শুজা রশীদ : (পর্ব ৬৩)

“মিলা বলেছে ক্যাম্পেইন সেন্টারে থাকবে আজ রাতে?” রিমা নিশ্চিত হতে চায়।
“হ্যাঁ,” ফায়জা বলল। “তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল।”
রিমা দোদুল্যমনতায় ভোগে। বিজয় পার্টিতে যাবে নাকি রবিনের সাথে থাকবে? মিলার সাথে আরেকবার তার দেখা হওয়াটাও খুব দরকার। একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়। ক্যাম্পেইন সেন্টার ওর বাসা থেকে মাত্র মিনিট দশেকের পথ। মিলার সাথে দেখা করে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবে ও।
“তুমি রবিনের দিকে খেয়াল রাখতে পারবে?” রিমা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে। “মিলার সাথে আমার দেখা করতেই হবে। আমাকে কোন কিছু বলার সুযোগই দেয়নি ও।”
ফায়জা জোরে জোরে মাথা নাড়ে। “আমি রবিনের দেখভাল করব। একদম ওর পাশে বসে থাকব। তুমি যাও।”
রিমা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে গেল কাপড় পাল্টাতে। “যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসবো, কথা দিচ্ছি।”
ফায়জা রবিনের পাশে বসল। “তাড়াহুড়া করবার কোন দরকার নেই, মা। রবের কিচ্ছু হবে না। ও অনেক শক্ত। তাই না, রব?”
রবিন বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গুঙিয়ে ওঠে।

৯৭

রিমা যখন ক্যাম্পেইন অফিসের ভেতরে পা রাখল তখন রাত এগারোটার একটু বেশী বাজে। সেখানে অনেক মানুষের ভীড়। সবাই আনন্দে উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। জোরে জোরে গান বাজছে। কেউ কেউ নাচছে, পরস্পরকে কংগ্রাচুলেট করছে- সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ বিজয় উৎসব!
উপস্থিত কাউকেই রিমার পরিচিত মনে হল না। কিন্তু তারপরও তার আগমনে উপস্থিত মানুষদের ভেতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, ঘুরে ঘুরে তার দিকে চাইছে তারা, কেউ কেউ বিশাল এক টুকরো হাসি দিয়ে হাত পর্যন্ত নাড়ল। রিমা ঘাবড়ে গিয়ে পাল্টা হাত নেড়ে ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায়, মিলাকে খোঁজে। কিন্তু সবার ব্যবহারে কেমন যেন মনে খটকা লাগে। মনে হয় সে যেন হঠাৎ সকলের মনযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে!

অফিসের প্রায় শেষ মাথায় কয়েকজন স্বেচ্ছাকর্মীর সাথে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল নোমান, ওকে দেখেই সে জোরে জোরে হাত নাড়তে শুরু করল। রিমা থেমে গেল, ভাবল হয়ত নোমানের সাথেই আছে মিলা কিন্তু তাকে দেখল না। একটু হতাশ হয়ে আবার নোমানকে লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করেছিল কিন্তু নোমান হাত নেড়ে ওকে থামতে বলল। ইতস্তত করে থেমে গেল রিমা। নোমান তার দল বল নিয়ে নিজেই ভীড় ঠেলে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। সবার মুখেই আকর্ণবিস্তৃৎ হাসি।
এবার মিলাকে দেখতে পেল রিমা। সবার পেছনে প্রায় লুকিয়ে আছে। গাঁড় নীল রঙের সালোয়ার-কামিজ পড়েছে, গলায় লম্বা সাদা ওড়না ঝুলছে। হাসি-খুশী, প্রাণবন্ত। কি হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারে না রিমা। নোমান আর মিলা কি শেষ পর্যন্ত জুটি বাঁধল? বাঁধলে বাঁধুক। রিমার তাতে কিছু আসে যায় না। ও শুধু মিলাকে খুশী দেখতে চায়। চায় না? ওর বুকের মধ্যে দুরু দুরু কাঁপুনী শুরু হয়ে যায়। কি যে ও চায় নিজেই বুঝতে পারে না।
নোমান ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখে খুব গম্ভীর মনে হয়, কিংবা হয়ত নার্ভাস। ঠিক ধরতে পারে না রিমা। মিলা অন্যদেরকে পিছু রেখে সামনে এগিয়ে এসে নোমানের পাশে দাঁড়ায়। তার হাবভাব দেখে মনে হয় না রিমার সাথে তার কখন কোন সমস্যা হয়েছে।
“শেষ পর্যন্ত এলে তাহলে?” নোমান কাঁপা গলায় বলে। “সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা সবাই।”
রিমার দৃষ্টি মিলার উপর। “ফায়জা বলল তুমি এখানে আসবে। সেই জন্যেই এলাম।” ওর গলা বুঁজে আসে।

মিলা ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। “কেঁদো না,” ফিসফিসিয়ে বলে। “এই বিশেষ মুহুর্তটা নষ্ট করে দিও না।”
রিমা কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওর মুখ দিয়ে শব্দ বের হল না।
“তুমি ভালো আছো?” মিলা আবার ফিসফিসিয়ে বলে।
“আমার সাথে আর কক্ষন এমনটা করবে না।” রিমা অবশেষে ভাষা খুঁজে পায়। “কক্ষণ না।”
“করব না, কথা দিলাম।” মিলা ওকে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গিয়ে নোমানের দিকে তাকায়। “মহারাজ, মঞ্চ এখন তোমার। চেয়েছিলে এই ঐতিহাসিক দিনে তুমিও ইতিহাস গড়বে- কর কি করবে। জলদি!”
রিমা বিস্মিত দৃষ্টিতে নোমানের দিকে তাকায়। নোমান পকেট থেকে ছোট একটা জুয়েলারি বাক্স বের করে, ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বাক্সটার ডালা খুলে নিজের হাতের তালুতে রাখে, হাতটা এগিয়ে দেয় রিমার দিকে। রিমার দৃষ্টি আটকে যায় বাক্সের ভেতরে জ্বল জ্বল করে জ্বলতে থাকা বিশাল একখানা হীরার আংটির উপর।
“রিমা, আমাকে বিয়ে করবে?” নোমানের কন্ঠ কেঁপে ওঠে।
ইদানীং এই বিশেষ মুহুর্তটির কথা কল্পনায় বহুবার ভেবেছে রিমা কিন্তু ঠিক এই পরিবেশে নয়, এতো মানুষের ভীড়ের মধ্যে তো নয়ই। ও জমে যায়, ওর মাথার ভেতরটা শূন্য মনে হয়, নোমানের নার্ভাস মুখের উপর ওর দৃষ্টি আটকে যায়। নোমানের সঙ্গীরা সবাই জোট বেঁধে চেঁচাচ্ছে বল হ্যা! হ্যাঁ! হ্যাঁ!

মিলা ওর দিকে এক পা এগিয়ে এলো। “এই পর্যায়ে তোমার বলতে হবে হ্যাঁ,” সে রিমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে।
রিমার সম্বিত ফিরে আসে কিন্তু পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারে না। নোমান তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। বাচ্চারা ওকে ভালোবাসে, মিলা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, ও নিজেও ধীরে ধীরে মানুষটার প্রেমে পড়ে গেছে, অবশেষে। এর চেয়ে ভালো আর কি ও আশা করতে পারে? নীরবে মাথা নেড়ে অনামিকা এগিয়ে দেয় ও। ওদেরকে ঘিরে থাকা সবাই হৈ চৈ করে ওঠে, নোমান কাঁপা হাতে ওর আঙ্গুলে আংটিটা পরিয়ে দেয়। চারদিকে করতালি পড়ে যায়, অনেকেই সেলফোনে ছবি তোলে। এ যেন এক বিরল অভিজ্ঞতা। প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য কানাডাতে যেমন বিজয়ের এই দিনটি চিরদিনের জন্য গৌরবজ্জ্বল হয়ে থাকবে তেমনি রিমার জীবনেও এই দিনের স্মৃতি চির জাগরূক হয়ে থাকবে।
সবার মনযোগের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকে রিমা, মাথার মধ্যে অদ্ভুত সব অনুভূতির আনাগোনা চলে। ওর ইচ্ছা হয় এক দৌড়ে এই ভীড় থেকে দূরে কোথাও চলে যায়, শান্ত সমাহিত কোন স্থানে গিয়ে একটু সুস্থির হয়ে দাঁড়ায়।
নোমান মনে হল ওর মনের কথা ধরতে পেরেছে। “চল বাইরে যাই,” সে বলল।
রিমা মিলার দিকে তাকাল। মিলা মাথা নেড়ে সায় দিল। “যাও। আমি তোমাকে ফোন দেব। কথা দিচ্ছি।”

নোমান ওর হাত ধরে ভীড় ঠেলে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায়, বাইরে পার্কিং লটে বেরিয়ে আসে। চারদিকে তাকিয়ে রিমার গাড়িটাকে খোঁজে নোমান, পায়, রিমাকে সেই দিকে যাবার জন্য ইংগিত করে। “চল তোমার গাড়ীতে গিয়ে একটু বসি। তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে।”
রিমা গাড়ীর দরজা খুলে ভেতরে ড্রাইভিং সিটে বসল। নোমান ওর পাশে বসল।
“কি বলবে?” রিমা জানতে চায়, ওর মাথা এখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
নোমান একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “কিভাবে যে বলব ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না…” এক মুহুর্তের জন্য দ্বিধা করে সে। “কিন্তু অন্য কারো মুখ থেকে পরে শোনার চেয়ে এখনি আমার মুখ থেকে শোনাই ভালো…”
রিমা ওর অনামিকায় পরে থাকা আংটিটাকে ছোঁয়। তিন স্বামী আর দশ বছরের বিচ্ছিন্নতার পর লোকটার সাথে তার শেষ পর্যন্ত মিল হচ্ছে। ওর মনে কোন সন্দেহ নেই এই মানুষটার সাথে সে তার বাকী জীবনটুকু কাটাতে পারবে। কিন্তু নোমানকে দেখে উদ্বিগ্ন মনে হয়, নার্ভাস দেখায়, বার বার ঢোক গিলছে সে, মুখখানা ফ্যাঁকাসে হয়ে উঠেছে। তার ব্যবহারের মাথা মুণ্ডু বোঝে না রিমা। তার তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠা উচিৎ।
“কি ব্যাপার নোমান?” কৌতূহলী হয়ে অবশেষে প্রশ্ন করল। তার দেয়া আংটি আঙ্গুলে পরে আছে ও আর লোকটা এমন ব্যবহার করছে যেন খুব ভয়াবহ কোন অপরাধ করে ফেলেছে।
“মানে… কথাটা তোমাকে অনেকবার বলতে চেয়েছি, কিন্তু বলতে পারিনি,” নোমান চোখ নামিয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠল।
“বলবে নাকি বলবে না?” রিমা বিরক্ত হয়ে বলে। “রবিনের শরীরটা ভালো নেই। আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেল। তোমার উপর এই মুহুর্তে আমি বেশী রাগ করতে পারব না।” হাত তুলে আঙ্গুলে পরে থাকা আংটিটা দেখাল।
নোমান একটা দীর্ঘ শ্বাস নিল। “মিন্টুর মৃত্যুর পর আমি ডিটেকটিভ মার্সেলের কাছ থেকে একটা কল পাই…”

“মার্সেল?” রিমা ভ্রূ কুঁচকে বলে। “সে তোমার সাথেও কথা বলেছে?”
“হ্যাঁ। বলেছিল ঢাকা থেকে নাকি আমার যোগাযোগের ঠিকানা পায় ও। মিন্টুর মৃত্যু সংক্রান্ত ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশন করছিল সে। আমার সাহায্যের তার দরকার।”
“কি সাহায্য?” রিমা হতবাক হয়ে বলে।
নোমান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “আমিও ঠিক ঐ প্রশ্নটাই করি। আমার সাথে তার আলাপ করবার কি দরকার হতে পারে ভেবে পাইনি। তোমাকে বছর দশেক দেখিনি। জানতাম তুমি টরন্টোতে থাকো কিন্তু তার চেয়ে বেশী কিছু জানার চেষ্টা করিনি। ঢাকা থেকে আমাকে কিছু না বলে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলে। সেখানেই সব কিছুর ইতি টানতে চেয়েছিলাম। তাকে আমি সব কিছু খুলে বলি কিন্তু সে কিছুতেই মানতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত এক রকম নিরুপায় হয়েই আমাকে রাজী হতে হল। সত্যি বলতে কি লোকটাকে আমার পিছু ছাড়া করাটাই ছিল আমার একমাত্র উদ্দ্যেশ্য।”
“তোমাকে কি করতে বলেছিল সে?” রিমা বিরক্তি ঢাকার কোন চেষ্টাই করে না।
“ওরা এটাকে বলে এনট্রাপমেন্ট। কারো সাথে ঘনিষ্ট হয়ে তার গোপন খবর জেনে নেয়া এবং সেই তথ্য কোর্টে ব্যাবহার করা,” নোমান দৃষ্টি নামিয়ে বলে।
রিমা ভাষা হারিয়ে ফেলে। বিস্মিত দৃষ্টিতে নোমানের দিকে দীর্ঘ একটা মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে ও। “সে তোমাকে পাঠিয়েছিল আমার কাছ থেকে মিন্টুর হত্যা সংক্রান্ত ব্যাপারে স্বীকারোক্তি নেবার জন্য?” অবশেষে বলে।

নোমান মাথা নাড়ে। “ক্লিনিকে তোমার সাথে যে আমার দেখা হয়েছিল সেটা দুর্ঘটনা ছিল না। মার্সেল তোমার গতিবিধির উপর নজর রাখছিল। ও পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে সাজাতে চেয়েছিল যেন মনে হয় আমাদের দেখা খানিকটা ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে।” নোমান আরেকটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়। “রিমা, তোমাকে যেঁচে পড়ে এটা বলার কারণ একটাইÑ আমি তোমার কাছ থেকে কোন কিছু গোপন রাখতে চাই না। তুমি পরে কখন মার্সেলের মুখ থেকে এটা শোন সেটা আমি চাই না।”
রিমা বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা খুঁজে পায় না। তারপর অবিশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ে ও। নিজের কানকেও যেন ওর বিশ্বাস হয়নি। “তার মানে, সে তোমাকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিল।” এবার ওর কন্ঠে উষ্মার ছাপ। “সেই শুরু থেকেই ঐ লোকটা মিন্টুর মৃত্যুর জন্য আমাকে লটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেন আমি জানি না। কিন্তু তুমি কি করে তার প্রস্তাবে রাজী হলে?” তার দৃষ্টিতে বিতৃষ্ণা ঝরে পড়ে। “আমাকে তোমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? আমাকে আগে কেন বল নি এটা?”

“বিশ্বাস কর আমি বলতে চেয়েছি,” নোমানের কন্ঠ ভেঙে যায়। “কিন্তু মার্সেল আমার সামনে অন্য কোন পথ খোলা রাখে নি। আমাকে বলেছে আমি যদি ওর কথা মত কাজ না করি কিংবা তোমাকে ব্যাপারটা বলে দেই তাহলে সে প্রমাণ করবার চেষ্টা করবে যে আমরা দুই পুরানো প্রেমিক একসাথে জোট পাকিয়ে মিন্টুকে খুন করেছি ইনস্যুরেন্সের টাকার জন্য। ভেবে দেখেছ ব্যাপারটা? এই গল্প যদি বাইরে ছড়ায় তাহলে আমরা মুখ দেখাতে পারতাম? আমার সত্যিই সত্যিই আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু তোমাকে আমি কখন সন্দেহ করিনি।
মার্সেলকেও কখন তোমার সম্বন্ধে কোন তথ্য দেইনি।”
“কিন্তু আমাকে ফাঁসানোর জন্য এতো কান্ডকারখানা করবার কারণ কি?” রিমা বিড়বিড়িয়ে বলে। “ঢাকা থেকে লাভলুর মৃত্যু সম্বন্ধে কেউ হয়ত ওকে ভুল তথ্য দিয়েছে। হয়ত ভেবেছে মাভলুর মৃত্যুতে আমার হাত ছিল।”

“তুমি ঠিকই ধরেছ। এই কথা আমাকে বলেও ছিল,” নোমান বলল। “ঢাকাতে ঐ কেসটা যে পুলিশ অফিসার তদন্ত করেছিল সে মার্সেলকে বলেছিল যে তুমি তাদের প্রধান সাস্পেক্ট ছিলে কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ তাদের হাতে ছিল না। মার্সেলের ধারণা তুমি খুন করে বেঁচে গেছ।”
“দু-মুখো সাপ ঐ মার্সেল!” রিমা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে। তারপর নোমানের দিকে ফেরে। “তুমি তো জানো কি হয়েছিল। তুমি তো তখন ঢাকাতেই ছিলে। ওকে ব্যাখ্যা করে বল নি?”
“বলেছিলাম। সব খুলে বলেছি। কিন্তু ও খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি কারণ লাভলূ যেখানে মারা গিয়েছিল আমি সেইখানে উপস্থিত ছিলাম না। সুতরাং বাস্তবিকই কি হয়েছিল সেটা জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।”
“বাস্তবিকই কি হয়েছিল?” রিমা চেঁচিয়ে ওঠে। “ওভারডোজড হয়েছিল! আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে তুমি মার্সেলের সাথে হাত মিলিয়ে আমাকে ট্র্যাপ করতে চেয়েছিলে! কি করে পারলে তুমি?”

“তুমি জানো না ও কিভাবে আমার পেছনে লেগে ছিল,” নোমান বলে। “শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়েই রাজী হয়েছিলাম। আবার এটাও হতে পারে হয়ত চেয়েছিলাম এই সুযোগটা নিয়ে আবার তোমার সাথে যোগাযোগ করতে।”
রাগে কাঁপছে রিমা, মনে হচ্ছে মাথাটা যেন ফেটে যাবে, কান গরম হয়ে উঠেছে, দৃষ্টি ঘোলাটে। “এই কাজটা করা ঠিক হয়নি। তোমাকে আমি কিভাবে আবার বিশ্বাস করব? বল? তোমাকে আমি কি আর কখন বিশ্বাস করতে পারব?” চীৎকার করে ওঠে ও, ওর মুখ রাগে, উত্তেজনায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। “এই যে আংটিটা আমাকে দিলে, এর মানে বোঝো তুমি? আমি যে নিরাপরাধ এটাই যদি তুমি বিশ্বাস না কর তাহলে আমার সাথে সংসার কেন করতে চাও?”
“আমি কখন তোমাকে সন্দেহ করিনি,” নোমান কাতর কন্ঠে বলে। “আমি শুধু বুঝতে পারি নি কিভাবে ওর খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসবো। কিন্তু বিশ্বাস কর ওর কাছে তোমার সম্বন্ধে কখন একটা কথাও বলিনি আমি। আমাকে অনেক দিন ধরে জ্বালাচ্ছে, ফোন করেই যাচ্ছে – আমি ওর সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। যা করার করুক। আমার কথা বিশ্বাস না হলে মার্সেলকেই জিজ্ঞেস করে দেখ।”

“মার্সেলকে জিজ্ঞস করব? সে তো একটা মিথ্যেবাদী। দেখা হলে মিষ্টি করে হাসে, সুন্দর সুন্দর কথা বলে আর উল্টো ঘুরলেই আপন জনকে লাগিয়ে দেয় আমার পেছনে। ওকে আমি কিছুই জিজ্ঞাসা করতে চাই না। আমি বিশ্বাস করতাম তোমাকে। দশ বছরের ব্যবধানে সেই বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায় না। তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। অন্য কেউ করলে মানতে পারতাম কিন্তু তুমি?” ওর ফোন বেজে উঠল। হাতব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হাতড়ে ফোনটাকে বের করল ও। নিশ্চয় ফায়জা। হয়ত রবিনের শরীরটা আরোও খারাপ হয়েছে।
ফোনের কলার আইডি ফায়জার নয়। প্রাইভেট নাম্বার। স্ক্যামাররা মাঝে মাঝে বদ মতলব নিয়ে কল করে। হয়ত সেই ধরনের কেউ। রিমা ধরল না। ও ফোনটাকে নিজের কোলে রেখে আঙ্গুল থেকে এনগেজমেন্ট আংটিটা খুলে নোমানের দিকে ছুড়ে দেয়। “এটা আমি নিতে পারব না। তুমি আমার বিশাস ভেঙ্গেছ। কেন করেছ আমি জানতেও চাই না। এবার আমার গাড়ী থেকে নেমে যাও। আমাকে বাসায় যেতে হবে।”
ওর ফোনটা আবার বাজছে। হারামীর দল! ফোনটা ধরল। “কি চাস তোরা?” চীৎকার করে ওঠে।
“মিসেস রিমা আহমেদ?” অপর প্রান্ত থেকে একটা গভীর কন্ঠ কথা বলে ওঠে। শুনে মনে হয় না উলটাপালটা কেউ। রিমা লোকটার কন্ঠে জরুরী কিছুর ইংগিত পায়।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কে তুমি?” ওর মাথার মধ্যে হাজারটা খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খায়।
“আমি পুলিশ কন্সটেবল জাভেদ ওমর। তোমার বাড়ীতে আগুন লেগেছিল।” অফিসার সাধ্যমত চেষ্টা করল শান্ত থাকতে যেন রিমা অতিমাত্রায় বিচলিত না হয়ে পড়ে।
রিমা কয়েক মুহুর্তের জন্য কিছুই ভাবতে পারে না। ওর শরীর কাঁপতে থাকে। “আগুন! আমার বাড়িতে? ও আল্লাহ!” চীৎকার করে ওঠে ও। “আমার বাচ্চারা বাসায় ছিল। আমার তিন বাচ্চা…”।