অনলাইন ডেস্ক : প্লাস্টিক দূষণ যে কেবল সমুদ্র বা বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করছে তা নয়, আমাদের প্রতিদিনের খাবারেও ঢুকে পড়ছে। নতুন এক গবেষণা তেমনই ভয়ঙ্কর সতর্কবার্তা দিয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানোপ্লাস্টিক কণা উদ্ভিদের শিকড় ভেদ করে সরাসরি খাওয়ার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। ফলে সবজি, শস্য এমনকি আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যেও অদৃশ্য প্লাস্টিক মিশে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব প্লাইমাউথ-এর গবেষকরা রেডিশ উদ্ভিদকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে পরীক্ষা চালান। হাইড্রোপনিক ব্যবস্থায় উদ্ভিদগুলোকে পলিস্টাইরিন ন্যানোপার্টিকলসমৃদ্ধ দ্রবণে রাখা হয়। পাঁচ দিন পর দেখা যায়, শিকড়ের ভেতরে লক্ষ লক্ষ ন্যানোপ্লাস্টিক জমা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ পৌঁছে গেছে রেডিশের খাওয়ার উপযোগী অংশে। এমনকি পাতাতেও প্রায় ১০ শতাংশ কণা পাওয়া গেছে। এই ন্যানোপ্লাস্টিক কণার আকার এতই ক্ষুদ্র—এক সেন্টিমিটারের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ—যে খালি চোখে দেখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু শরীরের ভেতরে প্রবেশ করলে এগুলো নিজের খেলা দেখাবে।
গবেষণার প্রধান লেখক ড. ন্যাথানিয়েল ক্লার্ক বলেন, “উদ্ভিদের শিকড়ে ক্যাসপারিয়ান স্ট্রিপ নামক একটি স্তর থাকে, যা বাইরের ক্ষতিকর কণাগুলোকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। কিন্তু এই গবেষণায় প্রথমবার প্রমাণ মিলল, ন্যানোপ্লাস্টিক সেই বাধা ভেদ করে উদ্ভিদের ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।” ড. ক্লার্কের মতে, এটি কেবল রেডিশের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বিশ্বের নানা সবজিতেই একই ঘটনা ঘটছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
এর আগে এই একই গবেষক দল দেখিয়েছিলেন, মাছ ও শামুকজাতীয় সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরেও দ্রুত ন্যানোপ্লাস্টিক জমা হয়। এবার স্পষ্ট হল সবজিও একই চক্রের অংশ। অর্থাৎ মানুষ প্লাস্টিক গ্রহণ করছে কেবল মাছ বা জলের মাধ্যমে নয়, উদ্ভিজ্জ খাবারের মাধ্যমেও।
অধ্যাপক রিচার্ড থম্পসন, যিনি প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল মেরিন লিটার রিসার্চ ইউনিট-এর প্রধান, বলেন, “আমরা যেখানে খুঁজেছি, সেখানেই মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছি। তাই ফলাফল অবাক করার মতো নয়। তবে এবার সরাসরি প্রমাণ পাওয়া গেল। তিনি আরও যোগ করেন, “এটি প্রমাণ করে, পরিবেশে থাকা কণা খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।”
বিশ্ববিদ্যালয়টি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা করছে। তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে টায়ারের ক্ষয়, কাপড় ধোয়ার সময় নির্গত তন্তু, রঙ, আর নষ্ট হওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য হল ন্যানোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎস। এগুলো এত ক্ষুদ্র যে শরীরে প্রবেশ করলে বের করা কার্যত অসম্ভব।
এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ কারণ ফসল যদি ন্যানোপ্লাস্টিক শোষণ করে, তাহলে তা গবাদি পশুর শরীরেও ঢুকে পড়বে, এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের শরীরে পৌঁছাবে। ফলে প্রতিদিনই মানুষ অজান্তে অল্প অল্প করে প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। এই গবেষণা শুধু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নয়, বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। সমুদ্র ও নদী দূষণের পাশাপাশি এখন কৃষিজ ফসলও ন্যানোপ্লাস্টিকের শিকার হলে খাদ্যশৃঙ্খল সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমস্যা আরও বড় হওয়ার আগে কার্যকর আন্তর্জাতিক নীতি, প্লাস্টিক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কড়াকড়ি আরোপ ছাড়া কোনও উপায় নেই।