আহমেদ আমিন: টরন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট কানাডার ব্যস্ততম একটি বিমানবন্দর। বিমানবন্দরটিতে পিআর (পাবলিক রিলেশন) সমস্যা দীর্ঘদিনের। ফলে অনেকেই শহরটিতে ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে পারেন বলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। পিয়ারসনের মধ্য দিয়ে ভ্রমণকারী অসন্তুষ্ট যাত্রীরা তাদের খারাপ অভিজ্ঞতার কথা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন। দীর্ঘ লাইন আপ, ফ্লাইট ব্যাহত এবং লাগেজ হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকেই। তারা অবিলম্বে সমস্যা সমাধানের আহবান জানিয়েছেন।

গত সপ্তাহে ফ্লোরিডা থেকে ভ্রমনকারী একজন দুই ডজনেরও বেশি বিলম্বিত ফ্লাইটের প্রস্থান বোর্ড দেখানো একটি ছবি সহ টুইট করে বলেছেন, টরন্টোর পিয়ারসন বিমানবন্দর নরকের একটি বিশেষ বৃত্ত। এ পর্যন্ত এটি সবচেয়ে খারাপ বিমানবন্দরের অভিজ্ঞতা। এই মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং বিবিসিসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিমানবন্দরের সমস্যাগুলো নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে।

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রোটম্যান স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং নীতির সহযোগী অধ্যাপক ওয়ালিদ হেজাজি বলেন, এটি জাতীয় বিব্রতকর ঘটনা। স্বল্পমেয়াদে এ সমস্যাগুলো স্পষ্টভাবে কানাডিয়ান পর্যটনকে প্রভাবিত করবে। ভ্রমণের আকস্মিক বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের বিমানবন্দরগুলো যানজট এবং ফ্লাইট বিলম্বের মত সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের সমস্যাগুলো অন্যান্যদের তুলনায় বেশি হওয়ায় এটি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই গ্রীষ্মে বিমানবন্দরটি ফ্লাইট বিলম্বের দিক থেকে শীর্ষে ছিলো। ফ্লাইট ট্র্যাকিং পরিষেবা ফ্লাইটএওয়ারের মতে, ১ জুন থেকে ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে পিয়ারসনে ৫৭ শতাংশ ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে। বিশ্বের ১০০টি ব্যস্ততম বিমানবন্দরের মধ্যে এটি ছিল সর্বোচ্চ হার।

গত সপ্তাহে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল শিরোনাম করেছে, ‘বিলম্বের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ টরন্টো বিমানবন্দর। মন্ট্রিলের ট্রুডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এই বিমানবন্দরের প্রায় ৫৩ শতাংশ ফ্লাইট বিলম্বিত হয়েছে। সারা বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরের মতো মে মাসে চাহিদা বেড়ে গেলে পিয়ারসনের সমস্যা শুরু হয়। এবং ফেডারেল সরকারী কর্মচারী সহ পূর্বে ছাঁটাই করা অনেক কর্মী ফিরে না আসায় পিয়ারসনে কর্মী ঘাটতি দেখা দেয়।

গ্রেটার টরন্টো এয়ারপোর্ট অথরিটি (জিটিএএ) এর মুখপাত্র টরি গাস এক ই-মেইল বার্তায় বলেছেন, এভিয়েশনের ভূমিকা অত্যন্ত দক্ষ, তাই নতুন কাউকে নিয়োগ দেয়া এবং তাদের টার্মিনালে বা এয়ারফিল্ডের বাইরে কাজে লাগানো এতো সহজ নয়। জিটিএএ একটি অলাভজনক কর্পোরেশন যা পিয়ারসন পরিচালনা করে। কিন্তু তার এই ব্যাখ্যা অসুবিধা গ্রস্থ যাত্রীদের জন্য কোন সান্ত¡না নয়।

ফিলাডেলফিয়ার ব্যবসায়িক ভ্রমণকারী এরিক গ্রিফিন বলেছেন, তিনি তার সা¤প্রতিক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে আপাতত পিয়ারসনকে বিদায় দিয়েছেন। গ্রিফিন তার ফোন এক্সেসরিজ কোম্পানির সম্ভাব্য ক্লায়েন্টের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের জন্য ২৭ জুন ফিলাডেলফিয়া থেকে টরন্টোতে ভ্রমণ করেছেন।

কিন্তু বিমানবন্দরের পিআর সমস্যার কারণে কোন কিছুই তার পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি। গ্রিফিনের এয়ার কানাডার ফ্লাইট টরন্টোতে অবতরণের পর দুই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। এরপর তিনি তার হারিয়ে যাওয়া ব্যাগের সন্ধানে আরো তিন ঘন্টা সময় ব্যয় করেন। ব্যাগটিতে গুরুত্বপূর্ণ বিক্রয়-সম্পর্কিত উপকরণ ছিল, যেটি তার বৈঠক শেষ হওয়ার তিন দিন পর পাওয়া যায়। এরপরে গ্রিফিনের ফিরতি ফ্লাইট বাতিল করা হয়। ফলে তাকে ফিলাডেলফিয়ার নিজ বাড়িতে পৌছাতে ৮০০ কিলোমিটার গাড়ি চালাতে হয়েছিলো। গ্রিফিন একটি জুম সাক্ষাৎকারে বলেন, পিয়ারসন বিমানবন্দরে আমার অভিজ্ঞতা ১০ স্টারের মধ্যে শূন্য ছিল। আমি মনে করি না এটি এর চেয়ে খারাপ হতে পারে।

যদিও ভ্রমণ স¤প্রতি বেড়েছে, তবে এটি এখনও প্রাক-মহামারী পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। পরিসংখ্যান কানাডার মতে, জুন ২০১৯ সালের তুলনায় চলতি জুনে বিমানযোগে কানাডায় বিদেশী আগমনের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম ছিল।

গ্রেটার টরোন্টো এয়ারপোর্ট অথরিটি (জিটিএএ) এই বিলম্বের জন্য প্রাথমিকভাবে স্টাফিং এবং অস্থায়ী যান্ত্রিক বিঘ্নকে দায়ী করেছে। কিন্তু জিটিএএ-এর প্রেসিডেন্ট এবং সিইও-এর মতে, পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত একা একাই সমাধান হয়ে যেতে পারে। ডেবোরা ফ্লিন্ট বলেছেন, আমরা এই গ্রীষ্মে এখানে টরোন্টো পিয়ারসন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিমানবন্দরে পুনরায় চালু করার চ্যালেঞ্জগুলো যাচাই করছি। আমরা এয়ারলাইন্স এবং সরকারী সংস্থাগুলোর পুরো সিস্টেমে শ্রমিকদের সচল হতে দেখছি এবং পাশাপাশি প্রক্রিয়াগুলোর উন্নতি দেখতে পাচ্ছি। জিটিএএ বলেছে যে, গত চার সপ্তাহে প্লেনের আগমনের সময় গড়ে এপ্রিলের ৩৩ মিনিট থেকে জুনের শেষ সপ্তাহে মাত্র ১৬ মিনিটে নেমে এসেছে।

তারা আরও বলে যে, ছেড়ে যাবার সময় যাত্রীদের ৮২ শতাংশ ১৫ মিনিট বা তার কম সময়ের মধ্যে ছেড়ে যেতে দেখেছে এবং সবাই এ প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ ছাড়াও জিটিএএ আরো যোগ করেছে, ব্যাপারটি বেশ ভালো, তবে এখনো প্রাক-মহামারী মানের নীচে রয়েছে।

আমাদের পূর্বের থেকে এটি একটি কঠোর উন্নতি, ফ্লিন্ট বলেছিলেন। আমাদের লক্ষ্য হল অপেক্ষার সংখ্যাটা শূন্যে নামানো এবং আমরা এটিকে উন্নত করতে সরকার এবং আমাদের সংস্থাগুলোর সাথে কাজ চালিয়ে যাব।

নতুন কর্মীদের নিয়োগের কারণে নিরাপত্তা এবং কাস্টমসের অপেক্ষার সময়গুলোতে উন্নয়ন এসেছে, কিন্তু জিটিএএ যোগ করেছে যে, পিক ট্রাভেল টাইম মোকাবেলা করার জন্য আরও বেশি কর্মী প্রয়োজন। সংস্থাটি আরও বলেছে যে, কানাডা কাস্টমসে নতুন কিয়স্ক এবং ই-গেট যুক্ত করাটা ওয়েট টাইমস হ্রাসে সহায়তা করছে। ফ্লিন্ট নিশ্চিত করেছেন যে, কিছু এয়ারলাইন্স তাদের কর্মীদের চাহিদা মেটাতে নির্ধারিত ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়েছে।
লাগেজ সংগ্রহের সমস্যাগুলোর বিষয়ে সামান্য তথ্য দেয়া হয়েছে, কিন্তু জিটিএএ বলছে যে, এটি সেই সমস্ত অবকাঠামোগত সমস্যাগুলোরই সমাধান করছে? জিটিএএ বুধবার একটি অনলাইন ড্যাশবোর্ড চালু করেছে, যেটি যাত্রীদের দিনের কোন সময়টায় এয়ারপোর্ট সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে তা দেখতে সাহায্য করে। বিমানবন্দর সতর্ক করে দিয়ে বলে যে, কেউ যদি ব্যস্ত সময়ে ভ্রমণ করে, তবে তাদের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের তিন ঘন্টা আগে এবং তাদের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সময় দুই ঘন্টা আগে দেখানো উচিত।

টরন্টো রিজিওন বোর্ড অফ ট্রেড বলেছে, পিয়ারসনের সমস্যাগুলো শীঘ্রই সমাধান করা না হলে এটি ব্যবসায?িক ভ্রমণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। অধ্যাপক ওয়ালিদ হেজাজি যুক্তি দেন যে, আরও ভাল পূর্ব পরিকল্পনা হওয়া উচিত ছিল। “এয়ারলাইনগুলো অনেক বেশি টিকিট বিক্রি করেছে, বিমানবন্দরের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি টিকিট।”

এ দিকে ব্যবসায়ী নেতাদের একটি গ্রুপ এই সতর্কবার্তা জানিয়েছেন যে, পিয়ারসন বিমানবন্দরের সমস্যা করোনা পরবর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। তারা কাস্টমস ও নিরাপত্তার নামে যাত্রীদের হয়রানীর বিষয়গুলোর প্রতি জোর দেন এবং দ্রুত সমস্যাগুলোর সমাধানের দাবি জানান। তারা ফেডারেল সরকারের কাছে বিমানবন্দরে আরো কর্মী নিয়োগ, সুবিন্যস্ত অ্যাপ ব্যবহার এবং কোভিড-১৯ এর র‌্যান্ডম টেস্টিং বাতিলের দাবি জানান।

কানাডার দুটি বৃহত্তম এয়ারলাইনস ‘ওয়েস্টজেট এবং এয়ার কানাডা’ বলেছে, তারা উভয়ই এই গ্রীষ্মে তাদের ফ্লাইট যথাক্রমে ২০ এবং ২৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। সারা বিশ্বে এয়ারলাইনগুলোতে ভ্রমন বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ায় জুনের শেষের দিকে এয়ার কানাডা আরও হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে জিটিএএ এবং ফেডারেল সরকার উভয়ই বলেছে যে, তারা কর্মী বাড়াতে এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে যাত্রীদের চলাচলের গতি বাড়ানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর কানাডিয়ান ট্রাভেল এজেন্সির সভাপতি ওয়েন্ডি পেরাডিস বলেন, বিমানবন্দরে দীর্ঘ সময় অপচয় হওয়ার খবরে ইতোমধ্যে অনেক যাত্রী তাদের রিজার্ভেশন বাতিল ও ভ্রমণ পিছিয়ে দেয়ার আবেদন করেছেন। এটি টরন্টোর পর্যটন ও পর্যটন শিল্পের জন্য হুমকি। তিনি বলেন, মহামারিতে আমাদের সেক্টর অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমরা আর ক্ষতির বোঝা বহন করতে পারব না। সূত্র : সিবিসি