শুজা রশীদ : ১.
অনুভূতিটা সব সময় শুরু হয় একটা হালকা গন্ধ দিয়ে- ভ্যাঁপসা, নোনা, কিন্তু তারপরও কেন যেন ভালো লাগে। বুক ভরে শ্বাস নেয় রিমা এবং যতক্ষণ সম্ভব ধরে রাখে। অন্ধকারে, ঘুমের ঘোরে সে বিছানার অন্য পাশে হাত বোলায় এবং যেন লোকটার সুতির শার্টের ছোঁয়া পায়। কল্পনায় সে যেন তাকে দেখতে পর্যন্ত পায়, রক্ত মাংসের একজন মানুষ, তার পাশে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাসের জোরালো গোঙ্গানীর মত শব্দে কান ঝালা পালা হয়ে যায়।

বিয়ের পরে প্রথম দিকের কথা মনে পড়ে যায় তার। কে জানত এমন সুদর্শন একজন মানুষ রাতের বেলা নাক দিয়ে এমন সুরের তরঙ্গ তুলে দিতে পারে। বিয়ের আগে একসাথে শুয়ে দেখে নেবার কোন সুযোগ ছিল না। রিমা তেমন মেয়ে নয়। এমনকি একটা চুমু খাবারও সুযোগ দেয়নি। কিন্তু দুজনার মধ্যে ভীষণ আকর্ষণ ছিল, বিদ্যুতের ঝলক ছিল। আর তার ছিল একটা নতুন ঘর বাঁধার প্রয়োজন, তার দুটি নাবালক বাচ্চার জন্য। প্রথম দিকে রাতে ঘুম ভেঙে যেত তার নাক ডাকানীর ভয়ানক তর্জনে, অন্ধকার ঘরে জেগে জেগে সে অসহায়ভাবে আপন মনে হাসত।

মানুষটার কথা ভাবলেই তার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
সে পাশ ফিরে শোয়, বিছানার অন্য পাশের শুন্যতাটুকু তার নজর কাড়ে। যদিও সে নেই কিন্তু তার শোবার জায়গাটা পরিপাট করে চাদর দিয়ে ঢাকা, মাথার জায়গায় তার প্রিয় বালিশটা রাখা। লোকটা যেভাবে পছন্দ করত সেভাবেই সাজিয়ে রেখেছে রিমা। তার দৃষ্টি কোমল অন্ধকার ভেদ করে সামনের দেয়ালে সেঁটে থাকা ব্রুসলীর বিশাল পোস্টারে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ক্ষুরধার লড়াকু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে কিংবদন্তীর নায়ক, তার তীক্ষ্ম চোখ, টান টান শরীর দেখে মনে হয় যেন ধনুকে বাঁধা তীর। মিন্টু প্রায়ই এই ঘরে একা একা ঐ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বাতাসে ঘুষি ছুড়ত, মাথার উপরে তীব্র গতিতে লাথি মারত- বহু দিন প্রাকটিস না করলেও তার নড়াচড়া দেখলেই বোঝা যেত তার তারুণ্যে মার্শাল আর্টে সে যথেষ্ট দক্ষ ছিল। তার অতিতের ঐ দিকটা রিমার ভালো লাগত। সেই গোপন মুহূর্তগুলোতে লোকটা যেন ফিরে যেত তার অতীতের গৌরবজ্জল দিনগুলিতে।

একবার রিমা হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল, তাকে হাত-পা ছুড়তে দেখেছিল বাতাসে বালকীয় আনন্দে। রিমাকে দেখে সে একেবারে জমে গিয়েছিল, অপরাধীর মত তাকিয়ে ছিল, লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। তার সেই প্রতিক্রিয়া দেখে রিমা নিজেই ঘাবড়ে গিয়েছিল। বুঝেছিল, মিন্টুর কাছে এই ব্যক্তিগত সময়টুকু তাকে তার পুরানো দিনের আনন্দময় জীবনের কথা মনে করিয়ে দিত। সেই গর্বিত সময়কে সে কখনই পরিপুর্ণভাবে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারেনি। এর পর মিন্টু সেই ঘরে থাকলে সে আর কখন পূর্বাভাস না দিয়ে ভেতরে ঢোকেনি।

রিমা হাত বাড়িয়ে সাজিয়ে রাখা বালিশটাতে হাত বোলায়, আলতো করে, খুব সাবধানে, তার দু চোখ বন্ধ, কিন্তু অনুভূতিগুলো সজাগ। সে লোকটার ছোট করে ছেটে রাখা চুল স্পর্শ করতে চায়। অনেক রাতে লোকটা ঘুমাত না, শুধু এপাশ ওপাশ করত, কখন চাদরটা গায়ে টেনে নিত, একটু পরে আবার ছুড়ে ফেলে দিত, কখন মেঝেতে, তারপর একটু পরে আবার সেটাকে তুলে গায়ে দিত। এ যেন তার কাছে একটা ছেলেমানুষি খেলার মত ছিল। যেন এমনটা করতে থাকলে একসময় ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে। বাস্তবে তেমনটা হত না। রিমাকেই শেষ পর্যন্ত তার শরীরে হত বুলিয়ে দিতে হত, বুক থেকে পুরুষাঙ্গ পর্যন্ত যেখানে প্রথম স্পর্শে সে চমকে উঠত, পরে উচ্ছ্রিত হত, এবং ধীরে ধীরে আবার নুয়ে পড়ত তার হাতের কোমলতায়, নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে যেত।

সেই মুহূর্তগুলো রিমার মনে পড়ে, যদিও মাঝে মাঝে তার কাছে পুরো ব্যাপারটা ক্লান্তিকর এমনকি নোংরাও মনে হত। কিন্তু মানুষটাকে শান্ত করবার একটা তাগিদ সে অনুভব করত।
অদ্ভুত ছিল মানুষটা। কখন ছিল সুখী, উচ্ছল, আনন্দে ভরপুর। আবার কখন ছেয়ে থাকত এক কৃষ্ণ মেঘের আড়ালে তখন তাকে মনে হত এক অসহায়, উদ্বিগ্ন, পরাজিত মানুষ যে পরাজয় স্মীকার করতে কখনই প্রস্তুত নয়।

রিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে তার সাথে সঙ্গমের সেই অতুলনীয় আনন্দময় সময়গুলোকে ফিরে পেতে চায়, দূর্বার আবেগে তার অভ্যন্তরে লোকটার প্রেমময় অভ্যুত্থান- তার শরীর কেঁপে ওঠে এক পরিচিত আবেগে, তার মাথা আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে আকস্মিক এক উত্তেজনার আক্রমণে। সেই মুহূর্তগুলো তার কাছে কত প্রিয় ছিল! নিজেকে তার একটু অপরাধী মনে হয়। মানুষটা আর নেই। তাকে নিয়ে এভাবে চিন্তা করাটা কি শোভন?

একটা অল্প বয়ষ্ক মেয়ে খুব চুপি চুপি, সতর্ক ভঙ্গীতে রিমার বিছানার পাশে হেঁটে যায়। নাইট লাইটের মৃদু আলোতে তার পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুলের রাশিতে তাকে কিঞ্চিৎ ভৌতিকীয় দেখায়। রিমার গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পায় সে, প্রগাঢ় ঘুমে থাকলে যেভাবে মানুষ শ্বাস নেয়। তার বিছানার পাশে দাঁড়ায় সে, কি করবে সিদ্ধান্ত নেবার চেষ্টা করে। তার বুক ধড়ফড় করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ভয়ে আঁটসাঁট হয়ে আছে সে। তার দৃষ্টি রিমার উপরে থাকলেও কান সদর দরজায়।

কেউ দরজায় নক করছে। পরপর তিনবার, একটু বিরতি, আবার তিন বার। ক্রমাগত করেই চলেছে। কাঠের দরজায় প্রতিটা আঘাত প্রকটভাবে শোনা যায়। মাস খানেক হল এভাবেই চলছে। তারা কখন দরজা খোলেনি। নিরাপদ মনে হয়নি। সব রাতে হয় না। মাঝে মাঝে। কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যেভাবে নক করা হয় সেটা শুনলেই বোঝা যায় যেই করুক তার উদ্দ্যেশ্য ভালো নয়। কেউ ইচ্ছে করে তাদেরকে ভয় দেখানোর জন্য, ভোগান্তি দেবার জন্য এটা করছে।

“মা! মা!” মেয়েটা সন্ত্রস্থভাবে ডাকে। ঐ দুর্বৃত্ত আর তাদের মাঝে শুধু দাঁড়িয়ে আছে একটা ইঞ্চি খানেক পুরু কাঠের দরজা।
রিমা বিছানা থেকে প্রায় লাফিয়ে নীচে নামল, সম্পূর্ণ সজাগ।

“ফায়জা!” সে ফিসফিসিয়ে বলে, মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারে এই ছায়াময়ীটি কে। নিশুতি রাতের এই ফ্যাসাদ এখন তাদের প্রায় নিত্যদিনের সঙ্গী হয়েছে। দুশ্চিন্তা আর ভয় দুটোই তাদেরকে গ্রাস করে, ঐ দরজার বাইরে কে এভাবে তাদেরকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে জানার তীব্র আগ্রহ হয়। সে অনেকবার অসম্ভব রাগে দজা খুলে তার মুখোমুখি হতে চেয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সম্বরণ করেছে। তার তিনটি বাচ্চা। কি বিপদ হতে পারে কে জানে। সে চীৎকার করলে পাশের এপার্টমেন্টের মানুষেরা হয়ত শুনতে পাবে কিন্তু তারা কি সাহস করে বাইরে বের হবে? পুলিশে ফোন করলে তাদের আসতেও অনেকখানি সময় লেগে যায়। তার আগেই এই দুর্বৃত্ত উধাও হয়ে যাবে।

“ভয় পাস না,” সে শান্ত কন্ঠে বলে, নিজের ভয়টুকু লুকিয়ে রাখে। ও জানে না কিভাবে এই আপদ থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। কি চায় বদমাশটা? কেন এভাবে রাতের পর রাত যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে?

রিমা নীচু হয়ে বিছানার নীচে হাত বোলায়, একসময় শক্ত একটা হাতলে তার হাত ছুঁয়ে যায়, সেটাকে ধরে বের করে নিয়ে আসে সে। একটা বেসবল ব্যাট। সে শক্ত করে ব্যাটটাকে তার মুঠিতে ধরে ফায়জার কাঁধে হাত রেখে তাকে সাহস দেবার চেষ্টা করে।
“পুলিশ ডাকো না কেন?” ফায়জা ফিসফিসিয়ে বলে।
“ডেকে কি হবে? তারা আসার আগেই পালিয়ে যাবে।” রিমা যুক্তি দেখায়। ওর ভয় হয় পুলিশ ডাকলে এই বদমাশ হয়ত রেগে গিয়ে আরও খারাপ কিছু করে বসবে।
দরজায় টোকা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। মায়ের হাত ধরে ফায়জা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, তার কান দরজার দিকে খাড়া হয়ে আছে, শরীর আলতো কাঁপছে।
“যা, গিয়ে শুয়ে পড়,” রিমা দৃঢ়ভাবে বলে।

“চলে গেছে মনে হয়?”
“হ্যাঁ,” রিমা ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখে। রাত দুটা। “যা, ঘুমা। আমি পাহারায় থাকব।”
ফায়জা নিঃশব্দে মাথা নেড়ে মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে যায়। ওর সাথে ওর দুই ভাই শোয়। দশ বছরের জিব্রান আর পাঁচ বছরের রবিন। মায়ের সাথে না শুয়ে বড় বোনের বিছানায় রাতে আস্তানা গাড়ে তারা। সে তাদেরকে গল্প বলে। রিমা কোন গল্প জানেই না।

রিমা পা টিপে টিপে সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজায় কান পাতে। শোনে। নিঃশব্দ। কোন কিছু শোনা যায় না। যেই হোক সে ইতিমধ্যেই চলে গেছে। প্রথম যখন এই আপদ শুরু হয়েছিল রিমার মনে হত তার জ্বর এসে গেছে, শ্বাস নিতে পারত না, শরীর ভয়ে কাঁপত। কি অদ্ভুত এক সমস্যা! কিন্তু ধীরে ধীরে একটা ব্যাপার তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে, যেই করুক তার উদ্দেশ্য ভয় দেখান, কোন ক্ষতি করা নয়, নিদেনপক্ষে আপাতত নয়। সে বেসবল ব্যাটটা কিনে বিছানার নীচে রাখতে শুরু করে আর রান্নাঘরে ছুরিগুলো এমনভাবে রাখে যেন প্রয়োজনের সময় ঝট করে তুলে নেয়া যায়। সাবধানের মার নেই।
ওর বান্ধবী মিলা একদিন বলল কিভাবে সদর দরজাটার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া যায়।

একটা চেয়ার নিয়ে দরজার হ্যান্ডেলের নীচে আটকে দেবে যেন দরজা ঠেললেও না খোলে। কারো কাছে যদি তোমার এপার্টমেন্টের চাবিও থাকে, মাস্টার কি জাতীয় কিছু, তারপরও ভেতরে ঢুকতে পারবে না। ঐ চেয়ার চীনের দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে থাকবে।
গত রাতে চেয়ারটা ঠেস দিতে ভুলে গেছে রিমা। খুব সামান্য একটা প্রতিরোধ কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া অনেক। ওটা দিলে নিজেদেরকে আরেকটু নিরাপদ মনে হয়, আরেকটু শান্তিতে ঘুমান যায়। সে চুপি চুপি মেয়ের ঘরে উঁকি দেয়। নীচু গলায় মেয়েকে ডাকে। ভেবেছিল মনে জোর দেবার জন্য কিছু একটা বলবে। ফায়জা জেগেই ছিল কিন্তু মায়ের ডাকে কোন উত্তর দেয় না। সে ভীত, ক্রদ্ধ। রিমা মেয়েকে দোষ দিতে পারে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে এই পরিবারটাতে। প্রতিটা দিন যেন একটা সংগ্রাম তাদের জন্য।

২.
মিলা খুব উচ্ছ¡ল প্রকৃতির, অধিকাংশ সময়। বয়েস মাত্র মধ্য ত্রিশ, রিমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়, ইতিমধ্যেই দু’বার ডীভোর্স করেছে, প্রায় সব দিক থেকেই রিমার একেবারে বিপরীত। কিন্তু কোন কিছু একটাতে নিশ্চয় মিল আছে নইলে তাদের এমন প্রগাঢ় বন্ধুত্ব কেমন করে হল? এই প্রসঙ্গ যখনই তোলে রিমা, মিলা হাসে যেন সে খুব একটা হাসির কিছু শুনেছে। দক্ষিণ এশীয় মেয়েদের তুলনায় সে বেশ লম্বা, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি তো হবেই, গৌর বর্ণ, অপুর্ব সুন্দর মুখে এক জোড়া চঞ্চল চোখ, হাসলে দুই গালে টোল পড়ে। পুরুষেরা যে তার আশে পাশে ছোঁক ছোঁক করবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তাদেরকে পোকার মত আকর্ষণ করবার যাবতীয় অস্ত্র তার ভাণ্ডারে রয়েছে।
কিন্তু এতো কিছুর পরও সে নিঃসঙ্গ!

রিমা তাকে আপন বোনের মত ভালোবাসে। যদিও তাকে মাত্র বছর দুয়েকের মত চেনে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে পরিচয় হবার সাথে সাথেই মনে হয় তাদেরকে যেন কতদিন ধরে চেনে। রিমা গিয়েছিল ডক্টর ফাতিমার অফিসে খোঁজ নিতে তিনি নতুন কোন রোগী নিচ্ছেন কিনা। বেশ কিছুদিন ধরে তার অনিয়মিতভাবে তলপেটে ব্যাথা হচ্ছিল, মেন্সট্রæয়েশনেও সমস্যা হচ্ছে। সারা জীবনে ডাক্তারদের কাছে তাকে খুব একটা কখনই যেতে হয়নি। সব সময়ই হালকা পাতলা ছিল, খেলোয়াড় সুলভ স্বাস্থ্য। হাঁটে সোজা হয়ে, পিঠ একেবারে খাড়া করে, তার সঙ্কীর্ণ কাধের উপর মাথাটা গর্বিত ভঙ্গীতে উঁচু হয়ে থাকে। তার সুডৌল শরীর, সুশ্রী মুখ এবং দৃষ্টিনন্দন রোদে পোড়া বর্ণ পুরুষদের উপর নিশ্চয় গভীর প্রভাব ফেলে কারণ সে যেখানেই যায় তাদের আগ্রহী দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করে, তার শরীরের আনাচে মানাচে বিচরণ করে, তারা তার পারফিউমের গন্ধ নিতে চায়, পরিচিত হবার জন্য অধীর আগ্রহে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

স্বাস্থ্যগত কারণে তার কখনই তেমন কোন অভিযোগ ছিল না। এই সমস্যাগুলো প্রথম যখন লক্ষ্য করতে শুরু করে, তার প্রাথমিক ভয়টা নিজের জন্য তত ছিল না, ছিল তার তিনটি সন্তানের জন্য। তার যদি কিছু হয় তাহলে ওরা কোথায় যাবে? ওদের দেখ ভাল করার মত মানুষ তার স্বামী ছিল না। নিজের বাবা মায়ের সাথে তার দীর্ঘদিন কোন সম্পর্ক নেই, শ্বশুর বাড়ির মানুষদের সাথে দা কুমড়া সম্পর্ক। সে আরেক লম্বা কাহিনী। তারা কোনভাবে সাহায্য করবে সেই আশা সে করে না।
ডক্টর ফাতিমা নতুন রোগী নিচ্ছিলেন না। এলাকার সমস্ত দেশী মহিলারা তার কাছে এসে ভীড় করলে আর নেবার মত সুযোগ থাকে কি করে? দক্ষিন এশীয় মহিলারা সবাই খোঁজেন মহিলা ডাক্তার, দেশী হলে তো আরও ভালো।
ওর কপাল ভালো, সেদিন মিলা কাজ করছিল। সে ডাক্তারের বেশ কয়েকজন মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্টের একজন। রিমাকে ওয়েটিং রুমে বসে থাকতে দেখে সে নিজেই কথা বলতে এগিয়ে আসে। “কোথায় যেন দেখেছি তোমাকে,” ঠোটের ফাঁকে এক চিলতে বন্ধুত্বপূর্ণ হাঁসি ধরে রেখে বলেছিল সে।

রিমা অবাক হয়নি।
বাংলা টাউনের নিকটে অবস্থিত ক্রিসেন্ট টাউন এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে বসবাস করলে দেশী মানুষজন যে দেখবে তাতে আশ্চর্য হবার কোন কারণ নেই। হয়ত এই মহিলাও সেখানেই থাকে। রিমা বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে থাকলেও কারো সাথে তার খুব একটা খাতির নেই। ও এই রকমই। একটু শীতল, দূরত্ব বজায় রাখতে চায়, ওর সাথে পরিচয়ের পরপরই সবাই সেটা ঝট করেই বুঝে ফেলে।
কিন্তু মিলার ভাব ভঙ্গীতে কি যেন একটা ছিল, যেমন স্নেহময়ী আত্মীয়ার মত উষ্ণ দৃষ্টিতে সে তকিয়ে ছিল মুহূর্তের মধ্যেই রিমার শীতলতা উবে যায়। সে ঘাড় নাচিয়ে মৃদু হেসেছিল।
“নাইন ক্রিসেন্ট টাউন, ঠিক?” মিলা নিশ্চিত ভংগীতে বলে। “ওখানে আমার একটা বয়ফ্রেন্ড থাকত। ফিফথ ফ্লোরে। প্রায়ই ওর ওখানে যেতাম। মাঝে মাঝে রাতেও থাকতাম। আপনাকে অনেকদিন দেখেছি। আপনার বাচ্চাদের সাথে। আমার স্মৃতি ভয়ানক ভালো। একবার কাউকে দেখলে জীবনে ভুলি না। বিশেষ করে আপনাকে ভোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি যেভাবে হাঁটেন নাÑ বেপরোয়া, গর্বিত, ভোলা সম্ভব না।” সে সামনে ঝুঁকে পড়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে, “আপনাকে দেখে আমার হিংসে হত, সত্যি! আপনাকে দেখলে এমন সাহসী মনে হত। ভাবতাম আমিও যদি আপনার মত হতে পারতাম।”

তারপর ঠিক কি নিয়ে তারা কথা বলেছিল রিমার মনে নেই কিন্তু ডাক্তার ফাতিমা তাকে নতুন রোগী হিসাবে গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় ভিজিটের পর তারা পরস্পরের ফোন নাম্বার নেয়। রিমা যেন শেষ পর্যন্ত এমন কাউকে পায় যাকে সে বোন বলে ভাবতে পারে। মিলার মাত্রই তার বয় ফ্রেন্ডের সাথে বিচ্ছেদ হয়েছিল, সে নিজেও বেশ মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে ছিল। পরে রিমাকে বলেছিল, লোকটার সাথে তার প্রাথমিক সময়টা ভালোই কেটেছিল কিন্তু এক পর্যায়ে সে ভীষণ শাসন করতে শুরু করে, সব কিছুতে নাক গলাতে থাকে, এমনকি মাতাল হয়ে কিংবা নেশা করে গায়েও পর্যন্ত হাত তোলে। এর আগে তার যে দুটি বিয়ে হয়েছিল সেগুলোও বিশেষ সুবিধার ছিল না। প্রথম স্বামী বছর খানেক ছিল, তারপর নিজেই চলে যায়। দ্বিতীয়জনকে সে নিজেই ছেড়ে দেয়, আরও কিছুদিন সুযোগ পেলে লোকটা তার ব্যাঙ্ক একাউন্ট ফাঁকা করে দিত। এতো সুন্দরী আর আকর্ষনীয় হয়েও পুরুষের ক্ষেত্রে তার ভাগ্য বরাবরই জঘন্য, সে ক্ষুব্ধ হয়ে বলত। ওর আরোও ভালো কাউকে খুঁজে পাওয়া উচিৎ ছিল।
নিশ্চয় ছিল। রিমা তার জন্য সারা দুনিয়া খুঁজে সবচেয়ে উত্তম এক পুরুষ এনে দিতে চায়। যার মধ্যে এতো মায়া আর মমতা আছে সে কেন অকারণে এতো কষ্ট পাবে?