জাবেদ ইকবাল: পৃথিবীর নানা দেশের জ্ঞানীগুণী ও খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৈশ্বিক সংগঠন আমেরিকান সোসাইটি ফর কোয়ালিটি (ASQ)। সংগঠনটি ২০২০ সালের নভেম্বরে তাদের ‘কোয়ালিটি মান্থ’ উদযাপনের অংশ হিসেবে ২৭ জন গুণী বিশেষজ্ঞকে ‘কোয়ালিটি হিরো’ নির্বাচন করে। এ নির্বাচনের মূল ভিত্তি ছিল বিশেষজ্ঞদের মেধা, গুণমান, পেশাদারিত্ব এবং অন্যদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে তাদের অনন্য ভূমিকা। ৩৫০ জন মনোনীত বিশেষজ্ঞের মধ্য থেকে ২৭ জন বিশিষ্ট ও গুণী বিশেষজ্ঞের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল খান। ASQ তাদের মাসিক প্রকাশনা ‘কোয়ালিটি প্রোগ্রেস’-এ ড. মোজাম্মেল খানসহ ২৭ জন কোয়ালিটি হিরোর নামও নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের অবদান প্রকাশ করে। অসাধারণ মেধার অধিকারী ড. মোজাম্মেল খান ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর কিছু সময় তিনি ইরাক, কুয়েত এবং সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপনা সূত্রেই ১৯৯৪ সালে তিনি কানাডা পাড়ি জমান এবং একই বছর কানাডার অন্টারিও প্রদেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেরিডান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড অ্যাডভান্সড্ লার্নিং-এ যোগদান করেন।

বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ্লাইড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদে অধ্যাপক ও সমন্বয়ক হিসেবে কর্মরত। ১৯৯৭ সালে ড. মোজাম্মেল খান পেশাদার প্রকৌশলী হিসেবে অনুমোদন লাভ করেন। এছাড়া তিনি শেরিডানের ১০০ সদস্যের নির্বাচিত সিনেটে প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ স্পিকার হিসেবে সাত বছর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫৫ বছরের ইতিহাসে ড. মোজাম্মেল খানই একমাত্র অধ্যাপক, যার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং তার নামে স্কলারশিপ চালু করা হয়েছে। ব্যক্তিজীবনে আত্মপ্রত্যয়ী, যুক্তিবাদী ও শান্তিকামী ড. মোজাম্মেল খান খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ হিসেবে কানাডায় বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
প্রকৌশলবিদ্যায় তিনি একজন সফল পথিকৃৎ। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার যেমন অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে, তেমনি একজন গবেষক হিসেবেও অর্জন করেছেন অনন্য খ্যাতি। এমনকি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (NASA) কর্তৃক তার একটি আবিস্কার পেটেন্ট করা হয়েছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এই বিদ্যানুরাগী, সমাজহিতৈষী ও কর্মবীর বাঙালির আরেকটি পরিচয় হলো তিনি শিক্ষার্থীদের শুভানুধ্যায়ী, অত্যন্ত আপন এবং অভিভাবকতুল্য একজন শিক্ষক।

তিনি ১৯৯৮ সালে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ‘কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স-ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক একটি প্রোগ্রাম চালু করে এ বিষয়ে পাঠদান শুরু করেন। পাঠ্য বিষয় হিসেবে অন্টারিওতে এ প্রোগ্রামটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন। তিনি অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবন বিনির্মাণে সফলতার রূপকার। এই দূরদর্শী শিক্ষাবিদ শেরিডন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৭ বছরের অধ্যাপনা জীবনে অগণিত শিক্ষার্থীর জীবন সমৃদ্ধ করেছেন তার অগাধ জ্ঞান, অকৃত্রিম স্নেহ-সাহচর্য আর গঠনমূলক পরামর্শের মাধ্যমে। এর স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসাসহ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পেয়েছেন অসংখ্য প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতাপত্র, যেগুলো সংকলিতভাবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ট্রান্সফর্মিং লাইভস অ্যাট শেরিডান : এ ট্রিবিউট টু ড. মোজাম্মেল খান’ শিরোনামের এ গ্রন্থে ৬৭ জন শিক্ষার্থীর প্রশংসাপত্র স্থান পেয়েছে, যারা তাদের কর্ম ও পেশাগত জীবন গড়ে তোলার পেছনে অভিভাবকতুল্য অধ্যাপক ও পরম শ্রদ্ধেয় গুরু ড. মোজাম্মেল খানের অবদানের ভূঁয়সী প্রশংসা করেছেন। এখানেই শেষ নয়, বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয় হলো, অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল খান অন্টারিও ও কানাডার সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার যথাক্রমে ‘অর্ডার অব অন্টারিও’ এবং ‘অর্ডার অব কানাডা’-র জন্য মনোনীত হয়েছেন। বাঙালির চিরাচরিত মেধা, মনন, স¤প্রীতি ও মনুষ্যত্ববোধের স্ফুরণ ঘটিয়ে তিনি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলেছেন।