সাজ্জাদ আলী : চাইলেই তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না! জীবন সচল রাখতে বাহিরমুখিতো হতেই হয়। ব্লাড প্রেসারের ঔষধ শেষ, কফি’র মজুদ পাত্রের তলানিতে ঠেকেছে, প্রিন্টারের কালিও কিনতে হবে। গত তিনটি দিন ঘর থেকে একেবারেই বের হইনি। টেলিভিশন বুলেটিনগুলো বারে বারেই নাগরিকদের ঘরে থাকতে অনুরোধ রাখছে এবং মনুষ্য সমাজের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে বলছে (স্যোশাল ডিসটেন্সিং)। করোনা’র আতঙ্কে সমাজ-সঙ্গরোধ করে ঘরেই তো আছি। আর ঘরে থাকলে স্যোশাল ডিসট্যান্সিংটা তো অটোমেটিক হয়েই যায়।

এদিকে আমার স্ত্রী আজই জানতে পেরেছেন যে, তা নাকি হয় না। তাঁর ভাষ্য মতে, বাড়ীতে আমরা দুজন মানুষ; কোভিড-১৯ ভাইরাস ঠেকাতে এই দুজনের মাঝেই “স্যোশাল ডিসট্যান্সিং” বজায় রাখতে হবে। তার মানে কি? জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালাম ওর দিকে? তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, মানে সোজা! আজ থেকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত কোন ঘেঁষাঘেঁষি নাই। আর এক্ষুণি আমার সোফা থেকে উঠে ওই সামনের সোফাখানিতে গিয়ে বসো। এখন থেকে খাবার টেবিলে আমরা আর পাশাপাশি চেয়ারে বসছি না, দূরতম চেয়ারে বসে খেতে হবে। অথবা দুজনে আলাদা আলাদা সময়ে খেয়ে নেবো।

হাঁ করে শুনছি তাঁর বয়ান! এবারে আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে চোখ বড় বড় করে বললেন, শোন ঘরের মধ্যে পরস্পরের থেকে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। বর্তমান স্বাস্থ্য বিধি মতো এাঁই হলো স্যোশাল ডিসট্যান্সিং। আর আমাদের রাত্রি বাসের সামান্য পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। আম্মার শোবার ঘরটা তো বহু দিন যাবৎ ফাঁকাই পড়ে আছে। সেখানে তোমার বিছানা পাটি পেতেছি। দরকারি সব বইপুস্তক, ল্যাপটপ, কোল বালিশ, টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি গুছিয়ে দিয়েছি। আপাতত ওই ঘরেই তুমি ঘুমুবে, আর নিচের বাথরুমটা ব্যবহার করবে।
মুখখানা প্রশ্নবোধক করে বললাম, তুমি কি সিরিয়াস নাকি? তিনি অধিক প্রত্যয়ের সাথে চোখে চোখ রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, এ বিষয়ে সংলাপ এ পর্যন্তই শেষ। এখন থেকেই আমরা “৬ ফুট দূরত্ব রক্ষার” শতভাগ চেষ্টা করবো। দেখ, বেঁচে থাকলে এ দূরত্ব কমবে, অন্যথায় তা সসীম থেকে অসীম হতে বাধ্য। অসহ্য! এল্টসব লেকচার শুনতে আর ভাল লাগছিলো না। গাড়ীর চাবি পকেটে গুজে উঠে পড়লাম। ড্রাইভ ওয়ের দিকে এগুতে এগুতে মনে মনে আওড়ালাম, আরে বালিকা তুমি যদি ৬ ফুট পারো, তবে আমি অনায়াসে ৭ ফুট পারবো। মনে সাহস সঞ্চয়ের জন্য মধু কবি’র মেঘনাদ বধকাব্যের সেই পংক্তিটি স্মরণে আনলাম, “ধামি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে”!

হ্যান্ডস্যানিটাইজার টিস্যু পেপারে মেখে ড্রাইভার্সসিট আর স্টীয়ারিং হুইল ভাল করে মুছে গাড়ী স্টার্ট দিলাম। সিটে বসে সাইড মিররগুলোর পজিশন মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। দেখি আমার স্ত্রী হন হন করে হেঁটে এসে তাঁর গাড়ীর দরজা খুললো। কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাও? বললো, বাসায় কাঁচা মরিচ নাই; গিয়ে নিয়ে আসি। আরে না না বাদ দাও তো, বললাম আমি। এুঁকু কাজের জন্য বেরুবার দরকার কি? ফেরার সময় আমি মরিচ নিয়ে আসবোনে। বললো, তোমার আনা মরিচ তো অর্ধেকই পঁচা হবে। বেছে খুঁটে তো কোনদিনই কিছু কেনো না!

তা ঠিক বটে! সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। তাহলে চলো একসাথে যাই, উঠে পড়ো। দুটো গাড়ী বের করার দরকার কি? আঁৎকে উঠলেন তিনি! ওরে বাবা না! এক গাড়ীতে যাওয়া যাবে না! গাড়ীর মধ্যে তো দুজনের মধ্যে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় থাকবে না! তাঁর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বললাম, তুমি তো দেখছি ব্যাপারটা নিয়ে আসলেই সিরিয়াস! কোন জবাব না দিয়ে তিনি দক্ষ হাতে তাঁর গাড়ী ড্রাইভওয়ে থেকে রাস্তায় নামিয়ে নিলেন। গাড়ীখানা চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, আল্লাহ মালিক এবার তো দেখছি তুমি আমাকে “স্যোশাল ডিসট্যান্সিংটা” হাতে-কলমে শিখিয়ে ছাড়বে!

চলতে শুরু করে ভাবলাম “কসকো” হোলসেল স্টোরেই যাই। বিশাল বড় দোকান ওটি, ওখানে গেলে সব কিছু এক জায়গা থেকেই কিনতে পারা যাবে। পার্কিংলট থেকে একখানা শপিংকার্ট নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে দোকানের দরজার দিকে এগুচ্ছি। দেখি স্টোরে ঢোকার জন্য অপেক্ষমাণ ক্রেতাদের ২০০ ফুট লম্বা লাইন। খুব যে বেশি লোক দাঁড়িয়েছে তা না, তবে লাইনটি লম্বা। কারণ একজন ক্রেতা থেকে আরেকজন ৬ থেকে ১০ ফুট দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে। স্টোরটিতে গত ১০ বছর ধরে আমি কেনাকাটা করতে যাই। ঢোকার জন্য কোনদিন লাইন দেখিনি।

এই প্রথম দেখলাম যে, সদর দরজায় ৩ জনপ্রহরী দাঁড়ানো। তারা দোকানে খরিদ্দার ঢোকার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করছে, যাতে ভেতরে লোকের ভিড় না হয়। পাঁচজন কেনাকাটা করে বেরুলে প্রহরীরা গুণে গুণে নতুন ৫ জনকে ভেতরে ঢুকাচ্ছে। প্রহরা যে শুধু প্রবেশ পথে তা না। স্টোরের ভেতরে মস্ত আইলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পাহারা বসিয়েছে। দুজন খরিদ্দার কোন শেলফে বেখেয়ালেও যেন কাছাকাছি চলে না আসে, তার জন্যই এ সতর্কতা। আবার এহেন নজরদারির মধ্যে খরিদ্দাররা কেউ কেনাকাটায় অস্বস্তিতে ভোগেন কিনা, স্টোর ম্যানেজমেন্টের সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি আছে। সুপারভাইজর গোছের দুজন বেরুবার দরজায় দাঁড়িয়ে বিনত ভংগিতে সবাইকে বলছে, আপনাদের সুরক্ষার জন্যই আমরা “৬ ফুট দূরত্ব” নীতিমালা অনুসরণ করছি।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী, সিটির মেয়র, শীর্ষ বিরোধী রাজনীতিকরা এবং স্বাস্থ্য কর্তারা, সারাক্ষণ টেলিভিশনে করোনা’র আপডেট ও পরামর্শ বলছে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা দুরূহ। আর সেজন্যে স্টেট ইমারজেন্সি জারি করে কর্মীদের কর্মে যাওয়া রোধ করা হয়েছে (জরুরী ও স্বাস্থ্যসেবামূলক কাজ ব্যতীত)। আপদকালীন অর্থবরাদ্দ অনুমোদন করিয়ে নিতে রাজ্য এবং ফেডারেল, উভয় সরকারেরই পার্লামেন্টের অধিবেশনে বসার দরকার পড়ছে। এ ক্ষেত্রেও স্পীকার স্বল্প সংখ্যক সাংসদদের বিশেষ এই সভাগুলোতে ডাকছেন। টেলিভিশনের পর্দায় আমরা দেখছি যে অধিবেশন কক্ষে দুজন সাংসদের মাঝে বেশ কয়েকটি আসন ফাঁকা। পরস্পরের থেকে ৮/১০ ফুট দূরত্বে বসছেন তাঁরা।

নন-কানাডিয়ান পাঠক বন্ধুদের জন্য বলছি। অতি সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কানাডিয়ান সমাজে উঠা বসাটা নিজ নিজ কমিউনিটি কেন্দ্রীক। অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সমাবেশ, নিমন্ত্রণ, ইত্যাদি সবাই যার যার কমিউনিটির মধ্যেই করে থাকে। আরো পরিস্কার করে যদি বলি তো, সামাজিক যাতায়াতের নিরিখে চাই নিজের বাড়ীতে বাঙ্গালী নিমন্ত্রণ পায় না, শ্রীলংকানের বাড়ীতে ইংরেজী লোক আসে না। বাংলা গানের আসরে উর্দ্দুভাষী খুঁজে পাওয়া যাবে না। তো এই করোনা সংকটে সব কমিউনিটির সামাজিক-সাংস্কৃতিক আয়োজন বন্ধ রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়েও কেউ বন্ধু-স্বজনদের আপাতত বাড়ীতে ডাকছে না। স্যোশাল ডিসটেন্সিং বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটা কানাডিয়ানরা খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।

এমনতর পরিস্থিতিতে আমাদের বন্ধু সোহেল ও তার স্ত্রী বড়ই বেজুত অবস্থায় পড়েছেন। বাড়ীতে লোক ডেকে খাওয়ানোর ব্যাপারে ওরা অগ্রণী। না, শুধু “অগ্রণী” বললে সুবিচার হয় না, ওরা আসলে এ বিষয়ে “ফার্স্ট হয়েছে” বলতে হবে। প্রতি সপ্তাহান্তে অতিথি আপ্যায়ন করা চাইই চাই। দরকার পড়লে কোটা দিয়ে লোক টেনে এনে টেবিলে বসায়ে খাওয়াবে। কাউকে বাড়ীতে ডাকার কথা মাথায় এলে জিকার আঠার মতো পেছনে লেগে থাকে! আমন্ত্রণে সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত ফোনের পরে ফোন করে করে তটস্থ রাখবে। আর কাংখিত অতিথি গিয়ে পৌঁছালে ওরা দুজন একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে খুশি হবে!

চারিপাশেই তো দেখি সবাই আমার লাইনের লোক, খেয়ে বেড়াতেই পছন্দ করে। আজকালকার জামানায় স্বজন আপ্যায়নের মানসিকতাই তো লুপ্ত হতে বসেছে। সেখানে সোহেলদের বাড়ীতে অতিথিরা একেবারে সাক্ষাৎ “নারায়ণ”। ওদের আরেকটি বড় গুণ যে, ওরা দুজনেই নিয়মিত বই-পুস্তক নাড়াচাড়া করে। তাদের রসবোধও অতি উঁচু। আর সঙ্গত কারণেই ওদের ডাইনিং টেবিলের পরিবেশটি খাদ্যসভা না হয়ে আলোচনা সভায় রূপান্তরিত হয়। করোনা সংকটে বাড়ীতে লোক ডাকতে না পেরে এই দম্পতি বড়ই মনোকষ্টে আছেন। এমন মহামারী পরিস্থিতির মধ্যেও সে দিন ফোন করে বলছে, ‘যদি আপনার অসুবিধা না থাকে তো আসুন না এক সাথে দুটো ডালভাত খাই’!

বন্ধু অসুবিধা তো আছেই। স্মরণকালের ভয়াবহতম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েছি আমরা। ঘরে, বাইরে, অফিসে, রাষ্ট্রে, সর্বত্র আতঙ্ক! কখন কার আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনি, নাকি নিজেই ধরাশায়ী হয়ে পড়ি; সেই দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না। কবি গুরুর থেকে ধার নিয়ে সকলের জন্য নিরন্তর প্রার্থণা করছি…!
“অন্ধজনে দেহোআলো, মৃতজনে দেহোপ্রাণ
তুমি করুণা মৃত সিন্ধু করো করুণা কণা দান।”
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)