ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩৭তম ভার্চুয়াল আসরটি জুলাই মাসের ১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রসংগীতের অনন্য শিল্পী-শিক্ষক সুবিনয় রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার এ আসরে, সুবিনয় রায়ের লেখা ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’সহ সামগ্রিকভাবে সুবিনয় রায়ের জীবন ও সংগীত নিয়ে আলোচনা করেন ভাষাবিদ, সংগীতশিল্পী ও সংগীত সংগ্রাহক রাজীব চক্রবর্তী এবং সুবিনয় রায়ের কণ্ঠে-গীত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন নন্দিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী বুলবুল ইসলাম।

রবীন্দ্রসংগীতের অসামান্য শিল্পী-শিক্ষক সুবিনয় রায় রবীন্দ্রসংগীতের গায়নরীতি নিয়ে লিখেছেন ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা।’ রবীন্দ্রগানের শিল্পী ও শিক্ষক সত্তায় যেমন তিনি স্বতন্ত্র একক ও অনন্য, তেমনি অনন্য তাঁর লেখা এই বই। কারণ রবীন্দ্রসংগীতের নানা দিক নিয়ে অনেক বই থাকলেও, এর গায়নরীতির ব্যবহারিক দিক নিয়ে এটিই একমাত্র বই। সুবিনয় রায় তাঁর সারাজীবনের চর্চা ও অভিজ্ঞতা থেকে অত্যন্ত কার্যকর কিছু পরামর্শ দিয়েছেন এই বইয়ে কণ্ঠ ও গায়কি এবং সেইসঙ্গে রবীন্দ্রগানের সাথ-সঙ্গত ও আবহসংগীত প্রসঙ্গে। এই বইতে তিনি তাঁর সারা জীবনের সংগীত সাধনা ও পরিবেশনা উপলব্ধ-জ্ঞান ও বিশ্বাস অত্যন্ত সৎভাবে বিবৃত করেছেন।

আসরের শুরুতেই ১৮৯৯ সালে কবির ৩৮ বছর বয়সে শিলাইদহে রচিত, গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের পার্থনা উপপর্যায়ের ধ্রæপদ-ভাঙা গান ‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে’ গেয়ে শোনান শিল্পী বুলবুল ইসলাম। সুবিনয় রায়ের জন্মশতবর্ষে, কবির প্রিয়তম বেহাগ রাগে নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রথম এই গান, এই ব্রহ্মসংগীতটির পরিবেশনা আসরের শুরুতেই অন্য এক মাত্রা যোগ করে। গানটির স্বরলিপিকার কাঙালীচরণ সেন।

আলোচক রাজীব চক্রবর্তী বলেন, “আমরা যারা গত শতকের সপ্তম দশক মানে ১৯৭০ থেকে যে দশক শুরু হয়েছে সেই সময় বেড়ে উঠছি, আমাদের একটা অসামান্য সৌভাগ্য হয়েছিল। আমরা সৌভাগ্যবান ১৯৬১র পরে জন্মেছি বলে। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে রবীন্দ্রসংগীতের স্বর্ণযুগ তৈরি হয়েছিল ১৯৬১ থেকে। রবীন্দ্রসংগীতের সমস্ত মহান শিল্পীদের অসংখ্য রেকর্ড তখন বাজারে আসছে। আমরা সেইসব শুনে বড়ো হচ্ছি। আমাদের শোনাটা শুরু হয়েছিল এইসব মানুষদের দিয়ে। ঐ ছোটো বয়স থেকেই আমাদের অভিজ্ঞতাটা ছিল- সুবিনয় রায়ের গান মানেই একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি। ঠাণ্ডা কোনদিক থেকে? শান্ত সমাহিত ভাব অর্থে। সেটি বুলবুল ইসলামের গানের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করলাম আমরা।

“সংস্কৃতি একটি পরম্পরাবাহিত উত্তরাধিকার। সংস্কৃতি মানুষ তৈরি করে তার চর্চার মধ্য দিয়ে এবং সেই চর্চা পরম্পরা ধরে আসে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের হাত ধরে সে পরম্পরা এগিয়ে চলে। জন্মসূত্রে কেউ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয় না। তাকে চর্চা করতে হয়। গত ১০০০ বছর ধরে বা তারও আগে থেকে যে লিখিত ইতিহাস আমাদের হাতে আছে, সাহিত্যের যে নমুনা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে, তাতে আমরা বলে থাকি যে, বাংলা ভাষার বয়স ১০০০ বছর। কিন্তু তার আগে থেকেই এই ভাষার সংস্কৃতি বহমান আছে বলে আমরা সকলেই মনে করি। সেই সংস্কৃতির মধ্যে সংগীতের যে মহৎ উত্তরাধিকার, সেই উত্তরাধিকার রবীন্দ্রনাথ নিজে পেয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর প্রতিভার আলোতে সেইটেকে গড়ে পিটে নিয়েছিলেন নিজের মতো করে। সেই প্রতিভার ফসল রবীন্দ্রসংগীত। সেই রবীন্দ্রসংগীতকে যাঁরা বহন করেছেন, যাঁরা আমাদের মধ্যে চাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ পুরুষ সুবিনয় রায়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ এর নভেম্বরে আমরা তাঁর জন্মশতবর্ষে পা দিয়েছি এবং তাঁর জন্মশতবর্ষ অতিক্রান্তও প্রায়। অথচ এ বঙ্গে কি ও বঙ্গে দু’বঙ্গেই তাঁকে নিয়ে তেমন কোনো উৎসবের আয়োজন আমরা দেখিনি। উৎসবের আয়োজন শুধু নয়, তাঁকে নিয়ে চর্চাও হয়নি সেভাবে। পাঠশালাকে ধন্যবাদ যে তারা এই চর্চার কথা ভেবেছেন, এই স্মরণ অনুষ্ঠান করার কথা ভেবেছেন।

“আমরা সুবিনয় রায়ের জীবনটাকে একটুখানি যদি দেখে নিই, তাহলে তাঁর জীবনের অন্তত ছোট্ট একটা চিত্র আমরা পাব। সুবিনয় রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ৮ই নভেম্বর কোলকাতায়। আদতে সুবিনয় রায় বাংলাদেশেরই মানুষ। ঢাকার মানিকগঞ্জের মালুচি গ্রামের বসুরায় পরিবারের। বাবার নাম বিমলাংশুপ্রকাশ রায়। তিনি পেশায় ছিলেন রসায়নবিদ। আমরা জানব যে, সুবিনয় পরবর্তীকালে রসায়ন তাঁর পঠনপাঠনের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। বাবার এই উত্তরাধিকারই হয়তো তিনি বহন করেছিলেন, যে উত্তরাধিকারের কথা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। বাবা চাকরি করতেন বার্ড অ্যান্ড কোম্পানিতে। তাঁদের পরিবারটা ছিল ব্রাহ্ম পরিবার। আমরা জানি যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রাহ্ম আন্দোলনের হাত ধরে আমাদের সংস্কৃতি, সংগীত, লেখাপড়ার চর্চা থেকে শুরু করে সবকিছুই অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল। সুবিনয় সেইরকম একটি পরিবারের সন্তান হওয়ায় সেই পরিবেশটুকু সেই প্রতিবেশটুকু তাঁকে সাহায্য করেছিল সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে চলে আসতে। বিমলাংশুপ্রকাশ পেশায় রসায়নবিদ হলেও সুকুমার রায়ের ননসেন্স ক্লাবের সদস্য ছিলেন। তাঁর নেশা ছিল সাহিত্যচর্চা। আর সুবিনয়ের মা সুখময়ী বিখ্যাত দার্শনিক পণ্ডিত সীতানাথ তত্ত¡ভূষণের কন্যা। মায়ের দিদির নাম সুধাময়ী। সুধাময়ীর বিয়ে হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আর সুধাময়ী-সুখময়ী গান শিখেছেন বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের কাছে। অতএব গানের একটা পরিবেশ একদম সবসময়ই যেন পরিবারটাকে ঘিরে ছিল। আর সুবিনয় এমন একটি পরিবারে জন্মেছেন, বড়ো হচ্ছেন, তাঁকে তো গান গাইতেই হবে। এই গান গাওয়াটা তাঁর একধরনের বিধিনির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সুবিনয়ের ছেলেবেলায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সুবিনয়ের মা’কে গান শেখাতে যখন আসতেন, সুবিনয় পাশের ঘরে বসে শুনতেন। সুবিনয়ের তখন গানের প্রতি যে খুব আগ্রহ ছিল তা নয়। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশ বা বুলা মহলানবিশের বাঁশি বরং তাঁকে টেনে রাখতো সবসময়। সেই বাঁশির সুরে সুবিনয় নিজেকে সিক্ত করেছিলেন। সুবিনয় বাঁশি বাজাতেন এবং মা’কে যে গান সুরেন্দ্রনাথ শেখাচ্ছেন সুবিনয় সেই গান বাঁশিতে তুলে নিচ্ছেন। সুরেন্দ্রনাথ শুনতে পাচ্ছেন, শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করছেন কে সেই ছেলে? জানা গেল, ছোট্ট সুবিনয় বাঁশি শুনে শুনেই তুলে নিয়েছে সেই গান। সুরেন্দ্রনাথ তাঁকে ভালোবেসে গৎ সেখালেন একটি রাগের।” এই পর্যায়ে বুলা মহলানবিশের বাঁশের বাঁশিতে ভৈরবী রাগে প্রেম পর্যায়ের রবীন্দ্রসংগীত ‘আমি যে আর সইতে পারি নে’ বাজিয়ে শোনানো হয়। “রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার প্রসারে এই বুলা মহলানবিশের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমরা অনেকেই হয়তো তা জানি না। ১৯৫১ সালে রাজেশ্বরী দত্ত ‘বুঝি ওই সুদূরে’ বলে একটি গান রেকর্ড করেছিলেন, যে গানটি রবীন্দ্রনাথের গান বলে হারিয়ে গিয়েছিল একসময়। বুলা মহলানবিশ সেই গান বাঁশিতে তুলে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিখে। রাজেশ্বরীকে তিনি শিখিয়েছিলেন সেই গান, যা ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি সুবিনয়কে গানের সুরের মধ্যে নিমজ্জিত করেছিলেন।

“সুবিনয়ের মা-মাসি সকলেই গান গাইতেন বলে বাড়িতে গানের পরিবেশ ছিলই। এমনকি শান্তিনিকেতনে যেহেতু তাঁর মাসি এবং মেসোমশাই প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থাকতেন, তাই শান্তিনিকেতনে সুবিনয়কে যেতে হতো সবসময়। সুবিনয়ের মা একসময় কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মেয়েদের হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। তারপর শান্তিনিকেতনে মেয়েদের হোস্টেলেরও তিনি সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। তাই সবমিলিয়ে শান্তিনিকেতনে সুবিনয়ের যাওয়া-আসা ছিলই। আর মনে রাখতে হবে, সুবিনয় জন্মেছেন ১৯২১ এ। রবীন্দ্রনাথ তখনও জীবিত। কাজেই তখন রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে তিনি না এলেও, রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তাঁকে আছন্ন করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এবং এভাবেই যাতায়াত করতে করতে তাঁর পড়াশুনোর জীবনটাও এগোতে থাকে। মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন থেকে মেট্রিক পাশ করেন তিনি। তারপর সিটি কলেজে ভর্তি হন রসায়ন পড়ার জন্য। রসায়ন তাঁর বিশেষ প্রিয় বিষয় ছিল। তবে রসায়নের সঙ্গে রসেরও একটা যোগ সুবিনয়ের জীবনে সেই ছোট বেলা থেকেই ছিল। তিনি সিটি কলেজ ছেড়ে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাভবনে চলে গেলেন পড়তে। এবং এখানে ঘটল একটা দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনা ইতিবাচক অর্থে। কারণ এখানে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে সুবিনয়ের পরিচয় হলো। শৈলজারঞ্জন তখন শিক্ষাভবনে পড়াতে এসেছেন, রসায়নের তরুণ অধ্যাপক। কিন্তু প্রাণ তাঁর গানে। তিনি রবীন্দ্রনাথের গান করেন, গান শেখান। শৈলজারঞ্জনের একরকম সাগরেদ হয়ে গেলেন সুবিনয়। এবং এই শুরু হলো সুবিনয়ের প্রথাগত রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে ঢোকা। তার আগে শিখেছেন কিন্তু সেটা প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। এমনি করেই ১৯৩৯ এর পরে কোনো একটা সময় বর্ষামঙ্গলের মহড়া দেবেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। তখন রবীন্দ্রনাথের কাছে সরাসরি ১৬ খানা গান সুবিনয় শিখেছেন। এইভাবে শুরু হলো তাঁর রবীন্দ্রসংগীতের দীক্ষা। শান্তিনিকেতনে শিক্ষাভবনের পাঠ শেষ করে তিনি সিটি কলেজে এলেন বিএসসি পড়তে। ১৯৪৩ সালে বিএসসি পাশ করলেন। ১৯৪৬ এ বিয়ে করলেন শিশুসাহিত্যিক অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কন্যা ইন্দিরা দেবীকে। ইন্দিরা দেবী-সুবিনয়ের দুই পুত্র- সুরজিৎ ও সুরঞ্জন। ৯ই জানুয়ারি ২০০৪ এ সুবিনয়ের প্রয়াণ।

“বুলা মহলানবিশের কাছে সুবিনয়ের প্রথম সংগীতে দীক্ষা। তারপরে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে।” এ পর্যায়ে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কণ্ঠে সিন্ধু রাগে পূজা পর্যায়ের টপ্পা-ভাঙা রবীন্দ্রনাথের গান ‘কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে ভুবনেশ্বর প্রভু’ বাজিয়ে শোনানো হয়।

‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ বইতে সুবিনয় রায় রবীন্দ্রসংগীতের স্বতন্ত্র গায়কী নিয়ে লিখেছেন- ‘যদিও রবীন্দ্রসংগীত ভারতীয় রাগসংগীত ও লোকসংগীতের ভিত্তির উপরেই গড়া তবুও সংগীত পরিবেশনের দিক থেকে এ একটি স্বতন্ত্র সংগীত বা সংগীতপদ্ধতি। তার গায়কি, বাচনভঙ্গি, স্বরপ্রয়োগরীতি ও অলংকরণপ্রণালি স্বতন্ত্র। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা, ভজন বিশুদ্ধভাবে গাইলে যেমন প্রত্যেকটি পরিষ্কারভাবে চিনে নেওয়া যায়, রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। এমনকি ভারতীয় সংগীতের কোনও এক বিশেষ পদ্ধতিকে অবলম্বন করে রচিত রবীন্দ্রসংগীতগুলিও বিশুদ্ধভাবে গাইলে তা রবীন্দ্রসংগীত বলে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। সুতরাং রবীন্দ্রসংগীতের বিশুদ্ধ গায়কি আয়ত্ত করতে হলে একদিকে যেমন চাই উচ্চাঙ্গ হিন্দুস্থানি সংগীতপদ্ধতির মোটামুটি ব্যবহারিক জ্ঞান, তেমনই চাই সংগীতের কাব্যাংশের উপলব্ধি, বাণী উচ্চারণের বিশুদ্ধতা ও বিভিন্ন অলংকারাদির (আশ, মিড়, গমক, গিটকিরি) যথাযথ মার্জিত ব্যবহার ইত্যাদি- যেগুলি রবীন্দ্রসংগীতের গায়কির মূল উপাদান ও বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয়।’ এ পর্যায়ে এই লেখাটি টেম্পলেট হিসেবে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় ও পাঠ করে শোনানো হয়।

১৯৪৫ সালে প্রকাশিত সুবিনয় রায়ের প্রথম অ্যালবামে ছিল দুটো গান। ‘এই করেছ ভালো, নিঠুর হে’ এবং ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে।’ ‘এই করেছ ভালো’ গানটির রচনাকাল ১৯১০, কবির ৪৯ বছর বয়সের রচনা। এর স্বরলিপিকার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভীমরাও শাস্ত্রী। গীতাঞ্জলির অন্তর্ভুক্ত গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের দুঃখ উপপর্যায়ের ইমনকল্যাণ রাগে এ ধর্মসংগীতটি এ পর্যায়ে গেয়ে শোনান বুলবুল ইসলাম। এ গানের পরই সুবিনয়ের প্রথম অ্যালবামের অন্য গান- ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’ সুবিনয়ের কণ্ঠে বাজিয়ে শোনানো হয়। গানটির রচনাকাল ১৯১১, কবির ৫০ বছর বয়সের রচনা। পিলু-ভীমপলশ্রী রাগে গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের বিরহ উপপর্যায়ের এ ধর্মসংগীতটির স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটি ‘অচলায়তন’ নাটকে পঞ্চকের গান।

রাজীব বলেন, “সুবিনয়কে আমরা যেভাবে চিনি, সুবিনয় রায় বলতে যেই ছবিটা ভেসে ওঠে সেইটে হচ্ছে- ধ্রুপদ ধামার-ভাঙা গান, গুরুগম্ভীর গান, সূক্ষ্ণ সুর কঠিন তালের গানের শিল্পী তিনি। এবং কথা সত্যিও। এই ধরনের গানে তাঁর পারদর্শিতা অসামান্য। কিন্তু পারদর্শিতা এক কথা। আগেও বলেছি পরম্পরার কথা, উত্তরাধিকারের কথা। সেই উত্তরাধিকার যাতে তৈরি হয় সেই চেষ্টা করে গেছেন তিনি ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ বইটি লিখে। একটিই মাত্র বই অথচ কী অসামান্য তার উপস্থাপনা! এটা সম্ভব হয়েছে তিনি শুধুমাত্র শিল্পী ছিলেন না বলে। তাঁর শিক্ষক সত্তাটিও জাগরূক ছিল সবসময়। এই শিল্পী ও শিক্ষক সত্তার মিশেলে এইরকম একটি বই তাই তৈরি হয়ে উঠতে পারলো। আমরা আজকাল প্রায়ই দেখতে পাই রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে নানাধরনের পরীক্ষা নীরিক্ষা। আমরা রবীন্দ্রসংগীত শুনতে গিয়ে বেহাগ রাগ শুনতে চাই, ভৈরবী শুনতে চাই। সুবিনয় রায়ের ছাত্র শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বই ‘উৎসারিত আলো: রবীন্দ্রনাথের গান।’ সেই বইয়ে আছে, প্রথম দর্শনে শঙ্কর সুবিনয়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা এ গানটা আপনি বেহাগে গইলেন? তখন সুবিনয় নাকি বলেছিলেন, আমি রবীন্দ্রসংগীত গাইলাম, আমি বেহাগও গাইনি, ভৈরবীও গাইনি। তখনকার দিনে বলা হতো হিন্দি-ভাঙা গান। ধ্রæপদ ধামার-ভাঙা গানগুলোকে হিন্দি-ভাঙা গান বলা হতো। সেই ভাঙা গানগুলি রবীন্দ্রসংগীত হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত। সেগুলি আর বেহাগও থাকেনি, ভৈরবীও থাকেনি, পরজও থাকেনি। ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ বইতে প্রথম এবং প্রধান কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রসংগীতের পরিবেশনার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের মধ্যে যে সুরের প্রাধান্য আছে সেইটাকে ছাড়িয়ে, সেইটাকে পেরিয়ে গিয়ে বাংলা গানের কাব্যধর্মিতা রবীন্দ্রনাথ বিশেষ করে গানের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। বলা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথ প্রথম বাংলা আধুনিক গান লিখেছিলেন। তার আগে আধুনিক অর্থে গান আধুনিক হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাংলা গানকে আধুনিক করলেন। সেই আধুনিক গান গাইতে গেলে কীভাবে গাইতে হবে, ধ্রæপদ ভাঙা-হিন্দি ভাঙা গান কীভাবে গাইতে হবে সে সম্পর্কে সুবিনয় রায় ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ বইতে বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন যে, কোনো গান যদি বেহাগ থেকে আসে তবে বেহাগ রাগের বৈশিষ্ট্য রেখে সে গান গাইতে হবে। সুবিনয় সেই সমস্ত আলোচনা করে বারবার বলছেন, বেহাগ শেষ পর্যন্ত নয়, ভৈরবী নয়, পরজ নয়, শেষপর্যন্ত সেটা রবীন্দ্রসংগীত। সেই কারণে ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’য় তিনি বারবার বলেছেন, সুরগুলি শিখতে হবে, রাগগুলি শিখতে হবে, বেসিক কাঠামোটা শিখতে হবে। কিন্তু কখনোই রবীন্দ্রনাথের গানকে রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে বের করে নেওয়া চলবে না। সেইটেই ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’র মূল কথা। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ এবং রাবীন্দ্রিকতা- বইটার মূল কথা।”

‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’য় রবীন্দ্রসংগীতের গায়কি শিরোনামে দ্বিতীয় অধ্যায়ে সুবিনয় রায় লিখেছেন- ‘রবীন্দ্রসংগীতের গায়কি বা গায়নপদ্ধতি বলতে আমরা কী বুঝি? খুব স্পষ্ট কথায় সংক্ষেপে বলতে গেলে- রবীন্দ্রনাথের রচিত গানগুলি তাঁর ইপ্সিত ও তাঁরই প্রবর্তিত সংগীতপদ্ধতি অনুসারে পরিবেশন করা- এটাই হলো রবীন্দ্রসংগীতে গায়কির আদর্শ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের শুধু যে কথার অংশগুলিই রচনা করে গিয়েছেন তা তো নয়, গানগুলির সুর-তাল সংযোজনাও তিনি নিজেই করে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, গানগুলি তিনি নিজে গেয়েছেন, শিখিয়েছেন এবং অনেকক্ষেত্রে স্বরলিপিকারদের ব্যবহারিক নির্দেশও দিয়ে গিয়েছেন গানগুলির সংরক্ষণ সম্পর্কে। কোন গানটি কীভাবে গাওয়া হবে, সে সম্পর্কে তিনি বিশেষ চিন্তা করতেন। গানের লয়, স্বরোচ্চারণের বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন অলংকারাদির ও শ্রুতিসমূহের যথাযথ ব্যবহার প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে কবি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর গান অপর কারও কণ্ঠে শুনে যেন তাঁর গান বলে চেনা যায়- এই কামনাই করতেন তিনি সর্বদা। স্টিম রোলার চালিয়ো না- এ কথা কবি তার গানের গায়কির সম্পর্কেই ইঙ্গিত করে বলেছিলেন।’ রবীন্দ্রসংগীতের গায়কি শিরোনামে দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাংগীতিক পর্যায় বা ধারার ‘হিন্দি ভাঙা গান’ সম্পর্কে আলোচনায় সুবিনয় লিখেছেন- “হিন্দুস্থানি পদ্ধতির কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় উপাদানগুলি গ্রহণ করে ও তার বাহুল্যের দিকটা বর্জন করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই পর্যায়ের গান রচনা করেছেন। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘… হিন্দুস্থানি সংগীতকে আমরা শিখব গাওয়ার জন্য, ওস্তাদি করবার জন্য নয়।’ এই কথাটা কবি তাঁর হিন্দি ভাঙা গান রচনার মধ্য দিয়ে যথার্থই কার্যে পরিণত করে গিয়েছেন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের যে কোনও গান গাইলে তা যেন রবীন্দ্রসংগীত বলে চেনা যায়- এই কথাটি সর্বদা স্মরণে রেখে তাঁর হিন্দি ভাঙা গানগুলি গাওয়া উচিৎ; এবং তানকর্তব্যের বাহাদুরি এড়িয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। রবীন্দ্রনাথের যে কোনও পর্যায়ের গান রচনানৈপুণ্যে, কাব্যমাধুর্যে ও ভাবগভীরতায় এতই সমৃদ্ধ ও এতই ‘সম্পূর্ণ’ যে এর মধ্যে আলাপ বিস্তার তানকর্তব্যের অবতারণা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক ও নিছক বাহুল্য বলেই মনে হয়।” হিন্দি ভাঙা গান প্রসঙ্গে সুবিনয় আরো লিখেছেন- “হিন্দুস্থানি সংগীতে আমরা গায়ককে বলি ‘অমুক রাগে (যথা বেহাগ) খেয়াল শোনান তো।’ সেখানে গায়ক কোন গানটি গাইবেন, সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের বেলায় আমরা বলি- ‘মহারাজ, একি সাজে এলে’ গানটি গাও তো। এ কথা বলি না- ‘বেহাগে একটা সাদরা গাও তো।’ কারণ রবীন্দ্রসংগীতের বিচারে ‘মহারাজ’ গানটির সামগ্রিক সংগীতরূপটি বা সত্তাটি ‘বেহাগ-সাদরা’ আখ্যার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।” এ পর্যায়ে এই তিনটি লেখা টেম্পলেট হিসেবে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় ও পাঠ করে শোনানো হয়।

গীতসুত্রসার থেকে প্রাপ্ত বৈজু বাওরার ‘প্রথম আদ শিব শক্তি’র সুরে ধ্রæপদ ভাঙা গান ‘প্রথম আদি তব শক্তি’ ধর্মসংগীতটির রচনাকাল ১৯১১ সাল, রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর বয়সের লেখা। সোহিনী রাগে গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের বিবিধ উপপর্যায়ের এ গানটির স্বরলিপিকার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং সরলা দেবীর সৌজন্যে প্রাপ্ত ত্যাগরাজার ‘অতি লাবণ্যরাম কন্যোলারা’র সুরে দক্ষিণী ভাঙা গান (মহীশূরী ভজন) ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’র রচনাকাল ১৮৯৩, কবির ৩১ বছর বয়সের রচনা। পূর্ণ ষড়জ রাগিণীতে (মহীশূর) গীতবিতানের পূজা পর্যায় সুন্দর উপপর্যায়ের এ গানটির স্বরলিপিকার সরলা দেবী। সরলা দেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় লিখেছেন- ‘মহীশূরে পদার্পণ করে দেখলুম যে একেবারে সঙ্গীতের রাজ্যে প্রবেশ করেছি। দেওয়ানের পৌত্রীর তরঙ্গায়িত কণ্ঠে ত্যাগরাজ নামে প্রসিদ্ধ তেলেগু কবির রচিত অনেকগুলি ওদেশী ক্লাসিকাল গান শুনে মুগ্ধ হলুম এবং মেয়েটিকে বাড়িতে আনিয়ে তার কাছ থেকে সেগুলি আদায় করলুম। দেশে ফিরে রবিমামাকে উপঢৌকন দিলুম। তিনি তাদের ভেঙে ভেঙে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করলেন- বাঙলার সুররাজ্য বিস্তৃত হল।’ সরলা দেবী আরো লিখেছেন- ‘মহীশূরে যখন গেলুম সেখান থেকে এক অভিনব ফুলের সাজি ভরে আনলুম। রবিমামার পায়ের তলায় সে গানের সাজিখানি খালি না করা পর্যন্ত মনে বিরাম নেই। সাজি থেকে এক একখানি সুর তুলে নিলেন তিনি, সেগুলিকে মুগ্ধচিত্তে নিজের কথা দিয়ে নিজের করে নিলেন- তবে আমার পূর্ণ চরিতার্থতা হল। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে, এসো হে গৃহদেবতা, এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, চিরবন্ধু চিরনির্ভর প্রভৃতি আমার আনা সুরে বসানো গান। আমার সব সঙ্গীতসঞ্চয়ের মূলে তাঁকে নিবেদনের আগ্রহ লুকিয়ে বাস করত। দিতে তাকেই চায় প্রাণ, যে নিতে জানে। বাড়ির মধ্যে শ্রেষ্ঠ গ্রহীতা ছিলেন রবিমামা, তাই আমার দাত্রীত্ব পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছিল তাঁতে।’এ পর্যায়ে এ দুটো গান গেয়ে শোনান বুলবুল ইসলাম।

রাজীব বলেন, “সুবিনয় রায় ছিলেন একাধারে শিক্ষক এবং শিল্পী এবং তাঁর শিক্ষক সত্তাটা কখনো কখনো তাঁর শিল্পীসত্তার উপরে উঠে গেছে। তিনি সাধারণত বেশিরভাগ সময় পছন্দ করতেন গান শেখাতে। গান গাইতে বা অনুষ্ঠান করতে খুব একটা আগ্রহী প্রথমদিকে সুবিনয় একেবারেই ছিলেন না। শিক্ষক সত্তা তাঁর মধ্যে যেহেতু সবসময়েই কাজ করেছে তাই তিনি ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’য় রবীন্দ্র-ধ্রুপদের গায়নপদ্ধতি সম্পর্কে রীতিমতো এক দুই তিন চার করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। একটু পড়ে শোনালে বোঝা যাবে, কীরকম চিন্তাভাবনার ঋজুতা ছিল তাঁর। ‘রবীন্দ্র-ধ্রুপদের গায়নপদ্ধতি সম্পর্কে প্রস্তাব হলো এই- ১) তানপুরার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ধ্রুবপদ্ধতির অলংকরণনীতির মার্জিত ও সংযত প্রয়োগের সাহায্যে গানের স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী ও আভোগের সুর নির্ভুলভাবে গেয়ে যেতে হবে। ২) কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা ও মাধুর্য- দুইই বজায় রাখতে হবে। কম্পন যেন এই ধরনের গানে একেবারেই ব্যবহার না করা হয়। ৩) স্বাধীনভাবে রাগের আলাপ, স্বরবিস্তার প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়।’ এখন রবীন্দ্রসংগীতে একটা ধারা তৈরি হয়েছে যেখানে একটু খেয়াল, একটু টপ্পা, একটু ধ্রুপদ সবকিছু মিলিয়ে রবীন্দ্রসংগীতকে তার মাঝখানে পাঞ্চ করে দেওয়া হচ্ছে। এগুলি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে হবে। ‘৪) মনে রাখতে হবে যে, দূন, ত্রিদূন, বাঁট প্রভৃতি না করলে রবীন্দ্র-ধ্রুপদের কোনওরূপ অঙ্গহানি হয় না। যদি নেহাতই প্রয়োজন হয় তবে ঢিমা লয়ের চৌতাল বা সুরফাঁকতালে রচিত ধ্রুপদে গানের সুর অটুট রেখে, খুব সংযতভাবে এবং কথার উচ্চারণের দিকে বিশেষ যত্ন নিয়ে স্থায়ীর বা অন্তরার কেবল দূন করা চলতে পারে। ৫) সর্বদা মৃদঙ্গ (বা পাখোয়াজ) সংগত সহযোগে গাইতে হবে এবং ধ্রুপদ গানের রীতি অনুসারে সর্বক্ষণ হাতে তাল রাখতে হবে।’ খেয়াল রাখতে হবে, এখানে শুধু সহযোগ না, সংগত এবং সংহত এই দুটোর কথাই সুবিনয় বলছেন রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে। ‘৬) গানের বিষয়বস্তুর সম্যক উপলব্ধির দ্বারা সমগ্র গানটির মর্মবাণী সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে যথার্থ প্রকাশ করে রবীন্দ্র-ধ্রুপদের বিশেষ অনুভূতিটি শ্রোতার মনে জাগিয়ে তুলতে হবে।’ রবীন্দ্রসংগীতের ওপর অসংখ্য বই লেখা হয়েছে কিন্তু সুবিনয় রায়ের ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ বইটি সবদিক থেকেই বিশিষ্ট এই কারণে যে, এটি কোনো পরীক্ষায় পাশ করার জন্য তিনি লেখেননি। তিনি একজন শিল্পীর, একজন গায়কের ঠিক কীভাবে গানটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে রবীন্দ্রসংগীতের একটা পথরেখা দিয়ে গেছেন এবং নিজেও সেই পথে এগিয়ে গেছেন। সেইদিক থেকে এই বইটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

“সুবিনয় রায় শেষদিকে শিখেছিলেন বিষ্ণুপুরের রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কাছে।” এ পর্যায়ে নমুনা হিসেবে রমেশ্চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ১৯৬১ সালে রেকর্ডকৃত সম্মেলক কণ্ঠে ‘আনন্দধনি জাগাও গগনে’ গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়।

“সুবিনয়ের অবস্থানটা ঠিক কোথায় রবীন্দ্রসংগীতে? তিনি গাইলেন, শেখালেন, আর কী করলেন? এর জন্য একটু পেছনে ফিরে গিয়ে দেখি। রবীন্দ্রসংগীতের অবস্থাটা ১৯৩০ এর আগে কেমন ছিল? তার একটা নমুনা শুনলে বোঝা যাবে সুবিনয় ঠিক কী কাজটা করতে চেয়েছেন এবং করেছেন।” নমুনা হিসেবে ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া’ গানটির কিছু অংশ বাজিয়ে শোনানো হয় এ পর্যায়ে। “এই গান শুনেই বোঝা যাচ্ছে, রাবীন্দ্রিকতা অর্থাৎ গানের যে রাবীন্দ্রিক ভাব সেটা এই গানে নেই। আরো আগের গান যেমন বেদানা দাসির গান যদি শুনি তবে ভয়াবহ অবস্থাটা বোঝা যায়। এইরকম অবস্থা ছিল রবীন্দ্রসংগীতের। এটা যে কেউ ইচ্ছে করে করেছেন তা নয় কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার প্রসার তৈরি হয়ে ওঠেনি তখনো। রবীন্দ্রনাথের গান শেখানোর জায়গা ছিল না। ১৯৩০ সালের পরে চর্চা বাড়তে থাকে। একটা নিয়মের মধ্যে আসতে থাকে সব। তার কারণ, ১৯৩০ এ দুটো গ্রামোফোন কোম্পানি বাংলাতে স্থাপিত হলো। একটি হচ্ছে মেগাফোন, আরেকটি হিন্দুস্থান রেকর্ডস। এরা রবীন্দ্রনাথের গান প্রচুর পরিমাণে রেকর্ড করতে থাকলো। আমরা হয়তো জানি যে, হিন্দুস্থান রেকর্ডস এর প্রথম রেকর্ডটি রবীন্দ্রনাথের।
রবীন্দ্রসংগীতকে এইভাবে রেকর্ডের মাধ্যমে বাজারে নিয়ে আসার ফলে তার মানোন্নয়ন ঘটল, প্রমিতকরণ ঘটল, আগে যেটা ছিল না। অনাদি দস্তিদার বা শৈলজারঞ্জন যেই প্রমিতকরণের পদ্ধতি শুরু করেছিলেন, সুবিনয় তাঁর যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। তিনি সেই দায়িত্বটা হাতে তুলে নিলেন। তিনি শুধু গান গাইলেন না, শুধু শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন না। বলা ভালো যে, শিল্পী হিসেবে সুবিনয়ের প্রতিষ্ঠা অনেক পরে। আমরা জানি, ১৯৪৩-৪৪ থেকে সুবিনয় রেডিওতে গান গাইছেন এবং প্রথমবার সুবিনয় অডিশনে পাশ করতে পারেননি। সুরেশ চক্রবর্তী তাঁকে রেডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন গান গাইবার জন্য, ১৯৪৩ বা কাছাকাছি সময়ে। অডিশনে সুবিনয় পাশ করলেন না। তখন তাঁকে বলা হলো শচীন দেব বর্মণের গান গাইতে। তিনি যখন রাজি হলেন না, তখন তাঁকে কোনোরকম ১০ মিনিটের একটা অনুষ্ঠান দেওয়া হয় এবং সেখানে তিনি ‘ওই মালতীলতা দোলে’ গান। তবে সঙ্গে শচীন দেবের একটা গানও তাঁকে গাইতে হয়েছিল। গানটি ছিল — ‘গোধূলির ছায়াপথে।’ শিল্পী হিসেবে সুবিনয়ের প্রতিষ্ঠা অনেক পরে হয়েছে। তিনি চাননি সেটা। তিনি প্রধানত চেয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের নতুন ধারাটাকে, গানের পদ্ধতিটাকে, সংস্কৃতির নতুন শাখাটাকে মানুষের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, গায়কদের মধ্যে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অনুস্যূত করে দিতে। এবং সেই কাজটাই তিনি করে গেছেন সারাজীবন। এটা যে কতবড়ো কাজ সেটি যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা জানেন। শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এক ধরনের কাজ কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করা অন্য ব্যাপার। সেটা দায়বদ্ধতা থেকে তিনি করেছেন। আমার মনে হয়, রবীন্দ্রসংগীতে সুবিনয়ের প্রধান অবদান হচ্ছে- তাঁর এই ভূমিকাটা। এবং এরই মধ্য দিয়ে তিনি অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছেন। সেটা একটা বড়ো বিষয়। অর্থাৎ নানারকমের গানের ধারায় যখন প্রমিতকরণ হচ্ছে তাতে সুবিনয় হাত মেলালেন।”

“শান্তিনিকেতনে সুবিনয় আরেকজনকে পেয়েছিলেন- সমরেশ চৌধুরী। সমরেশ চৌধুরীর খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সুবিনয় রায়ের হয়ে ওঠার পেছনে এবং সমরেশ চৌধুরী সংগীতভবন ছেড়ে যাওয়ার পরে সুবিনয় রায় প্রথম সংগীত শিক্ষক হিসেবে সংগীতভবনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সমরেশ চৌধুরী আমাদের প্রায় বিস্মৃতিতে চলে গেছেন।” এ পর্যায়ে সমরেশ চৌধুরীর কণ্ঠে ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ গানটির কিছু অংশ রেকর্ড থেকে বাজিয়ে শোনানো হয়। “সংগীতের পরম্পরা ধরার জন্য এঁদের গান শোনা খুব জরুরি। আমাদের সময়ের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতার কথা খুব মনে পড়ে। ‘আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলি থেকে, আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে। আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে, আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।’ এর মধ্য দিয়ে কী বোঝা যায়? আমাদের উত্তরাধিকারের প্রশ্নটাই বোঝা যায় যে, আমরা হঠাৎ করে তৈরি হয়ে উঠিনি। সুবিনয় রায়ও তৈরি হয়ে ওঠেননি। কোনো মহৎ শিল্পীই হঠাৎ তৈরি হন না, রবীন্দ্রনাথও হননি। তাঁরা তাঁদের নিজের মতো করে শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কিন্তু এর উত্তরাধিকার বুঝতে গেলে এঁদের পূর্বসূরিদের কথাও একটু শুনতে হবে বৈকি। সুবিনয়ের আরেক মাস্টারমশাই ছিলেন সুখেন্দু গোস্বামী। সুখেন্দু গোস্বামী সুবিনয় রায়কে বিখ্যাত এস্রাজিয়া অশেষ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে নিয়ে যান। অশেষ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে সুবিনয় কিছুদিন ধ্রুপদ শেখেন। তারপর অশেষ বন্দোপাধ্যায় সুবিনয়কে নিয়ে যান রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কাছে, যাঁর গান একটু আগে আমরা শুনেছি। সুখেন্দু গোস্বামীর কণ্ঠস্বর ছিল অসামান্য। তাঁর কাছে সুবিনয় খেয়াল ঠুমরি এসব শিখেছেন। এবং উচ্চাঙ্গসংগীতে সুবিনয়ের যে রীতিমতো তালিম ছিল, তার নমুনাও আমরা আজ শুনে নেব।” এ পর্যায়ে সুখেন্দু গোস্বামীর কণ্ঠে ‘মধুবনে অলি ফিরে যায়’ গানটি বাজিয়ে শোনানো হয়। “এঁদের গান সচরাচর শোনা যায় না। সুবিনয় রায়কে নিয়ে চর্চা করতে গেলে, তাঁর শতবর্ষে এইটুকু কাজ আমাদের করতে হবে। রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের কাছে সুবিনয় ধ্রæপদ শিখেছেন। সুবিনয়ের কণ্ঠে আমরা রবীন্দ্রসংগীত প্রচুর শুনেছি কিন্তু ধ্রæপদের কোনো রেকর্ড বাজারে নেই। কেউ শোনেননি। ব্যক্তিগত স্তরে হয়তো কেউ শুনে থাকতে পারেন। সেইরকম একটি নমুনা শুনব আমরা- সুবিনয় রায়ের কণ্ঠে ধ্রæপদের নমুনা। এটি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশেষ জায়গায় রেকর্ড হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলেন ইন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সুভাষ চৌধুরী।”

সুবিনয় রায় শুধু রবীন্দ্রনাথের গানই না, অন্য অনেক ধরনের গান করেছেন। যেমন বৈদিক স্তোত্র থেকে গেয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের সুর দেওয়া দুটি বেদমন্ত্র- শৃণ্বন্তু বিশ্বে (ঋগ্বেদ), যা আত্মদা বলদা (ঋগ্বেদ) এবং শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদের তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরাং তিনি গেয়েছেন। অন্য অনেকের ব্রহ্মসংগীতও গেয়েছেন। এ পর্যায়ে বুলবুল গেয়ে শোনান ‘ওঁ পিতা নোহসি।’ জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় কন্যা রেণুকা মৃত্যুশয্যায় বাবার হাত ধরে বলেছিল- ‘বাবা, পিতা নোহসি বলো।’ মায়ের মৃত্যুর পর শান্তিনিকেতনে বাড়িতে বাসকালে বাবার মুখে বারবার শুনেছে রেণুকা এই মন্ত্র-মন্ত্রের ব্যাখ্যা। এটি বাবার মুখে শুনেই অন্যলোকে পাড়ি জমায় ত্রয়োদশী তরুণী রেণুকা। এরপর বুলবুল গেয়ে শোনান মনমোহন চক্রবর্তীর ব্রহ্মসংগীত ‘অনন্ত অপার তোমায় কে জানে।’ রাজীব বলেন, “মনমোহন চক্রবর্তী ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার মানুষ। খুব অল্প বয়সেই তিনি ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। এমনকি বরিশালে যখন অশ্বিনী কুমার স্কুল স্থাপন করছেন, একদম প্রথম থেকে মনমোহন ঐখানে শিক্ষার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। একসময় তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে বাংলা বিহার ঊড়িষ্যা আসামে পরিভ্রমণ করেন ব্রাহ্মধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য। তাঁর গ্রন্থ বিশেষভাবে আদৃত হয়েছে। তিনি ব্রহ্মবাদী নামে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ব্রাহ্মসমাজের জন্য তিনি প্রচুর গান লিখেছেন।” এরপর জ্যোরিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ব্রহ্মসংগীত ‘জানি তুমি মঙ্গলময়’ গেয়ে শোনান বুলবুল। এটি একটি খেয়াল-ভাঙা গান। আদি ব্রাহ্ম সমাজের দীর্ঘদিন সম্পাদক ছিলেন জ্যোরিরিন্দ্রনাথ। রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্রহ্মসংগীতেরও প্রবর্তন করেন। ব্রহ্মসংগীত নামটিও তাঁরই দেওয়া। পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মে শাস্ত্রীয় মন্ত্রের যে ভূমিকা, ব্রাহ্মধর্মে প্রার্থনা এবং উপাসনায় ব্রহ্মসংগীতের সেই একই ভূমিকা। আমাদের ভক্তিসংগীত ও কাব্যসংগীতের যে ঐতিহ্য সেখানে ব্রহ্মসংগীত খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রহ্মসংগীতের মধ্য দিয়ে রাজা রামমোহন রায় আমাদের সংগীত রুচির এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন। রামমোহন রায় প্রয়াত হবার বেশ কয়েকবছর পরে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের হাল ধরলেন। তিনি ছিলেন রামমোহন রায়ের যোগ্য উত্তরসূরী। এই সময় ব্রহ্মসংগীত রচনার ক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার এলো। মহর্ষির উৎসাহে জোঁড়াসাকো ঠাকুর বাড়ির সদস্য সদস্যারা গান লিখতে মেতে উঠলেন। এদের গানগুলো বেশিরভাগই হিন্দি-ভাঙা গান। ব্রহ্মসংগীতে ব্রাহ্মসমাজের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস উঠে আসে। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ কিংবা নববিধান ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল যে, ব্রহ্মসংগীতের রূপের একটা পরিবর্তন ঘটছে, বিবর্তন ঘটছে। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশব চন্দ্র সেনের সময়ে ব্রহ্মসংগীতে যুক্ত হয় বৈষ্ণব উপাদান, সংকীর্তন, খোল, করতাল, শঙখধ্বনিও। এক পর্যায়ে ব্রহ্মসংগীতে সহজিয়া ধারাও দেখা যায়। পল্লীর সহজ সুরের স্পর্শ এসে লেগেছিল ব্রহ্মসংগীতে। আদি ব্রাহ্মসমাজে মহর্ষির যুগ থেকে ঈশ্বরকে দেখা হয়েছে পিতার মতো, কিন্তু নববিধান পর্বে কেশব সেনের যুগে ঈশ্বরকে কল্পনা করা হয়েছে মায়ের মতোন। বুলবুল ইসলামের পরিবেশনায় ব্রহ্মসংগীতের বিবর্তনের একটা চিত্রও উঠে আসে। তবে ব্রহ্মসংগীত পরিপূর্ণতা পায় রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। হজরত মোহাম্মদের জন্মদিনে শান্তিনিকেতনের প্রার্থনাঘরে গাওয়া হতো ‘কোন আলোকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো,’ গৌতমবুদ্ধকে স্মরণ করে গাওয়া হতো ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী,’ যিশুকে স্মরণ করে ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে,’ শিখ ধর্মগুরু নানকের জন্মদিনে শোনা যেত ‘গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে।’ রাজীব বলেন, “রবীন্দ্রনাথ অনেকভাবে আমাদের চারপাশের দেয়াল ভেঙে দিয়েছেন। ধর্মসংগীতকে তথাকথিত ধর্মের বাইরে বের করে একটা বৃহত্তর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে রবীন্দ্রনাথই পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম আধুনিক গান লিখেছেন। তাকে আমরা রবীন্দ্রসংগীত বলি বা যা-ই বলি, প্রথম আধুনিক গান রবীন্দ্রনাথের, সে কথার দিক থেকে হোক বা সুরের দিক থেকে। তেমনি আরো অনেক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এই কাজটি করেছেন।

“সুখেন্দু গোস্বামী একসময় সুবিনয়কে নিয়ে যান সুবিনয়ের শেষ গুরু গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে। গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে নিয়ে গিয়ে সুখেন্দু সুবিনয়কে বলেছিলেন, তুমি বলবে না যে তুমি গান জানো। শুধু ব’লো যে গান শিখতে চাও। সুবিনয় গান জানে কিনা গিরিজাশঙ্কর জানতে চাইলে সুবিনয় ‘না’ বলেন। কিন্তু শেখাতে গিয়ে গিরিজাশঙ্কর দেখেন, এ তো গান না-করা গলা নয়, এ তো গানের গলা! ছেলে তো মিথ্যে বলেছে! তখন বাধ্য হয়ে সুবিনয় স্বীকার করেন, গান তিনি করেন, রবীন্দ্রনাথের গান করেন। সেটিই তাঁর জীবনের প্রধান উপাস্য। তখন গিরিজাশঙ্কর নিয়ম করেছিলেন, প্রতিদিন গান শিখতে গেলে সুবিনয়ের তাঁকে প্রথমে দুটো রবীন্দ্রসংগীত শোনাতে হবে। ঐ গান শুনে তারপর তিনি শেখাবেন। কাজেই গিরিজাশঙ্করকে রবীন্দ্রনাথের গানের দিকে টেনে আনার কৃতিত্ব সুবিনয়ের।” এ পর্যায়ে অসামান্য গায়ক গিরিজাশঙ্করের কণ্ঠে ‘ভুলো না মন তারে’ বাজিয়ে শোনানো হয়। এরপর শোনানো হয় সুবিনয়ের গানের নমুনা। তিনি আড়ানা রাগে একটা ধ্রুপদ গেয়ে তারপরে ‘বাণী তব ধায়’ গেয়ে শোনাচ্ছেন। সুবিনয়ের কণ্ঠে এ ধরনের কম্বিনেশন বিরল। সুভাষ চৌধুরীর নেওয়া সুবিনয়ের সাক্ষাৎকারের কিছু অংশও গানগুলোর আগে শোনানো হয়। সাক্ষাৎকার অংশে- রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষায় রাগসংগীতের শিক্ষা অপরিহার্য কিনা, রবীন্দ্রগায়কিতে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতের সংযত পরিমিত ও পরিমার্জিত প্রয়োগ, হিন্দুস্থানি সংগীতের আঙ্গিক অক্ষুণ্ণ রেখে যথাসম্ভব হিন্দুস্থানিয়ানাকে বাঙালিয়ানায় রূপান্তর, বাংলা গানের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাংলা গানে অলংকরণ বিশেষ করে গমকের প্রয়োগকৌশলের ভিন্নতা ইত্যাদি বিষয়ে সুবিনয় বলেন ও দুটো গান গেয়ে বোঝান। “এই আলোচনা শিক্ষার্থীদের পক্ষে খুব জরুরি এবং সেটি সুবিনয়ের মুখ থেকে শোনা এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা।”

“সুবিনয়ের গুরুদের সম্পর্কে সুবিনয়ের বক্তব্য কী, তা জেনে নেওয়া যাক। অধ্যক্ষ সমরেশ চৌধুরী সম্পর্কে সুবিনয় বলেন, ‘ওঁর গানের শান্ত মার্জিত রুচিশীল ভঙ্গি আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করত। ওঁর গান একেবারে মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যেন ওঁর গায়নভঙ্গি আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল।’ এই বিশেষ গুণগুলো আমরা সুবিনয়ের মধ্যেও পরে দেখতে পাই। ইন্দিরা দেবী সম্পর্কে সুবিনয় রায় বলেন, ‘এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ওঁর কাছে গানের তালিম যেমন পেয়েছি তেমনই পেয়েছি স্নেহ, প্রশ্রয় আর ঠিক উপদেশ। উনিই আমাকে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের যে সব গানে রাগরাগিণীর বেশ স্পষ্ট ছাপ আছে সেগুলির চর্চা বেশি করে কোরো। আর সত্যি কথা বলতে কী, পরবর্তী জীবনে দেখেছি আমার কণ্ঠে ওই ধরনের গানই শ্রোতারা বেশি শুনতে চেয়েছেন।’ সুবিনয় ধ্রুপদ ধামার বা তথাকথিত উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রভাববিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত যে বেশি গেয়েছেন সারাজীবন তার একটা কারণ ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী? তিনিই সুবিনয়কে এ ধরনের গান গাইতে বলেছিলেন। কাজেই সুবিনয়ের গড়ে ওঠার পেছনের বিষয়টা এই কথাগুলোর মধ্যে ধরা রয়েছে। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের কাছেও সুবিনয় গান শিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শেখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটা গেরুয়া রঙের জোব্বা পরে প্রথম যে দিন এলেন রবীন্দ্রনাথ আমি মোহিত হয়ে যাই। বড় বড় চোখ, দুধে আলতায় রঙ আর কী স্নিগ্ধ ব্যবহার। এক একদিন গান লিখতেন আর নিজেই সুর করে শেখাতেন। এখনও মনে আছে, তিনি শিখিয়েছিলেন, মন যে কেমন করে হল দিশেহারা, সঘন গহন রাত্রি, ওগো সাঁওতালি ছেলে, আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে ইত্যাদি ১৬টি গান।’ ১৬টি গান সুবিনয় রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখেছেন। কাজেই রবীন্দ্রসংগীতের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি তিনি হবেন না কেন! তিনি রবীন্দ্রসংগীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।

“সুবিনয় বহু ছাত্রছাত্রীকে শিখিয়েছেন। শেখাতেই তিনি ভালোবাসতেন মূলত। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিখ্যাত বহু মানুষ আছেন। কিন্তু সবথেকে বিখ্যাত একটি নাম আছে, যেটি আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। তিনি হচ্ছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। ২৫ বছরের সুবিনয়ের কাছে গান শিখতে এসেছিলেন তিনি এবং সুবিনয়ের কাছে শিখে ৪টি গান রেকর্ড করেছিলেন। গানগুলো হচ্ছে- তিমির অবগুণ্ঠনে, খরবায়ু বয় বেগে, আঁধার অম্বরে ও নাই নাই ভয়। এটি একটি ঐতিহাসিক তথ্য এবং এই ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সুবিনয়ের তখন মাত্র ২৫ বছর, আর পঙ্কজ কুমার মল্লিক তখন রবীন্দ্রসংগীতের অবিসংবাদী শিল্পী। শুধু রবীন্দ্রসংগীতেই না, বাংলা হিন্দি দুই জগতেই তাঁর অবাধ গতায়াত। সেইরকম একজন মানুষকে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণ গান শেখাচ্ছেন? এখানেই বোঝা যায় সুবিনয়ের গুরুত্বটা, তাঁর জায়গাটা। সুকিয়া স্ট্রিটে ডাঃ শিবপদ ভট্টাচার্যের বাড়িতে পঙ্কজ মল্লিক শিখতে যেতেন সুবিনয়ের কাছে। পরবর্তীকালে সুবিনয় রায়ের ৭০ বছরের জন্মোৎসবে কয়েকজনের স্মৃতিচারণেও এই বাড়ির কথা এসেছে। তাঁরা বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন সুবিনয় রায়ের শেখানোর সময়ের গান শুনবেন বলে। সুবিনয় রায় বাইরে গাইতেন না কোথাও।”
সুবিনয় রায়ের কর্মজীবন সম্পর্কে রাজীব বলেন, “সুবিনয়, শুভ গুহঠাকুরতা ও সুজিতরঞ্জন রায়ের উদযোগে প্রতিষ্ঠিত গীতবিতানে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৪১ এ। অনাদিকুমার দস্তিদার তাঁকে বলেছিলেন সেখানে গান শেখাতে। তারপর শিক্ষকতা করেছেন সুবিনয় সংগীত ভবনে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী তাঁকে সেখানে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী, সংগীত ভবনে শিক্ষকতার সময়কার সুবিনয় রায়ের ছবি এঁকেছেন- ‘১৯৪৪ সালে শান্তিনিকেতনে দেখতাম এক সুপুরুষ গৌরাঙ্গ ভদ্রলোককে। শান্তিনিকেতনে তিনি মনা বা মনাদা নামে জনপ্রিয় ছিলেন।’ মনা সুবিনয় রায়ের সেই সময়ের ডাক নাম। তারপরে প্রেসিডেন্সির স্ট্যাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে চাকরি শুরু করেন সুবিনয় ১৯৪৫ সালে। তখনো ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট তৈরি হয়নি, যেই ইন্সটিটিউটে তিনি তাঁর পরের কর্মজীবন সমাপ্ত করেন। সেটি তৈরি হয়েছিল ১৯৫৩ তে। তৈরি হওয়ার পরে তিনি সেখানে চলে যান ঐ বছরেই। তার আগে প্রেসিডেন্সি কলেজের স্ট্যাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ছিলেন? প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ সেইসময় প্রেসিডেন্সিতে পড়াতেন। কাজেই এই যোগটাও আমরা বুঝতে পারি, কেন তিনি ওখান থেকে পরবর্তীতে স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটে গেলেন। তবে তার আগে তিনি একটি কাজ করে ফেলেছেন, যেই কথাটি আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। সুবিনয় গ্রন্থাগার বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছিলেন লন্ডন থেকে। সেটি তাঁর ছোটো ছেলে যখন হয়, ১৯৫২ সালে। সেই কাজটিও করেছেন তিনি এতকিছুর মধ্যে। এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ যে, শুধুমাত্র সংগীত নয়, সংগীতের চর্চা প্রচার প্রসার শিক্ষকতা নয়, তার সঙ্গে বিদ্যানুরাগও সবসময় তাঁর মধ্যে ছিল।”

এ পর্যায়ে রাজীব সুবিনয় প্রসঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, পাঠশালার এ আসরের জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু উপকরণ রাজীব চক্রবর্তীর বন্ধু সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন অধ্যাপক অভিমন্যু দেবের সৌজন্যে পাওয়া। অভিমন্যুর বাবা প্রদীপ দেব নানা সময়ে সুবিনয় রায়ের খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। রাজীব বলেন, “প্রদীপ দেবের কাছ থেকেই শোনা, সুবিনয় স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটে চাকরি করার সময় প্রত্যেক সপ্তাহান্তে আসানসোল যেতেন গান শেখাতে। দুদিন সেখানে গান শিখিয়ে সোজা আসতেন স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটে। সারাদিন অফিস করে তবেই তিনি বাড়ি ফিরতেন। গান শেখানোর প্রতি এই হচ্ছে তাঁর আগ্রহ, এই হচ্ছে তাঁর কমিটমেন্ট। সুবিনয় রায় ১৯৮১ সালে আমেরিকা যান, প্রদীপ দেবের উদযোগে। আমেরিকার বোস্টনে ১৫ই আগস্ট প্রথম অনুষ্ঠান হয়। সুবিনয় সেই অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন একটা অন্যরকমের গান দিয়ে। সুবিনয় রায়ের কণ্ঠে আমরা যে ধরনের গান শুনতে অভ্যস্ত সেরকম নয় গানটি। এ গানও বাজারে আসেনি কখনো।” এ পর্যায়ে সুবিনয়ের কণ্ঠে সেই গানটি — স্বদেশ পর্যায়ের রবীন্দ্রসংগীত ‘জননীর দ্বারে আজি ঐ শুন গো শঙখ বাজে’ লাইভ রেকর্ডিং থেকে বাজিয়ে শোনানো হয়।

বুলবুল ইসলাম এ পর্যায়ে গেয়ে শোনান ‘শ্রাবণের পবনে আকুল বিষন্ন সন্ধ্যায়’ ও ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে।’ ‘শ্রাবণের পবনে’ গানটির রচনাকাল ১৯৩৭ সাল, রবীন্দ্রনাথের ৭৬ বছর বয়সের রচনা। গীতবিতানের প্রেম পর্যায় প্রেমবৈচিত্র্য উপপর্যায়ের কেদার রাগে এই গানটির স্বরলিপিকার শৈলজারঞ্জন মজুমদার। তবে গানটি প্রেম পর্যায়ের হলেও এটি প্রথম গাওয়া হয় বর্ষামঙ্গলে। গানটি রচিতও ১৫-৩০ শ্রাবণের মধ্যে। গানটি নিয়ে রাজ্যেশ্বর মিত্র লিখেছেন, ‘ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সুগভীর শ্রদ্ধা ছিল। স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী এবং আভোগ — এই চারটি কলিতে যে গানের একটি সম্পূর্ণ রূপ প্রকাশ পায় সেটি তাঁর মতো খুব কম সুরকারই উপলব্ধি করেছেন। তাঁর আধুনিককালের কয়েকটি আধুনিক রীতিতে রচিত গানেও এই ঐতিহ্য সুরক্ষিত হয়েছে। শ্রাবণের পবনে আকুল — গানটি সবদিক দিয়ে আধুনিক, কিন্তু এর সংগঠনরীতি সম্পূর্ণ ধ্রুপদী ঢঙের। এইরকম এক একটি গানে ঐতিহ্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায়।’ বুলবুল ইসলামের গাওয়া ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’র রচনাকাল ১৯০৯ সাল, কবির ৪৮ বছর বয়সের লেখা। শান্তিনিকেতনে রচিত গীতাঞ্জলির অন্তর্ভুক্ত প্রকৃতি পর্যায়ের মিশ্র সাহানা রাগে বর্ষার এ গানটির স্বরলিপিকার হিসেবে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভীমরাও শাস্ত্রী, এ. এ. বাকে ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম পাওয়া যায়। শঙ্খ ঘোষ গানটি নিয়ে লিখেছেন, “ ‘তোমারি আশ্বাসে।’ তুমি, তুমি। কে এই ‘তুমি?’ এই গানটি যে প্রকৃতি-পর্যায়ে সাজানো আছে গীতবিতানে, এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বিব্রত ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ কীভাবে অতীন্দ্রিয় ইঙ্গিতে ক্ষান্ত থাকবে? কেন বা তাকে বলা হবে না প্রেমেরই গান? যার দেখা না পেয়ে এই বাদলবেলা কাটতে চায় না, প্রতীক্ষায় একা দুয়ারের পাশে বসিয়ে রেখেছে যে, সে কি প্রেমিক অথবা প্রেমিকাই নয়? এর কোনো কথাই নিশ্চিত করে বলবার উপায় নেই, এই ‘তুমি’ এক আশ্চর্য সর্বনাম, আক্ষরিক অর্থেই ‘সর্বনাম’ সে। … রিল্?কের এক কবিতা বিষয়ে বুদ্ধদেব বলেছিলেন যে একে ‘একাধারে এক মর্ত্যমানবী ও ভগবানের উদ্দেশে রচিত বলে মেনে নিতে আমরা সানন্দে সম্মত।’ ঠিক, কিন্তু আমার মনে হয় এ তার চেয়েও বেশি একটু, এ এমন অনতিবিভাজিত স্তর যেখানে মানবী আর ঈশ্বরের সঙ্গেই মিলে আছে আরো-এক সত্তা: আত্মসত্তা। কখন যে এই তিন মিলে গিয়ে এক হয়ে যায়, আর কখন এর একটি সঞ্চারিত হয়ে চলে আসে অন্যটিতে, তা জানে না কেউ। আর এই মহিমান্বিত অগোচরকেই আভাসে আমাদের সামনে তুলে ধরে গানের সুর।”

রাজীব বলেন, “বুলবুল ইসলামের গান শুনেই মনে হলো, সুবিনয়ই বোধহয় প্রথম প্রমান করেছেন যে, ব্যাকরণ এবং সৌন্দর্য একসঙ্গে যেতে পারে। নিয়মের মধ্যে থেকেও যে সুন্দর সৃষ্টিশীল হওয়া যায় সেটি সুবিনয় প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। সুবিনয়ের গাওয়া গান শুনলেই সেটি বোঝা যায়। যে গানই তিনি ধরেছেন, সে গানেই তিনি অনবদ্য। ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’তে সুবিনয় গুরুর কাছে শেখার প্রসঙ্গটি বারবার এনেছেন। গুরুর কাছ থেকে শিখতে হবে পরম্পরা। স্বরলিপি ছাপানো থাকে। সেটি দেখে অনেকেই গান তুলে নিতে পারেন। কিন্তু তাতে গান হয় না, তাতে প্রাণ আসে না। সুবিনয় রায় একদিকে ব্যাকরণসিদ্ধভাবে গান গাওয়ার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি বলেছেন এতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার কথা এবং একইসঙ্গে আরো কিছু বিষয়ের কথাও তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।” ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’র দ্বিতীয় অধ্যায়ে রবীন্দ্রসংগীতের গায়কি শিরোনামে সুবিনয় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীতের সম্যক অনুভূতি ও বিশুদ্ধ গায়কির সাধনায় মোটামুটিভাবে- উপযুক্ত কণ্ঠস্বর, অলংকারাদির যথাযথ মার্জিত ও সংযত ব্যবহার, শ্রুতিচেতনা, সুষ্ঠু উচ্চারণভঙ্গি, শ্বাসনিয়ন্ত্রণ, সাধারণ শিক্ষাদীক্ষা, রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ও রবীন্দ্রসংস্কৃতির পরিবেশ – এই কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রসংগীতের সাধনায় রবীন্দ্রনাথের কাব্য নাট্য প্রবন্ধ চিত্র প্রভৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়, রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান ও উপলব্ধি বা অনুভূতি প্রত্যেক শিক্ষার্থী ও শিল্পীর পক্ষে অপরিহার্য। রবীন্দ্রনাথের গানকে এগুলো থেকে আলাদা করে দেখলে চলবে না। কবি গানের মধ্যে দিয়েই তাঁর জীবনের অধিকাংশ বক্তব্য বলে গিয়েছেন। সেগুলিকে বুঝতে গেলে, উপলব্ধি করতে গেলে তাঁর বহুমূখী প্রতিভার নিদর্শনস্বরূপ তাঁর সাহিত্যরচনার, আধ্যাত্মসাধনার ও শিল্পসৃষ্টির বিরাট ক্ষেত্রকে আমাদের চিনতে হবে। তবেই আমরা রবীন্দ্রসংগীতের কাব্যাংশের অন্তরগভীরে প্রবেশ করতে পারব এবং প্রত্যেকটি গানের অন্তর্নিহিত মর্মবাণী সম্যক উপলব্ধি করে তা সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারব। রবীন্দ্রসংগীতের সাধনায় সাধারণ শিক্ষাদীক্ষা, মার্জিত রুচি, রবীন্দ্রনাথের গল্প, প্রবন্ধ, কাব্য, নাট্য, চিত্র প্রভৃতির সঙ্গে পরিচয় এবং তাঁর জীবনদর্শন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা ও অনুভূতি অপরিহার্য।’ এ পর্যায়ে এই লেখাগুলো টেম্পলেট হিসেবে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় ও পাঠ করে শোনানো হয়।
রাজীব বলেন, “সুবিনয় রায় গানের স্বরলিপির প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। স্বরলিপির ব্যাপারে তিনি কড়া ছিলেন। কিন্তু সেই কাঠিন্যের সঙ্গে নিষ্ঠা জড়িয়ে আছে। ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’য় তিনি বলছেন, ‘এস্রাজ বা দিলরুবার মতো যন্ত্র দিয়ে গান গাইলে অনেক বেশি সুর নিখুঁত লাগে।’ সেটা তো আমরা জানিই যে, সুরের যন্ত্র হিসেবে হারমোনিয়ামের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এস্রাজ বা দিলরুবার মতো ছড়ির যন্ত্রগুলিতে অনেক বেশি নিখুঁত সুর লাগে। কিন্তু তার সঙ্গেও তিনি বলছেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর রবীন্দ্রসংগীতে হারমোনিয়াম ব্যবহার নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। বইটিতে সুরযন্ত্র ও তালযন্ত্রের ব্যাপারে সুবিনয় রায়ের খুব উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। সেই দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিচয় ধরা আছে একটা ঘটনায়, যেটা হয়ত আমরা অনেকেই জানি না। সুবিনয়ের গাওয়া ‘এ কী সুধারস আনে’ গানের সঙ্গে যন্ত্রশিল্পী ছিলেন ভি বালসারা, ওয়াই এস মুলকী, সমির খাসনবিশ, খোকন মুখার্জি। এতে বোঝা যায়, তাঁর কাছে কোন্ যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গানের ভাবের সঙ্গে সেটি সংগতিপূর্ণ কিনা। এটি সুবিনয়ের উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। আমরা তাঁকে কঠোর কঠিন ঠ্যাঙ্গারে মাস্টার হিসেবে দেখছি না, তাঁর একটা উদার জায়গা আছে। সংগীতের রসের জায়গাটা তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন। তাঁর যেইটুকু কাঠিন্য সেটুকু শিল্পটাকে রক্ষা করার জন্য।” ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’র যন্ত্রসংগীত সহযোগিতা শিরোনামে তৃতীয় অধ্যায়ে সুরযন্ত্র ও তালযন্ত্র প্রসঙ্গে সুবিনয় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রসংগীত সহযোগিতা খুব সংযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। শিল্পীর কণ্ঠে কথার উচ্চারণ ও সুরের অলংকরণ-সূক্ষ্ণতা যন্ত্রসংগীতের আধিক্যে বা আওয়াজের প্রবলতায় যেন কখনও ম্লান না-হয়ে যায়। যন্ত্র সংগীতশিল্পীকে সহযোগিতা করবে, তাঁকে অতিক্রম করবে না — এইরকম ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। রবীন্দ্রসংগীতে বা কাব্যধর্মী বাংলা গানে সংগতের আদর্শ ভিন্ন ধরনের। এ ক্ষেত্রে তালযন্ত্র বাজানো উচিত এমন একটি পদ্ধতি অনুসারে, যাতে গানের পরিবেশটি সামগ্রিকভাবে সংযত অথচ শ্রæতিমধুর হয়ে ওঠে। তালযন্ত্রে ঠেকাও বাজবে; শাস্ত্রমতে তালের হিসাব ঠিকই মিলবে। কিন্তু তা সত্তে¡ও গানের কথার বাচন, সুরের ও অলংকারাদির সূক্ষ্ণতা এগুলিই তালযন্ত্রের আওয়াজ ছাপিয়ে শ্রোতার কানে অধিকতর শ্রুতিগোচর হওয়া চাই। ঠেকার আওয়াজ প্রছন্নভাবে তালের বা ছন্দের কেবলমাত্র একটি পটভূমিকার অবতারণা করবে।’ এ পর্যায়ে এই লেখাটি টেম্পলেট হিসেবে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় ও পাঠ করে শোনানো হয়।

রাজীব বলেন, “সুবিনয় রায়ের একটা বড়ো ব্যাপার তালের জায়গা। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট বেশ কয়েকটি তালের বোল তিনি নিজে তৈরি করেছেন। এটি রবীন্দ্রসংগীতে সুবিনয় রায়ের একটি বড়ো অবদান। এবং তিনি তবলার জন্য, পাখোয়াজের জন্য আলাদা আলাদা করে বোল তৈরি করেছেন। সেটি ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’র তাল নিয়ে যেখানে আলোচনা আছে সেখানে আমরা দেখতে পাই। শিক্ষকসত্তার প্রাবল্যের কারণে বারে বারে তিনি উত্তরসূরীর জন্য একটা পথ তৈরি করে দিয়েছেন। শুধু তালের কথা বলেননি, তালের বোলটাও তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। এতে তাঁর শিক্ষকসত্তার পরিচয় প্রকাশ পায়।”

“শিক্ষক সুবিনয় কেমন ছিলেন? ‘প্রসঙ্গ সুবিনয় রায়’ বলে সুবিনয় রায়ের ৮৮তম জন্মদিনে একটি ছোটো পুস্তিকা বের হয়। সেখানে তাঁর বেশকিছু শিষ্যশিষ্যা তাঁদের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। তাতে একজন লিখছেন, ‘শিক্ষক হিসেবে সুবিনয়দা ছিলেন অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড। দেরি করে ক্লাসে এলে বকাবকি করতেন খুব। প্রায় একঘণ্টা ক্লাস নিতেন। স্বর লাগানোর ব্যাপারে, শুদ্ধতার প্রতি উনি খুবই যত্নবান এবং খুঁতখুঁতে ছিলেন। টপ্পাঙ্গের গান তুলতে অসুবিধে হলে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সাহায্য করতেন। কেউ ভালো গান গাইলে সঙ্গে সঙ্গে তারিফও করতেন। ক্লাসের বাইরে তিনি আত্মীয়ের মতোই মিশতেন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সদস্য আমার স্বামী প্রয়াত হলে সুবিনয় দা উপস্থিত থেকে যে সান্ত¡না দিয়েছিলেন তা আমাকে সেই শোকাবস্থা সামলাতে যথেষ্ট মনোবল দিয়েছিল।’ অর্থাৎ একইসঙ্গে কঠোর মাস্টারমশাই যেমন, তেমনি একজন হৃদয়বান মানুষও বটেন তিনি। তাঁরই পুত্র সুরঞ্জন রায়ের একটি লেখায় পড়েছিলাম, বাবা নাকি তাঁদের সবাইকে গান দিতেন। দিতেন মানে সেটা আবার ফেরত নিতেন। অর্থাৎ গান শিখিয়ে সেটা পরদিন আবার যথাযথভাবে ফেরত নেবেন। তার মানে শুধুমাত্র গান শিখিয়ে খালাস হয়ে যাওয়া নয়, দায়িত্ব শেষ নয়, আবার সেটাকে যথাযথভাবে শিখছে কিনা এই কমিটমেন্টটা ছিল সুবিনয় রায়ের। সুবিনয় সম্পর্কে বলার বিষয় হচ্ছে এটাই। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে খুব বেশি মানুষ এই কাজটি করেননি আজও।”
এ পর্যায়ে বুলবুল ইসলাম গেয়ে শোনান- গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে। এই ব্রহ্মসংগীতটির রচনাকাল ১৯০৩ সাল, কবির ৪১ বছর বয়সের রচনা। পূজা পর্যায়ের অন্তর্মুখে উপপর্যায়ের পরজ রাগে এ গানটির স্বরলিপিকার কাঙালীচরণ সেন। এটি ১৩০৯ বঙ্গাব্দে কোলকাতায় আদি ব্রাহ্ম সমাজের মাঘোৎসবে গীত। গানটি রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট আটমাত্রার তাল রূপকড়ায় গাওয়া হয়। উল্লেখ্য, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্রæপদ ও খেয়াল ভেঙে গান রচনা করলেও, সঙ্গীত গবেষকরা মনে করেন, ভাঙা গানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নিজেও গান করতে পারতেন। সেকালের একটি জনপ্রিয় সাদরা ছিল শ্যামাশাম রচিত ‘যমুনা তেরা বুখা।’ এই গানটি অবলম্বনে সত্যেন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন- ‘কে রচে এমন সুন্দর।’ এই পরজের চলনটি ছিল বিষ্ণুপুর ঘরানার। সত্যেন্দ্রনাথের এই গানে বিষ্ণুপুরী ঘরানার পরজের ছায়া পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে সত্যেন্দ্রনাথের এই গানের সুরে দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী রচনা করেছিলেন- ‘দীন দয়াময় দীনজনে দেখা দাও।’ এই সুরের আদলেই, ১৩০৯ বঙ্গাব্দের মাঘোৎসব উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন- ‘গভীর রজনী রজনী নামিল হৃদয়ে।’
এ পর্যায়ে সুবিনয় রায়ের কয়েকটি স্থিরচিত্র দেখানো হয়। এর মধ্যে যথাক্রমে আছে- শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সুবিনয় রায়; মেসো রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মাসি সুধাময়ী দেবীর সঙ্গে সুবিনয় রায়; স্ত্রী ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে সুবিনয় রায়; সুবিনয় রায়, স্ত্রী ইন্দিরা দেবী, দুই পুত্র — সুরজিৎ ও সুরঞ্জন রায়; হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে’র সঙ্গে সুবিনয় রায়; শান্তিদেব ঘোষ, তাঁর স্ত্রী হাসি ও স্ত্রী ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে সুবিনয় রায়; সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সস্ত্রীক সুবিনয় রায়; কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে এস্রাজ সঙ্গতকালে সুবিনয় রায়। রাজীব বলেন, “সুরঞ্জন রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, সুবিনয় রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুরজিতের মৃত্যু হয় সুবিনয় রায়ের বেঁচে থাকা অবস্থায়।
সুরজিতের মৃতদেহ যখন সৎকারের জন্য যায় সেখানে দাঁড়িয়ে সুবিনয় নাকি বলেছিলেন, ছেলেকে একটা গান শুনিয়ে তিনি পাঠাতে চান শেষযাত্রায়। দুটি গান পরপর গাওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় গান হয়ে যাবার পর বলেছিলেন সুবিনয়, আগেরটির স্কেল ঠিক ছিল না। এটি কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। এটি অন্য এক ধরনের মানুষের পরিচয় বহন করে।”
এ পর্যায়ে সুবিনয় রায়ের জীবনে প্রাপ্ত পুরষ্কার ও সম্মাননার কথা উল্লেখ করেন রাজীব। এর মধ্যে রয়েছে- ১৯৭২ সালে কৃষ্ণচন্দ্র দে পুরষ্কার, ১৯৮৭ সালে রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্রের রবীন্দ্রতত্ত¡াচার্য, ১৯৯০ সালে দক্ষিণীর শুভগুহঠাকুরতা স্মৃতি পুরষ্কার, ১৯৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত অকাদেমির সংগীত নাটক অকাদেমি পুরষ্কার, ১৯৯৬ সালে পাটনার রবীন্দ্র পরিষদের রবীন্দ্র পুরষ্কার, ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, ২০০০ সালে এইচএমভির গোল্ড ডিস্ক, ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগের আলাউদ্দিন পুরষ্কার ইত্যাদি। রাজীব বলেন, “বিভিন্ন পুরষ্কারে সুবিনয় ভূষিত হয়েছেন। এখানে দেখার বিষয়, ১৯৬১ তে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের পর থেকে তিনি তবুও কিছুটা পাবলিক ডোমেইনে আসতে শুরু করলেন। তার আগে অব্দি তিনি মূলত শিক্ষকতার কাজেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। অন্য কিছুতেই তিনি যাননি। ১৯৭২ এ প্রথম পুরষ্কার পান তিনি। তখন তাঁর ৫০ বছর বয়স। অর্থাৎ ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁকে পুরষ্কার পাবার জন্য, সুবিনয় রায়ের মতো একজন মানুষকে! পরে একসময় অবশ্য বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তমও পেয়েছেন তিনি।”

“সুবিনয়ের একটা মূল্যায়ন করা যাক। তিনি যে ঠিক কী করেছেন সেটি রবীন্দ্রনাথের কথা উদ্ধৃত করেই বলতে হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘অলংকার জিনিসটাই চরমের প্রতিরূপ। মা শিশুর মধ্যে পান রসবোধের চরমতা- তাঁর সেই একান্ত বোধটিকে সাজে সজ্জাতেই শিশুর দেহে অনুপ্রকাশিত করে দেন। ভৃত্যকে দেখি প্রয়োজনের বাঁধা সীমানায়, বাঁধা বেতনেই তার মূল্য শোধ হয়। বন্ধুকে দেখি অসীমে, তাই আপনি জেগে ওঠে ভাষার অলংকার, কণ্ঠের সুরে অলংকার, হাসিতে অলংকার, ব্যবহারে অলংকার। সাহিত্যে এই বন্ধুর কথা অলংকৃত বাণীতে। সেই বাণীর সংকেত-ঝংকারে বাজতে থাকে অলম — অর্থাৎ ব্যাস আর কাজ নেই। এই অলংকৃত বাক্যই হচ্ছে রসাত্মক বাক্য।’ অলংকরণটা আসলে একটা সীমায়িত পরিসরের মধ্যেই ভালো। তার থেকে বেশি হলে অলংকার আর অলংকার থাকে না। অলং মানে হচ্ছে, ব্যাস, আর নয়। এরচে বেশি হলে অধিকতর অলংকরণে রসের ঘাটতি ঘটে। সুবিনয় এই কথাটুকু জানতেন এবং সারাজীবন পরিমিতি মেনে চলেছেন সর্বক্ষেত্রে।

“সুবিনয় কি শুধু রবীন্দ্রসংগীতই গেয়েছেন? আমরা তো তাই জানি। রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে অন্য কোনো গান তিনি সাধারণত গাননি বা গাইতে আমরা শুনিনি। রেডিওতে তাঁকে একবার শচীন দেব বর্মনের গান গাইতে হয়েছিল। তিনি মাঝেসাঝে শচীন দেবের গান গাইতেন। অভিরূপ গুহঠাকুরতা লিখছেন- ‘গানের ক্লাসের বাইরে সুবিনয় দার সঙ্গে আমার একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল? বন্ধুত্বও বলা যায়। অনেক গানের গল্প শুনেছি। শুনেছি ওঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা। সুবিনয় দা সবরকম গান জানতেন। এবং এ ব্যাপারে ওঁর কোনও গোঁড়ামি ছিল না। একবার বললেন, চলো তোমার বাড়িতে একটা আড্ডা করো। খাওয়াদাওয়া হবে এবং তোমার শচীন কর্তার গান শুনব। ব্যবস্থা করলাম? শুধু সুবিনয় দা আর আমি, আমার স্ত্রী রিনা। আমি গোটা দশ বারো কর্তার গান গাইলাম। এরপর সুবিনয় দা নিজে থেকে হারমোনিয়াম টেনে নিলেন এবং ধরলেন শচীন কর্তার গান। গোটা আট দশটা গান গাইলেন। আমি তার আগে একটাও শুনিনি। অনবদ্য সেই অভিজ্ঞতা। আগে জানলে টেপ করে রাখতাম।’ ” এ পর্যায়ে সুবিনয় রায়ের কণ্ঠে সুরসাগর হিমাংশু দত্তর গান ‘মম মন্দিরে এলে কে তুমি’ ও ‘নতুন ফাগুনে যবে’ বাজিয়ে শোনানো হয়। গান দুটোর সঙ্গে সুভাষ চৌধুরীর নেওয়া সুবিনয়ের সাক্ষাৎকারের প্রাসঙ্গিক আলাপচারিতাও শোনানো হয়।

এরপর বুলবুল ইসলাম গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান —‘তামায় আমায় মিলন হবে বলে।’ শান্তিনিকেতনে রচিত গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের বন্ধু উপপর্যায়ের এ গানটির রচনাকাল ১৯১৩ সাল, কবির ৫২ বছর বয়সের রচনা। এ গানের স্বরলিপিকার ইন্দিরা দেবী ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। গানটি মাঘোৎসবে গীত। ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’য় সুবিনয় রায় লিখেছেন, “ ‘ঢালা গান’, ‘তাল ছাড়া’ বা ‘ঢালা লয়ে’ গান বলতে বোঝায় রবীন্দ্রনাথের সেই গানগুলিকে, যা কোনও তালে না বেঁধে আলাপের ঢঙে নির্দিষ্ট সুরে গেয়ে যাওয়া হয়। এই ঢালা গানের পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের গান পাওয়া যায়; তার মধ্যে টপ্পার আদর্শে রচিত কবির নিজস্ব বা স্বকীয় অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ধরনের গানগুলিকে আমরা বলতে পারি ‘রবীন্দ্র-টপ্পা।’ রবীন্দ্র-টপ্পা -হিন্দুস্থানি গায়নপদ্ধতির প্রভাবমুক্ত রবীন্দ্রস্বকীয়তায় পরিপূর্ণ ‘তাল ছাড়া’ টপ্পার অলংকারসমৃদ্ধ রচনাকে ‘রবীন্দ্র-টপ্পা’ বলা চলে। ‘টপ্পার’ ‘দানাযুক্ত’ জটিল তান, বোলতান ও বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বরসমাবেশ এইসব গানে খুব ব্যাপকভাবেই স্থান পেয়েছে; কিন্তু তা সত্তে¡ও গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত শুনলে বেশ বোঝা যায় যে, এগুলি কবির ভাবাবেগসিক্ত এক অপূর্ব শিল্পসৃষ্টি। হিন্দুস্থানি সংগীতের কোনও বিশেষ শাখার ছায়া বা প্রভাব এতে পাওয়া যায় না।

রবীন্দ্র-গায়কি বলতে যা বোঝায়, এই গানগুলিতে তা শতকরা ৯৯ ভাগ বর্তমান।” এমনই একটি গান হচ্ছে — অন্ধজনে দেহ আলো। ভৈরবী রাগে পূজা পর্যায়ের পার্থনা উপপর্যায়ের এই রবীন্দ্র-টপ্পার রচনাকাল ১৮৮৫ সাল, কবির ২৪ বছর বয়সের রচনা। এর স্বরলিপিকার কাঙালীচরণ সেন, প্রফুল্লকুমার দাস (কবির রেকর্ড থেকে)। এই গান সম্পর্কে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ লিখেছেন, “মন যখন ক্লিষ্ট তখন কোনো কোনো সময় নিজের মনে গান করতেন। কুড়ি বছর আগে কোনো পারিবারিক ব্যাপারে কবির মন অত্যন্ত পীড়িত। … ৬ই পৌষ সন্ধ্যাবেলা শান্তিনিকেতনে গিয়ে পৌঁছেছি। কবি তখন থাকেন ছোটো একটা নূতন বাড়িতে — পরে এ বাড়ির নাম হয় ‘প্রান্তিক।’ শুধু দুখানা ছোটো ঘর। খাওয়ার পর আমাকে বললেন, তুমি এখানেই থাকবে। লেখবার টেবিল সরিয়ে আমার শোবার জায়গা হল। পাশেই কবির ঘর। মাঝে একটা দরজা, পর্দা টাঙানো। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে শুনতে পেলুম গান করছেন ‘অন্ধজনে দেহো আলো…।’ বারবার ফিরে ফিরে গান চলল, সারা রাত ধরে। ফিরে ফিরে সেই কথা, ‘অন্ধজনে দেহো আলো…।’ সকালে মন্দিরের পরে বললুম. ‘কাল তো আপনি সারারাত ঘুমোননি।’ একটু হেসে বললেন, ‘মন বড়ো পীড়িত ছিল তাই গান করছিলুম। ভোরের দিকে মন আকাশের মতোই প্রসন্ন হয়ে গেল।’” এ পর্যায়ে বুলবুল ইসলাম এ গানটি গেয়ে শোনান।

রাজীব বলেন, “ ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ প্রথম বের হয় ১৯৬২ সালে। সম্ভবত ১৯৬১ সাল থেকে যখন সুবিনয় রায় রেকর্ড করতে শুরু করলেন বা বেশি পরিমাণে রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা শুরু হলো, তখনই তিনি প্রয়োজন বোধ করলেন এমন একটি বই লেখার। তার আগে অব্দি তিনি শিখিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ৬১ সালে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা অনেকগুণ বেড়ে গেলো। সেটি হচ্ছে বইটি রচনার প্রেক্ষাপট। প্রথম সংস্করণ বের করেছিল গীতবিথী নামের একটি প্রকাশনা। সেটি ছিল তাঁর গানের স্কুল। তারাই বের করে বইটি প্রথম। তার ঠিক ১০ বছর পরে ১৯৭২ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সেটি ছাপে এ মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানি- কোলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে প্রকাশনা সংস্থাটি আর নেই। ২০২১ এর নভেম্বরে বইটির বিশেষ জন্মশতবর্ষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করে কোলকাতার সপ্তর্ষি প্রকাশনা। কিন্তু এখানে একটি কথা বলা দরকার, এটি তো জন্মশতবর্ষ প্রকাশনা, সেই প্রকাশনার প্রতি যথেষ্ট যত্ন এবং শ্রদ্ধাবোধ তেমন একটা নেই বলে মনে হয়েছে বইটি দেখে। আগের যে দুটি সংস্করণ হয়েছে সেই সম্পর্কিত কোনো তথ্য এই বইতে নেই। এই বইতে উপরন্তু বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ রয়েছে। একটা শতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে বিষয়টা খুব দুঃখের।”

গান পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুল ইসলাম সুবিনয় রায়ের গানের ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার কথাও ভাগাভাগি করে নেন শ্রোতা-দর্শকের সঙ্গে। বুলবুল বলেন, সুবিনয় রায় তাঁর সরাসরি শিক্ষক না হলেও তিনি নিজেকে সুবিনয়ের একলব্য শিষ্য বলেই মনে করেন। তিনি একসময় সুবিনয় রায়ের গান, গায়কীসহ সবটুকু আত্মস্থ করতে চেষ্টা করেছেন। গুরুদের কাছে গান শিখেছেন তিনি ঠিকই কিন্তু একইসঙ্গে সুবিনয় রায়ের গায়নপদ্ধতি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছেন। কারণ রবীন্দ্রসংগীত অনেকে করলেও সুবিনয় রায়ের গানে অন্য একটি ব্যাপার আছে যা তাঁকে আকর্ষণ করেছিল। আর যেসব গান তিনি সচরাচর শুনতে পেতেন না, সেই গানগুলোই সুবিনয়ের কণ্ঠে শোনায় আরো বেশি আকৃষ্ট হতেন সুবিনয়ের গানে। আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার, নীলিমা সেন, কণিকা মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যধন্য বুলবুল তাঁদের সঙ্গের কিছু স্মৃতির কথা বলেন। এবং বলেন স্বয়ং সুবিনয় রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ স্মৃতির কথাও।

সংগীত সংগ্রহ রাজীব চক্রবর্তীর নেশা। মূলত বাংলা গানের একটা কালানুক্রমিক ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করা তাঁর লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে তিনি কাজ করে চলেছেন গত প্রায় বিশ বছর যাবৎ। সে কাজ করতে গিয়ে অনুভব করেছেন গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা। তাঁর সংগ্রহে আছে দশ হাজারেরও বেশি রেকর্ড।

সুবিনয় রায়ের কণ্ঠে গীত রবীন্দ্রনাথের গান বুলবুল ইসলামের অত্যন্ত সমাহিত, পরিমিত, নিয়ন্ত্রিত একইসঙ্গে স্বরলিপিসিদ্ধ পরিবেশনায় দর্শক-শ্রোতারা মুগ্ধ হন। রাজীব চক্রবর্তীর গবেষণালব্ধ ও আন্তরিক আলোচনা এবং আর্কাইভ থেকে অতি দুর্লভ বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক গানের নমুনা উপস্থাপন সবাইকে মুগ্ধ করে। দর্শক-শ্রোতা পুরোটা সময় উপভোগ করেছেন এবং মন্তব্য করে সক্রিয় থেকেছেন। ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’ সহ সামগ্রিকভাবে সুবিনয় রায়ের জীবন ও সংগীত নিয়ে আলোচক রাজীব চক্রবর্তীর আলোচনা এবং শিল্পী বুলবুল ইসলামের সংগীত পরিবেশনায়, সত্যিকার অর্থেই জন্মশতবর্ষে এক পূর্ণাঙ্গ সুবিনয় রায়কে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে কিছুটা হলেও?

সুবিনয় রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার এ আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী?