আনিসুল হক : ‘দোস্ত, আমার একটা লাভস্টোরি ছিল। তোমারে বলা দরকার?’

‘মানে?’

‘আমি কেন বাঁইচা উঠলাম, জানো?’

‘কেন?’

‘প্রেমের কারণে।’

‘তাই নাকি! গল্পটা তো শোনা লাগে!’

‘দোস্ত, আমার বাসায় কবে আসবা?’

আমি বলি, ‘আসব, দোস্ত।’

‘দোস্ত, আমি শুকায়ে কাঠি হয়া গেছি, বুঝলা! আমার ওজন ছিল ৭৬ কেজি, এখন হইছে ৬২ কেজি। বুঝলা! ১৩ দিনে ১৩ কেজি হাপিস! দেখলে চিনতে পারবা না!’

‘আচ্ছা, তোমারে ভিডিও কল দিই। দেখি, তোমারে চিনতে পারি কি না!’

আমি আবুল বাশারকে ভিডিও কল দিই। আমার ক্লাসমেট আবুল বাশার। আমার মতোই বয়স হবে, ৫৫-এর কোঠায়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী। প্রায়ই ফেসবুকে সেলফি দেয়—এখন আমি প্লেনে, যশোর যাচ্ছি, আকাশে মেঘ। দোয়া কাম্য। এরপরের সেলফি হবে একটা স্পিডবোটে। কোনো নদীবক্ষে। নির্মাণাধীন বাঁধ দেখতে যাচ্ছে। ওর সেলফিগুলোও হয় মারাত্মক। মনে হচ্ছে, কেউ তার পেছনে বন্দুক ধরে আছে, বলছে, হাসো। আর সে মৃত্যুর আগে শেষ হাসি হাসছে।

আবুল বাশার ফোনে বলে, ‘দোস্ত, আমি করোনাবিজয়ী। তোমাদের কাগজে আমাকে নিয়া রিপোর্ট করো।’

আমি হাসি। সবাই মনে করে, তার জীবনের কাহিনি রিপোর্ট হওয়ার মতো, সিনেমা হওয়ার মতো, নাটক হওয়ার মতো।

ভিডিওতে আবুল বাশারকে দেখে চমকে উঠি, এটা কি প্রকৌশলী বাশার, নাকি তার কঙ্কাল! মাত্র দু–তিন সপ্তাহে একটা লোক এতটা রোগা হতে পারে!

বাশার বলে, ‘দোস্ত, করোনা হসপিটালের আইসিইউতে পইড়া ছিলাম। নাকের মধ্যে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা লাগানো। কেউ আমার কাছে ভিড়ত না। ডায়াপার পরায়া দিছিল। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠতে পারতাম না। বিছানাতেই সব। খাবার ছিল লিকুইড। একটা ব্রাদার আইসা দুই বেলা খাওয়ায় দিত। প্রথম দিকে তো কেবিনেই রাখছিল। ভালো লোকটা। এক রাতে শ্বাসকষ্ট। কী ভীষণ সেই কষ্ট! মনে হয়, হাপর দিয়া কেউ বুকের অক্সিজেন সব বাইর কইরা নিতেছে। মইরা যাওয়ার জোগাড়। অক্সিজেন দিল। তারপর নিয়া গেল আইসিইউ। হাই ফ্লো অক্সিজেন দিল। তখন তো বুঝি নাই। এখন বুঝছি। আমার লাংস দুইটা পুরাই গেছিল। ১০ লিটার পার মিনিট, বিশ লিটার…করতে করতে ৭০ লিটার পর্যন্ত উঠল অক্সিজেন। আমারে বলে, ভেন্টিলেটরে দিবে। আমার তখন তোমার ভাবির মুখটা মনে পড়ল। শান্ত আর শান্তার মুখটা মনে পড়ল। শান্ত পড়ে এনএসইউতে। প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা দিতে হয়। শান্তার বিয়ার জন্য টাকা জমাইতেছি। দোস্ত, তোমার ভাবি তো কোনো চাকরি করে না। আমি মারা গেলে এক দিনে একটা ফ্যামিলি পথের ফকির হয়া যাবে। তাই আমি বললাম, “ভেন্টিলেটরে যাব না। আপনারা অক্সিজেনে রেখে দেখেন।” দোস্ত, ফোনে সব কথা বলা যাবে না। তুমি আসো আমার বাড়ি। সামনাসামনি গল্প বলব।’

আমি বলি, ‘না দোস্ত, করোনার মধ্যে বাইর হব না।’

‘কী কও। আমার তো করোনা নেগেটিভ। তারপরে তিন সপ্তাহ পার হইছে।’

আমি মনে মনে বলি, তোমার বউ, তোমার ড্রাইভার, তোমার দারোয়ান, তোমার মেয়ে, তোমার বাড়ির কাজের লোক—কেউ না কেউ এসিমপটোম্যাটিক ক্যারিয়ার হতে পারে। নিজে ভুগছে না, আমাকে ধরিয়ে দেবে। মাথা খারাপ! আমি যাব না।

তখনো সে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘দোস্ত, আমার একটা লাভস্টোরি ছিল। তোমারে বলা দরকার।’

আমি আবারও বলি, ‘মানে?’

বলে, ‘আমি কেন বাঁইচা উঠলাম, জানো?’

‘কেন?’

‘প্রেমের কারণে।’

‘তোমার গল্পটা তো আমার শোনা লাগে। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় প্রেমের গল্প দিতে হবে।’

‘আসো না, চইলা আসো। সবকিছু ডিসইনফেকটেড কইরা রাখব স্যানিটাইজার স্প্রে কইরা স্যানিটাইজ কইরা রাখব।’

‘না দোস্ত, তুমি হোয়াটসঅ্যাপে বলো।’

‘আরে, সামনাসামনি না বললে শান্তি হয় নাকি।’

‘আরে বলো।’

‘শোনো, মইরা গেছিলাম। ৭০ লিটার পার মিনিট অক্সিজেন দেয়। আমি তবুও সামলাইতে পারি না। দুইটা প্লাজমা দিল। যত ইনজেকশন আছে দিতেছে। অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, স্টেরয়েড, ইমিউন রিডিউসার…’

‘ইমিউন রিডিউসার?’

‘হ্যাঁ। ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইমুইন জাইগা উইঠাই বডির সেলগুলারে মাইরা ফেলে। তাই এটাও দিতে হয়। আমার তো এত জানা নাই। পরে সব শুনছি। তো আমার হুঁশ নাই। আমি মরার মতো পইড়া আছি। এই সময় এক নারীকণ্ঠ বলে, “আজকে থেকে আমার ডিউটি। আগের শিফটের ডাক্তাররা আইসোলেশনে যাবে। আমি আপনাকে দেখভাল করব। আমার নাম মনীষা।” মনীষা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্রেন জাইগা উঠল। বুঝলা দোস্ত। দোস্ত, তোমার মনে আছে মনীষা নামটা?’

‘আমার? মনে আছে আছে লাগে!’

‘আরে একবার ইউনিভার্সিটি হঠাৎ ছুটি দিয়া দিল। মনে হয় এরশাদ ভ্যাকেশন। তুমি, আমি সবাই মিলা গেলাম গাবতলী। মনে আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি তো চইলা গেলা রাজশাহীর দিকে। আমি আর ওই মেয়ে গেলাম রংপুরের দিকে। সে রংপুর মেডিকেলে পড়ত। ঢাকার মেয়ে। আমাদের ইউনিভার্সিটি ছুটি। কিন্তু তার কলেজ খোলা।’

‘হ্যাঁ। সুইট একটা মেয়ে ছিল। গায়ে অ্যাপ্রোন পরা ছিল। আমরা টিকিট কাটছি, সে-ও পেছনে ছিল। আমরা যাব আরিচা। তারপর ফেরি ধরব। ওইপারে গিয়া আমি নিব রাজশাহীর বাস। তুমি নিবা রংপুরের বাস।’

‘রাইট। তখন ওই মেয়ে বলে, “আমারও একটা টিকিট করে দেন না?’ আমি জিগাইলাম, “কই যাবেন?” বলে, রংপুর। আমি বলি, “আমিও রংপুর যাব। আমরা সবাই বুয়েটের। হল ভ্যাকান্ট করে দিছে।” তারপর আমরা একসঙ্গে আরিচা গেলাম। ফেরি পার হলাম। ওই পারে গিয়া তুমি রাজশাহীর বাসে উঠলা। আমি রংপুরের বাসে উঠলাম। আমি আর মনীষা।’

‘রাইট, রাইট।’

‘এরপর রংপুরে নাইমা আমি তারে রিকশা পর্যন্ত কইরা দিলাম। তারপর আমি আমার বাড়ি গেলাম। পরে আমি তার সন্ধানে রংপুর মেডিকেলে আমার ফ্রেন্ডের কাছে গেলাম। শুনলাম, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। লেডিস হলে থাকে। আমি বিকেলে লেডিস হলে গিয়া তারে ডাইকা নামাইলাম। অত ডিটেইল তো মনে নাই। আমি তারে দুইটা চিঠি লিখছিলাম। সে উত্তর দেয় নাই। কিন্তু তারে আমি জীবনে ভুলি নাই। পরে আরেকবার রংপুর গিয়া তার খোঁজ নিলাম। সে মাইগ্রেট কইরা সলিমুল্লাহ না কই গেছে। আর খোঁজ পাইলাম না। কিন্তু তারে তো আমি ভুলি নাই। আমার রুমে টেবিলের পাশের দেয়ালে মনীষা কৈরালার ছবি টাঙায়ে রাখছিলাম, মনে আছে?’

‘আছে। আমরা তো হলের আনন্দ বিচিত্রায় মনীষা কৈরালার ছবি দেখলেই ছিঁড়া তোমার কাছে নিয়া যাইতাম! সেই মনীষা? এত দিন পর?’

‘আমি ওই বেঘোর অবস্থায় বললাম, আপনি মনীষা। আপনি রংপুর মেডিকেলে ছিলেন।’

‘দুই মাস ছিলাম। আপনি জানলেন কী করে?’

‘আমি বাশার। বুয়েটে পড়তাম!’

‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। দুইটা চিঠি লিখে আপনি হারিয়ে গেছিলেন। আপনাকে আমি কত খুঁজেছি পরে। আচ্ছা, আপনি সেরে উঠুন। বাকি গল্প পরে করব।’

‘তো আমি যখন মারা যাব যাব করছি, বাড়িতে কান্না, রংপুরে পাড়ার মসজিদে স্পেশাল মিলাদ চলছে, তখন আমার মনের মধ্যে কে যেন ডেকে উঠল, মনীষা তোমাকে কত খুঁজেছে, সেই গল্পটা তো জানতে হবে। মোরো না প্রকৌশলী আবুল বাশার, বেঁচে থাকো। আমি বেঁচে উঠলাম। ৭০ লিটার অক্সিজেন কমে ৫০ হলো, এরপর দিনই ১৫। তারপর ১০…সাত দিন পরে আমাকে কেবিনে দিল।’

‘তারপর কী হলো?’

‘মনীষা এল। বলল, “এবার আপনাকে বলি, কেন আপনাকে খুঁজেছিলাম। হঠাৎ করে আমার আব্বুর হার্ট অ্যাটাক করল। উনি ভাবলেন, উনি আমাদের দুই বোনকে বিয়ে দেবেন। বড় বোনকে দেখতে এক পাত্র এল। সরকারি অফিসার। আপুকে পছন্দ করল না। বলল, মনীষাকে পছন্দ হয়েছে। আমি বললাম, অসম্ভব। আব্বু বলল, দুই দিনের মধ্যে পাত্র ধরে আনো। বলো, একে বিয়ে করব। যাকে ধরে আনবে, তার সঙ্গেই তোমার বিয়ে দেব। যাও। আমার এক নম্বর চয়েস ছিল আমার সঙ্গে কোচিং করেছিল একজন। শাহিন নাম। তাকে বললাম। সে বলল, বিয়ে করা সম্ভব না। তখন আপনার কথা মনে পড়ল। আপনাকে আমি কত যে খুঁজেছি।”’

‘তারপর?’

‘আপনাকে পেলাম না। ওই সরকারি অফিসারকেই বিয়ে করলাম। তার সঙ্গেই আছি। দুইটা বাচ্চা। দুইটাই মেয়ে। বড় হয়ে গেছে। বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।’

আমি বললাম, ‘ভালো তো। এখন অনেক অবসর। তোমার অবসর ভালো কাটবে, দোস্ত।’

বাশার বলল, ‘তো ওই মেয়ে আমাকে বাঁচাল। আমি তো আইসিউতে শুয়ে ওকে দেখতে পেতাম, আঠারো-উনিশ বছরের এক কিশোরী। খোলা চুল। টানা টানা ভাসা–ভাসা চোখ। কাঁঠালচাঁপা ফুলের রঙে রং। একটা আকাশি রঙের জামা পরা। পায়ে দুই ফিতার স্যান্ডেল। পা দুটো হাঁসের পায়ের মতো, কিশোরীর, ঘুঙুর রহিবে রাঙা পায়…’

কয় কী হালায়। আমগো আবুল বাশার কবিতা কয়!

‘তারপর?’

‘তার আর পর নাই।’

‘এখন কী অবস্থা? চালায়া যাচ্ছ?’

‘না, দোস্ত।’

‘ক্যান?’

‘মনীষা যেই না তার মাস্কটা খুলল, দেখি, এ তো মনীষা না। কোথায় সে আঠানো–উনিশ বছরের কিশোরী? তার বদলে ৫৪ বছরের এক প্রৌঢ়া। গালে মেছতা। চোখের নিচে কালি। চুলে পাক ধরছে। করোনার কালে চুলে কালার দিতে পারে নাই। এ তো আমার মনীষা না। এ তো আমার মনীষা না। সে আমাকে বাঁচায়া দিল। আবারও মারতে পারত। কিন্তু কিশোরী মনীষার বদলে বয়স্কা ডাক্তার মনীষা এসে আমার সংসারটা বাঁচায় দিয়া গেল!’

আমি হাসতে লাগলাম।

আবুল বাশার বলে, ‘দোস্ত, তুমি হাসো ক্যান? আমার জীবনে আমি কিন্তু তখনো ছ্যাঁক খাই নাই। ওই মাস্কটা খোলার পরে ছ্যাঁক খাইলাম।’

আমি বলি, ‘দোস্ত, তোমার নিজের চেহারাটা তুমি একটু ভালো কইরা দেখো। তুমি নিজেও বুইড়া ধ্যারধ্যারা হয়া গেছ।’

‘যাও। নিজের বয়স নিজের কাছে বেশি লাগে না। মোষের শিং কি মোষের কাছে ভারী লাগে?’

আমি বললাম, ‘তা ঠিক। আমারও তো নিজেরে হালকাই লাগে। হা হা হা…’