শাহনুর চৌধুরী : বৈদ্যুতিক রেল বা ইলেকট্রিক ট্রেনের নেটওয়ার্ক ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত। সেখানে প্রতি বছরই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হচ্ছে। অন্যদিকে কানাডায় এখনো বেশিরভাগ ট্রেনই ডিজেল বা বড়জোর ডিজেল-ইলেকট্রিক ব্যবস্থায় চালিত। প্রধান শহরগুলোতে কিছু পাবলিক ট্রানজিট লাইন বাদে কানাডার সর্বত্রই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ইউরোপের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে।
২০২০ সালে প্রকাশিত কানাডিয়ান আরবান ট্রানজিট রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন কনসোর্টিয়ামের (সি ইউ টি আর আই সি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, কানাডার ইলেকট্রিক ও হাইড্রোজেন রেল ব্যবস্থার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের হার চীন ও মরক্কোর মতো বেশির ভাগ উন্নত অথবা উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক ধীর। গবেষণায় দেখাগেছে, ইউরোপের বর্তমান রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় ৬০ শতাংশ বৈদ্যুতিক। ১৯৭৫ সালের তুলনায় এই হার প্রায় দ্বিগুণ।
সি ইউ টি আর আইসির প্রেসিডেন্ট ও সিইও এবং ২০২০ সালের ওই প্রতিবেদনের একজন সহ-লেখক জোসিপা পেটুনিক বলেন, ইউরোপ ১০ বছর আগেই রেল খাতে কার্বনের শূন্য-নিঃসরণের এজেন্ডায় চলে গেছে।
ইউরোপের অনেক রেল লাইন মাথার উপর দিয়ে আংটাযুক্ত তারের সাহায্যে বিদ্যুতায়িত করা হয়েছে। তবে অন্যান্য প্রযুক্তিতে সেখানে এগিয়ে চলেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ফরাসী রেল কোম্পানি আলস্টমের তৈরি ‘কোরাডিয়া আইলিন্ট হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ট্রেন’ ২০১৮ সালে জার্মানিতে বাণিজ্যিকভাবে চলা শুরু করেছে। সেখানে দু’টি রাজ্যে এই ট্রেনের কয়েকজন ইউনিটের অর্ডার করা হয়েছে। তারপর ইতালি থেকেও এই ট্রেনের অর্ডার পাওয়া গেছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সে এই ট্রেনের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে বৈদ্যুতিক ট্রেনে কানাডা এত পিছিয়ে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে পেট্রুনিক বলেন, এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রধান কারণটি হল কানাডার বিশাল আয়তন এবং জনসংখ্যার কম ঘনত্ব। এছাড়া কানাডার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার ৮০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় মালবাহী কাজে। অন্যদিকে ইউরোপ তুলনামূলক উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বসহ একটি ছোট মহাদেশ। তাই সেখানে বিদ্যুৎতায়ন সস্তা। এছাড়া ইউরোপের রেল নেটওয়ার্কের ৮০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় যাত্রী পরিবহনে। ফলে তাদের টিকিট বিক্রির আয় বিদ্যুতায়ন খরচের সাথে সমন্বয় করার জন্য যথেষ্ঠ।
অন্যদিকে কানাডার ভৌগলিক আয়তন ও কম জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে এখানে ইউরোপের মত ওভারহেড তারের মাধ্যমে রেলকে বৈদ্যুতিক করার কৌশল কাজে লাগবে না। তিনি বলেন, রকি পর্বতমালার মধ্য দিয়ে কানাডা জুড়ে বৈদ্যুতিক গ্রিড স্থাপনের কথা কল্পনা করুন। এটি হবে খুবই ব্যয়বহুল ও জটিল একটি কাজ। এছাড়া হাইড্রোজেনও কোন সহজ সমাধান নয়। কেননা উন্নত মানের এই জ্বালানীর সরবরাহের জন্য যথেষ্ঠ অবকাটামো এখনো কানাডাতে গড়ে ওঠেনি। তাই কানাডাজুড়ে হাইড্রোজেন সাপ্লাই কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এছাড়া কানাডার রেল নেটওয়ার্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বিস্তৃত। তাই হাইড্রোজেন সাপ্লাই শুধু কানাডা নয়, গোটা নাফটা এলাকা জুড়ে হতে হবে।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ওকানাগান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গর্ড লাভগ্রোভ বলেন, বৈদ্যুতিক রেল ব্যবস্থাপনায় ইউরোপের চাইতে কানাডার পিছিয়ে থাকার আরেকটি কারণ হল, এখানে রেল অপারেটরদের জন্য এমন কোন নিয়ম বা আইন করা হয়নি যে একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস লক্ষ্যমাত্রা বা নেট জিরো নির্গমন অর্জন করতে হবে।
তবে কার্বন ট্যাক্স ও বায়ু দূষণ বিধির কারণে সরকার ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে রেলের উপর চাপ বাড়ছে। এই চাপ রেলওয়েকে স্বেচ্ছায় আধুনিক বিদ্যুতায়নের পথে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। ইতোমধ্যে সিএন একটি ব্যাটারি-ইলেকট্রিক রেল ইঞ্জিন প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং সিপি একটি হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল লোকোমোটিভ তৈরির কাজ শুরু করেছে। সূত্র : সিবিসি