ফারহানা আজিম শিউলী : টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র উনপঞ্চাশতম ভার্চুয়াল আসরটি মে মাসের এগারো তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব মা দিবসে (সদ্য প্রয়াত) সংগ্রামী মা লতিফা আজিম মায়ার স্মৃতিতে নিবেদিত পাঠশালার এ আসরে ‘সাহিত্যে মা’ বিশেষ করে ‘উপন্যাসে মা’ শিরোনামে মা নিয়ে লেখা এবং মায়ের লেখা সাহিত্যের সমাজতাত্তি¡ক-সামাজিক-মনস্তাত্তি¡ক দিক এবং বিশ্বসাহিত্যের মায়ের কোলাজে নিজদের মা’কে ঘিরে স্মৃতিনির্ভর দার্শনিক ভাবনা নিয়ে আলোচনায় করেন প্রাবন্ধিক-অনুবাদক-শিক্ষক আবেদীন কাদের ও লেখক নিজে।
বিশ্বসাহিত্যে মা’র রূপায়ন হয়েছে নানাভাবে-নানা মাত্রায়। রুশ বিপ্লবের পটভ‚মিতে লেখা ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ (১৯০৬)-তে পাই সন্তান বিপ্লবী হয়ে ওঠার সাথে সাথে সাধারণ মা থেকে রূপান্তরিত বিপ্লবী-কমরেড মা’কে। নোবেলজয়ী ইতালিয়ান লেখক গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দার ‘লা-মাদ্রে’ (১৯২০) উপন্যাসের মায়ের জীবন পরিক্রমায় উঠে আসে মা-ছেলের সম্পর্কের নির্ভরতা-মাত্রিকতা, মায়ের ত্যাগস্বীকার, পবিত্রতার অন্বেষণ এবং ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ও সামাজিক প্রত্যাশার মধ্যকার দ্ব›দ্ব। নোবেলজয়ী আমেরিকান ঔপন্যাসিক-মানবাধিকার কর্মী পার্ল এস বাকের উপন্যাস ‘দ্য মাদার’ (১৯৩৩) গ্রামীন চীনের রূপান্তরিত হতে চলা সমাজে এক কৃষাণীর জীবনের মাতৃত্ব, লিঙ্গীয় ভ‚মিকা, পরিবার ও ঐতিহ্যকে তুলে আনে। ইতালিয়ান সাংবাদিক ও লেখক ওরিয়ানা ফাল্লাচির উপন্যাস ‘লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন’ (১৯৭৫) জরায়ুতে বেড়ে উঠা এক ভ্রূণের সাথে অবিবাহিত মায়ের কথোপকথন। মা’র প্রস্থানের পরপর নিজ মা’কে নিয়ে লেখা নোবেলজয়ী লেখক আনি অ্যারনোর ‘অ্যা উওম্যান’স স্টোরি’তে (১৯৮৮) দেখা যায় মা-মেয়ের নিবিড়-দ্বা›িদ্বক বন্ধন এবং জীবনের পরিক্রমায় এর নবরূপায়ন। মার্কিন সাহিত্যিক লুইজা মে অ্যালকটের ‘লিটল উইমেন’ (১৮৬৮) উপন্যাসে পাই উনবিংশ শতাব্দীর গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত আমেরিকার একটি পরিবারের এমন এক মা’কে যে অনটন ও আনন্দে যুগপৎভাবে তার চার কন্যাকে বড় করে এবং তাদেরকে স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী হবার প্রেরণা যোগায়। মার্কিন লেখক হার্পার লী’র পুলিৎজারজয়ী ‘টু কিল অ্যা মকিং বার্ড’ (১৯৬০) উপন্যাসে শ্বেতাঙ্গ ফিঞ্চ পরিবারের আফ্রিকান-আমেরিকান রাঁধুনি ক্যালপার্নিয়া মাতৃহারা সন্তানদের ভিন্ন পথ-মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার শিক্ষা দেয় এবং নিজেই হয়ে ওঠে মাতৃসমা। মার্কিন গৃহযুদ্ধোত্তর সময়ের পটভ‚মিতে লেখা মার্কিন লেখক টনি মরিসনের ‘বিলাভেড’ (১৯৮৭) উপন্যাসের পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস মা গ্রেফতার হবার আগে তার সন্তানদের দাসত্বে ফিরে না-যাওয়ার জন্য তাদের হত্যা করার চেষ্টা করে এবং তার দুই বছর বয়সী মেয়েকে হত্যা করে নিষ্কৃতি দেয়। উনিশ শতকের মার্কিন কথাসাহিত্যিক ন্যাথানিয়েল হথর্নের ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ (১৮৫০) উপন্যাসের মা ‘অবৈধ’ সন্তান জন্মদানের অপরাধে পিউরিটান কমিউনিটির দÐাদেশ মেনে আত্মহনন না-করে, হার-না মেনে, নিজের ও তার কন্যার জন্য নিজের মতো করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নেয়।


কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘জননী’র (১৯৩৫) মা শ্যামার মাতৃসত্ত¡ার আত্মপ্রকাশের এক পর্যায়ে সে খোদ অনিবার্য জননীর ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সন্তানের জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনে সে তার চারপাশের মানুষ আর সমাজটাকে আবিষ্কার করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেশভাগ কালপর্বে লেখা কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের ‘জননী’ (১৯৬৮) উপন্যাস ‘অবৈধ’ সন্তানকে পৃথিবীতে এনে নিজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা মা দরিয়াবিবির মাতৃত্বের নানা স্বরূপ উদঘাটন করে। বিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ঔপন্যাসিক-নারী অধিকারকর্মী অনুরূপা দেবীর ‘মা’ উপন্যাসে তৎকালীন সমাজ-কাঙ্খিত আদর্শ মা, মাতৃত্বের জন্য আকুল মা ইত্যাদি নানা রূপে কয়েক মায়ের দেখা পাওয়া যায়। সত্তরে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের পটভ‚মিতে লেখা কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর অন্যতম আলোচিত ‘হাজার চুরাশির মা’ (১৯৭৪) উপন্যাসে এক পরিবারের ছোট ছেলে নকশাল আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রাণ হারিয়ে লাশকাটা ঘরে ঠাঁই পেলে তার সিরিয়াল নাম্বার অনুযায়ী পরিচয় পাওয়া ‘হাজার চুরাশি’র মা ছেলের মৃত্যুর পর অন্য আলোয় আবিষ্কার করে বিপ্লবী ছেলেকে এবং নিজকেও। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে (১৯৮৬) তাঁর সন্তান গেরিলাযোদ্ধা রুমীকে নিয়ে দিনপঞ্জির আদলে লিখেছেন একাত্তরের যুদ্ধগাথার ছায়ায় মা-ছেলের যুথবদ্ধতা এবং এই মা স্বাধীন দেশে হয়ে ওঠেন সব তরুণের মা। বেগম ফাতেমা বারীর নিজ সন্তান গেরিলাযোদ্ধা নৌফেলকে নিয়ে লেখা ‘শহিদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ (১৯৮৩) বইয়ে খুঁজে পাওয়া যায় আরেক শহিদ জননীর জীবনের গল্প। একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘একাত্তরের জননী’ (২০১০) পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতিতা এক আত্মপ্রত্যয়ী-সংগ্রামী মায়ের প্রাণস্পর্শী কাহিনী। একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আজাদ ও তার মা সাফিয়া বেগমের জীবনের ঘটনা নিয়ে লেখা কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মা’ (২০০৩) প্রবল আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও সন্তানের সারথি এক মা’কে তুলে ধরে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেডে’র (১৯৭৬) মা পাকিস্তানি বাহিনী তার ঘরে লুকিয়ে থাকা দুই মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে এলে নিজ ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ সন্তানকে তাদের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পালাতে সহায়তা করে। সেলিনা হোসেনেরই স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে অকালপ্রয়াত নিজের বৈমানিক কন্যা লারাকে নিয়ে লেখা বই ‘লারা’তে (২০১৯) পাই মা-মেয়ের সম্পর্কের সাতকাহন, কখনো মায়ের জবানিতে, কখনো মেয়ের জবানিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘গোরা’র (১৯১০) মা আনন্দময়ী সমস্ত জাতভেদ মাড়িয়ে জননীর ভ‚মিকায় উত্তীর্ণ। বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) ও ‘অপরাজিত’ (১৯৩২) উপন্যাসে প্রচণ্ড অভাবের সংসারে একাই লড়াই চালিয়ে যাওয়া অপু-দুর্গার মা সর্বজয়ার জীবনের নানামাত্রিক দিক উন্মোচিত হয়।
এইভাবে মাতৃত্বের নানামুখী মাত্রা এসেছে বিশ্বসাহিত্যে। তবে একথাও সত্য, সমাজ-সময়-দেশ-কাল ভেদে মাতৃত্বের ধরন ও নির্মাণে অবশ্যম্ভাবী ভিন্নতা থাকলেও সমাজ-সময়-দেশ-কাল নির্বিশেষে মা-সন্তানের সম্পর্কের সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যই সবচেয়ে বেশি।


মা নিয়ে লেখা-মায়ের লেখার অনেকগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। লেখাগুলোর বেশিরভাগই সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। যেমন: আন্না জালোমোভা এবং তার ছেলে পিওত্র জালোমভকে ঘিরে রচিত ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা।’ পার্ল এস বাকের ‘দ্য মাদার’ উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট নানজিং-এ বাকের দীর্ঘবছরের গৃহকর্মীর জীবন দ্বারা প্রভাবিত। ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্নে’র কাহিনি স্বয়ং ফাল্লাচির নিজের জীবনের ঘটনা বলে ধারণা করা হয়। আনি অ্যারনোর ‘অ্যা উওম্যান’স স্টোরি’ নিজ মা’কে নিয়ে লেখা। লুইজা মে অ্যালকটের লিটল উইমেন’ উপন্যাষে চার বোন ও মায়ের গল্প লেখক ও তাঁর তিন বোনের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। নিজের পরিবার, প্রতিবেশী এবং ১০ বছর বয়সে, ১৯৩৬ সালে, এলাবামায় হোমটাউনের কাছে ঘটা এক ঘটনা অবলম্বনে হার্পার লী লেখেন ‘টু কিল এ মকিং বার্ড।’ টনি মরিসনের ‘বিলাভেড’ ১৮৫৬ সালে ঘটা সত্য ঘটনার ‘অ্যা ভিজিট টু দ্য ¯েøইভ মাদার হু কিলড হার চাইল্ড’ শিরোনামে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক নিবন্ধ। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি,’ বেগম ফাতেমা বারীর ‘শহিদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ ও সেলিনা হোসেনের ‘লারা’ নিজ সন্তানকে নিয়ে লেখা। রমা চৌধুরীর ‘একাত্তরের জননী’ আত্মজৈবনিক। আনিসুল হকের ‘মা’ শহিদ আজাদ আর তার মা’কে নিয়ে লেখা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের সত্য ঘটনা অবলম্বনে সেলিনা হোসেন রচনা করেন উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড।’
পাঠশালার এবারের আসরে আলোচনা হয়েছে কয়েকটি ভাগে। প্রথমভাগে মা’কে নিয়ে রচিত সাহিত্য ও মা রচিত আত্মজৈবনিক ধরনের লেখা নিয়ে আলোচনা। দ্বিতীয়ভাগে নিজেদের মা’কে নিয়ে স্মৃতিনির্ভর দার্শনিক আলোচনা, তৃতীয় ভাগে সাহিত্যে মায়ের কোলাজে আমাদের মায়ের-মায়ের সাথে আমাদের সম্পর্কের অন্বেষণ এবং সবশেষ অংশে ছিল মা’কে নিয়ে লেখা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।
মা’কে নিয়ে রচিত-মা রচিত সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় আবেদীন কাদের প্রথমে মাধ্যম হিসেবে কথাসাহিত্য বা গদ্য সাহিত্যের আবির্ভাব নিয়ে বলেন। বলেন, বিশ্বসাহিত্যে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, সমাজের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক নানাভাবে আসে। বিশ্বের কথাসাহিত্যে বা উপন্যাসে বা গল্পে মা’কে নিয়ে, মা-সন্তান নিয়ে, মায়ের সাথে সমাজের সম্পর্ক নিয়ে লেখার চর্চা খুবই নবীন। কারণ উপন্যাস বা কথাসাহিত্য খুব সা¤প্রতিক একটি মাধ্যম। এর আগমন শিল্পবিপ্লব-নগরায়ন ও পুঁজিবাদের আবির্ভাবের পর। এর আগে ছিল কবিতা। কিন্তু কবিতায় মানুষের মনস্তাত্তি¡ক জটিলতা খুব একটা স্থান পায়নি। বিষয় স্থান পেতো পূজা, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, ভালোবাসা ইত্যাদি। কথাসাহিত্যই প্রথম ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের নানা দিক তুলে ধরে। ব্যক্তির মনোজাগতিক-দ্বা›িদ্বক দিক এবং ব্যক্তির সাথে সমাজের সম্পর্ক প্রথম পাঠক দেখতে পায় শিল্পমাধ্যম কথাসাহিত্যে। মায়ের কথা প্রথম আসে ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত হেনরি ফিল্ডিং এর লেখা উপন্যাস ‘টম জোন্স’এ। বাংলা সাহিত্যে আসে উনিশ শতক থেকে।


বিশ্বসাহিত্য এবং আত্মজৈবনিক গ্রন্থে মায়ের রূপায়ন প্রসঙ্গে আলোচনায় আবেদীন কাদের মূলত মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘জননী,’ শওকত ওসমানের ‘জননী,’ ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা,’ আনিসুল হকের ‘মা’ এবং ফাতেমা বারীর ‘শহিদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ এই পাঁচটি বই নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেন।
আবেদীন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের নবীন বয়সে লেখা উপন্যাস ‘জননী’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জননী’তে মা শ্যামা সহ অন্যান্য চরিত্রের রূপায়নের সাথে সমাজের-সমাজচিত্রের রূপায়নও ছিল সার্থকভাবে। একটি উপনিবেশিক সমাজে কলকাতার শহরতলির দরিদ্র এক পরিবারে একজন মা’কে বা একজন স্ত্রীকে অর্থনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি আরও যেসব সামাজিক ও অন্তর্গত দ্ব›েদ্বর ভেতর দিয়ে যেতে হয় তার চিত্র পাওয়া যায় ‘জননী’তে। শওকত ওসমানের উপন্যাস ‘জননী’ প্রসঙ্গে আবেদীন বলেন, এই উপন্যাসের মূল বিষয় কলকাতার এক মুসলিম প্রধান এলাকার মা চরিত্র দরিয়াবিবির সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এর পাশাপাশি জীবন জিজ্ঞাসা ও দার্শনিক কৌতূহল বা অন্বেষণ, মানুষের অন্তর্গত চরিত্রের সঙ্গে সমাজ বাস্তবতার সংঘাত এবং মা সহ অন্য চরিত্রগুলো যেভাবে ধর্মের উত্তরন ঘটিয়ে মানবিক সত্তা নিয়ে এগিয়ে যায় তার চিত্রায়ন। এই দুটো উপন্যাসের নাম এক হলেও এদের আঙ্গিকগত ভিন্নতা নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।
আবেদীন আনিসুল হকের ‘মা’ প্রসঙ্গে বলেন, এটি জনপ্রিয় ঘরানার লেখা নিঃসন্দেহে। এর ঘটনা কমবেশি সবার জানা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় গেরিলা গ্রæপ ‘অপারেশন ক্র্যাক প্লাটুন’ এর অন্যতম সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আজাদের (মাগফার আহমেদ চৌধুরী) মা সাফিয়া বেগম এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আজাদের ধনী বাবা আরেকটি বিয়ে করলে দৃঢ়চেতা সাফিয়া বেগম ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। যুদ্ধে আজাদ মা’র অনুমতি নিয়েই যায়, এক পর্যায়ে গ্রেফতার হয়, পাকবাহিনীর চরম নির্যাতনের শিকার হয়, তবুও মায়ের প্রেরণাতেই আজাদ তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারাগারে মা-ছেলের শেষ সাক্ষাতে আজাদ ভাত খেতে চেয়েছিল, মা শুনেছিলেন ছেলে মাদুরে ঘুমায়। স্বাধীন দেশে আমরণ মা সাফিয়া বেগম ভাত না খেয়ে, খাটে না শুয়ে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শুতেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত হলেও পাঠকের কাছে এই লেখা কিছুটা ‘টিয়ার জার্কার’ মনে হতে পারে। অবশ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসে এই ঘটনা বিরল না। তবে এর কাহিনির হৃদয়বিদারক ছবি পাঠককে দ্রæত টেনে নিয়ে যায়।


বিশ্বজুড়ে বহুল পঠিত ও জনপ্রিয় ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ নিয়ে আলোচক বলেন, এই উপন্যাসের সার্বজনীনতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু এটি বিশ্বব্যাপী পাঠকোত্তীর্ণ উপন্যাস। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির রূপান্তর, সমাজ বাস্তবতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মনোজগতের রূপান্তর এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সাধারণ এক মা, ছেলে পাভেলের রূপান্তরের সাথে সাথে নিজে রূপান্তরিত হয়ে পরিনত হন এক বিপ্লবী মা, কমরেড মা, বিশ্ববিপ্লবের মা রূপে।
বেগম ফাতেমা বারী নিজ সন্তান গেরিলাযোদ্ধা নৌফেলকে নিয়ে লেখা ‘শহিদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ সম্পর্কে আবেদীন বলেন, ১৮ বছরের টগবগে তরুণ নৌফেল ফরিদপুর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের একাধিক দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নেয় এবং সম্মুখসমরেই ফরিদপুরের করিমগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় বিজয়ের এক সপ্তাহ আগে। নৌফেলের লাশের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি, যুদ্ধ শেষে বিস্তর খোঁজখবর করা সত্তে¡ও। মা সাহিত্যিক না-হলেও, কোন সাহিত্যে বা কোন বয়ানে বা কোন আত্মজৈবনিক লেখায় পরিমিতি রাখা এবং নিজেকে কিছুটা নৈর্বক্তিক রেখে নিজের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হারানোর বেদনাকে সংহত করে বা নিয়ন্ত্রণ করে ভাষা ও কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কঠিন কাজটি করতে পেরেছেন, যেমনটি পেরেছেন জাহানারা ইমামও নিজ সন্তান রুমীকে নিয়ে লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে।
বিশ্বসাহিত্য এবং আত্মজৈবনিক গ্রন্থে মায়ের রূপায়ন প্রসঙ্গে আবেদীন কাদেরের আলোচনার সম্পূরক হিসেবে লেখক কয়েকটি কাজ সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। মা যখন সমাজের চোখে ‘অবৈধ’ সন্তান ধারণ করেন কিংবা জন্ম দেন, তখন যেই সামাজিক অভিঘাতের ভেতর দিয়ে একজন মা’কে যেতে হয় এই বিষয়টি সামনে এনে তিনি পার্ল এক বাকের ‘মা,’ ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘লেটার টু অ্যা চাইল্ড নেভার বর্ন,’ ন্যাথানিয়েল হথর্নের ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ ও শওকত ওসমানের ‘জননী’র মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করেন।
তিনি বলেন, কয়েকটি উপন্যাসে মা’দের নামই মা। ম্যাক্সিম গোর্কির মা’ উপন্যাসে মায়ের একটি নাম আছে – পেলাগেয়া নিলভ্না। কিন্তু সেই নামটি উচ্চারিত হয়েছে পুরো উপন্যাসে মাত্র দুইবার। বাকি সময় তিনি শুধু ‘মা।’ পার্ল এস বাকের ‘দ্য মাদার’-এর মূল চরিত্র একজন চীনা মা। সমগ্র উপন্যাসে একবার মাত্র ‘অমুকের স্ত্রী’ বলে তার উল্লেখ রয়েছে। কোথাও তার নামের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ ‘মা’ নামেই তাদের পরিচয়। সাহিত্যে বিষয়টা এতো সুপ্রযুক্ত যে, পাঠক সেটা অনায়াসে আত্মস্থ করতে পারেন।


গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দার উপন্যাস ‘লা-মাদ্রে’র উল্লেখ করে তিনি জানান, ১৯২৬ সালে মূলত এ উপন্যাসের উৎকর্ষের বিচারে দেলেদ্দা নোবেল পুরস্কার পান এবং এটি সাহিত্যমূল্যে উত্তীর্ন একটি উপন্যাস। সদ্য প্রয়াত মা’কে নিয়ে লেখা আনি অ্যারনোর ‘অ্যা উওম্যান’স স্টোরি’ সম্পর্কে বলেন, এটি মায়ের প্রতি একটি বলিষ্ঠ নিবেদন এবং নামটিই নির্দেশ করে যে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় মা-মেয়ের বহমান সম্পর্কের মাত্রিকতা হলেও এতে স্বাধীনভাবে একজন ব্যক্তি হিসেবে মায়ের সত্তাকে ধরার প্রয়াস হয়েছে এবং একইসঙ্গে এতে উঠে এসেছে ২০ শতকের ফ্রান্সের সত্যিকারের মানুষের ইতিহাসের চিত্র। ন্যাথানিয়েল হথর্নের দ্য স্কারলেট লেটার উনিশ শতকের পিউরিটান কমিউনিটির সামাজিক কঠোর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক এবং সেই সময়ের একটি আলোচিত কাজ বলে তিনি উল্লেখ করেন। বেগম ফাতেমা বারীর নিজ শহিদ সন্তান নৌফেলকে নিয়ে লেখা ‘শহিদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ সম্পর্কে বলেন, প্রিয় পুত্রকে বিস্মরণের বিলুপ্তি থেকে বাঁচানোর জন্যই মূলত কলম ধরেছিলেন ফাতেমা বারী এবং শহিদ জননী জাহানারা ইমামের সাড়া জাগানো বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশের বছর তিনেক আগেই এই বইটি প্রকাশ হবার কারণে এই বইটিকে মুক্তিযুদ্ধের কোনো শহিদের শোকাতুর জননীর প্রথম মুদ্রিত স্মৃতিচারণা হিসেবে গণ্য করা যায়। ওদিকে আজাদের মা যেমন আমৃত্যু ভাত স্পর্শ করেননি, তেমনি বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘একাত্তরের জননী’র জননী রমাও তাঁর ৩ সন্তান কবরস্থ বলে সারাজীবন পায়ে কিছু পরেননি এবং প্রচণ্ড অর্থকষ্টেও কারও কোনরকম সাহায্য ছাড়া নিজের লেখা বই বিক্রি করে বেঁচেছেন। বনফুলের ‘গণেশ জননী’র মতো রমা ছিলেন বিড়ালের মমতাময়ী জননীও।
আসরের আলোচনার দ্বিতীয়ভাগে নিজেদের মা’কে নিয়ে স্মৃতিনির্ভর দার্শনিক আলোচনায় আলোচক আবেদীন কাদের প্রথমেই কৃষিনির্ভর বাঙালি সমাজে মায়ের সাথে ছেলে এবং মেয়ে সন্তানদের সম্পর্কের ভিন্নতার দিক তুলে ধরেন। নিজের মা সম্পর্কে বলেন, মা’র সাথে তাঁর সম্পর্কটা অন্য ভাইবোনদের চেয়ে আলাদা ছিল। কয়েক সন্তান মারা যাবার পর তাঁর জন্ম এবং সময়ের আগেই জন্মেছিলেন বলে তাঁকে নিয়ে মা শৈশব থেকেই একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। ওদিকে বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন বলে শিক্ষা বিষয়ে তাঁর এক ধরনের উচ্চাভিলাষ ছিল এবং বাবা চেয়েছেন ছেলে শহরে গিয়ে স্কুলে পড়ুক। কিন্তু মা একদমই রাজি ছিলেন না। বাবার ইচ্ছেমাফিক তিনি এগারো বছর বয়সেই গ্রাম ছেড়ে ঢাকার স্কুলে ভর্তি হন। এরপর থেকে তিনি আর গ্রামে ফিরতে চাইতেন না, আবার ঢাকা ফেরার সময় মা’কে ছেড়ে আসতে কষ্ট হবে বলে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মা-ছেলের নিয়মিত চিঠি বিনিময় হতো। আমেরিকায় পড়তে আসা মনস্থির করার সময় থেকে মায়ের সাথে তিনি অন্যরকম সংযুক্তি অনুভব করেন এবং মা’র কষ্ট হবে জেনে মা’কে একরকম না বলেই বিদেশ চলে আসেন। পড়াশুনা শেষে আমেরিকাতেই শিক্ষকতায় যোগ দেন। ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নেন, সব ছেড়ে দেশে মায়ের কাছে ফিরে যাবেন। কিন্তু কোভিডকালীন সময়ে আমেরিকা ছেড়ে যেতে পারেন না এবং মা মারা যান ঐ সময়েই, ২০২১ সালে। এ সময়টা যেন একটা দেয়ালের মতো। মা বেঁচে থাকতে আর মা মারা যাবার পর মায়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। তিনি যে মায়ের সেভাবে একদমই কাছে থাকতে পারেননি, সেজন্য নিজেকে এখনও ক্ষমা করতে পারেন না এবং মায়ের ব্যাপারে খুব নৈর্ব্যক্তিকও হতে পারেন না। শারিরীক ও মানসিক দুইভাবেই তিনি মায়ের বেশি কাছাকাছি। নিজের জীবনের নিঃসঙ্গতাও মায়ের সাথে সম্পর্কে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। মা’কে নিয়ে স্মৃতিচারণ ইত্যাদি লিখলেও কোনকিছুই তাঁকে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দেয় না।


এবারের পর্বটি যে মায়ের জন্য নিবেদিত তাঁর নাম লতিফা আজিম। ডাক নাম মায়া। তিনি লেখকেরই মা। মায়ের স্মৃতিতে লেখকের ভাষ্যে উঠে আসেÑ মায়ের জন্ম চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের সম্ভ্রান্ত সম্পন্ন পরিবারে। সেই পরিবারে শিক্ষার আবেদন ছিল, রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। শিক্ষা সমাপনের আগেই মায়ের বিয়ে হয়ে যায় কুমিল্লার দেবিদ্বারের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক তরুণ অধ্যাপকের সাথে। বাবা আনোয়ারুল আজিম। তিনি অধ্যাপনা, পাঠ আর লেখাজোখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিছুকাল পর অনিশ্চয়তা, বাড়ন্ত সংসারের কথা বিবেচনায় এনে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। আজিমপুরের সরকারি বাসভবনে পাঁচ সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল এই দম্পতির। লেখকের দুবছরের মাথায় বাবার প্রস্থানে মা ৫ সন্তানকে নিয়ে এসে উঠেন কুমিল্লা শহরের ঝাউতলায় শশুর বাড়িতে। এক সময়ের পৌর চেয়ারম্যান, বৃটিশ আমলের এন্ট্রান্স-পাস শশুর তখনও বেঁচে ছিলেন। এই সময় থেকেই শুরু হয় মায়ের সংগ্রামের জীবন। বাবার অনুপস্থিতিতে মা হয়ে ওঠেন মা-বাবা দুইই। ৫ সন্তানের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-শিক্ষা জীবন অধ্যায়ে মায়ের অবদান, অংশগ্রহন ও পৃষ্ঠপোষকতা উল্লেখ করার মতো। তিনি সমস্ত প্রতিক‚লতার ভেতরও ছেলেমেয়েদের সর্বোচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করেছেন। এ ব্যাপারে কোনরকম আপোস করেননি। ওদিকে বাবার অকাল প্রয়াণে নানামুখী কঠিন বাস্তবতা তৈরি হলেও, পরিবারের সাংস্কৃতিক অভিভাবক হয়ে উঠেন মা। লেখকের গান থেকে শুরু করে, বিতর্ক, গার্ল গাইডস ইত্যাদি নানামুখী কর্মকাণ্ডে মা যে শুধু উৎসাহ দিতেন, তা-না, তিনি মেয়েকে রীতিমত নিয়ে যেতেন চট্টগ্রাম-ঢাকায় বিভাগীয়-জাতীয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতায়, কখনো টিভির অডিশনে, টিভির রেকর্ডিং-এ ইত্যাদি। কঠিন আর্থিক বাস্তবতায়ও মেয়েকে ওস্তাদ রেখে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শিখিয়েছেন। ওয়াহিদুল হকের কাছে প্রতি সপ্তাহান্তে কুমিল্লায় গানের ক্লাসে মেয়ের যোগ দেয়াতে ছিল মায়ের পুরো সমর্থন। শুধু পড়াশোনার ব্যাপারটা নিশ্চিত করলেই আর বাকি সবকিছুতে মায়ের উদার সমর্থন মিলতো। টরন্টোর ‘পাঠশালা’র জন্ম থেকেই মা ছিলেন এর শুভার্থী।
সামরিক জান্তা বিরোধী আশির দশকব্যাপী আন্দোলনে লেখকের ভাইরা ছিলেন প্রচÐ সক্রিয়। সেসময় নানান সভা-সমাবেশে গণসঙ্গীত গাইতে শামিল হতেন লেখকও। মা কখনোই সন্তানদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বাসাতেই সভা হয়েছে, সাংস্কৃতিক আয়োজনের মহড়া হয়েছে। বাসায় রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রী এলে মা নিজেই রেঁধে সবাইকে খাইয়েছেন।
মা ছিলেন সন্তানদের সমস্ত উদ্যোগ-প্রয়াসের প্রথম পর্যবেক্ষক, সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী। কুমিল্লার ঝাউতলায় লেখকের পারিবারিক ভবন ‘অজন্তা’র বেজমেন্টে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘লিংকবাংলা’ গড়ে তোলার পেছনে ছিল মা’র উদার সমর্থন। শুধু তাই না, ‘লিংকবাংলা’র সব কর্মকাণ্ডে-প্রদর্শনীতে মা নিজে এসেছেন, উদ্বোধন করেছেন, দর্শক-উপভোগকারী হয়েছেন।


লেখকের জীবনের বিভিন্ন মাইলস্টোন পর্বগুলোতে মায়ের ছিল খুব শক্তিশালী-প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা। সমাজের প্রত্যাশিত আচরণে মা তার মেয়েদের গড়ে তোলেননি। পড়ার সময়য় নষ্ট হবে বলে রান্নাঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দেননি। মেয়েদেরকে স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী হবার মন্ত্রণা দিয়েছেন। মা প্রত্যক্ষভাবে ছিলেন সন্তানদের সব লড়াইয়ে-সৃষ্টিশীলতায়, হাত ধরে, সমর্থন নিয়ে, সহযোগীর ভ‚মিকায়, সারথির ভ‚মিকায়। মা’র কাছে সন্তানদের কোন কিছুই লুকাতে হয়নি। বুক উঁচিয়ে প্রকাশ্যে তারা বিশ্বাসের চর্চা করতে পেরেছে। মা শুধু তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেননি। উনি শামিল হয়েছেন সব স্বপ্ন বাস্তবায়নের মিছিলে। উনি এসে পাশে বসেছেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। তিনি পাশাপাশি হেঁটেছেন। তিনি সারাজীবন দৃশ্যমান-সক্রিয়-ছায়াশীল থেকেছেন বটবৃক্ষের মতন। আম্মা ছিলেন সন্তানদের-পরিবারের সব সমস্যার অলৌকিক সমাধান। ছিলেন তাদের সকল কাজের কমরেড। মা-ই ছিলেন তাদের দৃশ্যমান ঈশ্বর।
মা ছিলেন অর্গ্যানিকেলি, খুব অনায়াসভাবে একটা মিনিমাল সত্তা – প্রসাধনে, পরিধানে, জীবনযাপনে, রন্ধনে, সুচিকর্মে। তিনি আজীবন বিলাসিতার আবর্জনামুক্ত মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দারুন ‘অর্গানিক মিনিমালিস্ট।’ তাঁর ধর্ম ছিল ঘোমটাময়-মৃত্তিকালগ্ন লোকজ ইসলাম যেখানে কোরান তেলাওয়াত আছে, সুরের আহবান আছে, অন্য অনেককিছুর বাড়াবাড়ি নেই। তিনি ছিলেন জীবনচর্চায় আগাগোড়া অসা¤প্রদায়িক। মা কেমন করে এতটা মুক্ত, অসা¤প্রদায়িক-মিনিমাল-মানবিক সামর্থ্যে ভরপুর ছিলেন এর সমাজতাত্তি¡ক অন্বেষণ করা যেতে পারে। মায়ের মিনিমাল জীবন নিয়ে শিক্ষণীয় তথ্যচিত্র নির্মিত হতে পারে।
মা সেলাই জানতেন, সোয়েটার বুনতে পারতেন, চমৎকার কুরুশ কাঁটার কাজ জানতেন, কাঁথা বুনতে পারতেন। অবসর সময়ে যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তাঁর বাঁচবার অজস্র মাধ্যম ছিল, অনুসঙ্গ ছিল। এক কথায় বলা চলে, মা ছিলেন অফুরান। মা ছিলেন দারুণ সঞ্চয়ীও এবং তাঁর সঞ্চয়ের টাকাকড়ি বারবার কাজে লেগেছে সংসার-সন্তানদের বিপদে-আপদে।


মা মাঝে মাঝেই নীরব সময় কাটাতেন। কাটিয়েছেন প্রস্থানের কয়েক দিন আগেও। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা চলে গেছেন। সারাজীবন তিনি যে আত্মনির্ভরতার সাথে, সম্মানের সাথে বেঁচেছেন, প্রস্থানেও তিনি কারো উপর আর্থিক বা কোনরকম ভার বা ন্যূনতম চাপ রেখে যাননি। মা শিখিয়ে গেলেন প্রস্থানই সত্য। কিন্তু তা এতো অবিচ্ছেদ্য আর মায়ার বাঁধনে জড়ানো তা ভাবা যায়নি আগে কখনো। মায়ের প্রস্থান আবার মৃত্যুর সত্যতা শিখিয়েছে। মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে পরিবারের উদ্যোগে পারিবারিক ভবন ‘অজন্তা’র প্রবেশ করিডোরে স্থাপন করা হয়েছে কোলাজ মাধ্যমে শিল্পী জোনায়েদ-জানভী নির্মিত ম্যুরাল ‘মায়ার ভুবন।’
আক্ষরিক, প্রায়োগিক এবং দার্শনিক সর্বার্থেই লেখক মনে করেন তিনি মায়ের বর্ধিত রূপ। যেন মা’কে বহন করে চলেছেন। মা-মেয়ে অবিচ্ছিন্ন সত্তা, কোনভাবেই আলাদা করা যায় না। ফলে মায়ের মৃত্যু ঐ অর্থে সত্য না, মেয়ের মৃত্যুতে বরং হবে মায়ের একরকম পরিণতি। এখানটায় তিনি উল্লেখ করেন মায়ের মৃত্যুতে চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা। ব্যক্তিগত জীবনে ঋতুপর্ণ ঘোষ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েছিলেন তাঁর মায়ের সঙ্গে। মা’র মৃত্যুর পর, তাঁর সিনেমায় একাকীত্বের সংজ্ঞাগুলিও পালটাতে শুরু করেছিল। তাঁর মা’র চলে যাওয়ার পর, লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার ইউনিভার্সিটি আয়োজিত এক কনফারেন্সে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর সিনেমার সা¤প্রতিক বিষয়ভাবনা ঠিক কীরকম? মায়ের স্মৃতি-অনুষঙ্গকে নিয়ে এসে উত্তরে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন, ‘ক্রিয়েটিং অ্যা ফ্রেন্ডশিপ উইথ ডেথ।’ ব্রাত্য বসুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে বিস্তারে বলেছিলেন এই কথাগুলি: ‘মা চলে যাবার পর, মা-র সঙ্গে নতুন করে আমার আর একটা বন্ধুত্ব তৈরি হলো। যখন মা ছিলেন এবং মা রোগশয্যায়, তখন সেই বন্ধুত্বটা আমার আলাদা করে পাতানোর প্রয়োজন হয়নি। পরে দেখলাম, আমার সত্যি কিন্তু মনে হয় না যে মা নেই। ৃআগে যেমন কিছু খুঁজে না-পেলে মা’কে বলতাম: একটু খুঁজে দাও! এখন হারানো কিছু খুঁজে পেলে মনে মনে বলি: থ্যাঙ্ক ইউ মা!’…
এ পর্যায়ে লতিফা আজিম মায়া ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় (২৪ ফেব্রæয়ারি, ২০২৫), তাঁকে নিয়ে তাঁর বড় ছেলে মনজুরুল আজিম পলাশের লেখা ‘আম্মা’ কবিতাটি পাঠ করে শোনানো হয়।

মা যদি না থাকে
বিদায় নেবো কার কাছ থেকে আর
প্রতিবার ভ্রমণ থেকে ফিরে মাকেই বলতাম
আম্মা ফিরে এসেছি
মা ছাড়া আমিতো এক অর্থহীন অনতিক্রান্ত বৃত্ত
মা ছাড়া আমি বারবার ফিরবো কার কাছে?
কে খোঁজ করবে আমার স্বাস্থের মা ছাড়া
ভালোমন্দ কিছু খাচ্ছি কিনা কে ভাববে আর সেই কথা
কে হাসিমুখ করে রাখবে প্রতিটি সম্মানে-অর্জনে
একমাত্র মা-ই দূর থেকেও জানতো আমার অসুখ
জ্বরে বিছানায় নির্জন আমাকে মা-ই একদিন খুঁজে পেয়েছিল

দূরে থেকেও আমি ছিলাম মায়ের নাগালে
মা সবকিছুই বুঝতে পারতো
মা ছাড়া আর কোন কিছুই নয় এমন অলৌকিক মমতাময়।
মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করবার সময়
তীব্র হয়ে ছুটে আসে সব শুভকামনা
কেটে যায় সকল দুর্যোগ
মা-ই সব অসম্ভবের সমাধান
গর্ভ থেকে যিনি আমাদের ঠাঁই দেন বুকের আশ্রয়ে
মা আছে জানাটাইতো স্বয়ং স্রষ্টার থাকা।
আমাদের মা-ই হলেন পিতামাতা একত্রে
পিতৃহীন শৈশব থেকে আম্মাকে ঘিরেই আমাদের সব
আমাদের মা একা আড়াল করেছিলেন পৃথিবীর সব অভাব
আর সকল ঐশ্বর্য জড়ো করে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের
আমাদের মা হলেন অফুরান এক আশাবাদ
পয়সাভর্তি মাটির ব্যাংক
অভয়, আমাদের জিয়নকাঠি
আমাদের স্পন্দনগুলো তাঁর কাছেই গচ্ছিত
আমাদের মা আমাদের জীবন-পাহারাদার।
আমাদের ভাইবোনদের সকল কান্না আজ একীভ‚ত এক মায়াবি নদী
আত্মীয়রা ছুটে এসেছেন শুভকামনায় ভালোবাসায়
শত মানুষ প্রার্থনায় আজ মায়ের জন্য
হসপিটাল নতজানু, শোকার্ত করিডোর
চিকিৎসকরা বলছেন ‘আপনাদের আমানত আপনাদের ফেরত দেয়াই আমাদের প্রচেষ্টা।’
নিশ্চয় আমাদের মা ফিরে আসবেন আমাদের কাছে
আমরা মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে আছি পরস্পর হাত ধরে
চোখ খুললেই আমাদের মা শুনবেন ‘আম্মা’ ডাক
দেখবেন আমাদের নয়নজুড়ে
আমরা আম্মাকে নিয়ে বাড়িতে যাবো
বলবো তাঁর অসুস্থতায় আমরা কতটা দুঃখ পেয়েছি,
কেঁদেছি
বলবো আম্মা আপনাকে আমরা খুব ভালোবাসি
বলবো আম্মা আমাদের জীবন দিয়ে আপনাকে আমরা অমর রাখবো…


আসরের আলোচনার তৃতীয় ভাগে সাহিত্যে মায়ের কোলাজে আমাদের মায়ের-মায়ের সাথে আমাদের সম্পর্কের অন্বেষণ পর্বে আবেদীন কাদের বলেন, কথাসাহিত্যে-নাটকে-কবিতায় মায়ের যে রূপায়ন তাতে দেখা যায় সন্তানের বেলায় মা’র চরিত্রটা একদমই ভিন্ন। বিভ‚তির উপন্যাস বা সত্যজিতের চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপরাজিত’র সংগ্রামী মা সর্বজয়া চুরি করতে পারে বা মানিকের শ্যামা কখনো কোন অপকর্ম করতে পারে তা পাঠকের কল্পনাতেও আসবে না। কিন্তু সাহিত্যে আমরা দেখি মা’রা কঠিন বাস্তবতায় সন্তানকে খাওয়াতে খাবার চুরি পর্যন্ত করে এবং পাঠক তা দেখে এক চরম মানবিক মাত্রার প্রকাশ হিসেবে। আবেদীনের মা ছেলের ছাত্রাবস্থায় অনেক সময় নিজের গয়না বিক্রি করে গোপনে সন্তানকে টাকা পাঠাতেন। এটা ঐ অর্থে সর্বজয়া বা শ্যামার মতো না, কিন্তু এতে সন্তানের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেবার ব্যাপারটা প্রকাশিত হয়। আবার তিনি ঢাকার স্কুলে যাবার জন্য গ্রাম থেকে লঞ্চঘাটে রওনা দেবার সময় মা যে বাড়ির সামনের কলাগাছ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং পদ্মা নদীতে লঞ্চ কিছুটা দূরত্বে সরে গেলে মায়ের অপসৃয়মান অবয়ব ইত্যাদি মনে করিয়ে দেয় বিভ‚তি বা সত্যজিতের ‘অপরাজিত’র অপু ট্রেনে শহরে চলে যাবার সময়য় সর্বজয়ার দাঁড়িয়ে থাকার কথা। বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের-গ্রামের কৃষিভিত্তিক পরিবারের মায়েদের সংগ্রাম নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজের মায়েদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। আবেদীন বলেন, ধান তোলার নানা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, তা সারাবছর কিছু কিছু বিক্রি করে ৮ সন্তানের পড়াশোনা-জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহে পরিবারের অন্যান্য অর্থ উৎসের সাথে তাঁর মা যেভাবে অংশ নিতেন, সামলাতেন সূক্ষ্ণভাবে, তাতে যেন বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া কাজ করতো। এরকম মায়ের চিত্রায়ন বাংলার অনেক কথাসাহিত্যেই দেখা যায়। তিনি বলেন, আবেগের শক্তিতে তিনি বেশি মায়ের কাছাকাছি। তবে মা-ছেলের সম্পর্কে দ্বা›িদ্বক দিকও আছে, যা বোঝানো মুশকিল। পশ্চিমা সাহিত্যের মতো আমাদের সাহিত্যে মা-সন্তানের সম্পর্কে নির্লিপ্তি খুব একটা থাকে না। স্কুল ছুটিতে বাড়ি গেলে ফেরার সময় মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেবার কষ্ট এড়ানোর জন্য তাঁর মধ্যে এক ধরনের ডিনায়াল কাজ করতো, তিনি বাড়িতেই যেতে চাইতেন না এবং এই দ্বা›িদ্বক সমস্যাতেই কেটেছে তাঁর সবটা জীবন। এই ধরনের সমস্যার চরিত্র বাংলা উপন্যাসে এবং বাংলা সিনেমায়, বিশেষ করে বিভ‚তি এবং সমরেশের উপন্যাসে অনেক দেখা যায়। তিনি বলেন, তাঁর জীবনবোধে বা দর্শনে মায়ের ভ‚মিকা অনেক বড় এবং এ বিশয়টি তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন সাহিত্য পড়েই। তিনি আলবেয়ার কামুর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ উপন্যাসের মায়ের মৃত্যুতে নির্লিপ্ত চরিত্র মার্সোর একদম বিপরীত। যুদ্ধ এবং পুঁজিবাদের বিকাশের নানা পর্যায়ে সমাজস্থ সম্পর্কগুলোতেও রূপান্তর ঘটে, যা উঠে আসে কথাসাহিত্যে। মার্সোর মতো নির্লিপ্তি না, কিন্তু তাঁর একরকম ডিনায়াল ছিল, যাকে তিনি বলছেন দ্ব›দ্ব বা একধরনের আচ্ছন্নতা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাচ্যের কোমল মা’কেই তিনি আবিষ্কার করেছেন মায়ের মধ্যে। ১২ বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে স্কুলে পড়তে ঢাকা যাবার সময় তাঁর ভীষণ ধার্মিক-পর্দানশীন মা আঁচল যথাস্থানে আছে কী নেই তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে প্রায় পাগলের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছেন ছেলের পিছু পিছু। বিভ‚তিভ‚ষণ এবং শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ মায়ের চরিত্রই এরকম।


সাহিত্যে মায়ের কোলাজে আমাদের মায়ের-মায়ের সাথে আমাদের সম্পর্কের অন্বেষণ পর্বে লেখক বলেন, এই আসরে যেসব উপন্যাস আলোচনায় এসেছে, তার অনেককটির মা চরিত্র সর্বার্থেই খুব সবল, বলিষ্ঠ, শক্তিশালী। সেই হিসেবে বেশ কয়েকটি উপন্যাসের মায়ের সাথেই তিনি তার মায়ের আদল খুঁজে পান। এমনকি শারিরীকভাবে শক্তিশালী মা, কর্মঠ মা, যেমন পার্ল এস বাকের পুরোদস্তুর কৃষক মা, শওকত ওসমানের জননীর দরিয়াবিবি এসব চরিত্রের সাথেও লেখকের নাগরিক মা’কে খুব অনায়াসেই দেখা যায়।
মা-মেয়েদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে সেলিনা হোসেনের ‘লারা’র কথা উল্লেখ করে বলেন, সমাজের চোখে ‘ভাল’ মেয়ে কিছুতেই হতে চায় না লারা, লারার মা’ও সেভাবে তাকে বড় করেননি। লারার সাথে তার মায়ের সংলাপ চলতো। রাতে দেরি করে ফিরলে মা’র মুখ গোমড়া হলে লারা মাকে বোঝাতো, মা বুঝতেন। লারা নিজের মতো স্বপ্ন দেখে, মা-ও সেই স্বপ্নপূরণে সহায়ক ভ‚মিকা নেন। লারা খুব স্বাধীন, স্বতন্ত্র, লারার মা-ও। লেখক এবং তার মায়ের চরিত্রে ‘লারা’র উল্লেখিত প্রতিটি জায়গার হুবুহু প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বেশ কয়টা উপন্যাসে, মায়ের যে প্রটেকটিভ চরিত্র দেখা যায়, তার সঙ্গে মিল পান লেখক তাঁর মায়ের। তিনি বলেন, খুব তরুণ বয়সে তাদের পরিবারের একজন সদস্য বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়ে অন্যায়ভাবে পুলিশি হেনস্থার শিকার হয়। পুলিশি দুর্ব্যবহার বলা চলে। খবর পেয়ে মা থানায় যান। মা’কে দেখানো হয়, যে পুলিশটি দুর্ব্যবহার করেছে, তাকে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মা সেই অভিযুক্ত পুলিশকে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। হতচকিত কর্মকর্তারা তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলে নেন এবং মাকে সসম্মানে থানা থেকে বিদায় করেন। কর্মকর্তারা থাপ্পড় খাওয়া পুলিশকে বলেন, মনে করো তোমার মা-ই অন্যায়ের শাস্তি দিয়েছেন। ‘হোয়াটস ইটিং গিলবার্ট গ্রেইপ’ চলচ্চিত্রে ডিকেপ্রিও এক ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ সন্তানের ভ‚মিকায় অভিনয় করে। একবার ডিকেপ্রিওর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের জন্য তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তখন ডিক্যাপ্রিওর বিশাল আকৃতির মা, যিনি সারাদিন বাসাতেই থাকেন এবং আসলে যার সক্ষমতাই নেই নড়াচড়া করবার, সেই মা-ই বাসা থেকে বের হয়ে পুলিশ স্টেশনে আসেন। পুলিশ বুঝতে পারে যে শুধু একজন পুলিশকে না, এই পাহাড়সম মা পুরো পুলিশ স্টেশনকে থাপ্পড় দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে দিতে পারেন। সন্তানের জন্য একজন মায়ের সাহসী ভ‚মিকা, এমনকি আক্রমণ, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বৈকি। লেখকের মা’ও সেরকম কিছু দৃশ্যের জন্ম দিতে পেরেছিলেন।


লুইজা মে অ্যালকটের ‘লিটল উইমেন’ উপন্যাসে ৪ মার্চ বোন – মেগ, জো, বেথ ও অ্যামির মা মার্মী একজন সাপোর্টিভ ও বলিষ্ঠ মহিলা যিনি মেয়েদেরকে আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেও একরকম আনন্দের মধ্য দিয়ে বড় করেন। চার কন্যা নিজস্বতায় তাদের জীবন গড়ে কিন্তু মা-ই কেন্দ্রে থেকে তাদেরকে স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী হতে প্রেরণা দেন। এখানটায় লেখক তাঁর ৩ বোন ও তাঁদের ব্যাপারে মায়ের ভ‚মিকার স্পষ্ট ছবি দেখতে পান।
আনি অ্যারনোর ‘অ্যা উওম্যানস স্টোরি’তে মা-মেয়ের সম্পর্ক একইসাথে চমৎকার ও জটিল, প্রীতিপূর্ণ ও বিরক্তির। মায়ের অভিব্যক্তি ছিল খুব প্রকাশ্য। মা’র মুখ দেখলে যে কেউ বুঝতো সে রেগে আছে কী নেই। একান্তে সরাসরি সব প্রকাশ করতেন মা, মাঝেমধ্যে গালমন্দ করতেন, গায়ে হাত তুলতেন, আবার খানিক পরেই হয়তো আনিকে বুকে টেনে নিতেন। আনির সবরকম বিকাশে ছিল মায়ের বড় ভ‚মিকা, আবার অন্যদিকে মায়ের মেয়ে সম্পর্কে কিছু মূল্যায়ন ছিল স্ববিরোধী, সাংঘর্ষিক। হিসাবের সংসারেও মা আনিকে নানদের দ্বারা পরিচালিত স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন, স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে না। ক্লাসের জন্য দরকারি সব জিনিসপত্রও সবসময় তিনি নিশ্চিত করতেন। মায়ের কর্তৃত্ব, আশা, অ্যাম্বিশনের অনেকটাই কেন্দ্রীভ‚ত ছিল শিক্ষা-পড়াশোনার সাথে। আনির সাংস্কৃতিক রুচি গড়ে ওঠার পেছনে ছিল মায়ের ব্যাপক ভ‚মিকা। মা সংসারে নানা বুদ্ধি করে খরচ সাশ্রয় করতেন ইত্যাদি। উপন্যাসের বর্ণিত প্রতিটি জায়গাতেই লেখক নিজেদের মা-মেয়েকে খুঁজে পেয়েছেন অনায়াসে। আনির বাবার চেয়ে মা ছিলেন বেশি ডমিনেটিং ফিগার। বাবার সাথে ছিল মজা, কিন্তু মায়ের সাথে হ’তো ‘সংলাপ।’ ওদিকে লেখকের বাবার অনুপস্থিতিতে মা-ই হয়ে উঠেন বাবা-মা এবং পারিবারিক-সাংস্কৃতিক অভিভাবক।
ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসের সাধারণ একজন মা থেকে রূপান্তরিত বিশ্ববিপ্লবের মায়ের সাথে লেখক তার মায়ের মিল খুঁজে পান। সময়ের বাস্তবতার সাথে রূপান্তরিত হয়ে একটা সাধারণ জীবন কীভাবে গৌরবজনক আর ভুমিকাময় হতে পারে সেটার উদাহরণ ছিলেন মা। পেলেগেয়া নিলভনার মতো কমরেড মায়ের সত্তা ছিল লেখকের মায়ের। ৮০র দশক জুড়ে সামরিক জান্তা বিরোধী আন্দোলনে সন্তানদের সক্রিয় অংশগ্রহণে তিনি ছিলেন সমর্থক, কখনো সহযোগী।


মা’কে নিয়ে লেখা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ পর্বে অর্থাৎ আলোচনার শেষ পর্বে আবেদীন কাদের বলেন, কথাসাহিত্য যেহেতু আধুনিক বা নাগরিক বা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফসল এবং ইউরোপে যেহেতু প্রাচ্যের আগে নগরায়ন হয়েছে তাই সেখানের সাহিত্যের চরিত্রায়ন হয়েছে প্রাচ্য থেকে ভিন্নভাবে কখনো কখনো। সেখানকার সাহিত্যে বা কথাসাহিত্যে একটা স্তরে শ্বাশত মাতৃচরিত্র ও মা-সন্তান সম্পর্ক রূপায়িত হয় কিন্তু আরেকটা স্তরে তা একদমই ভিন্নরকম। প্রাচ্যের মা’রা খুব কোমল। সংগ্রামী মায়েদের ‘মাসকুলিটি’ লিঙ্গের বিষয় না বরং স্বভাবের বিষয়, সংগ্রামের প্রত্যয়ের বিষয়। আনি অ্যারনোর ‘অ্যা উওম্যান’স স্টোরি’র মতো নিজের মা’কে নিয়ে লেখা ‘অ্যান ইজি ডেথ’ উপন্যাসে সিমন দো বোভোয়া মায়ের রোগ শয্যাপাশে প্রতিদিন থেকে দেখা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে মায়ের এগিয়ে যাওয়া এবং প্রস্থানই যে শ্বাশত সত্য তা তুলে এনেছেন। সিমন দেখাচ্ছেন, মৃত্যু একটা প্রক্রিয়া। আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মেমোয়ারস অফ অ্যা ডিউটিফুল ডটারে’র প্রথম খণ্ডেও সিমন মা-মেয়ের সম্পর্কে এই বিষয়টি তুলে আনেন। কিন্তু প্রাচ্যে আমরা মায়ের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকি না বলে তা অকস্মাৎ বড়রকমের কষ্ট নিয়ে আসে। প্রাচ্যের কথাসাহিত্যে মায়ের মৃত্যু তাই পশ্চিমা সাহিত্য থেকে এসেছে ভিন্নভাবে। আলবেয়ার কামুর মার্সো চরিত্রের মতো নির্লিপ্তি প্রাচ্যের কথসাহিত্যে খুবই কম। মার্সো চরিত্রের মতো চরিত্রগুলোকে পুঁজিবাদের অবক্ষয়িষ্ণু সমাজের এক ধরনের মানসিক ঝোঁক বা প্রবণতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। ডিনায়ালের মধ্য দিয়ে কিছুটা মার্সোর মতো চরিত্র সুনীলের আত্মপ্রকাশ বা শীর্ষেন্দুর ঘুনপোকা বা আরো দুই চারটা লেখায় পাওয়া যায়। তবে শ্বাশত মা এবং মা-সন্তান সম্পর্ক রূপায়নে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কথাসাহিত্যে কোন তফাৎ নেই। যেমন বলা যায় টনি মরিসনের ‘বিলাভেড,’ পার্ল এস বাকের ‘দ্য মাদার,’ হারপার লী’র ‘টু কিল অ্যা মকিং বার্ড’ উপন্যাসের মায়েদের কথা। যেহেতু প্রাচ্যে অনেক দেরিতে পুঁজিবাদের শেষ স¤প্রসারন ঘটেছে, তাই এখানকার মানুষের চরিত্রের ভেতরে একধরনের কোমলতা বেশি এবং বাঙালি মায়েদের হৃদয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’ বা ‘দেবদাস’ বা ‘শ্রীকান্তে’র নারী চরিত্রের মতো। এই মায়েরই রূপায়ন আমরা দেখি মানিকের ‘জননী’র শ্যামা, শওকত ওসমানের ‘জননী’র দরিয়াবিবি, আনিসুল হকের ‘মা’র সাফিয়া বেগম, ‘নৌফেল’ বইয়ের ফাতেমা বেগম, ‘একাত্তরের দিনগুলি’র জাহানারা ইমাম ইত্যাদি চরিত্রে। এইসব প্রচÐ সংগ্রামী মায়েরা আবার ভীষণই কোমল। এই স্তরটাতেই প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের মায়ের পার্থক্য পাওয়া যায়। সবশেষে আবেদীন বলেন, সাহিত্যে মানুষে-মানুষের সম্পর্কের রূপায়ন অলৌকিক কিছু না। তা আসলে বাস্তবেরই প্রতিফলন। সমাজবিজ্ঞানীরা যেভাবে সমাজকে ব্যাখ্যা করেন, শিল্পীরা সেই ব্যাখ্যারই শিল্পরূপ দেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় বাংলা কথাসাহিত্যের মূল্যায়ন সেভাবে না-হলেও, মানবিক জটিল সম্পর্কের রূপায়নে বাংলা ভাষার উপন্যাস যে কোন বিচারে বিশ্বের অন্যসব সাহিত্যের সাথে তুলনামূলক বিচারে কোন অংশেই কম না।
আসরের আলোচকদের আলোচনায় দর্শক-শ্রোতা পুরোটা সময় জুড়ে মন্তব্য করে সক্রিয় থাকেন। (সদ্য প্রয়াত) লতিফা আজিম মায়া সহ সবার মায়েদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানিয়ে সমাপ্তি টানা হয় পাঠশালার ৪৯তম আসরের।