সাজ্জাদ আলী: দুরু দুরু বুকে ফোন হাতে নিয়ে তুর্যকে ডায়াল করি! অপর প্রান্তের ফোন বেজে উঠার আগেই লাইনটি নিজেই কেটে দি। আজ সকাল থেকে এই একই টালবাহানা করছি। “কি শুনতে কি শুনি” সেই ভয়ে ফোন সংযোগ পেতে চাই না। আবার ওর খবরটা না জানা পর্যন্ত মনটাও থিতু হচ্ছে না। তুর্য আমার পিঠাপিঠি ছোটবোনটির ছেলে, ইতালীর রোম শহরে ওর আবাস। করোনাভাইরাস ওর দেশে মহামারী আকার নেবার পর থেকে ছেলেটিকে নিয়ে আমাদের পরিবারের উৎকন্ঠার শেষ নেই।

বছর দুয়েক আগে ইউরোপে বেড়ানোর সময়ে আমরা তুর্য আর টুনিকে দেখতে দুদিনের জন্য রোমে থেকে ছিলাম। ওরা দুজনে আমাদের নিয়ে কি যে হুলুস্থুল করেছিলো! কি খাওয়াবে, কি দেখাবে, কোথায় নিয়ে যাবে- একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিলো দুটিতে। প্রথমে আমাদের বিখ্যাত কলোজিয়ামে নিয়ে যাবে, নাকি ভ্যাটিকান সিটিতে; তাই নিয়ে দুজনের মধ্যে সে কি বিতন্ডা! রত্নার হস্তক্ষেপে সে যাত্রা টুনিই জিতে ছিলো। সেই শেষ দেখেছি ছেলেটিকে! ঘটনার দুর্বিপাকে তুর্য ব্যাটা এখন একাই ইতালীতে থাকছে। ছেলেটি নিজের খেয়াল রাখতে জানে না। সেটাই ওকে নিয়ে মস্ত ভাবনা।

আমার এই ফোন ডায়াল করা, আর তা কেটে দেওয়ার অস্থিরতা দেখে রতœা মহাবিরক্ত। বললো, ছেলেটা কেমন আছে সেটা তো জানা দরকার। ফোনটা কেটে দিচ্ছো কেন? ভয় করছে, বললাম আমি। যদি খারাপ কিছু শুনতে হয়! ফোনটি কেড়ে নিয়ে সে ডায়াল করতে করতে বললো, শোন তুমি অন্ধ সাজলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকবে না। ছেলেটা কেমন আছে তা জানাটা জরুরি। ওদিকে তুর্য’র ফোনের রিং বেজেই চলেছে, ধরছে না সে। আবার ডায়াল করলো, সেই একই অবস্থা! দু দুবার ফোন না ধরায় আমার ব্লাড প্রেসারের পারদ তো মুহূর্তেই একেবারে উপরের দাগে চড়ে বসলো। দেরি না করে রত্না বাংলাদেশে আমার বোনটিকে ফোন লাগিয়ে তুর্য’র কুশল খবর নিয়ে আমার প্রেসারের পারদ নামালো।

একি ঘোর অমানিশা, একি আকাল? গত অর্ধশত বছরে মানুষের এমন দুর্বিপাক তো দেখিনি কখনও। বিজ্ঞানের এই জয়জয়কারের যুগে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস কিনা মানব সভ্যতার দম্ভকে কাঁপিয়ে দিয়েছে? এত কাল দেখে এসেছি মানুষ যেখানে অসহায়, তাদের চিন্তা শক্তি যখন কিনারা খুঁজে পায় না; তখনই তারা পরমেশ্বরের শরণাগত হয়। এই করোনাভাইরাসের আতঙ্কে মানুষ উপযুক্তভাবে প্রার্থণাও করতে পারছে না। গির্জায় আজ ঘন্টা বাজে না, মসজিদে জুম্মা নেই, মন্দিরের শঙ্খনাদ শুনি না! বিজ্ঞান সর্বগ্রাসি এ ভাইরাস প্রতিরোধে অকার্যকর (এখন পর্যন্ত), আর ধর্ম অব্যবহার্য!

কি যে দুঃশ্চিন্তার নাগপাশে আটকে রয়েছি গত কষ্ফটি সপ্তাহ, তা লিখে বোঝাবার নয়! বোনদের মেয়েগুলো ঢাকায়। ওরা কেউ ছাত্রী, কেউবা চাকুরীরতা। এই লকডাউন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে আম্মা ওদেরকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছেন। তিন বেডরুমের এশটি বাসায় ৫/৭ জনমানুষ ওরা। করোনা নিরোধের জন্য পরস্পর থেকে যে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন, সেটা ওরা পারছে বলে তো মনে হয় না।

অমিয়া আর রুলু, আমার ছোট দুই বোনের দুই কনিষ্ঠ সন্তান; বেজায় দুরন্ত ওরা! ফোনালাপের শুরুতেই জেনে নেই, ওই দুষ্টু দুটো রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে কিনা! চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো’রা নানা জায়গায় ছড়িয়ে, দাদীর বাড়ী’র স্বজনেরা, গোপালগঞ্জে তিনটি বোন; কখন যে কার কি সংবাদ শুনি! অজানা শঙ্কায় রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়! ফোনটি হাতড়ে খুঁজে দেখি কোথাও থেকে কারো কিছু খবর এসেছে কিনা বা কোন বার্তা! জেগে বিছানায় বসে থাকি।

ক’সপ্তাহ আগে চীন, ইতালী, স্পেন, আমেরিকা, প্রভৃতি দেশে ক্রমবর্ধমান হারে এই করোনাভাইরাস যখন ছড়িয়ে পড়ছিলো, তখন ভেবেছিলাম আমাদের কানাডা স্বাস্থ্য সেবায় উন্নততম দেশ; এখানে তেমন কিছুই হবে না। মাত্র সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যেই টরন্টো শহরে আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে বেড়ে হাজার ছাড়ালো। মৃতের সংখ্যাও কম কিছু নয়। শৈশবে আমাদের গাঁয়ে এশটি প্রবাদ শুনতাম, “য়াওয়াল বিয়া দিছি বউ মরছে, আর মাইয়্যা বিয়া দিছি জামাই মরছে; আল্লাহ’র অশেষ রহমত। এ যাত্রা পরের উপর দিয়া গ্যাছে”!

তো টরন্টো শহরে এই রোগের বিস্তার শুরু হওয়ার পরে ভেবেছিলাম যে, রোগটি “পরের উপর দিয়েই যাবে।” কিন্তু আজ একদিনেই আমার শহরে এশাধিক পরিচিতজনের আক্রান্ত হওয়ার খবরে মনটা বড়ই বেদনাতুর হয়েছে। একি ঘোর তমশা! ফোন বেজে উঠলে চমকে উঠি! ফেসবুকের পাতা স্ক্রল করতে আতঙ্ক হয়! সারাক্ষণ শঙ্কা, এই বুঝি আঙ্গুলের ডগায় এশটি করোনাভাইরাস এসে বসলো! কল্পিত সেই ভাইরাসটি মারতে দিনের মধ্যে কতবার যে সাবান পানিতে হাত ধুই, তা গুণে শেষ করা যাবে না!

এ এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি! সাম্যবাদী এ ভাইরাসটি ইংল্যান্ডে তো রাজাপ্রজা মানছে না। লন্ডনে ভাই বুলবুল এবং আরো অনেক বন্ধুরা থাকে। ওরা সব কেমন আছে আল্লাহই জানেন। আমার হোম সিটি গোপালগঞ্জের মতই নিউইয়র্ক শহরটি আমার কাছে প্রিয়। উঠতি যৌবনের বড় একটা সময় কেটেছে সেখানে। কত বন্ধু, অগ্রজ, অভিভাবক, স্বজন, অনুজ, প্রিয়ভাজন, প্রিয়তমা থাকেন সেখানে! ওদের সবার জন্য মনটা কাঁদে সারাক্ষণ। এই বুঝি কোন খারাপ খবর কানে আসে! আবার যে কবে নিউইয়র্কে যেতে পারবো? ওদের কার সাথে যে দেখা হবে, বা হবে না; সে বিধানকর্তাই জানেন।

বাবু খালুর সাথে নিউইয়র্কে বসে আরকি তবে রাজনীতির তত্ত¡ কথা হবে না?
লংআইল্যান্ডে সালাউদ্দিন ভাইয়ের বাসায় কি আর যাবো না কোনদিন? ফিরোজ কি তবে তার রচিত ছড়াটি পড়া শেষ করে, প্রশংসা শোনার অপেক্ষায় থাকবে না?

আক্তার আর আমি কি তবে আর কষনও আটলান্টিক সিটির ক্যাসিনোতে যাবো না? নতুন কোন গান গলায় তুলেই মৃদুলা কি তবে ফোন করে আর বলবে না, দোস্ত কথা পরে হবে গানটা আগে শুনে নে প্লিজ! হাটসন নদীর পাড়ের সেই বেঞ্চখানিতে বসে রাত শেষ হওয়া অব্দি গ্লোরীয়া আর আমি কি তবে জলের ঢেউ গুনবো না আর কোনদিন? আমাদের জীবন কি আর আগের মতো ছন্দময় হয়ে উঠবে কখনও? এ মহামারী সমাজবদ্ধ মানবকে কি তবে সমাজচ্যুত করে ছাড়বে?

শুনেছি প্রকৃতির রাজ্যে যা কিছু ঘটে তা নাকি সব জীবের কল্যাণের জন্যই। জানি না এই মহাবিপর্যয়ের নেপথ্যে জগত সংসারের কি কল্যাণ(!) লুকিয়ে আছে? তবে যতটুকু দেখছি তাতে মানুষ এখন অধিক পরিবারমুখী, পারস্পরিক মমত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, কারখানা ও যন্ত্রযান চলাচল সীমিত থাকায় আমাদের গস্খহটির বায়ুদূষন মুক্তি ঘটছে এবং সেই সাথে ঘরে থাকার এই সময়টুকুতে আমাদের আত্মোপলব্ধির যথেষ্ট সুযোগ তৈরী হয়েছে।

আজ সকাল থেকে কেন জানি না রবি কবির এশটি গানের প্রথম দুটি চরণ মনোমাঝে বারে বারেই গুঞ্জন তুলছে। মনে পড়ছে ২৩ বছর আগের কথা। সেই সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের সবুজ ঘাসে পা মেলে বসে মৃদুলা শুনিয়েছিলো গানটি-
“সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোন শোন পিতা।
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা…।”
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)