হাসান আমিন : টরন্টোভিত্তিক ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা লীনা মানিমেকালাই টুইটারে তার তথ্যচিত্রের জন্য একটি পোস্টার শেয়ার করার পর মৃত্যুর হুমকি এবং পুলিশি তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, ‘কালী’ তথ্যচিত্র নিয়ে বিতর্কের জেরে একের পর এক হুমকি পাচ্ছেন পরিচালক লীনা মানিমেকালাই।
টুইটারে পরিচালক নিজেই এই অভিযোগ জানিয়েছেন। হুমকি দাতার মেসেজের স্ক্রিনশটও শেয়ার করেছেন তিনি।
লিনা যে পোস্টারটি শেয়ার করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে হিন্দু দেবী মা-কালীর বেশে এক মহিলা অভিনেত্রী। যিনি হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে সুখটান দেওয়ার ভঙ্গিমায় রয়েছেন। মা কালী হিন্দু দেবদেবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ দেবী মা দুর্গার এক অবতার। মা কালীকে যেমন নারী শক্তির এক পবিত্র রূপ বলে মনে করা হয় তেমনি তার সংহারক লোককথা হিন্দুশাস্ত্রে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তার জয়ের কথা বলে থাকে। এমনকী পোস্টারে এলজিবিটি বা রূপান্তরকারীদের প্রাইড ফ্ল্যাগও দেখা গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুদের দেবীকে নিয়ে এমন পোস্টারে বিতর্ক তৈরি হয়েছে এবং হিন্দুত্ববাদীরা একে ধর্মের আবেগে আঘাত বলে মনে করছেন।
এই মাসের শুরুতে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক স্নাতকের ছাত্রী লীনা মানিমেকালাই টরন্টোর আগা খান মিউজিয়ামে তার কালি চলচ্চিত্রের একটি স্ক্রিনিং প্রচারের জন্য পোস্টারটি শেয়ার করেন।
তিনি সিবিসি নিউজকে বলেন যে তিনি কখনই আশা করেননি ছবিটির পোস্টার এত মনোযোগ আকর্ষণ করবে। “যে কোনো শিল্পী তার কাজ প্রদর্শিত হওয়ার পরে আলোচনা-সমালোচনা প্রত্যাশা করে। কিন্তু আমি কখনই ভাবিনি যে আমি এই ধরণের সংগঠিত সহিংসতার দ্বারা আক্রান্ত হব,” বলেন লীনা।
পোস্টটি ভারতের রাজনীতিবিদ এবং ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং হিন্দুত্ববাদকে সমর্থনকারীরা রয়েছেন। এরা (বিজেপি) একটি ডানপন্থী মতাদর্শ যা ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র থেকে একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চায়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ কিছু গবেষক এবং সংস্থার মতে, এই মতাদর্শ ভারতে মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের মতো সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং সহিংসতার দিকে পরিচালিত করেছে। এমনকি কানাডায় ভারতীয় রাজনীতির গঠনমূলক সমালোচনাও স্তব্দ করে দিতে চায় এরা।
মানিমেকালাই বলেছেন, দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি এবং তার পরিবার যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হাজার হাজার ঘৃণ্য বার্তা পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ ও মৃত্যুর হুমকি। ইতিমধ্যে পরিচালক লীনা মানিমেকালাইয়ের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে দিল্লি পুলিশ ও উত্তর প্রদেশের পুলিশ। অটোয়ার ভারতীয় হাই কমিশন ইতিমধ্যেই কানাডার কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছে। তারা হিন্দু নেতাদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছে বলে জানিয়েছে। আগা খান মিউজিয়াম ছবিটি প্রদর্শনীর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, এটি তারা আর প্রদর্শন করছে না। টরন্টো মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিও মানিমেকালাইর সমর্থন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
তারপরেও থামেননি পরিচালক লীনা। টুইটারের তরফে বিতর্কিত ‘কালী’ পোস্টারটি মুছে দেওয়ার ঘটনাটিকে ‘হাস্যকর’ বলে কটাক্ষ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্র নির্মাতা লীনা বলেন, চলচ্চিত্রে কালীর সংস্করণটি তার দক্ষিণ রাজ্য তামিলনাড়ুর কালীর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে – একটি আদিবাসী নারীবাদী চেতনা যা পিতৃতন্ত্র পরিত্যাগ করে এবং গ্রামবাসীদের কাছ থেকে মাংস, অ্যালকোহল এবং ধূমপান গ্রহণ করে।
শর্ট ফিল্মে, মানিমেকালাই কালীকে মূর্ত করে তোলেন, যখন তিনি রাতের বেলা টরন্টোর রাস্তায় নিজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান। এক পর্যায়ে, সে পার্কের বেঞ্চে থাকা একজন ব্যক্তির কাছ থেকে একটি সিগারেট গ্রহণ করে। তিনি বলেন, এটি কানাডায় বহুসংস্কৃতির প্রতি তার গ্রহণ এবং এর বৈচিত্র্যের উদযাপন।
এ দিকে ফিল্ম এবং পোস্টার নিয়ে উদ্বেগ সম্পর্কে ভারতীয় হাইকমিশনের কাছ থেকে কোনও চিঠিপত্র পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা কেবল একটি বিবৃতিতে বলে যে, কুটনৈতিক চিঠিপত্র গোপনীয় এবং “কানাডা সর্বদা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রাখবে।
অন্যদিকে বিতর্কিত পরিচালকের পাশে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। পক্ষে ও বিপক্ষে মুখে খুলেছেন আরও অনেকেই। পরিচালক লীনা জানিয়ে দিয়েছেন, বেঁচে থাকতে মত প্রকাশ থেকে সরে আসবেন না।
এমন পরিস্থিতিতেই লীনা মানিমেকালাইয়ের শ্বিরচ্ছেদের হুমকি দিয়েছেন অযোধ্যার হনুমান গঢ় মন্দিরের মহন্ত রাজু দাস। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ‘কালী’ তথ্যচিত্রকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান তিনি। পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান।
এরপরই বিজেপির বহিষ্কৃত নেত্রী নূপুর শর্মার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “নূপুর শর্মা কথা বলায় গোটা দেশে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে। গোটা বিশ্বে যেন ভূমিকম্প হয়েছে। আর এখানে আপনি (লীনা) সনাতন ধর্ম-সংস্কৃতি নিয়ে মশকরা করবেন? কী চান? আপনারও মাথা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাক! এই ইচ্ছে হয়েছে নাকি?” এমনটা চলবে না বলেই তিনি তথ্যচিত্রটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। এই তথ্যচিত্র প্রকাশিত হলে পরিণাম মারাত্মক হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
নেটদুনিয়ায় হিন্দুত্ববাদীরা প্রবলভাবে লীনার উপরে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ইউজার লিখেছেন, ‘হিন্দু ভক্তদেরকে আঘাত করার জন্য ইচ্ছে করে এই পোস্টার তৈরি করা হয়েছে। বাক স্বাধীনতার মানে এটা নয় যে একজন সমস্ত বিধিনিষেধের গণ্ডী পার করে যাবে এবং সৃষ্টিশীলতার নামে যা ইচ্ছে তাই করবে।
ভারতে আইনি ব্যবস্থা :
‘কালী’ ছবির নির্মাতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। কালী ছবিতে হিন্দুদের আরাধ্য দেবীকে অপমান করা হয়েছে। এমন অভিযোগেই নির্মাতাদের বিরুদ্ধে দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশ পুলিশের তরফে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত, শান্তি নষ্ট করা সহ একাধিক ধারায় নির্মাতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। সূত্র : সিবিসি