শুজা রশীদ : (পর্ব ৫৪)
একটা বিষয় মরিয়ম নিশ্চিতভাবেই জানত- ডাউনসাইজ করব বলাটা সহজ, করাটা ততখানি নয়। হঠাৎ করে বড় ধরণের পরিবর্তন করতে গেলে মানুষের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। সবাই যে মন্দ চায় তা নয়, কেউ কেউ শুভাকাংখীও আছে। তাদের কাছে সত্য গোপন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপর রয়েছে বাড়ি বিক্রী করা, নতুন বাড়ি কেনা, সব মিলিয়ে যেন খুব মানসিক নীপিড়ন না হয়ে যায় সেদিকটাতেও লক্ষ্য রাখতে হয়। নতুন বাড়ি কেনার আগেও অনেক কিছু বিবেচনা করতে হবে, বিশেষ করে বাচ্চাদের স্কুলটা ভালো হওয়াটা জরুরি। আবার যদি বর্তমান বাড়িটা আগে বিক্রী হয়ে যায় তাহলে নতুন বাড়ি না কিনতে পারা পর্যন্ত সাময়িকভাবে অন্য কোথাও থাকতে হতে পারে। সেটাও আরেক সমস্যা।
রিমার দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ডলির ক্যাম্পেইন অফিসে স্বল্পক্ষণের জন্য থেমে তারপর ও গেল নীতাকে দেখতে। বার দুয়েক কলিং বেল বাজার পর লাট্টুই দরজা খুলে দিলেন। “মরিয়ম! এসো মা!” তিনি আন্তরিকভাবেই তাকে স্বাগতম জানালেন।

“আম্মা কোথায়?” মরিয়ম জানতে চায়। ও আশা করছে নীতা বিছানায় শুয়ে থাকবেন, খুব অসুস্থ হবার ভান করবেন। বাসা ছেড়ে চলে যাবার জন্য মরিয়মকে অপরাধবোধে মর্মাহত করবার এটাই তার সুবর্ণ সুযোগ। মনে মনে একটা নাটকের জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে ও।
নীতা ওকে নিরাশ করলেন না। তিনি বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন, দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ অসুস্থ, দুই নাত্নীকে দেখে শূষ্ক মুখে এক টুকরো হাসি দিলেন। মরিয়ম তার জন্য একটা ক্রিম রঙের শাল কিনে এনেছিল, বসন্তে কিংবা শরতে পরার জন্য। ও নীতার হাতে সেটা তুলে দিল। নীতা সেটার দিকে তাকালেনও না। লাট্টূ সেটাকে নিয়ে যতœ করে একটা সাইড টেবিলের উপর রাখলেন। মরিয়ম একটা চেয়ার টেনে নিয়ে নীতার সামনে বসল।
“আম্মা, আপনি অসুস্থ সেটা তো জানতাম না। কি হয়েছে?”
“কিছুই হয় নি,” নীতা তিক্ত কন্ঠে বললেন। “বয়েস হয়ে যাচ্ছে। তা এই বাসা ছেড়ে কবে বস্তিতে গিয়ে উঠছি আমরা?”

মরিয়ম একটা বড় করে শ্বাস নিল। পিন্টু ওকে আগেই জানিয়েছে ডাউনসাইজের কথা শুনে খুব ক্ষেপে গেছেন নীতা। কি বললে নীতার মেজাজ একটু ভাল হবে মরিয়মের কোন ধারণা নেই। দুই মেয়ে দাদীকে মুখ দর্শন দিয়ে চলে গেছে নিজেদের ঘরে। লাট্টু অবশ্য অর্থহীন অজুহাতে কাছাকাছি থাকছেন। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পরিস্থিতি যেন হাতের বাইরে না চলে যায় সেটা নিশ্চিত করতে চান। মরিয়ম অবশ্য আজ পর্যন্ত কখন শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর সাথে ঝগড়া-ঝাটি করেনি। কখন খুব রাগ হলে নিজের কামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে রাগ না পড়া পর্যন্ত। নীতার অবশ্য বরাবরি মেজাজ বেশি। রাগ হয়ে গেলে চীৎকার চেঁচামেচি করতে তিনি কখন পিছপা হননি। তার ক্রোধের কবল থেকে কেউই রক্ষা পায়নি। মরিয়মের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
“আমি আর তোমার আম্মা নতুন বাড়িটা কোথায় কেনা যায় তাই নিয়ে আলাপ করছিলাম,” লাট্টূ বললেন।
“দোযখে,” নীতা ফোঁস কর উঠলেন।

মরিয়ম কেশে গলা পরিষ্কার করল। এই ব্যাপারে আলাপ করবার জন্যই বিশেষ করে নীতার সাথে দেখা করতে এসেছে ও। “আমাদের সামনে খান দুয়েক পথ খোলা আছে। আমরা বড় শহর থেকে দূরে মফস্বলের দিকে গিয়ে বাড়ি কিনতে পারি, বিশেষ করে পূর্বে। তুলনামূলকভাবে বড় বাড়ি কিনতে পারব কিন্তু আমাদেরকে ড্রাইভিং বেশি করতে হবে। রেস্টুরেন্টটা ড্যানফোর্থে। আমাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবেরাও সবাই থাকে এদিকে। আরেকটা উপায় হচ্ছে রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি কোথাও বাড়ি কেনা। বাড়ি হয়ত খুব বড় হবে না কিন্তু যাতায়াতে অনেক সুবিধা হবে।”
“আমি চাই রিমার বাসার কাছাকাছি কোথাও যেতে,” নীতা বিড়বিড়িয়ে বললেন।
মরিয়ম এবার বেশ আশ্চর্য হল। তার ধারণা ছিল নীতা রিমার ধারে কাছেও যেতে চাইবেন না।
“তাতে রবিনকে আমরা আরোও বেশী দেখতে পারব,” লাট্টু বললেন।
“হাঁটা দূরত্বে কিনতে বলছেন?” মরিয়ম জানতে চায়।
লাট্টূ স্ত্রীর দিকে তাকালেন। “নীতা?”

“জানি না,” নীতা ধমকে উঠলেন। “আমি হাঁটাহাটি করতে পারব না। আমার হাঁটুতে ব্যাথা।”
লাট্টু মরিয়মের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “আশে পাশে কোথাও হলেই হবে।”
মরিয়ম মাথা নাড়ল। পিন্টুর সাথে এইসব নিয়ে ওর ইতিমধ্যেই বেশ আলাপ হয়েছে। ওরা এই শহর ছেড়ে খুব দূরে না যাবারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওয়ার্ডেন এবং সেন্ট ক্লেয়ার এলাকাটা বেশ ভালোই মনে হয়। যদি নজর বেশি উপরে না থাকে তাহলে মোটামুটি ভালো কিছু একটা পাওয়া কঠিন হবে না। বর্তমান বাড়িটার অর্ধেক মূল্যে কিছু একটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওদের বর্তমান বাড়িটা বিক্রী করে ওরা ভালো মূল্য পাবে কিনা। পিন্টু ইতিমধ্যেই জাফরের সাথে এই ব্যাপারে আলাপ করেছে। বিলাসবহুল বাড়ির বাজার বেশ ভালো এখন। ওরা মনে মনে ভালো দাম পাবারই আশা করছে।

কিন্তু বাড়িটাকে বাজারে দেবার আগে সেটাকে ঠিকঠাক করাতে হবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করাতে হবে, রঙ করাতে হবে এবং হয়ত স্টেজিংও করাতে হতে পারে। জাফর একজন এক্সটার্নাল কন্সাল্ট্যান্ট আনার বুদ্ধি দিয়েছে। কিছু খরচ হলেও লাভ বেশি। কিন্তু সমস্যা হল বাড়ির কাজ করাতে করাতে সেই বাসায় বসবাস করাটা কঠিন হবে। পিন্টু চেয়েছিল একটা ফার্নিশড তিন বেডরুমের বাসা ভাড়া করে সেখানে কয়েক মাসের জন্য থাকতে কিন্তু নীতা সেই প্রস্তাব শোনা মাত্র নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতে রাজী নন। যেখানে যাবার একবারেই যাবেন। যার অর্থ মরিয়মকে এই বাসায় ফিরে এসে জাফরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে বাড়িটাকে বিক্রীর জন্য প্রস্তুত করবার সাথে সাথে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর যেন খুব একটা সমস্যা না হয় সেই দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
“আম্মা, আমি বাচ্চাদেরকে নিয়ে দিন দুয়েকের মধ্যে চলে আসব,” ও নীচু স্বরে বলে। “বাবা-মায়ের সাথে বেশ কিছু দিন তো থাকলাম। তারা এখন ভালোই আছেন।”
নীতা পাশ বদলে অন্য দিকে ফিরে শুলেন। কিছু বললেন না।
“তাহলে তো খুবই ভালো হয়,” লাট্টু বললেন। “তোমাদের সবাইকে খুব মিস করছি আমরা।”

“তুমি কথাটা একটু বেশিই বল,” নীতা ধমকে উঠলেন। মরিয়মকে লক্ষ্য কর কিছু বললেন না। ওকে শাস্তি দেবার এটা তার সুযোগ। মরিয়ম জানে ফিরে আসার পর এই জাতীয় অনেক ব্যবহারই তাকে সহ্য করতে হবে। অবাক হলেও সত্য কয়েক মাস আগেও নীতার কাজকর্মে যতখানি ক্ষুব্দতা বোধ করত এখন তেমনটা করল না। নীতার শারীরিক দূর্বলতা দিনকে দিন তাকে আরোও নির্বিষ, অসহায় করে দিচ্ছে। আগের সেই দজ্জাল, অহংকারী মহিলা চেষ্টা করলেও আর হতে পারবেন না তিনি। বিয়ের পর এই প্রথম নীতার জন্য মনের মধ্যে এক ধরণের করুণা অনুভব করে মরিয়ম।

৮১

এই বছর বসন্ত আসবো আসবো করছে কিন্তু আসছে না। এক সপ্তাহে মনে হয় এই বোধহয় বসন্ত এলো, পরের সপ্তাহে আবার খুব ঠান্ডা পড়ে সেই সম্ভাবনা একেবারে মাঠে মেরে দেয়। মানুজন অবশ্য তাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য সারা দুনিয়াতেই আবহাওয়াগত নানা ধরণের পরিবর্তন হচ্ছে। স্থানীয় আবহাওয়াতে তার প্রভাব পড়তে দেখে অবাক হবার কিছু নেই।

এই শীতকাল বিদায় নিয়ে কবে গ্রীষ্ম আসবে তার প্রতীক্ষাতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে রিমা। দোকান উদ্বোধন করবার পর এখন ওর দরকার ক্রেতাদের সমাগম। শৈত্যের প্রভাব কমে যতই দিনগুলো উষ্ণ হয়ে উঠবে মানুষ জনের আনাগোনা ততই বাড়বে, বিক্রী বাটাও নিঃসন্দেহে বেশী হবে।
মার্চের প্রায় শেষ দিকে, আরেক পশলা শৈত্যতার প্রকোপের মধ্যেই হঠাৎ একদিন ওর দোকানে এলো নোমান, পরণে স্প্রিং জ্যাকেট, এক হাতে একটা কাগজের ঠোংগায় তন্দুরি-কাবাব আর অন্য হাতে একটা ফান্টার বোতল। “এই!” সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে দরজায় ঝোলানো ঘন্টিটা টুং টাং বেজে ওঠে।

“তুমি!” রিমা সেলাইয়ের ফাঁকে মুখ তুলে চায়, অভ্যর্থনা জানিয়ে আবার কাজে মনযোগ দেয়।
নোমান কাবাবের ঠোংগা এবং ফান্টার বোতলটা তার সামনে নামিয়ে রাখে। “তন্দুরী-কাবাব, এখনই বানিয়ে দিল।” একটা টুল টেনে নিয়ে পাশেই বসে সে। “সব কিছু কেমন চলছে?”
“কেমন চলছে জেনে তোমার কি লাভ?” রিমা ঠাট্টাচ্ছলে বলে। “আমার সুন্দরী, আকর্ষণীয়া বান্ধবীর সাথে নির্বাচণী কাজ কর্ম করে তোমার দিন কাল তো খুব ভালোই কাটছে মনে হয়। ঠিক কিনা?”
নোমান হাসল। “অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছি কিন্তু তোমার বান্ধবী যেমন সর্বক্ষণ খবর্দারী করে তাতে এখন মনে হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে যোগ দেয়াটাই ভুল হয়েছে।”
রিমা ফান্টার বোতলে একটা চুমুক দিল। “মাঝে মাঝে একটু বেশি বেশি করে স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু পুরুষেরা ওর ঐ দিকটা পছন্দ করে বলেই আমার ধারণা ছিল।” নোমানের দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসে ও। “সত্যি করে বল, কেমন যাচ্ছে তোমার?”
“ক্যাম্পেইন ভালোই যাচ্ছে। সবকিছু চমৎকার ভাবে এগুচ্ছে। বহু বছর ধরে এই এলাকায় ছিল লিবারেলের রাজত্ব। গত পনের বছর ধরে লরেনজো বেরারদিনেত্তি এখানকার এমপি ছিলেন। তাকে পরাজিত করাটা কঠিন হবে কিন্তু দেশী কমিউনিটি যদি একত্রিত হয় তাহলে অসম্ভব নয়। বহু তরুণ-তরুণীরা আমাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা দেখার মত। ফায়জা তো খুব খাটছে। তোমাকে কিছু বলে না?”
“বলে মাঝে মাঝে। কিন্তু ইদানিং দোকানে এতো সময় কাটাই যে ওর সাথে খুব একটা কথাবার্তাই হয় না। তোমার সাথে আলাপ হয়?”
“আমি প্রতিদিন বাসায় ফোন করে ওর খবর নেই,” নোমান ইতস্তত করে বলে। “তোমার কোন আপত্তি নেই তো?”

রিমা তার দিকে তাকিয়ে হাসল। “মোটেই না। বাচ্চারা তোমাকে পছন্দ করে। বিশেষ করে ফায়জা। মেয়েদের বাবার মত কাউকে দরকার। তাতে তাদের মনবল বাড়ে।”
নোমান রক্তিম হয়ে ওঠে। “আমি বাবা জাতীয় কিছু নই। বাবারা কিভাবে ব্যবহার করে জানিও না। আমি ওকে একটু সাপোর্ট দেবার চেষ্টা করি, এই আরকি।” একটু চুপ করে থেকে সে আবার বলে, “ওর আসল বাবার কথা ওকে বলেছ তুমি?”
রিমা এই প্রশ্ন শুনে অবাক হয় না। “কেন? জানতে চেয়েছে নাকি?”
“চেয়েছে। যেভাবেই হোক বুঝে ফেলেছে যে আমি তাকে খুব ভালো করে চিনি। আমাকে সারাক্ষণ খোঁচাচ্ছে আরোও তথ্য পাবার জন্য। এখন পর্যন্ত কিছু বলিনি। যা বলার সেটা তোমারই ওকে বলা উচিত।”
রিমা হাতের কাজটা এক পাশে সরিয়ে রেখে কাগজের ঠোংগাটা হাতে তুলে নিল। “গন্ধে আমার ক্ষিধে পেয়ে গেছে। তুমি একটা নাও।” ও একটা তন্দুরি রোল নোমানের হাতে তুলে দিয়ে অন্যটা নিজে নিল, উপরের কাগজের মোড়কটা সামান্য সরিয়ে একটা ছোট কামড় দিয়ে ধীরে সুস্থে চিবায়। “যা জানতে চায় তুমিই ওকে জানিয়ে দাও। ওর বয়েস মাত্র তের হলেও ও অনেক বুদ্ধিমতী। ও জানলে কোন অসুবিধা নেই।”
“তুনি কেন বলছ না?” নোমান কৌতুহলী কন্ঠে জানতে চায়।

“ঐ লোকটাকে নিয়ে কথা বলতে আমার স্বাচ্ছন্দ্য লাগে না। ভীতু কাপুরুষ একটা। কোনদিন তাকে ভালোবাসিনি আমি। তুমিতো সেটা ভালো করেই জানো। মিন্টুকে নিয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে পারি।” একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে।
কিছুক্ষণ দুজনে নীরবে খায়। রিমাই আবার কথা বলে ওঠে। “এবার বল তোমার জীবনে কি ঘটছে?”
তার কন্ঠে এমন কিছু একটা ছিল যেটা নোমানের দৃষ্টি আকর্ষন করল। রিমার দিকে তাকাল। দেখল সে সেল ফোনে তার ইমেইল চেক করছে। বুঝতে অসুবিধা হ্য় না ওর সাথে চোখাচোখি যেন না হয় তার একটা অজুহাত। “কি জানতে চাও বল?”
“যখনই দেখা হয় আমার প্রিয় বান্ধবী তোমার সম্বন্ধে প্রচুর কথা বলে….যদিও ইদানিং খুব একটা দেখা হচ্ছে না।” রিমা খুব হাল্কা কন্ঠে বলে।
নোমান কাঁধ ঝাঁকাল। “ওর সম্বন্ধে তোমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাই…”
রিমা তার দিকে তাকাল, আগ্রহী ভঙ্গিতে।
“ওর বর্তমান পরিস্থিতিটা কি?” নোমান জানতে চায়।
“তুনি নিজেই ওকে কেন জিজ্ঞেস করছ না?”
নোমান কেশে গলা পরিষ্কার করে। “আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।”
“বীরপুঙ্গব!” রিমা বক্র কন্ঠে বলে। “ও নিজের সম্বন্ধে কথা বলতে পছন্দ করে। আমার ধারণা ওর সম্বন্ধে যা বলার সব ও ইতিমধ্যেই তোমাকে বলেছে।”
“ও অনেক কিছুই বলে কিন্তু সব কিছু ঠিক মেলে না,” নোমান ইতস্তত করে বলে। রিমা মন্তব্যটাকে ঠিক কিভাবে নেবে বুঝতে পারে না।

রিমা মৃদু হাসে। এমনিতে সহজ সরল হলেও চাইলে মিলা খুব রহস্যময়ী হতে পারে। “আপাতত একাকী আছে। মাসখানেক আগে একটা ব্রেক আপ হয়েছে। ডাক্তার ছিল লোকটা। বিবাহিত। ওর দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছিল। ও নিজে বার দুয়েক বিয়ে করেছিল। প্রথমজন পালিয়ে যায়, দ্বিতীয়জন ছিল মহা হারামী। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ওকে মারত। ওর টাকাপয়সা চুরি করত। আরোও জানতে চাও? নাকি এটুকুই যথেষ্ট?”
নোমান মাথা নাড়ল। “আমি জানি জীবনে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর। বিশেষ করে হৃদ্য় সংক্রান্ত ব্যাপারে। অনেক কিছু বলেছে কিন্তু খুব পরিষ্কার করে বলে নি।”
“হয়ত লজ্জা পায়। বলার মত তো কিছু নয়। মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করে। মানুষ তার সুযোগ নেয়।”
নোমান নিঃশব্দে খায়। রিমা লক্ষ্য করল নোমানের কাছে পানীয় জাতীয় কিছু নেই। “তুমি চাইলে আমরা দুজনে এই ফান্টাটা ভাগ করে খেতে পারি।”
নোমান দাঁত বের করে হাসল। “খুব দরদী হয়ে গেছ দেখছি! নিজের ফান্টায় ভাগ দিতে চাইছ! আমি পানি খাব।” পেছনের কামরায় গিয়ে একটা পানির বোতল নিয়ে ফিরে এলো সে। চেয়ারে বসে দুই ঢোক পানি খেল।
“আমার মনে হয় না ও আমার কাছে যা চায় আমি ওকে সেটা দিতে পারব,” নোমান নীরবে বলে। “পারলে ভালো হত। ওকে যতটুকু চিনেছি অধিকাংশ পুরুষই ওর মত মেয়ে খোঁজে ঘর বাধার জন্য। সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, স্বভাবে মিষ্টি, আর কি চাই?”

এবার রিমা নোমানের চোখে চোখ রাখতে চাইল কিন্তু নোমান ইচ্ছে করে নজর মেঝের উপর নামিয়ে রাখল।। “তারপরও তোমার জন্য সে যথেষ্ট নয়!” খোঁচা দেবার চেষ্টা করছিল না রিমা। বরং খানিকটা কৌতুহলী হয়েই বলা। ওর মাথার মধে অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর কি খুশী হওয়া উচিত? মাত্র কয়েক দিন আগেই না ওদের মেলামেশার খবর শুনে জ্বলে পুড়ে মরছিল ও? এমনটাকি হতে পারে ওর হিংসা হলেও নোমানের সাথে মিলার মিল হয়ে গেলে, ওরা সুখী হলে, সেও ভালো বোধ করত? এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ এবং না দুটোই হয়।
নোমান অবশেষে মেঝে থেকে চোখ তুলে রিমার চোখে নিবদ্ধ করল। মনে হল রিমার কথায় সে একটু আহত হয়েছে। “তুমি তো আমাকে খুব ভালো করেই চেন। আমার বিয়েটা টেকেনি। আমি আজও সেই ব্যার্থতাকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারিনি। এখনই আরেকটা সম্পর্কের মধ্যে নিজেকে জড়াতে চাই না।”
“ও কি এখনই তোমার কাছ থেকে কোন ধরণের কমিটমেন্ট চাইছে?” রিমা জানতে চায়। মিলা তার সাথে সব সময় নোমানকে নিয়ে কথা বললেও বিয়ে-টিয়ে নিয়ে কোন কথা কখনও বলে নি।
নোমান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। “না, এখন কিছু বলে নি ও কিন্তু ওর হাবভাব দেখেই ও কি আশা করে পরিষ্কার বোঝা যায়।”