শাহনুর চৌধুরী: করোনা মহামারির কারণে কানাডায় অপরাধমূলক মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ফলে এসব মামলার নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছে। এই অবস্থার অবসানে আদালত সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

গত শুক্রবার একজন বিচারক আলোচিত একটি হত্যা মামলার শুনানী পিছিয়ে দেন। মামলার বাদি-বিবাদি ও স্বাক্ষীরা সবাই করোনার টিকা নিশ্চিত করতে না পারায় তিনি ওই সিদ্ধান্ত নেন। দীর্ঘ বিরতির পর মামলাটির কার্যক্রম আবার শুরু হওয়ার কথা ছিল। জানা গেছে, সাবেক স্ত্রী শিরি ফারতুককে হত্যার অভিযোগে আটক গ্রেগ ফারতুকের মামলার কার্যক্রম পুনরায় শুরুর ৩ দিন আগে বিচারক তা স্থগিতের ঘোষণা দেন। গ্রেগের বিরুদ্ধে ‘১ম মাত্রার হত্যাকান্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে আসামী রিমান্ডে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কানাডায় করোনা মহামারি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় গত ২৯ মার্চ বিচারক এই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। সাচকাটুনের একটি আদালতে মামলাটি দায়ের হয়েছে। এখন আবার কোভিড পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে ৬ মাসের জন্য মামলার কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দিলেন বিচারক। এতে বাদি ও বিবাদি উভয় পক্ষই হতাশা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তারা বলেছে এটি আমাদের উভয় পরিবারের জন্য একটি বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াল।

বিচারকের সিদ্ধান্তের কথা শুনে শিরি ফারতুকের বোন তেকা হোয়াইট বলেন, এটা খুবই অন্যায়। মামলার কার্যক্রম আবার পেছানোর অর্থ হলো, আমাদেরকে আরো দীর্ঘদিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাতে হবে। আমরা আশা করেছিলাম দ্রুতই আমরা ন্যায় বিচার পাব। কিন্তু বিচারক তা হতে দিলেন না।

অন্যদিকে আসামী গ্রেগ ফারতুকের ভাই রেগ ফারতুকও মামলা পিছিয়ে যাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, এটি খুবই বাজে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হল। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কানাডার বিচার ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বিচারকের এই সিদ্ধান্তে আমি, আমার মা এবং আমাদের গোটা পরিবার খুবই হতাশ। রেগ আরো বলেন, এখন আমার ভাইকে ন্যায় বিচারের আশায় আরো দীর্ঘ সময় কারাগারের অভ্যন্তরে আটক থাকতে হবে।

আসামী পক্ষের আইনজীবীর দাবি, তার মক্কেলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। কেননা যাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। এমনকি গত ২ বছরে তার কোন সন্ধানও পাওয়া যায়নি।

এই ‘ফারতুক হত্যা মামলা’ কানাডা জুড়ে করোনায় বিলম্বিত অপরাধমূলক মামলার অন্যতম একটি ঘটনা। এ ধরনের অনেক মামলা রয়েছে যেগুলোর বিলম্বের কারণে শত শত মানুষ সঠিক সময়ে ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস নীতি অনুযায়ী যৌক্তিক সময়ের মধ্যে বিচার পাওয়া জনগণের অধিকার। কিন্তু এই ‘যৌক্তিক সময়’ নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালে সুপ্রীম কোর্ট অব কানাডার দেয়া রুলিংয়ে ( যা জর্দান রুল নামে পরিচিত) সর্বোচ্চ ১৮ মাসের মধ্যে মামলার চার্জশিট প্রদান এবং ৩০ মাসের মধ্যে মামলা নিস্পত্তির কথা বলা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে পুলিশ চার্জশিট প্রদানে ব্যর্থ হলে রিমান্ডে থাকা আসামী পক্ষ মামলা বাতিলের আবেদন করতে পারবেন। ওই ধরনের আবেদন নিস্পত্তি করবেন ক্রাউন প্রসিকিউটর। তিনি মামলার বিচারকের সাথে পরামর্শ করে বিলম্বের কারণ খতিয়ে দেখবেন। যদি বিলম্বের সঠিক কারণ থাকে তা হলে মামলার কার্যক্রম চলবে অন্যথায় মামলা ডিসমিস করে অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে হবে।

কিন্তু করোনা মহামারির কারণে এখন অনেক মামলা মাসের পর মাস বিলম্বিত হচ্ছে। এই অবস্থায় জর্দান রুলিংয়ের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মামলায় বিচারকেরা ‘ অনিবার্য কারণ ও বিশেষ পরিস্থিতির’ অজুহাতে মামলার শুনানী পিছিয়ে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে আসামীরা আর ১৮ বা ৩০ মাসের ‘জর্দান সময়সীমার’ সুবিধা নিতে পারছেন না।

করোনা মহামারি শুরুর পর এক সমীক্ষায় দেখাগেছে কানাডার বিভিন্ন কারাগারে আটক প্রতি ১০০০ জন বন্দির মধ্যে গড়ে ২৬৮ জন করোনা আক্রান্ত। ২০২০ সালের মার্চ থেকে গত জুন পর্যন্ত প্রভিন্সিয়াল কারাগারে বন্দিদের করোনা আক্রান্তের হার ছিল ৩৭%। কেন্দ্রীয়ভাবে এই হার ছিল ১২.৭%। বন্দিদের অনেকেই এখনো করোনা টিকা দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে বিচারকেরা এসব বন্দিদের আদালতে এনে বিচারকাজ চালাতে চাইছেন না। তারা মামলার শুনানী পিছিয়ে দিচ্ছেন। মাসের পর মাস এভাবে মামলা পিছিয়ে যাওয়ায় অনেকে হতাশ হয়ে পরছেন। সাসকাচুয়ান কারাগারে বিচারের আশায় অপেক্ষমান একজন বন্দি বলছিলেন, গত মার্চে তার মামলার রায় হবার কথা ছিল। কিন্তু বিচারক এখন তা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছেন। ওই বন্দি বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এভাবে বন্দি থাকলে আমি মনে হয় এখানেই মরে যাব। আমাকে হয়তো আর সাজা ভোগ করতে হবে না। সূত্র : সিবিসি নিউজ