ফারহানা আজিম শিউলী: আমরা জানি, এ বছরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি, অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী। আর এই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নিবেদন করা হয়েছে টরন্টোভিত্তিক সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র এবারের অর্থাৎ ২৫তম আসর। আসরে আলোচিত হয়েছে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা বই “একাত্তরের দিনগুলি।”

বইটি নিয়ে আলোচনা করেন তামান্না মাকসুদ পর্ণা। অতিথি আলোচক ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কনিষ্ঠ সন্তান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদ শাফী ইমাম রুমীর ভাই সাইফ ইমাম জামী।

“একাত্তরের দিনগুলি” বইটি ফেব্রæয়ারি, ১৯৮৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এর অনেকক’টি সংস্করণ বেরিয়েছে। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে – ‘মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও জীবিত গেরিলাদের উদ্দেশে।’ বইটি লিখেছেন শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়ক, বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখক, শহীদ রুমীর মা, জামীর মা, আমাদের সবার মা- জাহানারা ইমাম। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৯৪ সালের জুনে মৃত্যুবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম পাঠকধন্য বই
“একাত্তরের দিনগুলি।” “একাত্তরের দিনগুলি” ১৯৭১ সালের দিনলিপি। প্রথমত, ডায়েরি বা দিনলিপিকে ইতিহাস না বললেও ইতিহাসের অত্যন্ত জরুরি উপাদান বলে মনে করা হয়। দ্বিতীয়ত, একটি বড় সংগ্রামের সামগ্রিক ইতিহাস খণ্ড খণ্ড অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে ধারণ হয়ে থাকে, যাকে একটু একটু করে জুড়লে একটা স্মৃতির সমগ্র তৈরি করে। স্বৈরশাসন, সামরিক দমন, জাতিগত নির্যাতন, গণহত্যা, অবরুদ্ধ জনপদ ও জনতার মাঠ-ঘাটের প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ- অবরুদ্ধ সময়ের ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাস, অশ্রুধারা ও আশাবাদে খুঁজে পাওয়া যায়। তাই “একাত্তরের দিনগুলি” পড়তে পড়তে “অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি”র কথা মনে পড়ে। উল্লেখ্য, এই স্মৃতিকথার মধ্য দিয়ে একজন গৃহবধূ, এক মা যেমন সবার মা হয়ে ওঠেন, তেমনি ভবিষ্যতের চলমান মুক্তিযুদ্ধের স্বাভাবিক নেতৃত্বেও অভিষিক্ত হয়ে যান তিনি।

১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে জাহানারা ইমাম বাংলার হাজার মায়ের মতো তাঁর শ্রেষ্ঠ ত্যাগটি স্বীকার করেছেন – সন্তান রুমীকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আর ফেরেনি তাঁর সন্তান, শহীদ হয় রুমী। শহীদ রুমির মা জাহানারা ইমাম পরিণত হন শহীদ জননীতে।
আলোচক তামান্না মাকসুদ পর্ণা শুরুতেই “একাত্তরের দিনগুলি”র পটভূমি ও মূল চরিত্রগুলো তুলে ধরেন। এ পর্যায়ে তিনি বইটির লেখার স্টাইলকে এপিস্টোলারি বা পত্রসাহিত্য আখ্যা দিয়ে মূলধারার কথাসাহিত্য হিসেবে এটি আলোচনা করেন।

পুরো বইটি জুড়ে রুমী ও তার মা জাহানারা ইমামের এক অনন্য অভিযাত্রা উঠে আসে পর্ণার আলোচনায়। মা-ছেলের বন্ধুত্বপূর্ণ-স্পষ্টভাষী-আদর্শিক সম্পর্ক, ছেলের হাত ধরে মায়ের রূপান্তর, ঘরের মা ক্রমে রাজনৈতিক মা হয়ে ওঠা, এক পর্যায়ে এক মা সবার মা হয়ে ওঠা- এসব আলোচিত হয় এই পর্যায়ে।

পর্ণা বলেন, একাত্তরের দিনগুলিতে মায়ের রূপান্তর, সন্তানের হাত ধরে মায়ের যুদ্ধে প্রবেশ, ঘরের মায়ের রাজনৈতিক মা হয়ে ওঠা, মা-সন্তানের রাজনৈতিক-মানবিক সম্পর্ক মনে করিয়ে দেয় মহাশ্বেতা দেবীর আলোচিত উপন্যাস “হাজার চুরাশির মা” এর মা চরিত্রটির কথা। দুটি বইয়ের প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা সত্তে¡ও মায়ের রূপান্তরসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে দুই মায়ের অন্তঃমিল আলোচনা করেন পর্ণা।

“একাত্তরের দিনগুলি” যে মা-সন্তানের স্মৃতিকথা ছাপিয়ে পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের দলিল হয়ে উঠেছে এবং ৭১ এর ইতিহাস জানতে চাইলে এই বই যে অবশ্য পাঠ্য তা উঠে আসে পর্ণার আলোচনায়। ১লা মার্চ থেকে ১৭ই ডিসেম্বর জুড়ে বইয়ে আলোচিত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ, মিডিয়ার ভূমিকা, পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচার, গণহত্যা, গেরিলা যুদ্ধ, বর্ডারে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ, বুদ্ধিজীবী হত্যা, বইয়ের অসংখ্য চরিত্রের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ততা এসব নিয়ে বলেন তিনি এ পর্যায়ে। আরো বলেন, বইটি জুড়ে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আরো অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য করেছে বইটিকে।

আলোচক পর্ণা “একাত্তরের দিনগুলি”তে সমান্তরালে দুটো গল্প – ঘরের গল্প ও যুদ্ধের গল্প কিংবা ঘরের যুদ্ধ ও বাইরের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় উল্লেখ করেন জহির রায়হানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র “জীবন থেকে নেয়া” ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক উপন্যাস “ঘরে বাইরে”র কথা।

রুমীদের ঘরে যুদ্ধ প্রবেশ করলে, মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের সম্মিলিত প্রয়াস বলতে গিয়ে পর্ণা রুমীর বাবা শরীফ ইমাম এবং রুমীর ছোটো ভাই জামীর ভূমিকা তুলে ধরেন।

এ পর্যায়ে পর্ণা, বইটির প্রথম পাঠ ও এখনকার পাঠের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন, এ যেন অনেকটা প্রিয় শহর কিংবা প্রিয় কবিতা-গানের কাছে ফেরা। বইটিকে নতুন করে নির্মাণ, বইয়ের সাথে নিজের যোগসূত্র আবিষ্কার এবং গোটা বইটিকেই পুনরাবিষ্কারের বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরেন তিনি।

পর্ণা বলেন, “একাত্তরের দিনগুলি” শুধুমাত্র পিরিয়ড পিস বা সময়ের দলিল না। তাহলে মুক্তিযুদ্ধও কারাবন্দি হয়ে পড়ে। এটি সময়কে অতিক্রম করে গেছে অনেকটাই। এটি সময়ের দলিল এবং চিরকালীনতার হাত ধরে সমকালীনও। এই বই সবসময়ের বই। বইয়ের একদম শেষে রুমীর ভাই জামীর হাতে স্টেনগান তুলে দেওয়া যেন প্রতীকীভাবে বহমান যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। পর্ণা বলেন, ৭১ এর ঘাতক দালালদের শাস্তির দাবিতে শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ আন্দোলন জাহানারা ইমামদের কর্মের লিগ্যাসি। এবং এখনকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান, তাদের অনিবার্য পথনির্দেশিকা হয়ে ওঠে ‘একাত্তরের দিনগুলি’।

সবশেষে পর্ণা বলেন, এই বই সন্তান-হারা মায়ের শোকগাথা ছাপিয়ে দিনশেষে পুরোপুরি আশা-জাগানিয়া একটি বই।

আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে “একাত্তরের দিনগুলি” বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র, শহীদ রুমীর ছোটো ভাই সাইফ ইমাম জামী প্রথমেই বইটির লেখক মা জাহানারা ইমামের বইয়ের প্রস্তুতিপর্ব ও সেসময় নিজের সম্পৃক্ততা তুলে ধরেন।

জামী বলেন, “একাত্তরের দিনগুলি”র প্রথম সংস্করণের কপি নিজে লিখে পুত্র জামী ও পুত্রবধূ ফ্রিডার হাতে তুলে দেন মা জাহানারা ইমাম ১৯৮৬ সালের মার্চে। সেই বইটি আসরের দর্শকদের দেখানো হয়। উল্লেখ্য, জামী ১৯৭৪ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বাস করছেন আমেরিকার মিশিগানে এবং মা জাহানারা ইমাম তখন ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আমেরিকায় জামীর বাসায় যান।

“একাত্তরের দিনগুলি” পড়ে আমরা জানতে পারি, রুমী-জামীদের পারিবারিকভাবে একটা মুক্ত পরিবেশ ছিল। সবক্ষেত্রেই একটা প্রাগ্রসরতা ও অগ্রসর ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই আমরা। এই ক্ষেত্রে মায়ের শিক্ষা, রুচিবোধ ও সার্বিক ভূমিকা তুলে ধরেন জামী তাঁর আলোচনায়।

বই থেকে রুমী চরিত্রটি একভাবে নির্মিত হয় আমাদের অর্থাৎ পাঠকের কাছে। আর জামী তুলে ধরেন আরেক রুমীকে, যার সাথে বেড়ে উঠেছেন জামী নিজে।

জামী বইটির প্রথম পাঠ এবং পুনঃপাঠের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, পড়তে গিয়ে অনেক কষ্ট হলেও প্রতি বছর মার্চ মাসে তিনি বইটি হাতে তুলে নেন। এ পর্যায়ে তিনি তাঁকে স্পর্শ করে যাওয়া, আন্দোলিত করা, ব্যথিত করা বইয়ের নানা অংশ থেকে সুখ-দুঃখ জাগানিয়া স্মৃতি নিয়ে আলোকপাত করেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উঠে আসে ভাইয়া রুমীকে (সাথে জামী, রুমীর বাবা, রুমীর চাচাত ভাই মাসুম, রুমীর বন্ধু হাফিজ) ধরে নিয়ে যাবার দিন থেকে দুই দিন দুই রাতের দুঃসহ স্মৃতি, বাবাকে হারানোর দিনের কথা, ১৭ই ডিসেম্বরে মায়ের সাথে পতাকা তোলা এবং মেজর হায়দার তাঁদের বাসায় আসার স্মৃতি। জামীর কথায় যুগপৎভাবে উঠে আসে ভাই-বাবা হারানোর কষ্ট আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা লাভের সুখস্মৃতি।

জামী বলেন, এক ভাইকে হারিয়ে তিনি রুমীর সতীর্থদের পেয়েছেন ভাই হিসেবে। ভাই ও বাবা হারানোর পর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশিরা তাঁকে আপনজন হারানোর ব্যথা ভোলাতে সচেষ্ট ছিলেন সবসময়।

রুমী-জামীর মা এক মা থেকে সবার মা হয়ে ওঠেন, আমরা জানি। এ পর্যায়ে জামী মা’কে পুনরাবিষ্কারের গল্প শোনান।

মা জাহানারা ইমাম কেন ক্যান্সারাক্রান্ত অবস্থাতেও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দায়িত্ব নেন, সেটি ব্যাখ্যা করেন জামী।

জামী ৭১ এ দাঁড়িয়ে “একাত্তরের দিনগুলি”র বর্ণনায় ৭১, আর ২০২১ এ দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ অর্থাৎ ডায়েরির বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ, মাঝখানে সেতুর মতো শাহবাগ – এই নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন তুলে ধরেন। বর্তমান বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চ্যুতিতে তিনি যেমন বিচলিত, তেমনি আশাবাদীও নতুনদের নিয়ে। তিনি বলেন, ৭১ ছিল একটা ফ্ল্যাশপয়েন্ট, আরেকটা ফ্ল্যাশপয়েন্ট শাহবাগ। ঠিক এমনিভাবে তরুণরাই দেশের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরেক ফ্ল্যাশপয়েন্টের সূচনা করবে সময়মতো।

সবশেষে জামীর অনুরোধে, রুমীর খুব প্রিয় ‘গেরিলা’ কবিতাটা পাঠ করে শোনান শিউলী। ৭১ এর আগস্টে মা-বাবার বিয়ে বার্ষিকীর আগের রাতে রুমী এসেছিল মেলাঘর থেকে ঢাকার বাসায়। সেবারেও মাকে পড়ে শুনিয়েছিল সে ‘গেরিলা’ কবিতা।

“একাত্তরের দিনগুলি” শুধুই একটি আত্মজৈবনিক দিনলিপি না। এই বই আমাদের অস্তিত্ব-সমগ্রতার অংশ হিসেবে স্থায়ী হয়ে আছে। এই বই একইসঙ্গে ঢাকার নাগরিক জীবন, আধুনিক বোধ, পরিবারময়তা, আদর, বন্ধুত্ব, সাংস্কৃতিক প্রাগ্রসরতা, সামাজিক উদারতা, মানবিক অনুশীলন আর মহান মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান হয়েছে, হয়েছে চলমান মুক্তিযুদ্ধের সারথিও। এই বই এমন এক বিশ্বাসযোগ্য সমাজ-গদ্য হয়েছে যা ঠিক এভাবে আর কোন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আত্মজৈবনিক গ্রন্থে আমরা পাইনি। আদরে-আবেগে-চোখের জলে আমাদের বুকে আগলে রাখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নিয়েই ছিল পাঠশালার এবারের আসর।

পাঠশালার এবারের আসরের বিষয়বস্তু হিসেবে পাঠক-নন্দিত বই “একাত্তরের দিনগুলি”র নির্বাচন, আলোচক তামান্না মাকসুদ পর্ণার গভীর-প্রাণবন্ত-হৃদয়গ্রাহী আলোচনা, সময়ের সরণি বেয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া “একাত্তরের দিনগুলি”র অন্যতম চরিত্র সাইফ ইমাম জামীর আলোচনা, জামীর উপস্থিতি- দর্শক-শ্রোতাদের আনন্দিত করেছে, উদ্বেলিত করেছে, করেছে আবেগীও। দর্শকদের অনেকেই মন্তব্য লিখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সরবে উপস্থিত ছিলেন ভার্চুয়াল এই আসরে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আয়োজিত পাঠশালার আসরের পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।