শারমীন শরীফ : মেহেরুন্নেসা মীরা ১৯৫২ সালের ১০ই মার্চ বাগেরহাটের সরই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা হাজেরা বেগম ও কৃষক পিতা তাসের উদ্দিন শেখের দুই সন্তানের মধ্যে মীরা প্রথম। দরিদ্র কৃষক পরিবারের মেয়ে মীরা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। কৈশোরে গ্রামের মক্তবে পড়েছেন ফলে তিনি কোরআন শরীফ পড়তে জানেন। যৌবনে স্থানীয় যাত্রাদলের সঙ্গে পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। যুদ্ধ শুরু হবার আগ পর্যন্ত মীরা এ পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। যুদ্ধের সময় যাত্রা পালা বন্ধ হয়ে গেলে মীরা তখন ঘরের কাজে মাকে সহযোগিতা করতেন।
মীরার মা ঝিয়ের কাজ করতেন বাগেরহাটের ওয়াবদা কলোনির এক অফিসারের বাসায়। সেখানে পাক-সেনা ও রাজাকারদের আসা-যাওয়া ছিল। কাজ করতে করতে প্রতিদিন তাদের আসা-যাওয়া এবং যুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা শুনতেন মীরার মা। মুক্তিযোদ্ধারা এই বিষয়টি সম্বন্ধে অবহিত ছিল এবং এই সুযোগটি তারা কাজে লাগাতে চায়। রফিকুল ইসলাম খোকন নামে এক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একদিন মীরার সাথে কথা বলেন। রফিকুল ইসলাম মীরাকে খুলে বলেন সারাদেশে কিভাবে পাক বাহিনী অত্যাচার করছে। তিনি মীরার কাছে জানতে চান যে সে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে চায় কিনা। মীরা, রফিকুল ইসলাম খোকনের কথায় সম্মত হন এবং জানতে চান তাঁকে কি করতে হবে। রফিকুল ইসলাম খোকন মীরাকে দায়িত্ব দেন পাক-বাহিনী বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। মীরা তাঁর মায়ের সাথে সেই অফিসারের বাসায় ঝিয়ের কাজ শুরু করে এবং বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতে শুরু করে। কোন একটি পর্যায়ে পাক সেনারা বুঝতে পারে যে মীরার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ রয়েছে। তারা মীরাকে ক্যাম্পে আটকে রাখে ও মীরার উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পাক সেনারা মীরার উপরে চাপ প্রয়োগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এনে দেবার জন্য। পাকসেনা ও রাজাকারদের প্রস্তাবে তিনি রাজি হওয়ার ভান করলে তাঁর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে মজিদ কসাই নামের একজন রাজাকারের বাড়িতে আটকে রাখা হয়। এই কসাই মীরার উপরে আগে থেকেই অনুরক্ত ছিল। মীরা বুঝতে পেরেছিল যে কসাই তার বাসনা চরিতার্থ করবার চেষ্টা করবে তাই তার আগেই সে সুযোগ বুঝে কসাইয়ের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।
প্রথম দিকে মীরা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পাহারার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সাথে তাঁর দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না-বান্না ও অসুস্থ যোদ্ধাদের সেবা করা। ক্যাম্পের অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণও ছিল তাঁর অন্যতম দায়িত্ব। একদিনের ঘটনা : সাহসপুর ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় একদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেরিয়েছে অভিযানে, মীরা একা ক্যাম্প পাহারার দায়িত্বে। অল্পক্ষণের মধ্যেই পাক সেনারা ক্যাম্পে আক্রমণ করতে পারে এমন একটি খবর মীরা জানতে পেরে তাৎক্ষণিক বুদ্ধিতে একটি নৌকার মধ্যে ক্যাম্পের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উঠিয়ে হোগলা বনের ভেতর দিয়ে নৌকা টেনে নিয়ে বিলের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন। এক রাত ও একদিন প্রচন্ড উদ্বেগের মধ্যে বিলের মধ্যে নৌকায় তিনি লুকিয়ে থাকেন গ্রেনেড হাতে নিয়ে। পরদিন মুক্তি যোদ্ধারা এসে তাঁকে বিলের মধ্যে থেকে উদ্ধার করেন।
এ প্রসঙ্গে মীরা জানান, ‘আমি অনেক সময় ভিক্ষুক সেজেও পাক সেনাদের শিবিরে যেতাম? ওদের কাছে গিয়ে খেতে চাইতাম? কিছু কথা বলতাম? ওরা একজন কাজের মহিলা জোগাড় করে দিতে বলে? তো আমাদের এলাকার বৃদ্ধ মহিলাকে সেখানে কাজের জন্য দিয়েছিলাম? তার কাছেও যেতাম এবং গল্প করতাম? আর সেসব খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতাম?’
উর্দু জানা থাকায় সহজেই মীরা বের করে ফেলেন মিলিটারি ক্যাম্পের হাঁড়ির খবর। নিজের মায়ের সাথেও দেখা হয়। তার কাছ থেকে একদিন জানতে পারেন, বাগেরহাটের সবচেয়ে বড় রাজাকার রজব আলী খুব শীঘ্রই তার বাড়ি যাবে। এই রাজাকার যুদ্ধ চলাকালে মিলিটারির ক্যাম্পে থাকত। তার হাতে খুন হয়েছে বাগেরহাটের শতাধিক মানুষ।
প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মীরা ফিরে আসেন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। সবাইকে জানান রজব আলীর বাড়ি যাওয়ার কথা। মুক্তিবাহিনীদের জন্য এ ছিল এক বিরাট সুযোগ। মীরার তথ্য অনুযায়ী তারা লুকিয়ে থাকেন রজব আলীর বাড়ির পাশে। রজব আলী বাড়ি আসতেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিবাহিনী। কিন্তু কাপুরুষ রজব আলী অবস্থা বেগতিক দেখে নিজের হাতের হীরার আংটি থেকে হীরা মুখে দিয়ে আত্মহত্যা করে। এভাবেই মীরার কৃতিত্বে নিধন করা সম্ভব হয় বাগেরহাটের এক কুখ্যাত রাজাকারকে। এরপর মুক্তিবাহিনীর লোকেরা রজব আলীর লাশ সারা বাগেরহাট শহরবাসীকে দেখানোর জন্য শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঝুলিয়ে রাখে।
পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে যায় রজব আলীর মৃত্যুর পেছনে মীরার ভূমিকা ছিলো। মীরার বাবার ওপর রাজাকাররা অকথ্য নির্যাতন চালায়। এরপর থেকে যুদ্ধে মীরার কর্মপদ্ধতি বদলে যায়। তিনি বাগেরহাটের সাধনার মোড়ে বসতে থাকেন ভিক্ষুক সেজে। এ সময় তার কাজ ছিল শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় ও সংযোগ স্থাপন করা। ভিক্ষুকবেশে বসে থাকা অবস্থায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা তার কাছে এসে বিভিন্ন খবর দিত, সেই খবর আবার মীরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
মীরা বলেন, ‘বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে বিভিন্ন কাজের ধরণ শিখিয়ে দেয়? সেই অনুসারে আমি কাজ করতে থাকি? অনেক সময় আমাকে ছাপানো লিফলেট দিয়ে দিত তারা? আমি ফকির বেশে সাধনার মোড়ে গিয়ে কাগজগুলো চুপ করে ফেলে দিতাম। তারপর অন্য রিকশা নিয়ে চলে যেতাম খাদ্দার মোড়? আবার সেখান থেকে কলেজে গিয়ে কিছু কাগজ ফেলে দিয়ে চলে যেতাম গোপালঘাটি? এ কাজ করতে গিয়ে কখনো সন্ধ্যা হয়ে যতে? আমি নদীর ঘাটে গিয়ে মাঝিকে আকাশ বলে ডাকতাম? মাঝি ঠিক বুঝে যেত তাকে ডাকছি? সে তখন আমাকে নদীর ওপারে পৌঁছে দিত? আমি অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে ফিরতাম?
এভাবেই গোটা একাত্তরজুড়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে গেছেন মেহেরুন্নেসা মীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন তিনি করে গেছেন এসব কাজ।
যুদ্ধ শেষে মীরা বিয়ে করেন এক দিনমজুরকে। এই দম্পতির কোলে আসে চার সন্তান। কিন্তু ক’বছর পরই মীরার স্বামী ছেড়ে যায় মীরাকে। কিন্তু দু:খের বিষয় সে যাওয়ার সময় মীরাকে দিয়ে যায় খারাপ মেয়ের অপবাদ।
স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর মীরার ঘাড়ে বর্তায় সন্তানের দায়িত্ব। হানাদারদের সাথে লড়াইয়ে জিতলেও দারিদ্র্যের সাথে লড়াইয়ে হার মানেন মীরা। অভাবের কারণে তিনি সন্তানদের পড়াশুনা করাতে পারেননি। এমন কি দু বেলা দুমুঠো খাবারও তুলে দিতে পারেননি সন্তানদের মুখে। তবু তার আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু হয়ত তাদের জন্য কিছু করবেন। কিন্তু পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সব আশা ছেড়ে দেন মীরা।
এর বাড়ি, ওর বাড়ি কাজ করে এতদিন জীবিকা নির্বাহ করেছেন মীরা। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় কিছু দিন বাগেরহাটের বাজারে বসে সবজি বিক্রি করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। হাড়ি-বাসন মাজা আর সবজি কোটার কাজ করেছেন বাগেরহাট লঞ্চঘাটের এক দোকানে। বর্তমানে বাস করছেন বাগেরহাট শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদীর পাড়ে জরাজীর্ণ এক ঘুঁপড়িঘরে। জীবন ও নদীর সাথে ক্রমাগত লড়াই করে চলছে তার দিনক্ষণ।
মীরার সম্পর্কে এক অদ্ভুত স্মৃতিচারণা করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (বীরপ্রতীক)। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে দ্বিতীয় গোলন্দাজ বাহিনীকে সংগঠিত করেছিলেন। ২০১২ সালের দিকে তিনি বাগেরহাটের মোল্লারহাটে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের এক অনুষ্ঠানে। সেখানে তার সাথে দেখা করতে আসেন এক নারী, হাতে যার টুকরি আর পরনে ছেঁড়া শাড়ি।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাজ্জাদকে সেদিন তিনি খুবই কড়া গলায় বলেছিলেন, ‘আমার নাম মেহেরুন্নেসা মীরা। মুক্তিযুদ্ধ করলাম আমি-আপনি। আমরা ছিলাম সহযোদ্ধা। আপনি হয়ে গেলেন বীরপুরুষ, আমি হয়ে গেলাম খারাপ মাইয়া, সমাজের বিচার ঠিক নেই। আমার সনদ নেই। সবাই বলে, তুই বস্তিতে থাকস সনদ দিয়া কী করবি?’
এই স্মৃতিচারণা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার পর অবশ্য মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেয়েছেন তিনি। এরপর থেকে ভাতাও পান। সাথে জুটেছে টুকটাক আরো কিছু সম্মাননা। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ কি যথেষ্ট একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্যে!