সাজ্জাদ আলী: বিশেষ একজন ডাক্তারের থেকে চিকিত্সা নেবো বলে গত ২ মাস ১১ দিন যাবত অপেক্ষা করছি। আসছে বুধবার ২৫ মার্চ বেলা ২:০০ টায় কাঙ্খিত সেই এপোয়েন্টমেন্ট। নাক-কান-গলা’র এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের খ্যাতি কানাডা’র গন্ডি ছাড়িয়েছে। তাঁর সাক্ষাত্প্রাপ্তির জন্য রোগীদের লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়। রোগের জটিলতা বিবেচনায় আমার সমস্যাটি তুচ্ছ, অত বড়সড় ডাক্তার আমার দরকার ছিলো না। তবুও ভাবলাম ফি যখন দিতে হবে না, তখন বড় ডাক্তারই দেখাই!

এদিকে সাক্ষাত্কারপূর্ব হোমওয়ার্কও আটঘাট বেঁধে করে রেখেছি। ইতিমধ্যে ডাক্তারের অফিসের চাহিদা মতো বিনেপয়সায় এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, ইত্যাদি পরীক্ষাগুলো করায়ে এসেছি। সকাল, দুপুর বা রাতে দিনের কোন সময়ে গলার কোন দিকটায় খুসখুসে কাশি লাগে এবং গত ক’মাসে সেজন্য কি কি ঔষধ খেয়েছি, -তার একটা তালিকা টাইপ করে প্রিন্ট নিয়ে রেখেছি। সাবধানের মার নেই! এত দিনের অপেক্ষার পরে এত্তবড় ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, কোন পয়েন্ট বলতে যেন ভুলে না যাই।

আজ সকালে সেই ডাক্তারের অফিস সহকারীর ফোন কলে আমার এতসব প্রস্তুতি, এতদিনের অপেক্ষা, -সবই ভেস্তে গেল। বললো, কোভিড-১৯ (করোনা ভাইরাস) সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকির কারনে ডাক্তারের সাথে আপনার ২৫ তারিখের সাক্ষাত্কার বাতিল করছি আমরা। তবে তিনি আপনাকে ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখবেন। আমরা কালকের মধ্যে আপনার বাড়ীতে একটা চিকন নলওয়ালা বিশেষ ধরনের মিনি ক্যামেরা পৌঁছে দেবো। ভিডিও কলের সময়ে ওটা আপনার গাল ও গলার সংযোগস্থলে কোথায় কিভাবে বসাবেন তার নির্দেশিকাও সাথে থাকবে। আর ভাববেন না, ক্যামেরার জন্য কোন খরচ নেই আপনার, বলে যাচ্ছে মেয়েটি।

আমি মাঝপথে তাকে থামিয়ে বললাম, আড়াই মাস অপেক্ষা করছি ডাক্তারকে সামনাসামনি সব বুঝিয়ে বলবো বলে। আর তুমি বলছো, দেখা হবে না! বললেই হলো? যেভাবেই হোক আমাকে ১০ মিনিটের জন্য দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও প্লিজ। মেয়েটি কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বিনয়ের সাথে বললো, কানাডাব্যাপী যে সেল্ফ কোয়ারেন্টিন অভ্যাস চলছে আমরা তা অনুসরণ করছি মাত্র। আপনার সহযোগিতা না পেলে এ কাজটা আমরা তো আর একা পারবো না! ২৫ তারিখ বেলা ২টায় ফোন খোলা রাখবেন, ডাক্তার আপনার অপেক্ষায় থাকবে।

পৃথিবীর দেশে দেশে করোনা ভাইরাস দ্রুতই মহামারী আকার ধারণ করছে এবং প্রত্যেক দিনান্তে তা মানব সভ্যতার জন্য অধিক বিপর্যয়কর হয়ে উঠছে। ছোঁয়াচে এই রোগটিকে নিয়ে সব থেকে বড় সংকট হলো এর নিরাময়ে এখন পর্যন্ত কোন ঔষধ নেই। সেক্ষেত্রে রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চলাই তো একমাত্র উপায়। এই রোগে আক্রান্ত জানা বা নাজানা ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়াতেই কানাডিয়ানরা স্বপ্রণোদিত হয়ে কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গরোধ ব্যবস্থা পালন করছে। ফেডারেল বা রাজ্য সরকার কোয়ারেন্টিনের জন্য কোন বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারি করেনি বটে, তবে জনস্বার্থে “অনুনয়” জানিয়েছে। সভ্য দেশের ভব্য নাগরিকদের জন্য সেই “অনুনয়টুকুই” যথেষ্ট।

সঙ্গরোধ বা সঙ্গহীনতা মনুষ্য অভ্যাসের পরিপন্থি। সামাজিক জীব মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অন্যের সাহচর্যের জন্য লালায়িত। একাকিত্ব মানবের জন্য কারাবাসস্বরুপ। আর ব্যক্তি আমার জন্য এ এক চরম শাস্তি! পেশা এবং নেশা, এই দুই ক্ষেত্রে আমি সদাই বন্ধু-স্বজন পরিবেষ্ঠিত থাকি। “সঙ্গরোধ” কিভাবে করতে হয় আমার তা জানাই নেই। কিন্তু নাগরিক কর্তব্য পালন তো করতেই হবে। অগত্যা টরন্টো’র করোনা ভাইরাস হেল্পলাইনে ফোন করে কিভাবে “সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে” থাকা যায় সেই পরামর্শ চাইলাম। ফোনের অপর প্রান্তের মহিলা খুবই আন্তরিক কন্ঠে বললেন, কাগজে লিখে রাখুন তাহলে অন্যদেরও জানাতে পারবেন। সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে কি কি করবেন না, আগে সেগুলো বলি আপনাকে,-

  • বন্ধু-প্রতিবেশিদের সাথে মিলিত হবেন না
  • কারো সাথে হ্যান্ডশেক করবেন না, বা কাউকেই চুমা দিবেন না
  • স্বজনদের কারো বাড়ীতে রাত্রিযাপন করবেন না
  • ইনডোর বা আউটডোরে খেলাধুলা বন্ধ রাখুন
  • আপাততঃ কাউকে বাড়ীতে নিমন্ত্রণে ডাকবেন না বা কারো নিমন্ত্রণ রক্ষাও করবেন না।
  • সভা, সমাবেশ, সেমিনার, কনসার্ট, একেবারেই না
  • সাবানে হাত না ধুয়ে নিজের চোখ, নাক, মুখ, ছুঁবেন না।
    মহিলার বলে যাওয়া পরামর্শগুলো আমি লিখে নিচ্ছি। তিনি বলছেন, এবারে শুনুন সেল্ফ কোয়ারেন্টিনের জন্য কি কি করবেন সেগুলো,-
  • যতটা সম্ভব ঘরে থাকুন, আর বাড়ীতে বসেই কাজ করুন।
  • ঘরের বা বাইরের যে কোন ব্যক্তি থেকে ২ মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন
  • হাঁচি/কাশিগুলো টিস্যু পেপার বা হাত দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ঝাড়–ন
  • অন-লাইন ডেলিভারী সার্ভিসে খাবার এবং গ্রোসারী অর্ডার করুন
  • দিনে দু চার পাঁচ সাতবার সাবান পানিতে হাত ধুয়ে ফেলুন
  • সব ধরণের সামাজিক বিষয়গুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখুন
    আর শুনুন, কঠিন কিছুই কিন্তু বলিনি আপনাকে। এক্ষুণি শুরু করুন, ২/১ দিনের মধ্যেই এগুলো সব অভ্যাসে এসে যাবে। আর আমরাও এই বিপর্যয় মুক্ত হবো। এটুকু বলেই পরামর্শক মহিলা ফোন রাখলেন।

কানাডার কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থার আরো একটি উদাহরণ বলে আমিও লেখাটি শেষ করবো। আমার স্ত্রী সম্প্রতি একটি নতুন চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এদেশে যে অনুপস্থিত তা তো নয়! তিনি গুন্ডা-বদমাস কিনা, চাকুরীদাতা সেটা নিশ্চিত হতে চান। তো তাঁর নতুন কর্মস্থল থেকে “ব্যাকগ্রাউন্ড চেক” সম্বলিত পুলিশ রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। সেই রিপোর্ট সংগ্রহ করতে আমার স্ত্রী বাড়ীর কাছের থানায় গিয়েছিলেন। থানার সদর দরজায় কর্তব্যরত একজন অফিসার তাঁকে আটকে দিয়েছে।

কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা চলমান রাখার অংশ হিসেবে থানা ভবনে আপাততঃ নাকি নাগরিকদের প্রবেশ নিষেধ। তবে পুলিশ রিপোর্টখানি পাওয়ার উপায় অফিসার বাত্লে দিয়েছে। অন-লাইনে আবেদন করার ঠিকানা লিখিত একখানা কাগজ তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অফিসার বলেছে, আবেদন করার ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাদের একজন অফিসার রিপোর্টখানি আপনার বাড়ীর ডাক বাক্সে পৌঁছে দেবে। কথামতো পরের দিনই আমার স্ত্রী বাড়ীতে বসেই তার সার্টিফিকেটখানি পেয়েছেন। কানাডার পুলিশ বাহিনীর এহেন করিৎকর্মের জন্য তিনি নিশ্চয়ই ২ রাকাত নফল নামাজ বরাদ্দ রেখেছেন!

কানাডীয়ান জীবনে এ সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা! সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত, ব্যাংক, বীমা, ইত্যাদি সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বাড়ীতে বসে কাজ করছে। বারগুলোর দরজা বন্ধ, তবে মদের দোকান খোলা; কিনে নিয়ে বাড়ীতে বসে খাও। স্কুল/কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো বন্ধ, ছাত্ররা বাড়ীতে বসে পড়ছে। রেষ্টুরেন্টগুলো খোলা, তবে দোকানে বসে খাওয়া যাবে না; খাবার কিনে বাড়ীতে নিয়ে খাচ্ছে সবাই। কাজ করতে পারুক বা নাই পারুক মালিকেরা কর্মিদের বেতন পৌঁছে দিচ্ছে, আর মালিকদের ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে সরকার। বিমানবন্দরগুলো ফাঁকা, বাস-ট্রেনে লোক নেই, গাড়ীর দেশ কানাডার রাস্তায় হাতেগোনা দুচারখানা গাড়ী, বিশাল সব শপিং মলগুলো খোলা থাকলেও খরিদ্দারের আনাগোনা নেই মোটেই। ব্যবসায়িক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সব ধরনের সমাবেশ বন্ধ। আমেরিকার সাথে বর্ডার বন্ধ করে দিয়েছে ফেডারেল সরকার। দেশটির সব থেকে বড় এবং ব্যস্ততম শহর টরন্টো যেন এক মৃত নগরী, পর্যটকদের পদধ্বনি শোনা যায় না। চারিদিকে শুনশান নীরবতা।

কানাডার স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিকদের জন্য আকস্মিক এ দুর্বিপাক নিশ্চয়ই লম্বা হবে না। চুম্বনপ্রিয় এ জাতি যখন গণস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় তাদের ঠোঁট আগলাতে পেরেছে; তখন আর তাদের আটকায় কে! যে দেশের সর্বস্তরের মানুষ মানবিক বিপর্যয় অনুধাবন করে স্বতস্ফুর্তভাবে “সঙ্গরোধ” করতে পারে; ঈশ্বরের আশিষও তাদের উপরে বর্ষিত হয়।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)