টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৩৬তম ভার্চুয়াল আসরটি মে মাসের ১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার এ আসরে, রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষা ভাবনা’ নিয়ে আলোচনা করেন আমাদের সময়ের জীবন্ত কিংবদন্তি শিক্ষাবিদ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, আমাদের সার্বিক অভিভাবক অধ্যাপক পবিত্র সরকার।

সদ্য প্রয়াত সন্তুরের যাদুকর পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার স্মরণে কবীর সুমনের লেখা আড়ানা রাগে খেয়াল বন্দিশ ‘ঝলমলে দিন গরমের তাপ ডাকে/ হঠাৎ হঠাৎ দমকা হাওয়ায় যাকে/ কে জানে সে এই উজ্জ্বলে জানে কিনা/ রাতের আড়ানা এ-বেলার ব্যালেরিনা/ Zorba the Greek সন্তুরে নেচে নেচে/ শিবকুমারকে দিয়ে গেছিলেন যেচে/ অতগুলো তারে তারে সুরগুলো স্যাঁকা/ বন্ধুর চিতা জাকির হোসেন একা’ পাঠ করে অনুষ্ঠান শুরু হয়।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনের জন্যে সার্বিকভাবে একটা মানদণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু তাঁর দ্বারা আমরা আন্দোলিত হবার বদলে বিনোদিত হতে চেয়েছি বেশি। পশ্চিমা নির্মাণ থেকে প্রাচ্যের ও বৈশ্বিক রবীন্দ্রনাথকে এবং প্রচলিত নির্মাণ থেকে নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকেও চিনে নিতে ব্যর্থ হয়েছি অনেক বিচারেই। সমাজ সংস্কারক রবীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারিনি আজও। শিক্ষা নিয়ে তাঁর যে মৌলিক ভাবনা, তা প্রয়োগ করতে পারিনি অনেক ক্ষেত্রেই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল বক্তৃতায় বলেছিলেন, “I myself had suffered when I was young through the impediments which were inflicted upon most boys while they attended school and I have had to go through the machine of education which crushes the joy and freedom of life for which children have such insatiable thirst. And my object was to give freedom and joy to children of men.” নোবেল বক্তৃতার এই ছোট্ট অংশটিতেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার অনেকটুকুর প্রতিফলন আছে।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার অপরিহার্যতা, অত্যাবশ্যক পাঠ বা শিক্ষাপুস্তকে শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ না-রাখা, শিক্ষাকে আনন্দে উন্নীত করা, শাসনের শিক্ষা বনাম আনন্দের শিক্ষা, প্রকৃতি-সংলগ্ন শিক্ষা, উপকরণবহুল শিক্ষা ও পুঁথিগত শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা, বিদ্যাদানের প্রধান মাধ্যস্থ হিসেবে ছাত্র-শিক্ষকের পরস্পরসাপেক্ষ সম্পর্ক, শিক্ষার মিলনে একাকার বনাম এক হওয়া এবং একত্রিত হওয়া বনাম মিলনের ধারণা, স্বদেশী-বিদেশী-বিশ্ববিদ্যার অবিরত যোগ, জাতিগত বিদ্যাস্বাতন্ত্র্য বনাম বিদ্যাসমবায়ের ধারণা, বিশ্ববিদ্যা সন্ধানের অভিযাত্রায় স্বদেশের বিদ্যার সমগ্রতার জ্ঞান, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের জ্ঞানের বৈষম্য দূর করতে লোকশিক্ষার প্রবাহ, আবশ্যিক শিক্ষার পাশাপাশি জনশিক্ষা ও স্বৈচ্ছিক শিক্ষার বিস্তার, পাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ছাড়াও কলেজে যাবার আগেই ঝরে-পড়া ছাত্রদের ব্যাপারে স্বাধীন শিক্ষার ধারণা, অজ্ঞতা ও স্বজাতীয় শিক্ষার অবজ্ঞা বনাম শিক্ষিত মূঢ়তা ও স্বাজাত্যাভিমানের যোগসূত্র, যান্ত্রিকতা বনাম আত্মিক বন্ধন, জ্ঞানের বৈষয়িক দিক বনাম পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের দিক, ব্যবহারিক ও পারমার্থিক শিক্ষার সমন্বয়, ভাষা স্বাতন্ত্র্যের মধ্য দিয়ে বিদ্যার সমবায়সাধন, বিশিষ্ট জ্ঞানের সঙ্গে সাধারণ জ্ঞানের নিত্য চলাচলের ভূমিকা, বিদ্যা বিদ্বানের সম্পত্তি না হয়ে সমস্ত সমাজের সম্পদ হয়ে ওঠা, শহর ও গ্রামের যোজন দূরত্বের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বনাম একইসঙ্গে বৈচিত্র্য ও ঐক্যের পরিব্যাপ্ত শিক্ষা, শিক্ষার সঙ্গে দেশের মনের সহজ মিলন, সংকীর্ণ আধুনিক শিক্ষা বনাম আধুনিক সভ্যতার সচিন্ত সচল প্রবল বৃহৎ সমগ্রতা, স্কুল কলেজের বাইরে শিক্ষা বিছিয়ে দেবার মাধ্যম সাহিত্যকে সর্বাঙ্গীণভাবে শিক্ষার আধার করে তোলা, জীবনযাত্রার সিদ্ধিলাভে শিক্ষা থেকে স্খলিত হয়ে পড়া ‘সংস্কৃতি’কে পুনঃস্থাপন, বইয়ের পাতা অতিক্রম করে শিক্ষার মধ্যে সংস্কৃতির প্রবেশ করানো, শিক্ষার ঐক্যযোগে চিত্তের ও বিত্তের ঐক্যযোগ, জাতীয় ঐক্যসাধনের মূলে স্বাতন্ত্র্যসহ শিক্ষার ঐক্যসাধন, ভাষাশিক্ষা-ভাবশিক্ষা-জীবনযাত্রার সম্মিলন — ইত্যাদিসহ আরও নানা দিক মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা অনেক পরিব্যাপ্ত ও সমসাময়িক।

শুধুমাত্র ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধ সংকলনটিতেই আছে ২৫টি প্রবন্ধ: শিক্ষার হেরফের, শিক্ষা সংস্কার, শিক্ষাসমস্যা, জাতীয় বিদ্যালয়, আবরণ, স্ত্রীশিক্ষা, ছাত্রশাসনতন্ত্র, অসন্তোষের কারণ, বিদ্যার যাচাই, বিদ্যাসমবায়, শিক্ষার মিলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ, শিক্ষার বিকিরণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, শিক্ষার সাঙ্গীকরণ, আশ্রমের শিক্ষা, ছাত্রসম্ভাষণ, শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধের অনুবৃত্তি, প্রসঙ্গকথা এক দুই, প্রাইমারি শিক্ষা, পূর্বপ্রশ্নের ও অনুবৃত্তি, বিজ্ঞানসভা, ইতিহাসকথা, স্বাধীন শিক্ষা ও শিক্ষার আন্দোলনের ভূমিকা। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য লেখায় এসেছে শিক্ষা প্রসঙ্গ, তাঁর শিক্ষা ভাবনা। অধ্যাপক পবিত্র সরকার ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধ সংকলনের প্রবন্ধসহ আরও অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্যের সম্মিলনে শিক্ষা, রবীন্দ্রনাথ পরিকল্পিত শিক্ষা এবং রবীন্দ্রনাথের দ্বারা বাস্তবায়িত শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষা ভাবনা’ বা ‘শিক্ষা চিন্তা’ নিয়ে আলোচনা করেন।

অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “প্রথমত আমরা শিক্ষা ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলি। শিক্ষা কী? মানুষের জগতে শিক্ষা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা হয়, কারণ মানুষের ভাষা আছে, পৃথিবীর আর কোনো প্রাণির ভাষা নেই। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণির ভাষা নেই বলে তাদের শিক্ষাও খুব সীমাবদ্ধ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা প্রকৃতিগত – খাদ্য সংগ্রহ, শিকার করা, সন্তান জন্ম দেওয়া, সন্তান পালন, সন্তান রক্ষা এবং কখনও কখনও দলের মধ্যে দলের আধিপতের ক্রম মেনে চলা, কিছু ডাক শুনে অর্থ বোঝা যেমন বিপদের ডাক, দলের একসঙ্গে জুড়ে যাওয়ার ডাক ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রাণিদের শিক্ষা ব্যবস্থা খুব সরল। কিন্তু মানুষ প্রকৃতির পক্ষপাতে ভাষা পেয়েছে এবং ভাষার সাহায্যেই তার সভ্যতা নির্মাণ, সমস্ত সৃষ্টি, সমস্ত কাজ। তার মধ্যে বিচিত্র বিশাল ও বিস্তারিত শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষ নির্মাণ করতে পেরেছে। কাঠামোবাদী নৃবিজ্ঞানী লেভি স্ট্রস ‘প্রকৃতি’ ও ‘সংস্কৃতি’ ভাগ করেছেন। প্রকৃতিতে আমরা বাস করি প্রাণি হিসেবে, জীব হিসেবে, কিন্তু মানুষের সংস্কৃতি বিশাল বিচিত্র। অন্য প্রাণির সংস্কৃতি সরল। আমরা প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে পৌঁছাই। সব মানুষ সমানভাবে সংস্কৃতিতে পৌঁছাতে পারে না। কারণ সংস্কৃতির অনেক শ্রেণি আছে, অনেক স্তর আছে, অনেক বিন্যাস আছে। কিন্তু যারা লেখাপড়ার সুযোগ পায় এবং যাদের লেখাপড়ায় এগিয়ে যাবার সুযোগ থাকে তারা সংস্কৃতিতে এসে পৌঁছায়। ‘প্রকৃতি’ ও ‘সংস্কৃতি’র বাইনারি ভেঙে এভাবে অনেক মানুষ প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে পৌঁছায়। তার শিক্ষা তাকে সেখানে পৌঁছে দেয়। এর মূল কথাটা হচ্ছে – একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে হবে, নিয়মগুলো জানতে হবে, নিয়মের পরিণাম জানতে হবে এবং নিয়মের মধ্যে কাজ কীভাবে করা যায় তা জানতে হবে।


রবীন্দ্রনাথকে যদিও ‘ইচ্ছামন্ত্রের দীক্ষাগুরু’ বলা হয় এবং ‘তাসের দেশ’ এ আমরা ইচ্ছের গানও শুনেছি। কিন্তু ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছাকে সংযত করা, নিয়ন্ত্রণ করার যে দ্বিমুখী প্রবণতা চলে এবং এই নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই আমরা আস্তে আস্তে যেভাবে শিক্ষার দিকে, সংস্কৃতির দিকে এগিয়ে যাই – এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেন।

“১৮৯২ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ লেখার শুরু। ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধ সংকলনটি বের হয় ১৯০৮ সালে। মাঝখানে অনেকগুলো শিক্ষা সংক্রান্ত প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। পরে সংকলনে আরও অনেক সংযোজন হয়েছে। শুধুমাত্র ‘শিক্ষা’ বইটিতে নয়, আরো অনেক বই বা বক্তৃতায় আছে তাঁর শিক্ষা সম্বন্ধে লেখা। যেমন ‘শান্তিনিকেতন আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ এ, ‘বিশ্বভারতী’তে, ‘শান্তিনিকেতন উপদেশমালা’য়, মাদ্রাজে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার আগে আগে ‘সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান কালচার’ নামে ইংরেজি বক্তৃতায় ভারতীয় শিক্ষা সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছেন তিনি। নোবেল বক্তৃতায় নিজের শিক্ষা জীবনের কথা বলেছেন। ‘জীবনস্মৃতি’, ‘ছিন্নপত্র’ ‘ছেলেবেলাতে’ও পাওয়া যায় শিক্ষা সম্বন্ধে বিচিত্র কথোপকথন। অর্থাৎ নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে তাঁর শিক্ষা বিষয়ক লেখা। কিন্তু শিক্ষা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা নয়, মূলত তত্তে¡র কথাগুলো ‘শিক্ষা’ বইটির ২৫টি প্রবন্ধে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

“আধুনিক পৃথিবীর চিন্তার কথাটা একটু বলে নিই। ১৯৯৬ সালে প্যারিসে একটা আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে শিক্ষার ৪টি স্তম্ভের কথা বলা হয়। সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট জাঁক ভেলরের রিপোর্টে আছে – Learning to know. অর্থাৎ আমরা কীভাবে শিখব, সেটা জানা দরকার। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মধ্যেও এটা ছিল। শেখার নানা পদ্ধতি আছে। সব পদ্ধতি ঠিক না। শুধু মুখস্ত করা, মুখস্ত বিদ্যা উগড়ে দেওয়া এটা শিক্ষার ঠিক পদ্ধতি না। শিক্ষারও একটা পদ্ধতি আছে। ২য় স্তম্ভ – Learning to do. শিক্ষা মানে শুধু জ্ঞান আহরন করা না, মস্তিষ্কের কোষে নানারকম তথ্য ভরে দেওয়া না এবং তা আবার জানানো না, এর সঙ্গে দক্ষতা আয়ত্ত করতে হবে। দর্শনের পণ্ডিত হলে একরকম শিক্ষা, আবার পদার্থবিদ্যার, প্রযুক্তির বা প্রকৌশলের পণ্ডিত হলে আরেকরকম শিক্ষা। কাজেই জ্ঞান এবং দক্ষতা এই দুটোর দিকে নজর দিকে হবে অর্থাৎ ‘লার্নিং টু ডু’ একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শিক্ষার। ৩য় স্তম্ভ হচ্ছে – Learning to live together. এর মানে হচ্ছে সব মানুষের সঙ্গে একত্রে বাস করা। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে বারবার বলেছেন। শিক্ষা নিয়ে বিচ্ছিন্ন বা আলাদা হয়ে যাওয়া না, সমাজের কথা অন্যদের কথা না-ভেবে নিজের স্বার্থের সন্ধানে ছোটা শিক্ষার লক্ষ্য না। শিক্ষা আমাদের মানুষের সঙ্গে বন্ধনে নিয়ে যায়, মানুষের সঙ্গে যুক্ত করে, সমাজের কাছে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ধর্মের বাইরে, ভাষার বাইরে, পোশাক-আশাকের বাইরে, বর্ণের বাইরে, জাতি-সংস্কৃতির বাইরে সবার সঙ্গে এই বন্ধনে, এই সার্বিক মনুষ্যত্বে আমরা যাতে যুক্ত হতে পারি অর্থাৎ ‘লার্নিং টু লিভ টুগেদার’ এর ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্যারিসের সম্মেলন এখানটায় থেমে গেছে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের আরেকটু বাড়িয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা শুধু মানুষের সঙ্গেই একসঙ্গে বাঁচব না, যেসব প্রাণি মানুষের কাছে ভালোবাসার সূত্রে আসে তাদের সঙ্গেও বাঁচব, তাদের বাঁচাব। বৃক্ষলতা, সমস্ত প্রকৃতি – বর্ষা বসন্ত শীত গ্রীষ্মর সঙ্গে জড়িয়েও আমাদের অস্তিত্ব অর্থাৎ প্রাণি উদ্ভিদ জড় প্রকৃতি সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা সব মিলিয়েই আমাদের অস্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান’ গানটার কথা আমরা সবাই জানি। এই বিশাল অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত হবার কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ। মানুষের সঙ্গে মানুষ শুধু না, মানুষের সঙ্গে প্রাণ, প্রাণের সঙ্গে প্রকৃতি, প্রকৃতির সঙ্গে জড় প্রকৃতি এই বিশ্ব চরাচর সবকিছুর সঙ্গেই। ফলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার ধারণাটা আরো ব্যাপ্ত। ৪র্থ স্তম্ভ – Learning to be. অর্থাৎ আমরা যেন স্বতন্ত্র মানুষ হই, ব্যক্তি হই। ব্যক্তি হওয়া মানে মূল্যবান হওয়া। অন্যের মতো হওয়া, অন্যের অনুকরণ করা মানে সৈন্যদলের মধ্যকার একজন সৈন্য হওয়া, সেখানে ব্যক্তির আলাদা মূল্য থাকে না, সেখানে থাকে দলগত মূল্য। কিন্তু নিজের শিক্ষাদীক্ষা দক্ষতা এবং মনুষ্যত্ব নিয়ে আলাদা ব্যক্তি হতে পারলেই কেবল সমাজের কাছে, মানুষের কাছে মূল্যবান হওয়া যায়। এটাই ‘লার্নিং টু বি।’ ‘লার্নিং টু নো,’ ‘লার্নিং টু ডু,’ ‘লার্নিং টু লিভ টুগেদার’ (রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক অর্থে) ও ‘লার্নিং টু বি’ শিক্ষার এই চারটে লক্ষ্য, চারটে স্তম্ভের কথা রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই চমৎকার করে বলে গিয়েছেন।

“শিক্ষা কেমন হবে? শিক্ষার পদ্ধতিটা কীরকম হবে? বলা বাহুল্য আমরা যারা উপনিবেশের মধ্য দিয়ে গেছি, সাম্রাজ্যবাদ আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল এবং তারাই আমাদের শিক্ষার পদ্ধতি তৈরি করেছিল। আমরা জানি, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে আমরা পরাধীন হই। তারপর ধীরে ধীরে কোলকাতা বৃটিশ ভারতের রাজধানী হয়। আস্তে আস্তে ইংরেজ সাম্রাজ্য আমাদের ওপর দখলদারি নিয়ে বসে এবং এই সাম্রাজ্য চলে ১৯৪৭ সালে তথাকথিত স্বাধীনতা বা দেশভাগ পর্যন্ত। ১৮১৩ তে তারা প্রথম সরকার হিসেবে দায়িত্ব নেয়। দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব সরকার নেয় এবং সেই বছর থেকেই একটা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তার আগে মূলত ইংরেজি শেখানোর জন্য প্রাইভেট স্কুল হয়েছিল। কিন্তু সরকার স্কুল করার দায়িত্ব নেয় এবং ১৮১৩ সালে স্কুল সোসাইটি, স্কুলবুক সোসাইটি এসমস্ত স্থাপন করে, পাঠ্যবই রচনা করে এবং আস্তে আস্তে ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে স্কুলের ব্যবস্থা স্কুলের প্রণালি গড়ে ওঠে। এবং এই গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়েও আলোচনা চলতে থাকে। ১৮৩৫ সালে টমাস হ্যামিল্টন মেকলের সুপারিশে সরকার এইটে স্থির করে যে, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা হবে এবং তার ফলে কিছু বাদামি রঙের সাহেব তৈরি হবে। এই বাদামি সাহেবরা গায়ের রঙে ভারতীয় কিন্তু তারা শিক্ষাদীক্ষায় ইংরেজের মতো হবে এবং মেকলে ভেবেছিলেন যারা বাদামি সাহেব হবে তারা নিজেরা নিজেদের দেশের লোককে নিজেদের মাতৃভাষায় শেখাবে। সেই স্বপ্নটা সত্যি হয়নি। অর্থাৎ বাবুরা ইংরেজি শিখে ভালো চাকরিবাকরি পেলো, সরকারি চাকরি পেলো কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের শিক্ষার জন্যে তারা খুব কম চেষ্টাই করলো। ১৮৩৫ সালে এই নীতি গৃহীত হলো এবং ১৮৫৪ সালে জন অ্যাডাম এটা লক্ষ্য করলেন যে, শিক্ষার বিস্তার হয়নি। ১৮৫৭ সালে ভারতে ৩টা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় কোলকাতা, মাদ্রাজ ও বম্বেতে। ১৮৭২ সাল থেকে জনগণনা শুরু হয়। সেবারে প্রথম গণনায় দেখা যায়, লিখতে পড়তে পারে বা নাম সই করতে পারে এরকম লোকের সংখ্যা ৩.৭৫ অর্থাৎ ১০০ জনে ৪জনও না। ঐ সময়ে কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন পত্রিকা বের হচ্ছে অর্থাৎ বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা অনেক ছড়িয়ে গেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র রামমোহন অক্ষয়কুমার দত্ত দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে গেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে স্কুল তৈরি করছেন। যে বছর বিদ্যাসাগর কলেজ স্থাপিত হয় সেই বছরে, ১৮৭২ সালে পৌঁছে আমরা দেখি, ১০০ জনের মধ্যে ৪ জনেরও কম লিখতে পড়তে বা সাক্ষর করতে পারে। এবং ক্রমে আমরা দেখছি সাম্রাজ্যবাদ এই ব্যাপারটায় মোটেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ১৯০১ এ আমরা দেখেছি শিক্ষিতের হার ৬ জন পেরোয়নি, ১৯১১ সালে ৭ জনের মতো, ১৯২১ এ ৯ জনের মতো এবং দেশভাগের বছরে ২৪ জন মাত্র। ফলে সাম্রাজ্যবাদের পরিচালিত স্কুল ব্যবস্থা, কলেজ ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার ফলে সাধারণ শিক্ষা ও জনশিক্ষার কোনোরকম সুযোগ বড়ো করে উন্মোচিত হয়নি। ১৯২১ এ ১০০ জনের মধ্যে ৯ জন, ১৯৪১ এ দেখা যায় হঠাৎ সেটা লাফ দিয়ে ১৫র মতো গিয়ে পৌঁছে। কেন? কারণ ১৯২৯ থেকে মাতৃভাষায় স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম মেট্রিকুলেশন পর্যন্ত মারাঠি ভাষায় পড়ার অনুমতি দেয় এবং ১৯৪০ এ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষায় বা হিন্দি ভাষায় মানে মাতৃভাষায় মেট্রিকুলেশন পর্যন্ত বই লেখা, বই পড়ার অনুমতি দেয়। তার ফলে হঠাৎ লাফ দিয়ে পরিসংখ্যানটা বেড়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভূমিকার পটভূমিকা তৈরি করার জন্য এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বলা, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা আমাদের শিক্ষাকে কতটা এগিয়ে দিয়েছিল বা কতটা ব্যাহত করেছিল সেসব বলা। সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা কেমন ছিল সেটা রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় এসেছে। সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘরবাড়ি হয়েছে, দেয়াল হয়েছে, বেঞ্চি চেয়ার অনেক হয়েছে, বø্যাকবোর্ড হয়েছে, পাঠ্যবই হয়েছে, শিক্ষক পড়াচ্ছেন ‘চক এন্ড টক’ পদ্ধতিতে। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যেমন ব্রতকথা চলে, একজন বলবে আর কেউ কথা বলবে না, শিক্ষাব্যবস্থাও সেইরকম। প্রশ্নোত্তরের সুযোগ নেই। ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরি বলেছেন, ‘ছাত্রদের চাওয়াটা শোনো, তাদের কথাটা শোনো। ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিচ্ছ এভাবে তুমি পড়াবে না। প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের জানো, তাদের চাহিদা জানো, তাদের চাহিদা পূরণ করো।’ কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থাটা একেবারেই সেইরকম শিক্ষা না। একদম যান্ত্রিক শিক্ষা প্রবর্তিত হলো। এই যান্ত্রিক শিক্ষার প্রগতিটাও দেখালাম। ১৯৪৭ পর্যন্ত ভারতের এক চতুর্থাংশ মানুষও সাক্ষরসম্পন্ন ছিল না। এখনো পুরোপুরি হয়নি। এখনো ভারতে ২২/২৩ শতাংশ নিরক্ষর মানুষ আছে। এই অবস্থার মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করতে হয়েছিল।


“রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তার মূলে বাংলাদেশের বড়ো অবদান আছে। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের শিলাইদহ পতিসর শাহজাদপুর এসব জায়গায় যদি না-যেতেন তাহলে তাঁর শিক্ষা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিটাও যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তারিত হতো কিনা সংশয় আছে। রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় ১৮৮৩ সালে। সে সময়টায় গম্ভীর মজার কৌতুকপূর্ণ রোম্যান্টিক কবিতা, অপেরা এসমস্ত লেখা চলছে তাঁর। যদিও বিশ্বজগতে কী ঘটছে সেটা তিনি জানতেন। ১৮৮১ সালেই ‘চীনে মরণের ব্যবসায়’ বলে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। আফিম খাইয়ে বৃটিশরা কীভাবে চীনকে পদানত করে রাখছে সে সম্বন্ধে এই প্রবন্ধ। চিনেরা এর কথা এখনো মনে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের চোখ সবদিকেই খোলা ছিল। ১৮৯১ এ রবীন্দ্রনাথের বাবা যখন তাঁকে মধ্যবঙ্গে জমিদারি দেখতে পাঠান তখন আস্তে আস্তে দেশের চেহারাটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করে। তিনি লক্ষ্য করলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর। নানান ধরনের লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় গ্রাস করেছে তাদের। দরিদ্র, নিরক্ষর জনগণকে শোষণ করছে মহাজন, শোষণ করছে জমিদার, শোষণ করছে পুলিশ এবং শোষণ করছে সমাজের তথাকথিত উঁচু জাতের লোকজন, উঁচু শ্রেণির লোকজন। এইরকম নানা শোষণের ব্যবস্থার মধ্যে নিষ্পেষিত যে মানুষেরা তাদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের চোখ পড়লো। এই চোখ পড়ার পেছনে বিদেশের প্রেরণা ছিল। তিনি নিজেই সেটা লিখেছেন। রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ‘ট্রেজার আইল্যান্ড,’ ‘কিডন্যাপ’ এসব বই জনপ্রিয় আমরা জানি। কিন্তু তাঁর লেখা ‘ফ্যামিলিয়ার স্টাডিজ অফ মেন এন্ড বুকস’ বইটা খুব কম লোকেই পড়েছেন। ১৮৮০ সালের কাছাকাছি বইটা বের হয়। রবীন্দ্রনাথ সেখানে পড়েছিলেন একজন জাপানি দেশপ্রেমিকের কথা। তাঁর নাম যোশিদা তোরাজিরো। তোরাজিরো সামন্তপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করবেন বলে, জাপানকে মুক্তি দেবেন বলে সংকল্প নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন, তিনি কি জাপানকে চেনেন? কোন জাপানকে তিনি উদ্ধার করবেন? তখন তোরাজিরো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – ‘চাল-চিঁড়া বাঁধিয়া পায়ে হাঁটিয়া ক্রমাগতই সমস্ত দেশ কেবল ভ্রমণ করিয়াই বেড়াইয়াছেন।’ জাপানের পথে হাঁটছেন তোরাজিরো। হেঁটে কখনো থাকছেন চাষীর ঘরে, কখনো শ্রমিকের ঘরে, কখনো মৎস্যজীবীর ঘরে। তিন বছর ধরে জাপানের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কাটিয়ে তোরাজিরো বললেন, ‘হ্যাঁ আমি বলতে পারি আমি এবার আমার জাপানকে চিনি। জাপান হচ্ছে জনগণ আর তার তলায় থাকা জনগণ, বঞ্চিত জনগণ।’ রবীন্দ্রনাথ এই বইটা পড়েন যখন ১৮৮৫ সালে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হলো, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলো তখন। তিনি দেখলেন, জাতীয় কংগ্রেস আর কিছুই চায় না, চায় শহরের মধ্যবিত্তদের জন্য চাকরিবাকরি, ডেপুটিগিরি এইসমস্ত। আর ইংরেজিতে ভাষণ দেয় কোলকাতার পার্কে, দিল্লীর পার্কে। জাতীয় কংগ্রেসের চোখেই নেই ঐ মানুষগুলো, রবীন্দ্রনাথ যেসব মানুষকে মধ্যবঙ্গে গিয়ে পেলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রজাদের জন্যে কী করেছেন এই পরিসরে আমি সেই বৃত্তান্তে যাব না। পরে তিনি ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে লিখলেন সাধারণ লেখাপড়া নিয়ে। এটুকু শেখালে সাধারণ মানুষেরা নিজেরাই শিক্ষিত হতে পারবে, নিজেরা এগিয়ে যেতে পারবে। জনশিক্ষার কথা রবীন্দ্রনাথের তখনই মনে হয়েছিল। প্রজাদের জন্য স্কুল করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেইসঙ্গে তাঁর দুটো ব্যক্তিগত ইতিহাসও ছিল। একটা হচ্ছে তাঁর নিজের ছেলেবেলার শিক্ষার স্মৃতি। সেটা ‘জীবনস্মৃতি’ এবং ‘ছেলেবেলা’য় আছে আমরা জানি। স্কুল তাঁর অসম্ভব খারাপ লাগতো। ওরিয়েন্টাল সেমিনারিই হোক বা সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুলই হোক, স্কুলের শিক্ষকদের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা মোটামুটি একইরকম ছিল তাঁর। কোনো কোনো শিক্ষক হয়তো মমতাপূর্ণ ছিলেন কিন্তু স্কুলের যান্ত্রিক শিক্ষাপদ্ধতি তাঁর ভালো লাগতো না। দেয়ালে বন্দি অবস্থা, সাম্রাজ্যবাদের ছকে বাঁধা ‘ফর্ম্যাল এডুকেশন’ বা বিধিযুক্ত শিক্ষার তিক্ত স্মৃতি তাঁর মনে ছিল বলে তিনি ভেবেছিলেন, এর পরিবর্তন দরকার। ওদিকে ১৮৯০ সাল নাগাদ তাঁর সন্তানরা কিছুটা বড়ো হয়েছে। বড়ো মেয়ে মাধুরীলতা ও ছেলে রথীন্দ্রনাথ জন্মেছে। তাদের শিক্ষার জন্য বিশেষ করে বড়ো মেয়ের শিক্ষার জন্য তিনি ভাবলেন, একজন শিক্ষকও রেখেছিলেন। ভাবলেন, সন্তানদের এইরকম স্কুলের শিক্ষায় পাঠাবেন না। নিজের বাল্য জীবনের শিক্ষার স্মৃতি এবং সন্তানদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ-ভাবনা এই দুটো স্মৃতি বা আশু প্রয়োজন মিলে তাঁর মনের মধ্যে এক ধরনের উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার কথা জাগ্রত হয় এবং যেটার মূর্তি তিনি দেন ১৯০১ এ শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। তাহলে একদিকে শিক্ষার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পটভূমিকা আমরা দেখলাম। আর দেখলাম রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত পটভূমি। আমরা সবাই জানি, রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। বাড়িতেও দীর্ঘদিনের শিক্ষক ছিলেন অনেকেই। গৃহশিক্ষক বেশ কয়েকজনই ছিলেন। তাঁদের কথা বলেছেন, মজা করে বলেছেন তিনি। বাড়ির শিক্ষা সত্যি সত্যি হয়তো তাঁর কাজে লেগেছিল, বিশেষ করে সাহিত্য শিক্ষা। কিন্তু তা সত্তে¡ও নিজের স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সেইসঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েদের শিক্ষার যে প্রয়োজন সেসব মিলিয়ে তাঁর মনের মধ্যে শিক্ষা-চিন্তা দানা বাঁধে। এই শিক্ষা চিন্তার কথা ‘শিক্ষা’ বইতে আছে। আবার সেইসঙ্গে আরও কিছু ঘটনাও হচ্ছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন হয়েছে, শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পরে। ঐ সময় জাতীয় শিক্ষা বলে কোলকাতার বুদ্ধিজীবিরা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছিলেন, যা থেকে বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা ১৯০৫ সালে। তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যুক্ত হয়েছিলেন। তার কথাও আছে ‘শিক্ষা’ বইতে। আছে জাতীয় বিদ্যালয়, জাতীয় শিক্ষার কথা। কিন্তু তার আগে ১৯০১ সালে বের হলো ‘নৈবেদ্য’ বইটি। ‘নৈবেদ্য’র কবিতাগুলো যখন লিখছেন তখন প্রাচীন ভারত, হিন্দু ভারত সম্বন্ধে তাঁর মনে অতি উচ্চ ধারণা তৈরি হয়েছিল। প্রাচীন ভারত যেন এক আদর্শ স্বপ্নলোক। যদিও মূলত ব্রাহ্মন্য সংস্কৃতি শাসিত, পৌরোহিত্য নির্ভর প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে অনেক সমালোচনা আছে। আমি মনে করি, পৌরোহিত্য একটা ব্যবসামাত্র, মানুষের বিশ্বাসের ওপর শোষণব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া। এটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথ তখন উপনিষদ পড়ছেন, কারণ তাঁর বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেদ, উপনিষদ পড়ে তাঁর মনে হয়েছে – ‘হে ভারত, নৃপতিরে শিখায়েছ তুমি/ ত্যজিতে মুকট দণ্ড সিংহাসন ভূমি’ ইত্যাদি। ‘নৈবেদ্য’র কবিতায় প্রাচীন ভারত আছে আবার বর্তমান পৃথিবী সম্বন্ধেও আছে। ৬২ ৬৪ এইসমস্ত কবিতাগুলোতে আছে আফ্রিকাতে বুয়র যুদ্ধ হচ্ছে এবং সেখানে ইউরোপিয় শক্তি আফ্রিকাকে কীরকম লুটপাট করছে এইসমস্ত কথা। অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে বুয়র যুদ্ধ নিয়ে কবিতা আছে। সবই আছে কিন্তু সেইসঙ্গে আছে প্রাচীন ভারত সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা। তপোবনকে উপনিষদের সঙ্গে আরো বেশি সমর্থন করেছিল কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কালিদাস পাঠ। তপোবনের শিক্ষাকে তাঁর মনে হয়েছিল আদর্শ শিক্ষা। কেন আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা? প্রথমত হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষা মানেই ইট কাঠ পাথরের দেয়াল বেঞ্চি টেবিল চক ডাস্টার, বাঁধানো পাঠ্যবই মুখস্ত করা। ‘শিক্ষা’ বইয়ের একদম প্রথম প্রবন্ধ ‘শিক্ষার হেরফের’ এ আছে ‘বাল্যকাল হইতেই আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই।’ রবীন্দ্রনাথের নিজের অভিজ্ঞতা সেইরকম। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েরা ঐ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাক সেটা তিনি চান না। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ কীভাবে ব্যবস্থা করা যাবে? বেত্রদণ্ড হাতে শিক্ষক, রক্তচক্ষু শিক্ষক, ধমকে ধমকে পড়ানো শিক্ষক – তাতে তো আনন্দ নেই। আনন্দের কিছু কিছু উপাদান দরকার। আনন্দের কী কী উপাদান থাকবে?”

এ পর্যায়ে ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধ সংকলনের ‘শিক্ষার হেরফের’ ও ‘আবরণ’ প্রবন্ধ থেকে আনন্দের শিক্ষা, ভাষা শিক্ষা-ভাবশিক্ষা-জীবনযাত্রা ত্রয়ীর সমন্বয়ের গুরুত্ব, আবশ্যিক শিক্ষার বাইরের পাঠ, পুঁথিগত বিদ্যাশিক্ষা থেকে ‘স্বদেশপ্রেম’ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, পুঁথিগত শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের লেখার নির্বাচিত কয়েকটি অংশ উদ্বৃতি আকারে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়।

অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “ ‘আনন্দ’ কথাটা আমরা প্রথমে ধরি। আনন্দটা হচ্ছে ভিত্তি। রবীন্দ্রনাথ যে শিক্ষাচিন্তার কথা বলেন তার মূল কথা হচ্ছে আনন্দ। আনন্দের যোগান কী করে হবে? শিক্ষার পরিবেশ শিক্ষকদের নিয়ে বলি, তারপর শিক্ষকদের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে বলি, তারপর পাঠ্যপুস্তক টিচিং ম্যাটেরিয়াল এগুলো নিয়ে বলি। প্রথম কথা হলো, পরিবেশটা বদলাতে হবে। অর্থাৎ এই দেয়াল স্কুল সবই খুব ভালো কিন্তু তার মধ্যে বন্দি রেখে ছাত্রকে ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত একটানা যে কারখানা ঘরে কারখানার মেশিনের মতো চালানোর শিক্ষা সেইটা ভেঙে প্রথমত উদার প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে। যেমন শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যা বিদ্যালয়ের প্রথম কথাই হচ্ছে একেবারে খোলা প্রকৃতির মধ্যে গাছের তলায় ক্লাস বসবে। রবীন্দ্রনাথের চিঠিতেও আছে – ছেলে গাছে উঠে ডালে চড়ে বসে আছে, তাতে মাস্টারমশাই বিরক্ত হচ্ছেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, ‘বিরক্ত হলে চলবে না। ওটাতে সে মজা পাচ্ছে, ওদের একটু স্বাধীনতা আপনি দেবেন।’ এই যে মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষা এই শিক্ষাটা হচ্ছে আনন্দের একটা প্রধান সূত্র। আর বলা হয়েছে পুঁথির বাইরে যেতে হবে। শুধু পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত না। যেমন জগদানন্দ রায় বলে একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি রাত্রিবেলায় শান্তিনিকেতন থেকে শ্রীনিকেতনের পথে বিশাল মাঠের মধ্য দিয়ে ছেলেদের নিয়ে যেতেন আকাশের তারা চেনাতে চেনাতে। রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষা’ বইয়ের প্রবন্ধে উদাহরণ দিয়েছেন, একটা ছেলে রিভার কী সেটা জানে। কিন্তু যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয় সে রিভার দেখেছে কিনা তাহলে সে নদীর ধারে বসেও বলে রিভার দেখেনি। এভাবে শুধু ঘরের মধ্যে না, বইয়ের মধ্যে আটকে থাকার বেড়াটাও ভাঙতে চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কাজেই প্রকৃতির কোলে শিক্ষা এটা একটা বড়ো দিক। শুধু প্রকৃতি না, প্রকৃতির কোলে রোদ বৃষ্টি ঝড় এসব দেখবে ছাত্ররা, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয় হবে, এসব ছাড়াও আনন্দের আর কী উপকরণ? সংস্কৃতি। তারা গান গাইবে। রবীন্দ্রনাথ অজস্র গান রচনা করেছেন। তারা বর্ষামঙ্গল করবে, শারদোৎসব করবে, ফাল্গুনী করবে। এই যে ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে তাদের জীবনটা, মানুষও প্রকৃতির অংশ, সে একটা বৃহৎ পরিবারের অংশ, মানব পরিবার শুধু না প্রকৃতি পরিবারের অংশ এইটে বোঝানো। তারা গান দিয়ে বুঝবে, নাটক দিয়ে বুঝবে নাচ দিয়ে বুঝবে। আনন্দের আরেকটা উপকরণ কী? সেটা হলো ভাষা। সে নিজের ভাষায় পড়বে, মাতৃভাষায় পড়বে। এই মাতৃভাষার কথা শিক্ষার নানান প্রবন্ধে এসেছে। আমি পড়া বুঝতে পারছি না, বুঝতে না-পেরে আমি মুখস্ত করছি এবং তার ফলে আমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছি না, আমি কিছু আবিষ্কার করতে পারছি না, আমি কিছু মৌলিক ভাবতে পারছি না, আমি পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারে কিছু যোগ করতে পারছি না। কারণ আমি মুখস্ত বিদ্যার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি, মুখস্ত বুলি পরীক্ষায় উগড়ে দিয়ে আসছি, সত্যি সত্যি শিক্ষাটা হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, পড়ানো হচ্ছে কিন্তু শিক্ষাটা হচ্ছে না। নিজের ভাষায় শিখলে বুঝতে বুঝতে শেখা হয়। বুঝতে বুঝতে শেখার মধ্যে আনন্দ আছে এবং বুঝতে বুঝতে শেখার মধ্য থেকেই নিজের মৌলিক ভাবনাও আসে। এখানেই মাতৃভাষার কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পরে তিনি বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে ইংরেজি বাংলা দুটো রাস্তা খোলা হোক। বাংলায় যারা পড়বে তারা ইংরেজি পড়বে নিশ্চয়ই কিন্তু মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে তিনি সমস্ত স্তরের শিক্ষার কথা ভেবেছেন – সেটা আনন্দের আরেকটা উপকরণ। তার ফলে প্রকৃতি, বিনোদন সংস্কৃতি – গান নাচ নাটক, আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভাষা আনন্দের উপকরণ। আরেকটা কী? শিক্ষকের সঙ্গে মানবসম্পর্ক। শিক্ষক গুরু হয়ে উঠবেন। শিক্ষক বেত হাতে নেওয়া শাসক নন। ক্লাসরুমে যিনি আধিপত্য করবেন আর সবাই ভয়ে ভয়ে থাকবে তিনি শিক্ষক নন। পাওলো ফ্রেইরির কথা আমি আগেই বলেছি। শিক্ষক ছাত্রের সঙ্গে গান গাইবেন, তার সঙ্গে নাটক করবেন, নাচবেন এবং শিক্ষক তাকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে প্রকৃতি চেনাবেন, তাকে নিয়ে বেড়াবেন, মেলায় যাবেন। এইজন্য রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক-ছাত্রদের এক জায়গায় থাকার কথা বলেছেন। ছাত্ররা যদি একটা আবাসনে থাকে, শিক্ষকও আশ্রমেই এক জায়গায় থাকবেন। প্রতিবেশী হিসেবে শিক্ষক বিকল্প অভিভাবক হবেন। বাবা-মা ছেড়ে আসবে যেসমস্ত শিক্ষার্থীরা শান্তিনিকেতনে, সেখানে শিক্ষক তাদের অভিভাবক হয়ে উঠবেন। তাহলে মানববন্ধনের মধ্যে আনন্দের আরেকটা সূত্র, ছাত্ররা যেখানে শিক্ষককে পাচ্ছে বাবা মায়ের বিকল্প অভিভাবক হিসেবে।

“এবারে আসি শিক্ষা পদ্ধতির কথায়। আগের আলোচনাতেই বলেছি শুধু ‘টক এন্ড চক’ না, শুধুমাত্র একটানা বক্তৃতা না, ক্লাসরুমে ধমকানো না – শিক্ষক ক্লাসঘরের বাইরে ছাত্রদের নিয়ে যাবেন, বাইরে নিয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের শেখাবেন। তাতে আনন্দের যোগান যথেষ্ট হবে। তারপরে হলো পাঠ্যবই। পাঠ্যবইয়ের কথা বারবার এসেছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। আমাদের বয়সী কিংবা আরেকটু কম বয়সী যাঁরা তাঁরা দেখেছেন, আমাদের সময় পাঠ্যবইয়ের ভাষা ছিল আধিপত্যের ভাষা। ভাষাটা আমরা বুঝতে পারতাম না। যেজন্য আমাদের মানে বই পড়তে হতো। আগেকার দিনের টেক্সটবুক বোর্ড সেটা স্কুলবুক সোসাইটি হোক বা স্কুল সোসাইটি হোক, ঊনবিংশ শতাব্দীর পাঠ্যবইয়ের বাংলা নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিশেষ করে তত্ত¡বোধিনী পত্রিকায় প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। কঠিন ও অদ্ভুত সব পরিভাষা দিয়ে লেখা হতো পাঠ্যবই। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখছেন ১৮৬১ সালে, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দিয়ে বাংলা পাঠ্যপুস্তক লেখানো হোক। পাঠ্যবইয়ের ভাষাও ছিল সাধু। সাধু ভাষা আমাদের জীবন্ত ভাষা না। আবার সঙ্গে কঠিন শব্দ, অদ্ভুত পরিভাষা। ফলে মুখস্ত করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। এবং মুখস্ত করা মানে বুঝছি না, বোঝার যে আনন্দ সেই আনন্দ পাচ্ছি না, মুখস্ত করছি যান্ত্রিকভাবে আর তা পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দিচ্ছি। আমার শিক্ষাটা হচ্ছে না। আমি পরীক্ষা দিচ্ছি, পরীক্ষিত হচ্ছি কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছি কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আস্তে আস্তে পাঠ্যবইয়ের বিবর্তন ঘটেছে – এটা সুখের কথা, ইদানিংকালে বিদেশের দেখাদেখি হয়তো। আমেরিকায় যেমন বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিকেরা ছোটোদের জন্য পাঠ্যবই লিখছেন। ইউরোপেও তাই হয়েছে। ছবি দিয়ে রঙ দিয়ে ছেলেমেয়েদের মনের মতো করে পাঠ্যবই লেখা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও সেটা হয়েছে। এই বইগুলো সহজভাবে আমাদের জ্ঞানের রাস্তায় ধাপে ধাপে উঠিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু আগেকার দিনের পাঠ্যবই, রবীন্দ্রনাথের সময়কার পাঠ্যবইগুলো ছিল ভয়ঙ্কর, জ্ঞানের প্রবেশপথ যেন আটকে রাখতো। আমরা বুঝতে পারছি না, না-বুঝে মুখস্ত করছি। সেই পাঠ্যবইয়ের বিবর্তন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন ‘সহজ পাঠ’ লিখেছেন। এটি একটি চমৎকার বাংলা শেখার বই, আনন্দের সঙ্গে বাংলা শেখার বই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই পাঠ্যবই লিখে দেখিয়েছেন। আরো লিখেছেন পাঠ্যবই, যেমন ‘মহাভারত’ ইত্যাদি। ইংরেজি পড়ানোর পাঠ্যবইও লিখেছেন। চেষ্টা করেছেন ছেলেমেয়েদের ভাষার কাছাকাছি থাকতে। ‘মহাভারত’টা একটু কঠিন ভাষায়। সংস্কৃত ভাষার স্বাদ দেবার জন্য ওটা করেছিলেন তিনি। কিন্তু একইসঙ্গে ছেলেমেয়েদের সহজ ভাষায় ইংরেজি-বাংলা পাঠ্যবই লেখার চেষ্টা করেছেন, অনেক কিছু করবার চেষ্টা করেছেন। টিচিং ম্যাটেরিয়াল বা পাঠ্যবইয়েও আনন্দ থাকে। আনন্দটা দু’ধরনের। এক আনন্দ হচ্ছে আমি সহজে বুঝছি। আরেক আনন্দ হচ্ছে এই বুঝা থেকে আমি চিন্তা করতে পারছি, চিন্তায় এগিয়ে যেতে পারছি এবং তার ফলে আমার মনের মধ্যে মৌলিক ভাবনা আসছে।”


এ পর্যায়ে ‘আবরণ’ প্রবন্ধে পুঁথিগত শিক্ষায় ভ্রান্তভাবে গড়ে ওঠা ‘স্বদেশপ্রেম’ এর ধারণা ও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তা প্রসঙ্গে অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “এই স্বদেশপ্রেম কাদের জন্যে? আবার সেই পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশের কথায় আসতে হবে। আগেও একবার বলেছি। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলো কিন্তু আবেদন নিবেদনে পড়ে রইলো। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে বলছেন, ‘Politics of mendicancy’ ‘ভিক্ষুকের রাজনীতি।’ একটি বইয়ের ভূমিকায় সেটা লিখেছেন। মানুষকে জাগাতে হয় তার ভাষায় কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ পরে ১৯০৮ এ পাবনায় বাংলা কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বলেন, এইসব রাজনৈতিক সভার বদলে যাত্রা করুন, মেলা করুন। দেশি সংস্কৃতিকে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করবার চেষ্টা করেছেন। যাত্রার মধ্য দিয়ে, মেলার মধ্য দিয়ে শেখানোর ব্যাপারে মানুষের মনে স্বাভাবিক আবেদন আছে। মানুষ আগ্রহ করে শোনে, মেলায় যায়। মেলাতে আপনারা গিয়ে বলুন, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তাদের নিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ বরাবর দেশের কথা ভেবেছেন। আর ঐ যে বললাম, যে মানুষগুলোর জন্যে স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে সেই মানুষগুলো কারা? এইটে রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন। ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ বলে একটি প্রবন্ধ আছে। এটি শিক্ষা বিষয়ক খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ। ‘আত্মশক্তি’তে আছে। ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ এ তিনি কোন মানুষের কথা বলছেন? ঐ যে বইয়ের মধ্যে অলীক উচ্ছ¡াস কল্পনা এইগুলোর কথা বলছেন, তখনকার দিনে ভারতমাতা ভারতলক্ষ্ণী এইসমস্ত নিয়ে বলছেন। কে ভারতমাতা? ভারতমাতা কি একটা ছবি? ভারতমাতা কি চারহাতওয়ালা কোনো মহিলা? আমি আমার দুর্বল স্মৃতিতে উদ্ধার করছি অল্পস্বল্প। একটা চমৎকার প্যারাগ্রাফ আছে এই প্রবন্ধতে। ‘ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণ সুরে বীণা বাজাইতেছেন, এ কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র’…। এটা হচ্ছে অলীক কল্পনা যেটা আমাদের ওপর রাজনীতিকেরা চাপিয়ে দিয়েছেন। তাহলে কোন ভারতমাতা? ‘ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্য ভাণ্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা।’ এই ভারতমাতার ছবি অন্যরকম। একে তো অগ্রাহ্য করা যায় না। এই ভারতমাতার নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ ‘নৈবেদ্য’র প্রাচীন ভারতের ধারণা থেকে সরে এসেছেন। এটা ১৯০৫ সালে লেখা। ‘যে ভারতমাতা ব্যাস-বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের তপোবনে শমীবৃক্ষমূলে আলবালে জলসেচন করিয়া বেড়াইতেছেন তাঁহাকে করজোড়ে প্রণাম করিলেই যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে জীর্ণচীরধারিণী ভারতমাতা ছেলেটাকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিখাইয়া কেরানিগিরির বিড়ম্বনার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবার জন্য অর্ধাশনে পরের পাকশালে রাঁধিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে তো অমন কেবলমাত্র প্রণাম করিয়া সারা যায় না।’ তাহলে একটা অবাস্তব অলীক কাল্পনিক ভারতমাতা, আরেকটা হচ্ছে যথার্থ ভারতমাতা, ঐ বিধবা নারী, ঐ নারীরা যারা ছেলের পথ্য কেনার কথা ভাবছেন, যারা অন্যের পাকশালে রেঁধে বেড়াচ্ছেন। এখানে নারীর ব্যাপারটাও এসেছে, জেন্ডারের ব্যাপারটাও এসেছে। কারণ নারীরা সব সমাজেই একটু তলায় থাকে, যারা তলায় থাকে তাদেরও তলায়। বাস্তববিরহিত হলে যে সমস্তটাই পণ্ডশ্রম হয় সেটা রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ প্রবন্ধে বারবার করে বলেছেন। শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবের যোগ থাকার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন জাতীয় শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন ১৯০৫ এ তখন বলছেন, আমাদের শিক্ষাটা কেমন শিক্ষা হবে? আমরা ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে যে ‘হে মেইকিং’ শিখছি এটা শিখে আমাদের কোনো লাভ নেই। আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের দেশের লোকজ্ঞান আমাদের দেশের লোকজন সম্বন্ধে জানবে, লোকজীবন সম্বন্ধে জানবে, গাছপালা সম্বন্ধে জানবে এটাই আসল কথা। এই আবার পুঁথির বাইরে বেরিয়ে যাবার কথা আসছে। ছাত্রদের রবীন্দ্রনাথ বারবার করে বলছেন, বাংলাদেশের সব জেলা থেকে তোমরা আসছ। তোমরা দেখো সেখানে ধর্মের কী কী আচার হয়, সেখানে কী কী গান হয়, সেখানকার ভাষা কীরকম, সেখানকার লোকজীবন কীরকম। তিনি নিজে লোকশিল্প সংগ্রহ করছেন। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তখন চট্টগ্রাম কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ওখানে কুটিরের চালাঘরের মডেল পাঠাতে, ওখানকার হাঁড়িকুড়ির মডেল পাঠাতে। মেয়েদের বলছেন কোথায় কীরকম আলপনা হয় আমাকে এঁকে পাঠাও। এই যে লোকজীবনের সমস্ত ব্যাপার – আমাদের শিক্ষার সঙ্গে বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে জনগণের সঙ্গে যুক্ত করার যে শিক্ষা, তাতে স্বাদেশিকতার শিক্ষার মধ্যেও এই লোকজীবনটা উঠে আসছে। বড়োলোকেরা শুধু নয়, মধ্যবিত্তেরা শুধু নয়, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা শুধু নয়, এই জনজীবনের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেইজন্যই পরে জনশিক্ষার কথাটা রবীন্দ্রনাথ এতবার করে বলেছেন। তাঁর ‘লোকহিত’ আমরা সবাই পড়েছি। জনশিক্ষা, সবাইকে শেখানোর কথা আছে সেখানে। তিনি বলছেন, মানুষকে একটু লেখাপড়া শিখিয়ে দাও, আর কিছু নয়। অক্ষর পরিচয় শিখিয়ে দাও, তারপর তারা নিজেরাই পড়তে শিখবে, নিজেরাই এগোতে শিখবে। ব্যাকুলভাবে তিনি বলছেন বারবার। এই জনশিক্ষা আমাদের উপমহাদেশে এখনো সমাপ্ত হয়নি। এখনো একশ ভাগের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ নিরক্ষর মানুষ রয়ে গেছে আমাদের দেশে। ভারতে মাত্র ৭৭ শতাংশ সাক্ষর মানুষ এই ২০২০ এ।

“শিক্ষায় আনন্দের উপকরণ পরিবেশের মধ্যে আছে, শিক্ষাকে বইয়ের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে আছে, সংস্কৃতির মধ্যে আছে, আমাদের গান নাচ নাটক নানারকম উদযাপনের মধ্যে আছে, শিক্ষকের সঙ্গে সম্বন্ধের মধ্যে আছে যেখানে শিক্ষক গুরু হয়ে উঠবেন। রবীন্দ্রনাথ এমনকি এমনও বলছেন, একটুখানি বাগান করা শেখাবেন শিক্ষক কিংবা হয়তো গোয়ালে গরু থাকবে, ছেলেমেয়েরা গরু বাছুর পালন করবে, তারা গ্রামে গিয়ে প্রতিবেশী সাঁওতাল পল্লীতে গিয়ে কাজ করবে, তাতে শিক্ষকেরা তাদের সহায় হবেন, তাদেরকে পরিচালনা করবেন। এই যে নানান ধরনের সামাজিক বিস্তারের পরিকল্পনা তার মধ্যেও আনন্দ আছে। গানও আছে রবীন্দ্রনাথের – ‘আমরা চাষ করি আনন্দে/ মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে’ অর্থাৎ চাষের মধ্যেও আনন্দ। আনন্দ সর্বকাজে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার ‘কি ওয়ার্ড’ হচ্ছে আনন্দ। আর সেই আনন্দের উৎস শিক্ষকের সঙ্গে বন্ধনে, সঙ্গীতে নৃত্যে, প্রকৃতির মধ্যে, পাঠ্যপুস্তকে, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে চলে যাওয়ার মধ্যে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে বৃহৎ মানুষের সঙ্গে সম্মিলনে।”

এ পর্যায়ে মাতৃভাষায় সাধারণ শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসঙ্গে ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধ সংকলনের ‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’, ‘শিক্ষার হেরফের প্রবন্ধের অনুবৃত্তি’ ও ‘প্রসঙ্গকথা’ প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখার অংশবিশেষ উদ্বৃতি আকারে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়।
অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “এটা ঠিক যে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়েছিল। মাতৃভাষা কথাটা আমি একটুখানি ব্যাখ্যা করি। ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি বলে মাতৃভাষা কথাটা আমার কাছে প্রশ্নসংকুল। ভাষাবিজ্ঞানে বলে, শিশু যে ভাষায় প্রথম জন্মায় সেটাই তার মাতৃভাষা। শিশু যে ভাষায় প্রথম জন্মায় সেটা তার গ্রামের ভাষা, পরিবারের ভাষা, জেলার ভাষা। চট্টগ্রামের শিশুর মাতৃভাষা চট্টগ্রামের ভাষা, মেদিনিপুরের শিশুর মেদিনিপুরের ভাষা। কিন্তু এই ভাষায় সবার শিক্ষার সুযোগ হয় না। তার কারণ হলো, রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব না সমস্ত স্কুলে সেই জায়গার ভাষায় শিক্ষা দেবে, পাঠ্যবই ছাপবে। এভাবে সম্ভব না যেমন একদিকে, অন্যদিকে সেই ভাষায় শিখে সে যদি বাইরে চাকরি করতে আসে তাহলে সেই ভাষার শিক্ষা তার কাজে লাগবে না। সেইজন্যে সমস্ত ভাষাতে একটা স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত ভাষা তৈরি হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছিল যেটা আমরা মুখে বলতাম না কিন্তু লেখাতে খুব চালু হয়ে গিয়েছিল। সাধু ভাষাতে লেখা হতো। মোটামুটি সাধু ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন। ঐ যে ইংরেজি স্কুল বা সোসাইটি, পরে অক্ষয়কুমার দত্ত এবং বিদ্যাসাগর পর্যন্ত। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন ‘বোধোদয়’। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিদ্যাসাগর একদম খাঁটি বামুন, বন্দোপাধ্যায় বামুন হয়েও ধর্ম নিয়ে কোনো মাথা ঘামাননি। সারাজীবন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান পড়েননি বিদ্যাসাগর, স্কুলে পড়েননি, সংস্কৃত কলেজে পড়েননি। কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর বিপুল আগ্রহ। ফলে ‘বোধোদয়’ এবং অন্যান্য লেখার মধ্যে সব বিজ্ঞানের বিষয় লেখা। ‘বোধোদয়’ এর প্রথম প্রবন্ধই হচ্ছে ‘পদার্থ কী?’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরেও লিখেছেন বিজ্ঞান নিয়ে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সালে ‘বিশ্বভারতী পরিচয়’ বলে যেই বইটা লিখলেন তাতে বিজ্ঞান সম্বন্ধে চমৎকার আলোচনা আছে। মাতৃভাষায় না শিখলে আমরা যে বুঝতে পারব না, মৌলিকভাবে চিন্তা করতে পারব না এটা এখন তো ইউনেস্কোও বলছে। মাতৃভাষায় শিক্ষা সম্বন্ধে আছে – I dont enjoy which I dont understand. এটা উদ্বৃতি দিয়ে আছে। শিখতে হবে মাতৃভাষাতে। আমি এবার বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে ২২শে ফেব্রæয়ারি একটা বক্তৃতা দিয়েছি, ইংরেজি ভাষায়। তাতে বলেছি যে, মাতৃভাষায় সমস্ত স্তরের শিক্ষা হোক কিন্তু ইংরেজিটা গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হোক।
“শিশু বিকাশের শিক্ষা, আনন্দের ব্যাপারটা শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে কীভাবে জড়িত এবং আনন্দের কী কী উপকরণ উপাদান সেগুলো সম্বন্ধে আমরা বললাম। এবারে যাই উচ্চশিক্ষায়। রবীন্দ্রনাথ তো উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানও তৈরি করলেন আস্তে আস্তে। ১৯২২ এ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হলো। তারও একটা প্রস্তুতি ছিল। ১৯১২র পর থেকেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। নানা জায়গায় তিনি বলছিলেন, ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব কিছু জ্ঞান আছে, কিছু দর্শন আছে, ধর্মতত্ত¡ আছে, ভাষা আছে, নিজেদের সংস্কৃতির একটা চরিত্র আছে – এগুলোর কথা পৃথিবী জানবে না? বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তাতে এসব জানবার সুযোগ খুব কম। প্রথমদিকে তো ছিলই না। পরে আস্তে আস্তে ভারতীয় ভাষাগুলো পাঠ্য হওয়ার পর থেকে খানিকটা ভারতীয় উপাদান, দক্ষিণ এশীয় উপাদান তার মধ্যে ঢোকে। নইলে বলা চলে প্রায় ছিলই না। ‘সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান কালচার’ বলে একটা বক্তৃতা রবীন্দ্রনাথ মাদ্রাজে দিয়েছিলেন ১৯১৯ এ। তিনি বললেন, আমি এরকম একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভাবছি যা ভারতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র হবে এবং তাতে সারা বিশ্ব থেকে পড়তে আসবে ছেলেমেয়েরা। এবং সংস্কৃতের ঐ কথাটির মতো – ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্’ – অর্থাৎ যেখানে সারা পৃথিবী একটা বাসায় মিলিত হবে। ‘দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে’ লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ আরো আগেই, ১৯১০ এ। বাইরের লোকেরা তাদের জ্ঞান নিয়ে আসবে, আমাদের জ্ঞান নিয়ে যাবে। এবং এটা সমাজের নিজের মধ্য থেকে তৈরি হবে। কোনো রাজা তাকে চাপিয়ে দেবে না। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলে ভারতে কোলকাতা, বম্বে ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল। তিনি বলেছেন, আমাদের গাছের মতো তা তৈরি হয়নি, মাটি জল হাওয়া নিয়ে তৈরি হয়নি। তিনি বলছেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে আমাদের সমাজের, একটা গাছ যেমন চারপাশ থেকে জল হাওয়া আলো উত্তাপ নিয়ে তৈরি হয় সেইরকম করে তৈরি হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্বভারতীতে বিশ্বজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় জ্ঞান যুক্ত হয়। ‘শিক্ষা’ বইয়ে ‘শিক্ষার মিলন’ বলে একটা প্রবন্ধ আছে ১৯৩০ এর কাছাকাছি সময়ে লেখা। এটার উৎস হলো মহাত্মা গান্ধীর একটা কথা – আমাদের পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান দরকার নেই। মহাত্মা গান্ধী ঐভাবে বলেছিলেন কিনা কথাটা জানি না। তাতে রবীন্দ্রনাথ তখন খুব ক্ষুব্ধ হন। রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধা খুবই ছিল কিন্তু সময় সময় রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধীর তীব্র প্রতিবাদও করেছেন। যেমন ১৯৩৪ সালে বিহারের ভূমিকম্পে মহাত্মা গান্ধী বললেন, আমরা হরিজনদের ঘেন্না করি এই পাপে এই ভূমিকম্প হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বললেন, এই কুসংস্কার আমাদের কাছে বলবেন না যে, পাপের ফলে হয়েছে। এটা প্রকৃতিক ঘটনা। অন্য জায়গায় হরিজনদের ওপর অত্যাচার হয় না? সেখানে কেন ভূমিকম্প হলো না? বিহারেই কেন? রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের সময়ও প্রতিবাদ করেছেন। এইখানেও প্রতিবাদ করলেন। তিনি লিখেছেন, ‘দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।’ আমরা জ্ঞানের দরজা বন্ধ করে দেব! পাশ্চাত্যের জ্ঞান আমাদেরকে এতটা এগিয়ে নিয়ে এসেছে, যেই জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সভ্যতা এগিয়েছে তাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করব! শিক্ষার মিলন মানেই হচ্ছে সমস্ত শিক্ষা একসঙ্গে মিলিত হবে। যা সত্যিকারের শিক্ষা, যা যথার্থ শিক্ষা তা আমাদের অনাত্মীয় নয়, তা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। আমরা সে শিক্ষাও নেব আবার আমাদের দেশের যে প্রাচীন শিক্ষা বা চিরকালীন শিক্ষা সেই শিক্ষাও আমরা পাশ্চাত্যকে দেবার চেষ্টা করব আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্য দিয়ে। সারা পৃথিবীতেই ভারত চর্চা বা দক্ষিণ এশীয় চর্চা যে নামেই হোক, প্রাচ্যের জ্ঞানও পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নেবার চেষ্টা করছে, বুঝবার চেষ্টা করছে। কখনো সাউথ এশিয়ান ডিপার্টমেন্ট করে, কখনো পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের মধ্যে, আবার কখনো দর্শনের মধ্যে ভারতীয় দর্শন পাঠ্য হয়েছে ইত্যাদি। এই উচ্চতর শিক্ষায়, শিক্ষার মিলনের ব্যাপারটাতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলেন, বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। কাজেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তাকে এবার আমরা মানবজীবনের প্রগতির সঙ্গে বা আমাদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারি। শৈশবের শিক্ষার কথা আমরা বলেছি। যাতে আনন্দের কথা সবার আগে এসেছে। আনন্দের উপাদান ও উপকরণগুলো আমরা দেখলাম। আনন্দ প্রকৃতিতে, আনন্দ সংস্কৃতিতে, আনন্দ ভাষায়, আনন্দ গুরুর সঙ্গে সম্বন্ধ বন্ধনে, আনন্দ সর্বকাজে। এবং সেইভাবে শিশু বড়ো হবে শিখতে শিখতে, মৌলিক শিক্ষা শিখে বুঝতে বুঝতে শিখবে, উপভোগ করতে করতে শিখবে। যার জন্য সত্যি সত্যি শান্তিনিকেতন আশ্রমের মতো হয়তো আমরা আশ্রম নির্মাণ করতে পারব না। কিন্তু আমরা যদি তার মূল ধারণাগুলো নিয়ে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী আমাদের শিক্ষালয়গুলোর মধ্যে, স্কুলগুলোর মধ্যে কিছুটা অবকাশ তৈরি করতে পারি তাহলে মনে হয় অনেকটা এগিয়ে যাব। আর বড়োদের শিক্ষার ব্যাপারে মূল বিষয় হচ্ছে শিক্ষার মিলন বা বিদ্যাসমবায়ের ধারণা। আমরা জানি, মধ্যপ্রাচ্য একসময় পৃথিবীর জ্ঞানকে রক্ষা করেছে, গ্রিক বইগুলো রক্ষা করেছে। এবং মধ্যপ্রাচ্য রক্ষা করেছিল বলেই আমরা প্রাচীন গ্রিক ও ইউরোপের জ্ঞান পেয়েছি। কাজেই মধ্যপ্রাচ্যের নিজস্ব জ্ঞান, সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞান, মানুষের জ্ঞানকে একসঙ্গে সংহত করে যে শিক্ষা, সেই শিক্ষাই আমাদের দেশের আমাদের তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেবে এবং সেজন্যই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পরিকল্পনা করেছিলেন, যাতে সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানের ও সংস্কৃতির মিলন ঘটে। এই মিলনের কথা তাঁর বড়োদের শিক্ষার মূল কথা। ছোটোদের শিক্ষায় যেমন আনন্দের কথা মূলকথা, বড়োদের শিক্ষায় তেমনি জ্ঞান এবং সংস্কৃতির মিলনের কথাটা মূল কথা। এইভাবে আমরা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তাকে দুটো স্তরে বিন্যস্ত করে দেখতে পারি।”

এ পর্যায়ে বিদ্যা সমবায়, স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেও সমবায়, একাকার বনাম এক হওয়া, স্বাজাত্যাভিমান দূর করা, সর্বোপরি শিক্ষার মিলন বিষয়ে ‘বিদ্যা সমবায়’ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ ও ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখার অংশ উদ্বৃতি আকারে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়।

প্রশ্নোত্তর পর্বে “রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কোনো ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ হয়েছিল কি?” – এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “হ্যাঁ সুযোগ হয়েছিল দু’রকম। এক হচ্ছে রবীন্দ্রভারতীর সিলেবাস আমি গিয়ে করিনি। প্রত্যেক বিভাগেই সেটা দর্শনেই হোক নীতিবিজ্ঞানেই হোক, রবীন্দ্র চর্চা রবীন্দ্রনাথের লেখা এসব ছিল। সেটা সেখানকার অধ্যাপকেরাই করেছিলেন। তাঁদেরকে সেজন্য কৃতিত্ব দিতে হবে। এটা হয়ে এসেছে। অর্থাৎ সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ সেই সম্বন্ধে কী বলেছেন সেই চিন্তা নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সুযোগ ছিল পাঠক্রমে। আমি যেটা করেছিলাম সেটা বলা যায় একটা উৎসবের ব্যাপার। আমি একটা বার্ষিক রবীন্দ্রভারতী উৎসবের ব্যবস্থা করেছিলাম। এমনিতেই তো নানা সময়ে নানারকম উৎসব হতো কিন্তু শীতকালে সাতদিন কোলকাতার সবগুলো প্রায় সরকারি রঙ্গমঞ্চ নিয়ে রবীন্দ্রভারতীর ছেলেমেয়েরা নাটক করবে, গান গাইবে, নাচবে, বক্তৃতা দেবে, আবৃত্তি করবে এরকম একটা রবীন্দ্রভারতী উৎসবের আমি প্রবর্তন করেছিলাম। যেটা খুব উৎসাহ সঞ্চার করতো। আমরা জোড়াসাঁকো থেকে শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করে, চমৎকার সেজে রবীন্দ্রসদনে আসতাম। সেখানে উৎসব উন্মোচিত হতো। আমি সেটা করেছিলাম। সেটা এখনো চলছে দেখে আমি খুশি হই।”

“আশ্রমভিত্তিক শিক্ষাকে সার্বজনীন করা ব্যয়বহুল। একটি শান্তিনিকেতন সব বাচ্চার চাহিদা মেটায় না। এতে করেও তো একধনের এলিটিজম তৈরি হচ্ছে।” – এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “এটি খুব সঙ্গত প্রশ্ন। শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে তো সেটা আছেই। রবীন্দ্রনাথ একটা মডেল তৈরি করেছেন এবং আমরা জানি এইরকম মডেলে সারা পৃথিবীতে অনেক জায়গায় স্কুল হয়েছে। আমি ইন্দোনেশিয়ায় এই মডেলে স্কুল দেখে এসেছি। শান্তিনিকেতন মডেল। দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণমূর্তির আশ্রমে এইরকম একটি মডেল আছে। অবশ্যই সঙ্গত প্রশ্ন যে এতে এলিটিজম তৈরি হয়, ব্যয়বহুল হয় কিন্তু আমরা আমাদের প্রথাগত শিক্ষার মধ্যেই খানিকটা ভাঙচুর করতে পারি। অর্থাৎ আমাদের শিক্ষালয়গুলোর মধ্যে একটুখানি খোলামেলা অবকাশ থাকে কি না। আমরা সব পারব না। সব জায়গায় শান্তিনিকেতন তৈরি করা যাবে না। কিন্তু Joyful Learning এর একটা ধারণা এসেছে ভারতে, ২০০১ থেকে। রবীন্দ্রনাথের কথাটাই তাঁরা নিয়েছেন। আমরা এইটে এনেছি অনেক স্কুলে। বাংলাদেশেও হয় আমি দেখেছি, ভারতেও হয়। স্কুলে নানারকম উৎসব অনুষ্ঠান হয়। পহেলা বৈশাখ হয়, পঁচিশে বৈশাখ হয়, স্বরস্বতী পুজো হয় বা বসন্ত উৎসব হয়। এই ব্যাপারগুলো আগে তো তেমন ছিল না। এই ‘জয়ফুল লার্নিং’ এর ব্যাপারটা সাধ্যমতো নিয়ে আসার চেষ্টা করা যায়। শান্তিনিকেতনের মতো বড়ো আশ্রম ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার ধারণাটি খানিকটা আমরা নিয়ে আসতে পারি। কীভাবে কতটা আনা হবে সেটা রাষ্ট্র ভাববে, সমাজ ভাববে। কিন্তু এলিটিজম বলে পুরোটা প্রত্যাখ্যান করা মূর্খামি হবে বলে আমার কাছে মনে হয়।”

সবশেষে “স্ত্রীশিক্ষা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে নারীর অধিকার হিসেবে দেখেছেন, সে অধিকার দেয়ার জন্যে সমাজকে, প্রকারান্তরে সমাজের কর্ণধার পুরুষকেই আহ্বান জানিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত ‘ভালোবাসার কষ্টিপাথরে’ই মেয়েদের বিচার করতে চেয়েছেন। বলছেন জীবনের দায় দাসত্বের বারো আনা পুরুষের কাঁধে। তথ্য উপাত্ত এমনকি আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় আমরা কিন্তু উল্টোটাই দেখি – জীবন যাপন, প্রজাতির প্রবাহ বা উৎকর্ষ, উৎপাদন এর সব ক’টিতেই নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেই উদার রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই, নারীর যথাযথ মূল্যায়ন, প্রকৃত ক্ষমতায়নে রক্ষণশীল পুরুষের তুলনায় উদার হলেও এই বিষয়ে তাঁকে সেভাবে পাই কি?” – এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “স্ত্রী শিক্ষা লিখেছেন তিনি লীলা মিত্রের লেখা একটি চিঠির জবাবে। রবীন্দ্রনাথকে ইতিহাসের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আমাদের দেখতে হবে। তবে তিনি সীমাবদ্ধতাকে কীভাবে অতিক্রম করবার চেষ্টা করেছেন আমরা সেটা দেখব। আগে ধারণা ছিল যে, মেয়েরা শিখবে, সংসারের কাজে লাগবে। অর্থাৎ স্বামীর কাছে চিঠি লিখবে, শাশুড়িকে রামায়ণ মহাভারত পড়ে শোনাবে ইত্যাদি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলছেন তা নয়। মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে তাদের নিজেদের জন্যে, তাদের নিজেদের মানবিক বিকাশের জন্যে। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে তাদের সেটা দাবি এবং তাদের সেটা অধিকার। এই জায়গাটা মনে করি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ‘কালান্তর’ এর ‘নারী’ প্রবন্ধে এ নিয়ে লেখা আছে। সমস্ত ক্ষেত্রে নারীরা যে সুবিধে সুযোগ পাবে তা নাও হতে পারে তার শারীরিক ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার জন্যে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পরে অনেকটা এগিয়েছেন। ১৯১৪ নাগাদ লেখা গল্পগুলো যদি আমরা পড়ি তার প্রতিফলন পাব। যেমন ‘স্ত্রীর পত্র।’ ‘স্ত্রীশিক্ষা’ প্রবন্ধটা একটু আগের লেখা। অর্থাৎ ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে আমাদের সেসব পাঠ করতে হবে আর এটাও বুঝতে হবে সীমাবদ্ধতাকে তিনি কতোটা ডিঙোবার চেষ্টা করেছেন।”
আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিবেদিত পাঠশালার আসরে আলোচক অধ্যাপক পবিত্র সরকারের গভীর, প্রাঞ্জল, তথ্যনিষ্ঠ, আন্তরিক ও সহজবোধ্য আলোচনা এবং প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁর প্রানবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দর্শক-শ্রোতারা প্রাণভরে উপভোগ করেন। এই আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।