শাহনুর চৌধুরী : ২০ বছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলার পর অনেক মুসলমান দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। ওই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইসলামপন্থী উগ্রবাদীদের দায়ী করায় মুসলমানরা সে সময় মামলা- হামলার ভয়ে দেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন। উন্নত জীবন-যাপনের আশায় অনেক মুসলমান সে সময় পাশ্ববর্তী কানাডাতেও আশ্রয় নেন। ২০ বছর পর তারা এখন এদেশে কেমন আছেন? ভবিষ্যৎ নিয়েই বা তারা কী ভাবছেন? স¤প্রতি কানাডাতেও ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি মুসলিম বিদ্বেষী ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়া কী? এসব বিষয় জানতে স¤প্রতি সিবিসি নিউজ কয়েক জনের সাথে কথা বলেছে। তাদের একজন ইদ্রিস আল বাকির। ৯/১১-এর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তিনি ও তার স্ত্রী কানাডায় চলে আসেন। বর্তমানে তারা কানাডার উইনিপেগে বসবাস করছেন। ম্যানিটোবা ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা আল বাকির বলেন, আমার জন্ম জেরুজালেমে। আমি শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। সেখানে আমি স্থাপত্য বিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ শেষে পিএইচডিও সম্পন্ন করি। বলতে গেলে আমি আমার জীবনের সেরা সময় সেখানে কাটিয়েছি। কিন্তু ৯/১১-এর ঘটনার পর সব কিছু পাল্টে যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুসলিম ছাত্র ও শিক্ষকদের তুলে নেয়া শুরু করে। তাদের অনেককে পরবর্তীতে আর ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি। সত্যিকার অর্থে মুসলমানদের মধ্যে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়ে। সবার মধ্যে এমন একটা মনোভাব দেখা যায় যে, মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী। এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীর পরামর্শে আমি দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই।

তিনি আরো বলেন, পেছনের দিকে তাকিয়ে এখন মনে হচ্ছে, আমাদের কানাডায় আসার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে আমার স্ত্রী হিজাব পরে রাস্তায় বের হলেই সবাই যেন কেমন সন্দেহের চোখে তাকাত। এখানে এমন কোন সমস্যা নেই। আমরা স্বাধীনভাবেই রাস্তায় চলাফেরা করতে পারি।

কানাডার সা¤প্রতিক ইসলাম বিদ্বেষী ঘটনাগুলোর বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এধরনের ঘটনা কানাডার ঐক্যের জন্য হুমকি। কানাডার যে বহুজাতিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য আছে তা ধরে রাখার জন্য ধর্মীয় বিদ্বেষ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

ইদ্রিস আল বাকিরের মতোই ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে কানাডায় বসবাস করছেন নাবিলা ইসাবেলা। লেবানিজ অভিবাসী মা-বাবার সন্তান ইসাবেলা যুক্তরাষ্ট্রের হাউস্টন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়ন করছিলেন। ৯/১১-এর ঘটনার আগে সেখানে তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ওই ঘটনার পর দ্রুত সবকিছু পাল্টে যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, রাস্তা ও খেলার মাঠে মুসলমানদের প্রতি শুকরের রক্ত-নাড়িভুড়ি ইত্যাদি ছুড়ে মারা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত মা-বাবার পরামর্শে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন ইসাবেলা। তিনি প্রথমে কিছুদিন সুইডেনে বসবাস করার পর কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি অ্যালবার্টার রাজধানী এডমন্টনে বসবাস করছেন। কানাডার জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানকার সবকিছুই ‘ব্যাতিক্রমী’। এদেশের বহুজাতিক সংস্কৃতি সত্যিই তুলনাহীন। তবে স¤প্রতি অন্টারিও, এডমন্টন, লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরে কিছু মুসলিম বিদ্বেষী কর্মকান্ডে তিনি হতাশা ব্যাক্ত করে বলেন, এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। কেননা এসবের মাধ্যমে দেশের কোন কল্যাণ আসে না। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার কয়েকমাস পর পরিবারের সাথে হুসেইন মালিক যখন কানাডায় আসেন তখন তার বয়স মাত্র ১৬। তিনি খুব বেশি দিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন নি। সুদানে জন্ম নেয়া মালিক ২০০০ সালে পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। তিনি বলেন, ৯/১১-এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের দিন আনন্দেই কাটছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর রাতারাতি সব কিছু পাল্টে যেতে শুরুর করে। লসএঞ্জেলসে বসবাসকারী হুসেইন মালিক ও তার বন্ধুরা ঈদের নামাজ পড়তে গেলে স্থানীয়রা তাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে গালি দেয় এবং ধাওয়া করে। ওই ঘটনার পর তারা কানাডায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে ৩৬ বছর বয়সী মালিক টরোন্টোতে সিরিয়ান রিফিউজিদের সাথে কাজ করছেন। তিনি বলেন, শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য কারো জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলা মোটেও কাম্য নয়। সূত্র : সিবিসি