আকতার হোসেন : পোস্টমর্টেম টেবিলে শুয়ে আছেন শ্রী সত্য বাবু। গতরাতে তিনি দেহ ত্যাগ করেছেন। এ নিয়ে পুলিশ রিপোর্ট হয়েছে। সত্য বাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এতে অন্যের হাত আছে। তার এই মৃত্যুর জন্য কে দায়ী সেটা জানতে সকলে উৎসুক।

পুরানো ভাঙ্গা বিল্ডিং-এর নিচতলায় লাশ কাটা ঘর। দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও পেট উগলানো দুর্গন্ধ আসে। যাদের আপনজন মারা যায় তারাও নাকে কাপড় দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। একটা বটগাছ থাকায় অনেক উপকার হয়েছে। লোকজন বটগাছের ছায়ায় বসে আরাম করতে পারে।

যে ডাক্তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট লিখবেন তার নাম মিথ্যে মশাই। তার এই প্রতীকী নাম লোক মুখে বহুল প্রচলিত। অনেক অপেক্ষার পর জনসম্মুখে রিপোর্টটি এলো। এলো মানে জনসম্মুখে তুলে ধরা হলো।

সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রথম পক্ষ হলো সাব-ইনস্পেক্টর ইউসুফ। তার কাছে রিপোর্ট যেতেই সাংবাদিকদের সামলে পড়তে শুরু করে দেয়। আইনি জটিলতা মানতে চায় না। সাব-ইনস্পেক্টর ধরেই নিয়েছে গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি রিপোর্ট সম্পর্কে জনগণের জানার অধিকার সবচাইতে আগে। ‘সিভিল সার্ভেন্ট’ কথাটাকে বাংলা করে সে বলে, আমরা হলাম জনগণের চাকর। তাহলে মনিব আগে না চাকর?

মিথ্যে মশাইয়ের দস্তখত করা কাগজে যা গোপন থাকার কথা, সাব-ইনস্পেক্টর ইউসুফের কারণে সেটা সকলে জানতে শুরু করে আগেভাগে। রিপোর্টের সংক্ষিপ্ত সার হলো; যারা বিশ্বাস করেন উপরে বসে একজন সব জন্ম মৃত্যুর হুকুম দেন সেই বিশ্বাসীরাও উপরওয়ালার ইচ্ছে শক্তিকে কখনো কখনো মানতে চান না। স্বাভাবিক জন্ম মৃত্যুর ক্ষেত্রে মেনে নিলেও অস্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর বেলায় সেটা কেউ মানতে চায় না। একজন ধর্মগুরুর সন্তান খুন হলে সেও মনে করে তার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে খুনির কারণে। শতভাগ ধার্মিক লোকও মনে করে আমাদের সমাজে কিছু কিছু জন্ম অবৈধ! যদিও তাদের বিশ্বাস জন্ম মৃত্যুতে মানুষের কোন হাত নেই।

সাব-ইনস্পেক্টর পুরো রিপোর্ট না পরে সংক্ষিপ্তসার বলে যেতে লাগলো। সে বলল ডাক্তার মিথ্যে মশাই লিখেছেন সত্য বাবুর মৃত্যু যদি কোন কিছুর আঘাতের কারণে হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আঘাতের বস্তুটিকেও আমলে নিতে হবে। মিথ্যে মশাই মন্তব্য করেছেন, আমাদের দেশে ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে কিন্তু বস্তুকে নয়। বাস্তবতা হলো, যে বস্তুটি ধারালো কিংবা ভোতা হবার কারণে সত্য বাবুর মৃত্যু হয়েছে সেটা ব্যবহার না করলে কি সত্য বাবুর মৃত্যু হতো? যে সমস্ত বস্তুর কারণে একজন মানুষের মৃত্যু হতে পারে সে সে সমস্ত বস্তুকে মারণাস্ত্র কিংবা বিপজ্জনক বলা হলেও শাস্তি দেওয়া হয় না কেন?

সাধারণত এক ব্যক্তির মৃত্যু জন্য দায়ী ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় যাতে সেই ব্যক্তি পুনরায় অন্য কারোর মৃত্যুর হেতু না হতে পারে। কিন্তু হত্যা কাণ্ডে ব্যক্তির ব্যবহৃত বস্তুটি উন্মুক্ত অবস্থায় এক হাত থেকে অন্য হাতে কেন ঘুরতে থাকে?

একজন সাংবাদিক অনেকক্ষণ থেকে প্রশ্ন করার জন্য উশখুশ করছিল। প্রথম সুযোগেই তিনি সাব ইনস্পেক্টরকে প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলেন কিন্তু সাব ইনস্পেক্টর অন্য কাউকে লাইভে আসার সুযোগ দিতে চায় না। সে মিথ্যে মশাইয়ের রিপোর্ট পড়ছে আর হাতে রাখা মোবাইল ফোনে লাইকের সংখ্যা দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে উঠছে।

লাইকের সংখ্যাতে থেকে চোখ উঠিয়ে সে বলল, আপনারা শুনে অবাক হবেন যে মিথ্যে মশাই তার রিপোর্টের প্রশ্ন করেছেন সত্য বাবুকে আঘাত করার বস্তুটি যিনি বানিয়েছেন কিংবা সেটার নকশা যিনি তৈরি করেছেন এই মৃত্যুর ব্যাপারে কি তাদের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা নেই?

একজন মহিলা সাংবাদিক যাকে টেলিভিশনে বড় বড় রিপোর্ট করতে দেখা যায় তিনি হাত উঁচু করে বললেন স্যার আমার একটা প্রশ্ন আছে।

স্যার! তাও এত নাম করা এক সাংবাদিকের মুখ থেকে! সাব ইনস্পেক্টর চুপ থেকে মহিলা সাংবাদিককে প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিলেন।

স্যার, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন মিথ্যে মশাই বলছেন মানুষের মৃত্যুকে তরান্বিত করার কাজে যদি কোন বস্তুকে ব্যাবহার করা হয় যেমন; ছুরি কাঁচি তলোয়ার মুগুর ইত্যাদি, তাহলে এই বস্তুগুলোকেও আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে?

সাব ইনস্পেক্টর জবাব দেয়, আপনারা এই প্রশ্ন মিথ্যে মশাইকে সরাসরি করতে পারলে হয়তো সঠিক উত্তর পেয়ে যাবেন। তার পক্ষে কথা বলা আমার জন্য শোভনীয় হবে না।
মহিলা সাংবাদিক বলল, তিনি তো জনসম্মুখে আসেন না। তাকে আমরা কোথায় পাব?
সাব ইনস্পেক্টর বলল, আপাতত রিপোর্ট নিয়ে কথা বলি। আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেন। যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব আমি করবো।

পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে মিথ্যে মশাই লিখেছেন আদালত কি কখনো জানতে চাইবে, যে বস্তুটি দিয়ে আঘাত করার কারণে সত্য বাবুর মৃত্যু হয়েছে সেটার ওপর কোন ওয়ার্নিং বা নিষেধাজ্ঞা ছিল কিনা? যেমন ‘ইহা মানুষের ওপর প্রয়োগ দণ্ডনীয় অপরাধ’। সেটা না হলে যিনি সেই ধারালো বস্তুটি সত্য বাবুর ওপর ব্যবহার করেছেন তিনি তো বলতে পারেন তাকে কেউ সতর্ক করেনি কিংবা আঘাতের গুরুত্ব বা ফলাফল কী হতে পারে সে সম্পর্কে তার পূর্ব ধারণা ছিল না।

প্রশ্ন এখানে থেমে যায় না। কে আঘাত করেছে এবং কে সত্যিকার অর্থে মৃত্যুর জন্য দায়ী সেটা যাচাই করাও প্রয়োজন আছে। যাকে আসামী করা হয়েছে সেই ব্যক্তি কি তার হাত ব্যবহার করার জন্য দায়ী হয়েছেন নাকি তার বুদ্ধি ব্যবহারের জন্য দায়ী হবেন? তার পেশিশক্তি এ ব্যাপারে কতটুকু দায়ী? ঠিক একই বস্তুটি দিয়ে সত্য বাবুকে যদি কোন শিশু বা রুগ্ন ব্যক্তি আক্রমণ করতো তবে কি সত্য বাবু সত্যি সত্যি মারা যেতেন? তাহলে পেশী শক্তি সন্দেহের বাইরে কেন?

মিথ্যে মশাইয়ের মতে, হত্যার দায়ে যদি কারোর জেল কিংবা ফাঁসি হয় তাহলে তো সম্পূর্ণ দেহ শাস্তি পায়, অথচ দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিন্তু অপরাধ করেনি। এক হাতের অপরাধের জন্য অন্য হাত শাস্তি পাচ্ছে। ব্রেনের জন্য কিডনি। মাংস পেশির জন্য চোখের কর্নিয়া।
সবচাইতে বড় কথা হলো, সত্য বাবুকে জীবিত রাখার শেষ দায়ভারটা কার ওপর ছিল সেটা শনাক্ত করা কি জরুরি নয়? ডাব গাছের নিচে দিয়ে সত্য বাবু হেঁটে যাবার সময় একটা ডাব তার মাথা পড়ার ফলেও মৃত্যু হতে পারতো। অথবা সত্য বাবুর মাথার ওপর প্রতিদিন একটা করে ডাব পড়ার পরও তিনি বেঁচে থাকতে পারতেন যদি না মৃত্যু শেষ অনুমতি না পেত। অতএব, ধরে নিতে হবে অজ্ঞাত এক শক্তির কারণে সত্য বাবুর মৃত্যু সংগঠিত হয়েছে। সেই অজ্ঞাত শক্তি মানুষের দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। শুধু অনুমান করা যেতে পারে।

সবশেষে মিথ্যে মশাই লিখেছেন, আমি অনুমানের ভিত্তিতে এমন কিছু লিখবো না যাতে ক এর কারণে খ শাস্তি পায়। কেননা মৃত্যু একটি প্রক্রিয়া। এখানে একাধিক উৎস কাজ করে। যেমন শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা, চিন্তা শক্তি, মাংস পেশী, বস্তুর গঠন ইত্যাদি সবই ধারাবাহিকতার অংশ। এর সব স্তরেই মানুষের মৃত্যু হয় না। ব্যাপারটা ভেবে দেখা দরকার মৃত্যু যখন হয়, তখন কেন হয়? সমাপ্তি মন্তব্যে মিথ্যে মশাই লিখেছেন, দুঃখিত আবারও একটি মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণে আমি ব্যর্থ হলাম।

লাশ কাটা ঘরে এখন ভীষণ শূন্যতা। যারা লাশ গুনে পেটে চালায় নতুন চালানের অপেক্ষায় তারা বসে আছে। পথগুলো সব অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছু ঘরে বাতি জ্বলছে কিছু আঁধার। চিরাচরিত নিয়মে মিথ্যে মশাইয়ের এখন বাড়ি ফেরার কথা। তিন ব্যাটারির টর্চ হাতে নিয়ে তিনি দপ্তর থেকে বেরিয়ে এলেন। বটগাছের গোড়াতে তিন চারটা কুকুর শুয়ে থাকে। মিথ্যে মশাই তাদের কাছে এসে একটু দাঁড়ান। তাকে দেখে বটগাছের উপর থেকে ঝুপ করে কিছু অন্ধকার লাফিয়ে পরল। মাটিতে লুকিয়ে থাকা কিছু অন্ধকার সাপের মত মাথা উঠিয়ে দুলতে লাগল। মিথ্যে মশাই ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করেন। পুরানো পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বাতাসে উড়ে এসে মিথ্যে মশাইয়ের গালে চুমু খেয়ে যায়। পকেট থেকে কিছু বাদাম অন্ধকারে ছুঁড়ে দিয়ে মিথ্যে মশাই সোজা হাঁটতে শুরু করেন। তিনি কখনো টর্চের আলো মাটিতে মারেন না বরং আকাশের দিকে জ্বালিয়ে হাঁটতে থাকেন। ব্যাপারটা মিথ্যে মশাইয়ের জন্য একটা নিয়ম হয়ে গেছে।