শুজা রশীদ : (পর্ব ২৬)
রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে মিলাকে আসমার সাথে ওর বাড়ী কেনা নিয়ে যা আলাপ হয়েছিল তার বর্ণনা দেয় রিমা। ও যদি সাড়ে তিন লাখ ডলার ডাউন পেমেন্ট দিয়ে একটা তিন বেড রুমের বাড়ী কোনভাবে কিনতে পারে তাহলে ওর হাতে যা থাকবে সেটা দিয়ে একটা ছোট খাট ব্যবসা হয়ত শুরু করা যাবে। ওর অনেক দিনের স্বপ্ন সেটা। মনের মত কিছু একটা করতে চায়। যা করলে মানসিক আনন্দও পাবে আবার মোটামুটি ভালো উপার্জনও হবে যা দিয়ে সাংসারিক খরচটা চলে যাবে। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক মহিলারাই এখানে নিজেদের বাসায় বেসমেন্ট থেকে শাড়ী, সালোয়ার-কামিজ সহ নানা ধরনের দেশী কাপড়ের ব্যবসা করে। তাদের অনেকেই বেশ ভালোই করছে। রিমার তেমন একটা কিছু করার সখ বহু দিনের। মিন্টুকে একবার বলেছিল, চেয়েছিল এপার্টমেন্ট থেকেই শুরু করবে কিন্তু মিন্টু ব্যাপারটা পছন্দ করে নি। তখন ওদের এমন সামর্থও ছিল না যে একটা দোকান ভাড়া করবে। পরবর্তিতে রিমা আর কখন সেই প্রসঙ্গ তোলেনি।

“নতুন বাড়িতে তুমিও তো আমাদের সাথে এসে থাকতে পারো,” রিমা কথাচ্ছলে বলে। “আমরা দুজনে মিলে একটা দেশী ফ্যাশনের ব্যবসা খুলে দেব। ছোট একটা দোকান ভাড়া করব। দু’ জনে পার্টনার হব।”
মিলা রহস্যময় হাসি দেয়। “সেটা খুব একটা মন্দ হত না।”
“মন্দ হত না!” রিমা সন্দিহান দৃষ্টিতে বান্ধবীকে পর্যবেক্ষণ করে। “ঘটনা কি? খুলে বল।”
মিলা লাজুক ভঙ্গিতে বলে, “খুব শীঘ্রই কেউ একজন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।”
“কি!” রিমা নিজের আসন থেকে প্রায় লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। “তুমি কারো সাথে প্রেম করছ সেটা তো আমাকে বলনি। কবে হল? কে লোকটা? কিভাবে আমার কাছ থেকে এমন বড় একটা ব্যাপার তুমি গোপন করে গেলে?”

মিলা খিল খিল করে হাসে। তারপর খেতে খেতে একটু একটু করে সে তার নতুন রোমান্সের কাহিনী শোনায় রিমাকে। তার নতুন প্রেমিক একজন তরুণ ডাক্তার, বয়েস মধ্য ত্রিশ হবে, যেমন লম্বা তেমন সুদর্শণ, ক্লিনিকে এসেছিল এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে, তখনই মিলার সাথে পরিচয়। পরে ফোন করে। বেশ কয়েক দিন ধরে ফোনে আলাপ চলার পর তাকে বাইরে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। প্রথমে খুব একটা নিশ্চিত ছিল না মিলা কিন্তু তারপরও রাজী হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই ও বুঝতে পারে ওর জীবনে আবার প্রেমের ফুল ফুটেছে। কিন্তু এবারের অনুভূতি অন্যন্য গুলোর মত নয়। লোকটার মধ্যে কি যেন এক যাদুকরী ক্ষমতা আছে। এই রকম প্রেমে আচ্ছন্ন সে আর কখন হয়নি কারো জন্য। প্রথম ডেটের পর সম্পর্কটা দ্রæত গতিতে এগোয়। ঘন ঘন বাইরে দেখা করে ওরা। মাত্র মাস খানেকের পরিচয় হলেও মনে হয় যেন মানুষটাকে জনম জন্মান্তর ধরে চেনে। সে কাজ করে সেন্ট মাইকেলস হাসপাতালে, টরন্টো ডাউন্টাউনে একটা দামী কন্ডো এপার্টমেন্ট আছে। সেখানে প্রথম তার সাথে দৈহিক মিলন হয় মিলার। এতো ভালো তার আর কখন লাগেনি। শেষ পর্যন্ত সে তার আত্মার সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। দু’ জনেই দেশ ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। মাত্র কয়েক দিন আগেই তার প্রেমিক বলছিল হানিমুন করতে তারা আফ্রিকা যাবে। যদিও এখনও সাড়ম্বরে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় নি কিন্তু লোকটা যে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে তার ইংগিত মিলা ঠিকই পেয়েছে। হয়ত ওকে আশ্চর্য করে দেবার জন্য বড় সড় কোন পরিকল্পনা করছে। কিন্তু যা হবার তা খুব শীঘ্রই হবে বলে তার ধারণা।

মাত্র এক মাসে কাউকে ভালো ভাবে চেনা যায় কিনা সে ব্যাপারে রিমা খুব একটা নিশ্চিত নয় কিন্তু সেই কথা বলে মিলার সুন্দর অনুভূতিটাকে নষ্ট করতে চায় না ও। এতো অল্প বয়েসেই মিলা অনেক ঝুট ঝামেলার ভেতর দিয়ে গেছে। প্রতিবার যখনই নতুন কোন প্রেমে নিজেকে জড়িয়েছে শুধু আঘাতই পেয়েছে। হয়ত এবারের এই সম্পর্কটাই ওর জীবনে নিয়ে আসবে সুখ শান্তি এবং ভালোবাসা। এখনও দক্ষিন ভারতীয় মেয়েদের অধিকাংশই এরেঞ্জড ম্যারেজে নিজেদেরকে সঁপে দেয়, বাবা-মা কিংবা ঘটকের নিয়ে আসা কোন ছেলেকে দু-একবার দেখেই বিয়ে করে ফেলে। আপাতত দৃষ্টিতে পদ্ধতিটাকে প্রাচীন এবং অগ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে কিন্তু সেই সব দম্পতিদের অধিকাংশই পরস্পরকে ভালবাসতে শেখে এবং সুখে শান্তিতে সংসার করে। পরিচয়ের পর্ব সংক্ষিপ্ত হলেও মিলার জীবনে যে এই প্রেমটাই সত্যিকারের পরিবর্তন নিয়ে আসবে না সেই কথা কে হলপ করে বলতে পারে?

খাবারে পর ওরা একটা আইসক্রিম শপে থামল। এটা রিমার ট্রিট। আইসক্রিম শেষ হলে ওরা গেল স্কারবরো বøাফার্স পার্কে-কিংস্টন এবং ব্রিমলি রোডের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত একটি অসম্ভব সুন্দর স্থান, ঠিক লেক ওন্টারিওর ঘন নীল পানি আর সুউচ্চ ধুসর বালিয়াড়ির ছায়ায় এ যেন প্রকৃতির এক মোহময় সৃষ্টি। এক পাশে রয়েছে বিস্তীর্ণ সৈকত, অন্য পাশে পাথুরে তীর, মাঝে মেরিনা এবং একটা বিশাল রেস্টুরেন্ট – মাছ ধরা থেকে শুরু করে হাইকিং করতে আসে সহস্র মানুষ। রিমা একবার মিন্টুর সাথে এসেছিল এখানে স্যালমন রান দেখতে। সেপ্টেম্বর মাসে যখন তাপমাত্রা কমে যেতে শুরু করে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ে তখন লেক ওণ্টারিওর বিভিন্ন প্রান্তর থেকে স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতরে আসে পূর্ণ বয়স্ক স্যালমন মাছ তাদের জন্মস্থানে ডিম পাড়ার জন্য। এই মাছগুলির অধিকাংশেরই জীবনের সমাপ্তি হয় সেইখানেই। লেকের তীরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের সাতড়ে বেড়ান দেখেছিল ও। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা মৎস শিকারির দলের ভীড় থেকে হঠাৎ হঠাৎ কেউ চীৎকার করে উঠছিল ‘মাছ! মাছ!’। যার অর্থ তার বড়শীতে স্যালমন ধরা পড়েছে, নিকটবর্তী সবাই তাদের বড়শি পানি থেকে তুলে নিক যেন মাছটাকে তীরে তুলতে গিয়ে অন্যদের বড়শীর সাথে জট পাকিয়ে না যায়। সেই সব বিশাল মাছগুলোকে ধীরে ধীরে খেলিয়ে তীরের কাছে নিয়ে এসে ছোট জাল দিয়ে তোলা দেখাটাও একটা অভিজ্ঞতার মত। আর মাছগুলোর আকার দেখে তো ওর ভিমড়ী খাবার জোগাড় হয়েছিল। প্রায় চার ফুট লম্বা, ত্রিশ থেকে চল্লিশ পাউন্ড ওজন! ওর এতো ভালো লেগেছিল সেবার যে ভেবেছিল প্রতি বছর আসবে স্যালমন রান দেখতে। কিন্তু বাস্তবে তারপর আর কখন এই পার্কেই আসা হয় নি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য অনেকেই এই অপূর্ব স্থানের খুব কাছে বসবাস করেও কত বছর হয়ত সেখানে পা-ই রাখেনি।
অক্টোবার মাসের শেষে ভীড় ভাট্টা প্রায় নেই বললেই চলে। তীরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা ধরে ওরা বালুর সৈকতের দিকে হেঁটে যায়, পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটে, ঠান্ডা পানিতে শরীর সির সির করে ওঠে। মিলা বিশ্বাস করতে পারে না যে জায়গাটা এতো সুন্দর। বহুবার পার্কটার নাম শুনেছে কিন্তু নানা কারণে কখন আসা হয় নি। বছরের এই সময়েও দুই একজন মৎস শীকারীকে দেখা গেল কাছেই পাথুরে তীরের উপর দাঁড়িয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে।
রিমা দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে শেষ বিকালের আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বুক ভরে ঠান্ডা বাতাস টেনে নেয়।

“শান্তি!”
ফায়জা হেসে ওঠে। মাকে এমন আবেগপ্রবণ হতে সে আগে কখন দেখেনি। মিলাও তার সাথে গলা মিলিয়ে হাসে। তার কালো চোখের গভীরে ভবিষ্যতের সুখ, স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। সেই আনন্দময় জীবনের কল্পনায় সে যে কতখানি বিভোর তা তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি এবং অভিব্যাক্তিতে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
ইত্যবসরে, ছেলে দুটি মিহি বালুর উপর সোৎসাহে গড়াগড়ি করতে থাকে। রিমা এবং ফায়জা দু’ জনেই চোখ বড় বড় করে তাদের সেই পাগলামি দেখে কিন্তু কেউই তাদেরকে বাঁধা দেয় না। মাঝে মাঝে একটু নিয়ম ভাঙার মধ্যে দোষের কিছু নেই। সামান্য বালুতে কি আর হবে!

৩৭.
ড্রাইভিং শুরু করার পর থেকে রিমার জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। টরন্টোর ট্রান্সপোর্টেশোন সিসটেম যথেষ্ট ভালো হলেও যাতায়াতে প্রচুর সময় চলে যায়। গাড়ী নিয়ে চলাচল শুরু করতে সেই যাতায়াতের সময় অনেক সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। সকালে আর বিকালে অফিসের সময় না বের হলেই হল। তখন আবার ভীড়ের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে জীবন অতিষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু অন্য সময়ে স্বল্প ভীড়ের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে মজা, ঝট করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলে যাওয়া যায়। তবে রিমার এখনও খুব ভীড়ের মধ্যে কিংবা বড় বড় ইন্টারসেকশনে গাড়ী চালাতে ওয় করে, আশংকায় বুক কাঁপে। কোন একটা দুর্ঘটনা হলে ইন্সিউরেন্স এক লাফে আকাশচুম্বী হয়ে যাবে।

নোমানের সাথে কফি শপে দেখা করার পর তাকে বাসায় বহুবার ডাকবে বলে ভেবেছে রিমা কিন্তু প্রতিবারই কোন না কোন একটা অজুহাতে পিছিয়ে গেছে। কিসের এতো ভয় ওর? হয়ত ঐ মানুষটাকে আবার আরেকটা কঠিন সময়ের মধ্যে তার জীবনে সে টেনে আনতে চায় না। প্রতিবারই যখনই ও কোন একটা সমস্যায় পড়েছে তখন নোমানকেই কোন না কোন ভাবে আসতে হয়েছে তাকে রক্ষা করবার জন্য। এবার সেটা ও হতে দেবে না। তবে এটা জেনে ওর ভালো লেগেছে যে ওর প্রতি নোমানের কোন রাগ কিংবা ক্ষোভ নেই। থাকলেও সে সেটা কোনভাবে প্রকাশ করে নি। কিন্তু যদি সে তাকে রাগ করে কয়েকটা মন্দ কথাও শোনাত তাতে ওর বিন্দু মাত্র মন খারাপ হত না। বরং হয়ত ভালোই লাগত। ভাবত ওর পাওনাটা নোমান কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নোমানের মুখ থেকে কখন কোন মন্দ কথা বের হবে সেই সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।

শারদীয় রঙের বাহারে চারদিক যেন স্য়লাব হয়ে গেছে, তারই মাঝে খসে পড়ছে পাতার সারি, পথে – ঘাটে – আঙিনায় সব খানে জমছে পাতার স্তর। একটু একটু করে ঝরতে ঝরতে এক সময় পাতা ঝরা গাছের শরীরে শুধু আটকে থাকে বাকল আর পত্রহীন শাখা প্রশাখার অরণ্য। সেই রুপান্তরের মধ্যে কেমন যেন একটা মন খারাপ করা দিক আছে। অন্তত রিমার কাছে তাই মনে হয়।

কাজ, বাসা, বাজার করা, রান্না-বান্না, খাওয়া, ঘুম, বাচ্চাদের স্কুল- একই নিয়মে চলতে থাকে দিনগুলো। কিন্তু তা নিয়ে রিমার কোন নালিশ নেই। মিন্টুর অকস্মাৎ মৃত্যুর পর যে উন্মাদনা তার জীবনটাকে কিছুদিনের জন্য সম্পূর্ণ পরিবৃত করে রেখেছিল ধীরে ধীরে সেই বৃত্ত থেকে সে যেন বেরিয়ে আসছে। তাতেই সে খুশী।

হঠাৎ করেই, সেই নিয়ম বদ্ধ জীবনের মাঝে, সমুক্ষণ সতর্কতার কারণেই হোক আর অনুক্ষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্থতা থেকেই হোক, ধীরে ধীরে একটা সন্দেহজনক কিছুর আঁচ পেতে শুরু করে ও। যেখানেই সে যায় এক জোড়া কৃষ্ণ, কঠিন মুখ যেন তাকে অনুসরণ করে। তাদেরকে সে চেনে না, কখন দেখেনি আগে, কিন্তু তার চারপাশে, যত্র তত্র তাদের বিচরণ। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার তাদেরকে সে হাতে নাতে ধরেছে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে, চোখে চোখ পড়তে তারা দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অন্য কোথাও নিবদ্ধ করেছে। এটা কি শুধুই তার কল্পনা? ও নিশ্চিত হতে পারে না। হতে পারে লোক দু জন এদিকেই কোথাও বাস করে। যে কারণে দোকানে কিংবা মলে গেলে দূর্ঘটনাবশত তাদের সাথে দেখা হওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু মনের গভীরে ও জানে দুয়ে দুয়ে চার মিলছে না। তাদেরকে সে কখন কিছু কিনতে দেখে নি, তাদের পরিবার পরিজনদের কাউকেও কখন সঙ্গে দেখে নি। বহুবার দেখেছে হয় পার্কিং লটে নয়ত রাস্তার পাশে একটা কালো জেনারেল মটরসের পিক আপ ট্রাকে চুপচাপ বসে আছে, ওর কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে। তাদের কার্যক্রম দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখবার কোন প্রয়াস তাদের নেই। যার শুধুমাত্র একটাই অর্থ আছে। তাদের উপস্থিতি একটা মেসেজ।

ওর ভয়টা মিথ্যে নাকি বাস্তব জানার কোন উপায় রিমার নেই কিন্তু তবুও সাবধানের মার নেই। ফায়জা এবং জিব্রানকে পই পই করে বলে দিয়েছে স্কুলে যাবার কিংবা আসার পথে কোন অপরিচিত মানুষের সাথে কথা না বলতে। সবচেয়ে ভালো হয় তারা যদি দল বেঁধে যাতায়াত করে। বাসায় যখন একলা থাকে তখন মিলা কিংবা লিয়াকত ছাড়া আর যেই আসুক তারা দরজা খুলবে না। ফায়জা যখন এই সতর্কতার কারণ জানতে চেয়েছে মেয়েকে কিছু বলে নি ও। শুধু বলেছে সতর্ক থাকাই ভালো। অযথা কিছু একটা বলে বাচ্চাদেরকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় নি, তাতে ভালোর চেয়ে খারাপ হবার সম্ভাবনাই বেশী।

তারপর বেশ কয়েকটা দিন চুপচপ পেরিয়ে যায়। লোক দু জনকে আরে দেখে নি রিমা। যখন ও আবার একটু নিরাপদ বোধ করতে শুরু করছিল, ভাবছিল পুরাটাই বোধহয় ছিল ওর উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, তখনই ছোট্ট একটা ঘটনা ওকে আবার ভীত সন্ত্রস্থ করে তোলে। রাতে খাবার সময় জিব্রান হঠাৎ বলে ওঠে, “একটা লোক আজকে আপুর সাথে কথা বলছিল।”
রিমা রবিনকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। ছেলেটার আজ মেজাজ মর্জি খুব একটা ভালো নেই। সকাল থেকেই নানা ধরনের ঝামেলা করছে। ও মুখে খাবার ঠেসে ঢুকিয়ে দিলেও থুথু দিয়ে বের করে দিচ্ছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার উপক্রম হচ্ছে রিমার, ইচ্ছা হচ্ছে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ঠিক সেই সময় জিব্রানের কথাটা চাবুকের মত এসে বিঁধল ওর কানে। “কি?”

“মা, খামাখা চিন্তা কর না,” ফায়জা দ্রুত বলে। “আমাদের বিল্ডীঙের সামনে একটা লোক আমার কাছে এখানকার ঠিকানাটা জানতে চাইছিল।”
রিমা একেবারে জমে যায়। “দেখতে কেমন লোকটা?” একরকম ধমকে ওঠে ও।
মায়ের কন্ঠস্বরের আচমকা পরিবর্তনে চমকে ওঠে ফায়জা। “মাঝ বয়েসী ভদ্রলোক। স্যুট প্যান্ট পরা ছিল।”
“রঙ কালো?” রিমা তীক্ষ্ণ কন্ঠে জানতে চায়।
“হ্যাঁ, কিন্তু তাতে কি হয়েছে?” ফায়জা মায়ের এতো তটস্থ হয়ে উঠবার কারণটা ধরতে পারে না।
“ছোট ছোট চুল,” জিব্রান যোগ করে।

রিমা একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়, ধীরে ধীরে ছাড়ে। বর্ণনাটা পিক আপ ট্রাকের ড্রাইভারের সাথে মোটামুটিভাবে মিলে যায়। রিমার শরীর কাঁপতে থাকে। হাজারটা দুশ্চিন্তা ঝড়ের মত ওর মাথার মধ্য দিয়ে বয়ে যায়। বুকের মধ্যে হৃতপিন্ডটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। নিজের ভুল বুঝতে পারে।ফায়জাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা উচিৎ ছিল। দ্রুত টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। কল চালিয়ে দিয়ে ঠান্ডা পানি চোখে মুখে ছিটায়। কি করা উচিৎ ওর? কার সাথে কথা বলবে? মার্সেলকে ফোন দেবে? কি বলবে তাকে? শুনলে তাকে পাগল ভাববে না লোকটা? মার্সেল না হলে আর কাকে বলা যায়? লিয়াকত! একমাত্র ওকেই ওর সন্দেহের কথাটা নির্ভয়ে খুলে বলা যায়।

একটা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বাইরে বেরিয়ে আসে ও, ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে সেল ফোনটা তুলে নিয়ে শোবার ঘোরে গিয়ে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। লিয়াকতকে ফোন দেয়। মোনা ধরল, রিমা লিয়াকতকে চাইতে স্বামীর দিল। লিয়াকত বরাবরের মতই হাসিখুশি, জীবনে ভরপুর। “ভাবী! কেমন আছেন? সবকিছু কেমন চলছে? কিছু লাগবে?”
রিমা একটা লম্বা শ্বাস নেয়। “লিয়াকত ভাই, আপনার সাথে একটু আলাপ করা দরকার। ভীষণ জরুরী।”
তারপর লিয়াকতের কাছে ওর ভয় পাবার কারণটা সবিস্তারে বর্ণনা করে ও। লিয়াকত চুপচাপ শুনল।
“কেউ আপনাকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করছে,” শেষে বলল।
“তোমার কি মনে হয় পিন্টুই ঐ লোক দুজনকে আমার পেছনে লাগিয়েছে?” রিমার কন্ঠ উৎকণ্ঠায় ভেঙে যায়।

“অসম্ভব না,” লিয়াকত শান্ত গলায় বলে। “ওর সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। কোন কিছু স্বীকার করবে না। ওর বাবার সাথে কথা বলা যায়। উনি মানুষটা খুব খারাপ না। উনি আবু বকর মসজিদে প্রতিদিন জোহরের নামাজ পড়তে আসেন। সেখানেই ওনাকে ধরা যায়। কালই যাই চলেন।”
“ঠিক আছে। কাল দুপুরে।” ওর গলার কাঁপনটা লুকাতে পারে না রিমা। ফোনটা রেখে দেবার পর বেশ কিছুক্ষণ লাগে নিজেকে শান্ত করতে। পিন্টু কি এতো নীচে নামতে পারে? সত্যি সত্যিই কি ওর বাচ্চাদের কোন ক্ষতি সে করবে?
– টরন্টো, কানাডা