শাহনুর চৌধুরী : কানাডায় করোনা মহামারির ৪র্থ ঢেউয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। উচ্চ মাত্রায় সংক্রমক ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তারের ফলে এই শঙ্কা বাড়ছে। এছাড়া আগামী মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সীমান্ত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নতুন করে মহামারি বিস্তারের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে অনেকে আবার আশার বাণীও শোনাচ্ছেন। তাদের মতে বর্তমান ভ্যাক্সিনেশনের ধারা বজায় থাকলে মহামারির কারণে দেশ আর আগের মতো ‘ক্রাইসিস পয়েন্টে’ ফিরে যাবে না।
কানাডার সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার আগের ৩টি ঢেউ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা এবং জনগণের টিকা নেয়ার আগ্রহ এই দু’টি বিষয় কানাডাকে ৪র্থ ঢেউয়ের সংকট কাটাতে সহায়তা করবে। হ্যামিলটনের ম্যাক মাস্টার ইউনিভার্সিটির ইনফেকশাস ডিজিজ অ্যান্ড ইমিউনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেথিও মিলার বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সংক্রমণের হার বৃদ্ধির প্রবনতা টের পাচ্ছি। তবে এটি আগের মতো অতটা ভয়াবহ নয়। সংক্রমনের আগের ধারাকে যদি ‘পর্বতমালার’ সাথে তুলনা করা যায় তবে বর্তমান ধারাকে বলা যেতে পারে ‘ছোট পাহাড়’। তবে তিনি সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে আরো বলেন, সামনে শীতকাল আসছে। আমরা সবাই জানি কোল্ড ওয়েভে কোভিডের বিস্তার তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া আগামী ১ মাসের মধ্যে স্কুলগুলো চালু হবে। বেশির ভাগ শিশুই এখনো টিকার বাইরে রয়ে গেছে। আর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে কিন্তু কম বয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কাজেই আমাদের যত দ্রুত সম্ভব শতভাগ টিকা নিশ্চিত করতে হবে। কানাডায় এ পর্যন্ত ১.৪ মিলিয়ন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া ২.৬ শতাংশ কানাডিয়ানের শরীরে করোনার এন্টিবডি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত কানাডার ৮০% নাগরিক অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন এবং ৬০% দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। এই হিসাব শুধুমাত্র ১২ বছরের বেশি বয়সীদের নিয়ে করা হয়েছে। কানাডার পুরো জনসংখ্যার হিসাব ধরলে ভ্যাকসিনেশনের হার হবে- ১ ডোজ ৭০% এবং উভয় ডোজ ৫০%। এমন পরিস্থিতিতে কি জনসাধারনের সার্বিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে যথেষ্ঠ বলা যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার সহযোগী অধ্যাপক ও সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রেওয়াত দিওনান্দন বলেন, না, বলা যায় না। কেননা ভ্যাকসিন নেয়ার পরও অনেকে কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট খুবই বিপদজনক। ভ্যাকসিন না নেয়া ব্যাক্তিদের মধ্যে এটি ইতোমধ্যে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত এক সপ্তাহে গড়ে আক্রান্ত হয়েছে ২৬ হাজারের বেশি। আগের সপ্তাহের তুলনায় যা প্রায় ৭০% বেশি। সেখানে মৃত্যুর হারও বেড়েছে ২৬ শতাংশ। কানাডার চিত্রও অনেকটা একই রকম। এখানে যে সব প্রভিন্সে ভ্যাকসিনেশনের হার কম সেখানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে যেসব অঞ্চলে সবাই পুরোপুরি ভ্যাকসিনেটেড সে সব অঞ্চলে সংক্রমণের হার খুবই কম।
এদিকে পুরোপুরি ভ্যাকসিনেটেড মার্কিন নাগরিকদের আগামী মাস থেকে স্বাগত জানাবে কানাডা। আর ভ্যাকসিনেটেড সব বিদেশিদের স্বাগত জানানো হবে পরের মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কার্যালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। তবে ভ্রমণকারীরা যে পুরোপুরি ভ্যাকসিনেটেড তা কীভাবে প্রমাণ হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বিবৃতিতে বলা হয়নি। সে ক্ষেত্রে বিদেশীদের মাধ্যমে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের শঙ্কা থেকে যাবে বলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মনে করছেন।
ম্যাক-মাস্টার ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ডোমিনিক মার্টজ বলেন, আমরা জানি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট খুবই মারাত্বক। এটি এরই মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় নতুন করে বিস্তার লাভ করছে। কাজেই বিদেশিদের ঢালাওভাবে কানাডায় স্বাগত জানালে করোনা মহামারির ৪র্থ ঢেউয়ের বিপদ থেকে আমরা শঙ্কামুক্ত থাকতে পারব না।
কানাডায় ৪র্থ ঢেউয়ের বিস্তারের আশঙ্কার আরেকটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে স্কুল রি-ওপেনিং। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব স্কুল খুলে দেয়া হবে। কিন্তু কানাডাতে ১২ বছরের কম বয়সীরা এখনো টিকার আওতায় আসেনি। এদিকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে কম বয়সীরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া টিকা নেয়া বাধ্যতামূলক না হওয়ায় অনেকে এখনো টিকার নিবন্ধন করেননি। টিকা নেয়ার পর বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াসহ নানান গুজবে অনেকে টিকা নিতে আগ্রহী নন। ফলে ডেল্টা ভাইরাসের বিস্তার তথা ৪র্থ ঢেউয়ের শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিস অর্গানাইজেশনের ভাইরাস বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিসন কেলভিন বলেন, শিশুসহ কানাডার প্রতিটি নাগরিকের টিকা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আমরা কেউ নিরাপদ নই। এ বছরের শুরুতে কানাডায় টিকা নিয়ে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল তা আমরা যেভাবে মোকাবেলা করেছি তাতে যেমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে, তেমনি আমাদের সবার মনে রাখতে হবে আমি যদি ভ্যাকসিনেটেড না হই, তাহলে, কোন না কোন পর্যায়ে এসে আমি মহামারিতে আক্রান্ত হবই। সূত্র : সিবিসি