খোন্দকার তোফাজ্জল হোসাইন: ১৯৪৭ সনে দেশ ভাগের পর পূর্ব বাংলা নাম পরিবর্তন হয়ে যখন পূর্ব পাকিস্তান হলো তার তিন কি চার বছরের মধ্যে প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার রাজপথে এক সুবেশধারী কালো রাজপুত্রকে দেখা গেলো শান্তিপুরি ঝোলা কাঁধে। সেসময়কার পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় বসবাসরত মানুষদের মধ্যে সেই রাজকুমার বেমানান ছিলেন নিঃসন্দেহে। কারণ সোয়া ছয় ফুট লম্বা হৃষ্টপুষ্ট এক যুবা, কানের নীচ অবধি নেমে আসা মোটা জুলপি, বড় বড় ডাগর চোখ, কেতাদুরস্ত পোষাক, কাঁধে শান্তিপুরি ঝোলা এবং অত্যন্ত শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে তখন বিরল হওয়ারই কথা। তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে আরো যে বিষয়টার উল্লেখ এখানে দরকার, তিনি ছিলেন তখনকার কলিকাতার সিনেমার নায়কদের সাথে তুলনা করার মতো স্মার্ট একজন মানুষ। তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিলো অতুলনীয়, সেটা কি বাংলা, কি ইংরেজি, কি উর্দু কিংবা হিন্দি সব ভাষাতেই তিনি ছিলেন পারঙ্গম। তাঁর মতো এতোটা গুছিয়ে কথা বলার মতো লোক তখনকার ঢাকাতে খুব একটা দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিকই বলতে হবে।

কে ছিলেন সেই দৃষ্টিনন্দন বিরল যুবক? তাঁর সঙ্গে যতো মানুষের সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো তাদের সবার কাছেই তিনি ছিলেন প্রিয় কামাল ভাই, শিল্পী কামাল আহমেদ। পশ্চিম বাংলার কলিকাতায় তাঁর জন্ম হয়েছিলো বিরাশি বছর আগে এক সম্ভ্রান্ত বনেদি মুসলিম পরিবারে। লেখাপড়া করেছেন কলিকাতার নামি স্কুল-কলেজে। রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠার কারণে সে সময়ের এবং পরবর্তীকালে যারা ভারতে ও সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁদের অনেকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিলো ঈর্ষা করার মতো। তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সলিল চৌধুরী, চিত্র পরিচালক ঋতিক ঘটক, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়, কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দেসহ আরো অনেকে। দু’দেশেই প্রচুর রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলো। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমদ। যাঁকে তিনি চাচা বলে ডাকতেন এবং মুলত তাঁর নির্দেশেই তিনি উঠতি যৌবন বয়সে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন, আবাল্যের সখ্য ও পরিচিত পরিমণ্ডল ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন অপরিচিত আরেকটা দেশে চলে আসেন। পরে যখন পরিবারের ইচ্ছায় বিয়ে করেন তখনো তিনি ওপার পশ্চিম থেকে পূর্ব এপারে প্রায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন।

শুরু থেকেই তখনকার উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং কিংবদন্তী শেখ মুজিবের নির্দেশে সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে দলের সকল প্রচার প্রোপাগান্ডার ডিজাইনের কাজগুলো করতেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে আমি তাঁর নিজমুখে বলা কতো অবিশ্বাস্য কথা শুনেছি যা অল্পপরিসরে বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে ভারতে আশ্রয় নেয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের কতোভাবে যে তিনি সহায়হতা করেছেন তা লিখে শেষ করা যাবে না। ভিনদেশে অস্থায়ী সরকারের দাপ্তরিক প্রয়োজনের নানা অনুষঙ্গ তিনি জোগান দিয়েছেন সাধ্যমতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন ও শিল্পী, সুরকার, লেখকদের ডেকে এনে এক সাগর রক্তের বিনিময়ের মতো গান নির্মাণে সর্বোত সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ের অনেক পৃষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করা আছে। স্বাধীনতার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের পরামর্শে তিনি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে চলে আসেন এবং ১৯৯৪ সন পর্যন্ত এদেশেই বসবাস করেন। সারাজীবন তিনি মেহনতি মানুষের রাজনীতি সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আশাবাদি ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই এদেশের গণমানুষের আশা আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হবে এবং শোষনহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু স্বাধীনতার অনতিকালের মধ্যেই তাঁর সে বিশ্বাস আরো কোটি মানুষের বিশ্বাসের মতো মুখ থুবরে পড়ে যায়। দেশের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয়া আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাকর্মীরা দেশটাকে মগের মুল্লুকে পরিণত করে ফেলে। তারা সমুদ্রসম ভালোবাসাস্নাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পর্বত প্রমাণ ইমেজকে সুউচ্চ শিখর থেকে নামিয়ে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলে। যার খেশারত এখনও আওয়ামী লীগ দিচ্ছে। এসব ঘটনায় তিনি ভীষণ পীড়িত বোধ করতেন। তাঁর দীর্ঘকালের বিশ্বাস ও বাসনার এই অপমৃত্যু তাঁকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। এক সময় প্রিয় বাংলাদেশ ছেড়ে তিনি স্বস্ত্রীক কানাডায় চলে যান এবং আমৃত্যু ওখানেই থেকে যান। দুই বাংলার সেতুবন্ধন হিসেবে খ্যাত সকলের প্রিয় কামাল ভাই গত ৩১ জানুয়ারি ২০২১ রাত সাড়ে দশটায় বাংলাদেশের প্রতি তাঁর সকল ভালোবাসা অভিমানের যবণিকা টেনে এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁর বিদুষী স্ত্রী যিনি বাংলাদেশ বেতারে বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের হিন্দি অনুষ্ঠানের ধারাভাষ্যকার হিসেবে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন, তিনিও গত বছর বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মহামান্য বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এই ত্যাগী বরেণ্য মানুষটি যেন তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু পায় তার ব্যবস্থা করা।
আজেবাজে কতো চাটুখোর মোসাহেবকে রাষ্ট্র নানান পদক দিয়ে ভ‚ষিত করে, যা বিদ্বজ্জনদের ব্যাথিত করে নিঃসন্দেহে। অথচ এই বাংলাদেশ যাদের কাছে সত্যিকারের ঋণী তাঁদের যদি আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করি তাহলে আগামীর ইতিহাস বর্তমানের এই হীণমন্যতার কারণে ভবিষ্যতে আমাদের পরিহাস করবেই করবে। তাঁর বিদেহী আত্মা শান্তি পাক।