শুজা রশীদ : (পর্ব ২৯)
৪১.
নীতার সাথে দেখা করে ফেরার পর সেদিন সন্ধ্যাটা রিমা বাচ্চাদের সাথে নিভৃতে কাটাবে বলে ভেবেছিল। ফায়জার সাথে এক জোট হয়ে কিছু একটা রান্না করবে, বাচ্চাদের সাথে এক সাথে খাওয়া দাওয়া সেরে কোন একটা বোর্ড গেম খেলবে- লুডো, স্ক্র্যাবল কিংবা মনপলি। রবিন লুডো খেলতে খুব পছন্দ করে। ছক্কাটাকে মেঝেতে ছুড়ে দেয়াটা ওর খুব প্রিয়। কাজ থেকে পরের দিনটা ছুটি নিয়ে নিয়েছে রিমা। ঐ বদ লোক দুটা আবারও বাচ্চাদের কাছে যেন না ঘেঁষে সেটা নিশ্চিত করতে চায়।

সন্ধ্যায় পরিকল্পনা মোতাবেক ফায়জার সাথে রান্নাঘরে যখন দেশী স্টাইলে ভুনা মুরগী রান্না করছে তখন ওর ফোনটা বেজে উঠল। ওর দুই হাত তখন মসল্লায় মাখামাখি, তাই জিব্রানকে বলল ফোনটা খুঁজে বের করে কলার আইডি দেখতে। কিন্তু এই আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ কাজই খুবই জটিল হয়ে উঠল যখন দুই ভাই তার ফোন নিয়ে টানাটানি শুরু করল। একটু পরে রবিন যখন তারস্বরে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করল তখন ফায়জা গেল তাদের হাত থেকে রিমার ফোনটাকে উদ্ধার করতে। এতো টানাটানির মধ্যে ফোনের লাইন কেটে গেছে। ফায়জা কলার আইডি চেক করে গলা উঁচিয়ে বলল, “নোমান। নোমান কে?”
“নোমান?” রিমা অবাক হল। “কোন মেসেজ রেখেছে?”

“রেখেছে। শোনাবো তোমাকে?” ফায়জা ভয়েস মেইলে চলে গেল। চালিয়ে দিল মেসেজটা।
রিমা, নোমান বলছি। আশা করি ভালো আছো। শেষ বার দেখা হবার পর আর তোমার সাথে কথা হয়নি। আজ সন্ধ্যায় আমার করার কিছু নেই। তুনি যদি খুব ব্যাস্ত না থাকো, তোমার বাসায় আসতে পারি? ফায়জাকে দেখার জন্য খুব ব্যাস্ত হয়ে উঠেছি। মেসেজটা পেলে একটা কল দিও। বাই।

ফায়জা বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে তাকাল। “তুমি ওর সাথে ডেটিং করছ?”
“ডেটিং?” রিমা তীব্র প্রতিবাদ করে। “আরে না! আমার পুরানো বন্ধু। কয়েক দিন আগে আমরা দুজনে এক জায়গায় বসে পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম।”
“ও আচ্ছা! জেনে ভালো লাগল।” ফায়জা অবিশ্বাস নিয়ে বলে। “আমাকে দেখার জন্য তার এতো আকুতি কেন?”

“কারণ তোমাকে শেষবার যখন দেখেছিল তুমি তখন খুব ছোট্ট ছিলে। এখন কত বড় হয়েছ দেখতে চায়।” রিমার ভয় হয় ফায়জা না আবার তার অতীত নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে। তার সব প্রশ্নের উত্তর সে এখনও দিতে প্রস্তুত নয়। ওর আসল বাবা সম্বন্ধে এখন পর্যন্ত ওকে কিছুই বলে নি রিমা। কেন হঠাৎ বাংলাদেশ ছেড়ে দুই বাচ্চাকে নিয়ে চলে আসতে হয়েছিল সেটাও কখন খোলাসা করে নি। এক প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে অন্যটাও চলে আসবে, কারণ সব কিছুই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

ফায়জা রান্নাঘরের কাউন্টারের উপর ফোনটা রেখে মায়ের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল। “তোমার পুরানো বন্ধুদের কাউকে আমি কখন দেখিনি, মা। এই ভদ্রলোককে না হয় চলে আসতে বল। আমাদের সাথে ডিনার করবেন। উনিও আমাদের দেখবেন, আমরাও ওনাকে দেখব।”
“সত্যিই বলব?” রিমা সন্দিহান দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে।

“হ্যাঁ বল,” ফায়জা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে। “ভালোই হবে। এখনই ফোন কর তাকে।”
“ঠিক তো? পরে আবার পস্তাবে নাতো?” রিমা নিশ্চিত হতে চায়। ফায়জা অপরিচিত মানুষ জনের সাথে আলাপ করতে খুব একটা পছন্দ করে না।
“হ্যাঁ মা, একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত। আমি বাসাটাকে ঝটপট গুছিয়ে ফেলে দুই গাধাকে ভালো জামা কাপড় পরাচ্ছি। তুমি ভদ্রলোককে ফোন দাও, জলদি।” ফায়জা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে তর্জনী দিয়ে রিমার ফোনটা নির্দেশ করে। রিমা এক মুহুর্ত ভেবে ফোনটা হাতে তুলে নিল। নোমান সব সময় ওর ভালো চেয়েছে, যথাসাধ্য উপকার করেছে। তাকে নিজ সংসারে টেনে আনতে দ্বিধা করবার কোন কারণ ওর নেই। সত্য হচ্ছে, রিমাই বার বার তার জন্য ঝুট ঝামেলা সৃষ্টি করেছে, তাকে বিপদে ফেলেছে।

নোমানের সাথে তার কথা হল। ডিনারের আমন্ত্রণ পেয়ে সে ভয়ানক খুশী। জানিয়েছে অবশ্যই আসবে। রিমা দ্রিতহাতে ডিনারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রান্না করতে করতে তার মন হারিয়ে যায় দূর অতীতে। জীবন মাঝে মাঝে সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।

ড্রাগ ওভারডোজে লাভলুর অকাল মৃত্যুর পর ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ে রিমা। সবাই তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাত যেন তার স্বামীর অযাচিত মৃত্যুতে তার নিশ্চয় কোন একটা ভূমিকা ছিল। অনেকে এমন কথাও বলছিল যে লাভলুর মত নষ্ট একটা ছেলের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য সে নিজেই কোন এক ভাবে ব্যাপারটা ঘটিয়েছিল। সে নিজেই হয়ত ড্রাগের শেষ ডোজটা লাভলুর শরীরে প্রবিষ্ট করিয়েছিল। নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব রিমা নির্জনে চোখের জল ফেলত। তার বাবা-মাও তাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে আসে নি। কিভাবে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না রিমা। ঠিক সেই সময় বিশ্বস্ত বন্ধুর মত তার পাশে এসে দাঁড়ায় নোমান, সেই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে অসম সাহস আর দৃঢ়তা দেখিয়ে তাকে বের করে নিয়ে আসে সে।

তার নীল টয়োটা গাড়ীতে চেপে শ্বাস রুদ্ধকর ট্রাফিক জ্যামের মাঝ দিয়ে প্রায় ঘন্টা খানেক যাত্রার পর রামপুরে পৌছেছিল ওরা, যেখানে নোমানের এক চাচাতো বোন তার পরিবার নিয়ে থাকত। সেখানে সপ্তাহ খানেক থাকল রিমা। আপা-দুলাভাই তাকে অনেক যতœ করলেন। তারপর একদিন নোমান এসে ওকে সুন্দর পোশাক আষাক পরিয়ে তার সাথে নিয়ে গেল মতিঝিলের এক আকাশচুম্বী অফিস বিল্ডিঙয়ে তার এক অনাত্মীয় বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। ভদ্রলোক এক বড় কম্পানির ঈঊঙ. নোমান তাকে বহু বছর ধরে চেনে। নোমানের ধারনা ছিল তার কাছে গেলে রিমার কিছু একটা কাজ হয়ে যাবে। রিমার তাতে ভয়ানক সন্দেহ ছিল। তার সাকুল্যে বছর দুয়েকের ইউনিভার্সিটীর পড়াশুনা রয়েছে। তা দিয়ে কি অফিসে কোন কাজ পাওয়া যায়? কিন্তু নোমানকে সেসব নিয়ে খুব একটা উদ্বিগ্ন মনে হয়নি।

আরে, দেলোয়ার ভাই কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেবেন। সে দৃঢ়তা নিয়ে বলেছিল।
তারা সেই অফিস বিল্ডিঙয়ের নয় তলায় উঠে সুন্দর করে সাজানো একটা প্রশস্ত লবিতে নরম গদি আঁটা চেয়ারে বসে। তাদেরকে জানানো হল দেলোয়ার একটা মিটিংয়ে আছে, শেষ হলেই দেখা করতে আসবে। নোমান আগেই ফোন করেছিল, জানিয়েছিল তারা আসবে। তার সম্মানেই দেলোয়ার রিমার সাথে দেখা করতে সম্মত হয়েছিল। নোমান তার অনাত্মীয় এবং বয়েসে ছোট হলেও দেলোয়ার তাকে নিজের ভাইয়ের মত দেখে, নোমান তাকে জানিয়েছিল।
তাদেরকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। হয়ত আধা ঘন্টার মত। নোমানের পাশে একটা নীল রঙের চেয়ারে সালোয়ার কামিজ পরে বসে ছিল সে, তার লম্বা কালো চুল পাট পাট করে আঁচড়ান। তার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, নিজেকে বেমানান মনে হচ্ছিল সেই পরিবেশে। কাজ পাবার কি যোগ্যতা আছে তার? ভদ্রলোক দু চারটা প্রশ্ন করেই বুঝতে পারবেন রিমাকে দিয়ে কিছুই হবে না।

দেলোয়ার নিজেই চলে এসেছিল ওদেরকে স্বাগতম জানাতে। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল তার সুসজ্জিত অফিসে যেখানে দামী আসবাবপত্রের পাশাপাশি ছিল চমৎকার সব চিত্রকলার নিদর্শণ- ভাষ্কর্য থেকে শুরু করে পেইন্টিং। রিমার এসব নিয়ে অল্প বিস্তর জ্ঞান ছিল। দেখেই বুঝেছিল কয়েকটা পেইন্টিং পিকাসো এবং ভ্যন গঘের কপি।
রিমাকে হাতের আলতো ইশারায় বসতে আহবান করে দেলয়ার বলেছিল, “আমি আবার খুব শীল্পের ভক্ত। সব ধরনের।” নোমান ইতিমধ্যেই একটা চেয়ারে আয়েস করে বসে গেছে। বোঝাই গেল এই অফিসে তার প্রায়ই যাতায়াত আছে।

দেলোয়ারের ডেস্কটা বৃত্তাকার, গ্রানাইটের, পাথরের কাঠিন্য ভেদ করে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে অপূর্ব রঙের বাহার, অনেকটা পেইন্টিংয়ের মত। ডেস্কটাকে ঘিরে বেশ কিছু চেয়ার বসান, একেকটার শরীর এবং কুশনের রঙ ভিন্ন। সব মিলিয়ে চারদিকে নজর কাড়া আকার এবং বর্ণের সমারোহ।

রিমা দ্বিধান্বিতভাবে একটা চেয়ারে বসে আড় চোখে নোমানের দিকে তাকায়। নোমান তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে, তার দৃষ্টিতে উৎসাহ উদ্দীপনা। দেলোয়ার দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা লাল টকটকে চেয়ারে উপবেশন করে। “আমার প্রিয় রঙ,” সে লাজুক হাসি দিয়ে বলে।

লোকটার দিকে তখনই প্রথমবারের মত ভালো করে তাকায় রিমা। সাধারণের চেয়ে লম্বা সে, ছয় ফুটের মত হবে, হালকা পাতলা, হাসি হাসি এক জোড়া চোখ, পরিষ্কার করে কামানো দাঁড়ি-মোচ, উল্টো করে আঁচড়ানো কাঁধ সমান লম্বা চুল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে চুলে কলপ ব্যবহার করে। একটা ধুসর স্যুট আর ফুল তোলা টাইয়ে তাকে সুদর্শণ এবং বয়েসের তুলনায় তরুণ মনে হচ্ছিল। দেখে বোঝা কঠিন ছিল যে তার বয়েস পঞ্চাশ। আসার আগেই নোমান তাকে কিছু তথ্যা জানিয়েছিল ভদ্রলোক সম্বন্ধে।

দেলোয়ার কফি এবং নাস্তা আনালো। ইন্টারভিউ হল নামেমাত্র। “নোমান আমাকে বলেছে তুমি একটা কাজ খুঁজছ,” সে হালকা গলায় বলেছিল। “আমার অফিস এডমিনিস্ট্রেটর ক’ দিন হল বিয়ে করে কাজটা ছেড়ে দিয়েছে। ভাবছিলাম তুমি দয়া করে সেই পজিশনটা নিয়ে আমাকে এই যাত্রা রক্ষা করবে কিনা? প্রতিজ্ঞা করছি আমি খুব ভালো বস হব।”
অফিস এডমিনিস্ট্রেটর? রিমা ভয়ে ভয়ে নোমানের দিকে তাকিয়েছিল। নোমান উপরে নীচে সমানে মাথা দোলাচ্ছিল। হ্যাঁ! হ্যাঁ! সত্যিই? কিন্তু অফিস এডমিনিস্ট্রেটরের তো কিছুই রিমা জানে না। তাকে কি কাজ করতে হবে? এপয়েন্টমেন্ট আর শিডিউল দেখতে হবে? সেইটুকু সে নিশ্চয় করতে পারবে।

তার মুখভাব দেখে দেলোয়ার নীচু গলায় হেসে উঠেছিল। “ম্যাডাম, ভয় পাবার কোন কারণ নেই। এটা এমন কোন রকেট সায়েন্স নয়। তোমার কাজ হচ্ছে আমার মায়ের ভূমিকা পালন করা।”
কথাটা সে যেভাবে বলেছিল তাতে রিমা ভেতর থেকে বুদবুদিয়ে উঠে আসা হাসির দমকটাকে চেপে রাখতে পারেনি।

“তুমি হাসলে তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগে!” দেলোয়ার ছদ্মবিস্ময়ে বলে। “এতক্ষণ পর্যন্ত তুমি এতো গম্ভীর হয়ে ছিলে যে আমি একটু চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিলাম। আমি আবার মুখ গোমড়া মানুষ একেবারেই পছন্দ করি না,” কন্ঠস্বর হঠাৎ নামিয়ে রিমার মুখের সামনে মুখ এনে খুব নাটকীয়ভাবে বলেছিল সে।

নোমান হেসে উঠেছিল। “দেলোয়ার ভাই, বেচারীকে ভয় পাইয়ে দিয়েন না। ও ভীষণ স্মার্ট মেয়ে। যা করতে বলবেন দেখতে না দেখতে শিখে ফেলবে। কবে শুরু করবে?”
“আজকেই, যদি তার আপত্তি না থাকে,” দেলোয়ার মুচকি হেসে বলেছিল।
রিমার বিশ্বস করতে কষ্ট হচ্ছিল। এতো সহজেই কাজ হয়ে গেল তার! নোমানকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাবে সে?

“তুমি যদি রাজী থাকো তাহলে আমি আমার হায়ারিং ডিপার্টমেন্টকে নির্দেষ দিতে পারি একটা কন্ট্রাক্ট লিখে তোমার কাছে পাঠাতে,” দেলোয়ার রিমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল। “টাকা পয়সা নিয়ে একেবারেই ভেব না। আমি নিশ্চিত করব তুমি খুব ভালো প্যাকেজ যেন পাও। কি রাজী, মিস রিমা?” তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সে। রিমা হাত মিলিয়েছিল। বার দুয়েক হাত নেড়ে তার হাত ছেড়ে দেয় দেলোয়ার। “আমাদের কম্পানীতে সুস্বাগতম। তুমি আমাদের এখানকার পরিবেশ খুবই পছন্দ করবে। চল, সেলিব্রেট করা যাক। টেক অউট লাঞ্চের অর্ডার দেই। নাকি রেস্টূরেন্টে গিয়েই খাবে? তুমি যা বল।”
প্রশ্নটা তাকে লক্ষ্য করেই করা। রিমা দ্বিধান্বিত ভাবে তাকিয়েছিল নোমানের দিকে যে শুধু হেসেছিল। যার অর্থ রিমাকেই সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। কি বলবে বুঝতে পারছিল না রিমা। নোমানই তাকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে। “দেলোয়ার ভাই, চলেন একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভালো করেই সেলিব্রেট করা যাক। আপনাকে এই উপলক্ষ্যে একটু খসানো হবে।”
দেলোয়ার কোন আপত্তি করে না। “টেক আউটের কথা তোলাই আমার ভুল হয়েছে। আমার আগের সহকারী চলে যাবার পর আমি গলা সমান পানিতে ডুবছি রাজ্যের শিডিউল সামলাতে। আমার মিটীংয়ের সময় সব ওলট পালোট হয়ে যায়, মানুষ জনের নাম ঠিকানা হারিয়ে যায়। তুমি ম্যাডাম আমার প্রাণ বাঁচাতে আসছো। চল, কোন ভালো জায়গাতেই যাওয়া যাক।”

তাদেরকে খুব দামী একটা বিদেশী খাবারের দোকানে নিয়ে যায় দেলোয়ার এবং খাবারের পুরো সময়টা নানা ধরনের আলাপে পরিবেশটা মুখর করে রাখে। তার চমৎকার মার্জিত ব্যবহার যে কারো মন জয় করে নিতে পারে। ঠাট্টা মশকরা করলেও কখন ভদ্রতার সীমানা সে পার হয় না।

ভদ্রলোককে রিমার ভালো লেগেছিল। ঘন্টা দুই পরে যখন তারা হাত মিলিয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেয় তখন ভদ্রলোক সম্বন্ধে তার মনে খুব চমৎকার একটা ধারনা তৈরি হয়েছে। এমন একজন মানুষের সাথে কাজ করতে তার কোন অসুবিধা হবে না।

দিন দুই পরে কাজে যোগ দেয় রিমা। অফিসের কাছাকাছি একটা বাসা নেবার দরকার ছিল যেন অফিসে যাতায়াত নিয়ে তাকে বিপদে না পড়তে হয়। নোমানই খুঁজে পেতে তার জন্য একটা এপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করে এবং প্রথন তিন মাসের ভাড়া দিয়ে দেয়। রিমাকে বলে টাকাটা সে ধার হিসাবে দিচ্ছে এবং যখন রিমা বেতন পাবে তখন শোধ করে দিলেই হবে। তার প্রতি রিমার কৃতজ্ঞতাবোধ দিনকে দিন যেমন বাড়ছিল তেমনি একই সাথে নিজের মধ্যে অপরাধবোধটাও বাড়ছিল কারণ ও পরিষ্কার বুঝতে পারত নোমান তাকে কতখানি ভালোবাসে। ওর মনে হত ও যেন লোকটার দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। প্রায়ই ভাবত ওর প্রতি নোমানের যে প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল তারও যদি নোমানের প্রতি একই ধরনের অনুভূতি থাকত তাহলে এমন যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। ও বুঝতে পারত নোমান একদিন ওকে বিয়ে করে সংসার করার স্বপ্ন দেখছিল। দূর্ভাগ্যবশত নোমানের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রিমা কোন কিছুই চিন্তা করতে পারত না। ওর কাছে নোমান ছিল বয়জ্যেষ্ঠ কোন দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের মত। তাকে ও ভালবাসত কিন্তু সেই অনুভূতিতে প্রেমের কোন ছাপ ছিল না। যে কারণেই হোক তার প্রতি সেই ধরনের কোন অনুভূতি ওর মাঝে তৈরী হয় নি।

যাইহোক, ওর অফিস এডমিনিস্ট্রেশনের কাজটা যা ভেবেছিল তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সে হয়ে উঠেছিল দেলোয়ারের প্রতিনিধি। ও যে শুধু তার এপয়েন্ট, শিডিঊল এবং কন্ট্যাক্ট দেখছিল তাই নয় বরং প্রায়ই তার হয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে মিটিং করছিল, নানান বিষয়ে তার সাথে আলাপ করে তাকে সিদ্ধান্ত নিতেও সাহায্য করছিল। সেক্রেটারি নয়, বরং সে হয়ে উঠেছিল দেলোয়ারের সকল অফিসিয়াল কাজকর্মের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে কারণে কাজের প্রতিটা মুহুর্ত ও ভালবাসতে শুরু করে। কিছুদিন পরে আগের অফিস এডমিন কেন কাজ ছেড়ে হঠাৎ চলে গিয়েছিল সেই রহস্যও তার কাছে উন্মোচিত হয়। দেলোয়ারের প্রেমে পড়েছিল মেয়েটা। দেলোয়ার বিবাহিত মানুষ, সুখী, যদিও তার বাচ্চাকাচ্চা ছিল না। দেলোয়ার যখন তার প্রেমের আবেদনে সাড়া দেয় নি তখন মেয়েটা তার দীর্ঘদিনের এক পুরুষ বন্ধুকে বিয়ে করে কাজ ছেড়ে চলে যায়। তার বয়েস ছিল মাত্র বাইশ, রিমার চেয়ে মাত্র বছর তিনেকের বড়। এতো অল্প বয়েসী একটা মেয়ে কেন তার বাবার বয়েসী একটা লোকের প্রেমে পড়েছিল ভেবে অবাকই হয়েছিল রিমা।
– টরন্টো, কানাডা