে। ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসি’ শব্দগুলি অস্পষ্ট, ধোঁয়াটে থেকে যায় তার কাছে। মনের রঙিলা নৌকা অনির্দিষ্ট স্রোতে ভেসে চলে, কোথাও ভিড়ে না। ‘খুব দেরী হয়ে যাচ্ছে’ ‘বাড়ি যাই’ বলে স্বভাবজাত তড়িঘড়ি ভঙ্গি ছিল সেদিনের সত্যবতীর। পাশে দাঁড়ানো তরুণ হৃদয় যে ফাগুন হাওয়ায়, তার জন্য ভালোবাসায় উথাল পাথাল তা বুঝেও না বুঝে নিঠুর দরদী চালে ‘যাই’ বলে সে। স্বল্পভাষী গভীর কণ্ঠে কবিতার লাইন বিড়বিড় করে। দীর্ঘ লম্বা দেহ সমর্পণে অসহায়ভাবে ঝুঁকে পড়া, নির্মোহ চোখে ভালোবাসার স্বর্গীয় দ্যুতি! থমকে দাঁড়ায় সত্যবতী। এই বুঝি সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ! এই বুঝি সেই কবিতা! এই বুঝি সেই ভালোবাসার ঘর, ঠিকানা! এই বুঝি সেই প্রেম! অনিশ্চিত তবু অবিনশ্বর! জোনাকি! জোনাকি! “ভালোবাসা” সত্যি একটা শুদ্ধ শব্দ!!

২।
জানো! আজ বিশ্ব ‘ভালোবাসা দিবস’! দুই হাতে ভালোবাসার হৃদয় চিহ্ন এঁকে দেখায় সে। সে আবার কি? সত্যবতীর বেরসিক প্রশ্নে কম কথার মানুষ তাঁর প্রতিক্রিয়াটা সেদিন অব্যক্তই রেখেছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রকৃতি কৃষ্ণচুড়া, পলাশ, জারুল ফুল রঙে চোখ ঝলসানো সৌন্দর্যে ঝলমল। তাঁর চোখে মুখেও সেই আলোর ছটা। ভালোবাসা দিবসের ব্যাখা দিয়ে বলে- জানো! গোটা বিশ্বে হাজার হাজার প্রেমিক প্রেমিকা আজ মহা সমারোহে এই দিনটা উদযাপন করছে। আর তুমি বাসায় বসে। হুম! বুঝলাম! কিন্তু তুমি কেন আমার কথা বন্ধুর কাছে সেয়ার করেছো? আমার মানা ছিলো না বুঝি? আহ্লাদ, আদরে, ভালোবাসার দখলে গরবিনী সত্যবতী গ্রীবা বাঁকিয়ে রাগ প্রকাশ করে। অনুরাগ আর খুনসুটির অভিমানে থমথমে মুখটা অসম্ভব সুন্দর দেখায়। তথ্য ফাঁসের অপরাধবোধে মলিন সঙ্গীর মুখ- না মানে খুব কাছের একজন বন্ধুকেই শুধু বলেছি। ‘তুমি আমার, তুমি আছো’ এই খবরটা যে আজ এই ভালোবাসা দিবসে সবাইকে চিৎকার করে জানাতে ইচ্ছে হয় সত্য! এখন যদি সারা দুনিয়া জানে? যদি কোন কারণে সম্পর্ক টুটে যায় বা তুমি বা আমি কেউ কাউকে ছেড়ে যাই? আমার ভবিষ্যৎ কি তখন? আর জানোতো! একটা মেয়ের বিয়ে ঠিক হলে পরিবার, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর প্রথম প্রশ্নটাই থাকে- ছেলে কি করে? একটা মেয়ের স্ট্যাটাস তার নিজের যোগ্যতার উপর নয়, ষোলআনা নির্ভর করে হবু স্বামীর আয়-উপার্জন, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রতিপত্তির উপর। সেক্ষেত্রে আমার দিকে যে হাজার প্রশ্নবাণ অপেক্ষা করছে। তোমাকে যে দায়িত্ব নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতেই হবে! বাস্তবতার হিসাব নিকাশ মিলাতে ব্যস্ত সত্যবতী প্রেমের সফল জুটিদের সংসার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে জোর তৎপর হয়। সঙ্গীর মলিন মুখটা অধিকতর মলিনতায় অধোবদন হয়ে থাকে। হাতের ভিতরে শক্ত মুঠিতে ধরা সত্যবতীর হাতটা যেন এইমাত্র কোন অধিকার হারিয়ে অবসন্ন শিথিল। সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার জলন্ত উদাহরণ টানতে টানতে হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করে সত্যবতী। সঙ্গীর পোড়া মাটির মত দগ্ধ মুখে তাকিয়ে ভিতরটা মুচড়ে উঠে তার। আমার জন্য নয় প্রিয়, সমাজ, পরিবারের কাছে তোমার গ্রহণযোগ্যতা, উপযুক্ততা প্রয়োজন। ভালোবাসার ঋণ যে একমাত্র প্রমাণেই শোধ হয়! অস্তগামী সূর্যের শেষ আলোটা অসহ্য যন্ত্রণায় সত্যবতীর চোখের উপর তির্যক আলো ফেলে। ঝাপসা দৃষ্টিতে ক্ষণিকেই বুঝি অন্ধ হয় সত্যবতী। কৃষ্ণচুড়া রঙ উজ্জ্বল এক ‘ভালোবাসা দিবস’ অসমাপ্ত গল্পের অপূর্ণতায় শেষ হয়। ভালোবাসার শর্ত, যুক্তি, কথায় আহত মানুষটা অসীম শুন্যতায় চুপচাপ বসে থাকে। আর ভালোবাসার মানুষকে আহত করার দায়ে সদা প্রগলভ সত্যবতী নীরব কান্নায় ঝুরঝুর ভাঙ্গে। আচ্ছা জোনাকি! “ভালোবাসি” কি আসলে একটা অশুদ্ধ শব্দ?

৩।
জোনাকি! শোন! এখন সময় বদলেছে, বদলেছি আমি, সেও! ভালোবাসার রঙ, উত্তাপ, মাত্রা, তান, সুর, ছন্দ, লয়ে সবেতেই দ্যাখো কি তুমুল বদল। মুনাফা লুটেরার বাণিজ্য গোলাপের ‘ভালোবাসা’- সেই তখনো ভালো লাগেনি, এখনও লাগেনা। আমার না, তারও নয় কিন্তু। এখন ‘ভালোবাসা’ ঘরের জানালায় আকাশ নীল পর্দায় তিরতির কাঁপা দখিন হাওয়ার দোল। এখন ‘ভালোবাসা’ বিছানায় টান টান দুধ সাদা চাদরে সুই সূতায় তোলা নকশার কারুকাজ। ‘ভালোবাসা’ এখন শাড়ির ভাজে লুকানো কষ্টের টাকায় সখের জিনিষ ধুম করে কিনে সংসার সাজানো। এখন ‘ভালোবাসা’ দুজনে মিলেমিশে প্রাণপণে বাড়ির ঋণ শোধের আনন্দ। ‘ভালোবাসা’ এখন সারাদিনের কাজ শেষে নিরাপদে ঘরে ফেরার স্বস্তি। ‘ভালোবাসা’ এখন অসুখে-ঔষধে মমতার হাত, পছন্দের রান্নায়, যতেœ বানানো চায়ের কাপে, অন্যের ক্ষুধার মাত্রা বুঝে ভাত মেপে বেড়ে রাখার দক্ষতায়। ‘ভালোবাসা’ এখন শুধুই সাহচর্যে, আস্থায়, বিশ্বাসে, যুক্তিতে, তর্কে, দ্বন্দ্বে, মিল, অমিলে, লেনদেনের আরোপিত শর্তে এবং অভ্যাসেও। জোনাকি! ভালোবাসা এখন আর শরীরে নয়, মনে! ভালোবাসা এক স্বর্গীয় ক্ষমতা। ভালোবাসা!! ভালবাসি!! – এখন শুদ্ধ অশুদ্ধের বিতর্কের অনেক উপরে ভীষণ কাঙ্খিত দুই শব্দ!! (চলবে…)

Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com

 

Exit mobile version