কামাল কাদের: ঢাকা থেকে বেশ কিছুদিন আগেই এই ছোট্ট শহরটিতে ফজল মাহমুদ এসেছে, কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি সব কিছু ঘুরে দেখার। পাহাড়ী এলাকা, মফস্বল শহর। বেশ পরিষ্কার এবং ছিমছাম। শহর থেকে চারিদিকে তাকালে মনে হয় ছোট ছোট রাস্তাগুলো এঁকে বেঁকে ছড়িয়ে পড়েছে অসীম সীমান্তে। যে দিকে চোখ যায়, শুধু দেখা যায় মাঝারি আকারের গাছ আর গমের ক্ষেত। কখনো কখনো ক্ষেতের মাঝে দেখা যায় গরু অথবা মেষ চড়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তার দু ধারে সবুজ ঘাস। বড় সুন্দর এবং মনোরম দৃশ্যগুলি।

একদিন ফজল হাতে সময় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো শহরটা দেখার জন্য। শরতের বিকালে ভালোই ছিল দিনটি। রোদ্রৌজ্জ্বল আকাশ। এ সময়টাতে এতো পরিষ্কার আকাশ খুব কমই দেখা যায়। রাস্তাটা খুব একটা ভিড় না। সময়ে সময়ে রাস্তা দিয়ে যাত্রীবাহী “গ্রীন লাইনের” বাসগুলি “হু” করে চলে যায় এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক প্রান্তে থেকে অন্য প্রান্তে।
পায়ে হেটে আনমনে চলছে তো চলছে। হঠাৎ ফজলের হুশ হলো হাত ঘড়িটার সময় দেখে। রাত নয়টা বেজে গেছে, সন্ধ্যা হয় হয়। এরই মধ্যে কয়েক মাইল হাটা হয়ে গেছে। বিলেতে এই এক মজা, রাত নয়টা হলেও দিনের আলো কিছুটা ছিল। পা আর কিছুতেই চলতে চাইছে না, ফজলের হোস্টেলে ফেরা দরকার। অগ্যতায় সামনের এক বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়ালো। গ্রামের রাস্তা, প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর বাস এলো। বাসের যিনি ড্রাইভার, তিনিই কন্ডাক্টর অর্থাৎ যাত্রীদের কাছ থেকে বাস ভাড়াও আদায় করেন। ফজল বাসে উঠলো। ড্রাইভার ভাড়া হাঁকলো, “এক পাউন্ড প্লিজ!” ফজল পাঁচ পাউন্ডের একখানা নোট ড্রাইভারের সামনে বাড়িয়ে দিলো। ড্রাইভার বললো “ভাংতি নাই”। ফজল জানালো, “আমার কাছেও ভাংতি নাই”।

“সরি, যদি তোমার কাছে ভাংতি না থাকে তবে প্লিজ নেমে পড়ো”, একটু আদেশের সুরেই ড্রাইভার ফজলকে বলে দিলো।
ক্লান্তিতে ফজলের মেজাজ বিগড়ে যাবার কথা। কি আর করা যায়, বাস থেকে নেমে যেতে হলো। লাইনের পেছন দিক থেকে এক ইংরেজ ভদ্র মহিলা ফজলকে বাস থেকে নেমে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে মিস্টার…?”
— আমি ফজল মাহমুদ। আমার কাছে ভাংতি নেই, তাই ড্রাইভার আমাকে নেমে যেতে বললো।
— ঠিক আছে, তুমি উঠে পর আমি ভাড়া দিয়ে দিব।
— আপনি আমাকে দারুন বাঁচালেন, ফজল হাঁফ ছেড়ে বলে উঠে।

বাসে ফজল এবং ভদ্রমহিলা পাশাপাশি বসলো। এরই মধ্যে বাইরে ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে। দ্রæত গতিতে বাস চলছে। কোথায় দিয়ে কোথায় যাচ্ছে কিছুই বোঝার উপায় নাই। সেই আমাদের বাংলাদেশের অজ পাড়াগাঁয়ে যে অবস্থা, এখানে তাই মনে হচ্ছিল। রাস্তার দু ধারে কোনো লাইটপোস্টের চিহ্ন মাত্র নাই, শুধু মাঝে মাঝে সারি সারি গাছের ভিতর থেকে জোনাকি পোকার উজ্জ্বল আলো জ্বলছে আর নিবছে। কয়েক মিনিট নীরব থাকার পর ভদ্র মহিলা ফজলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি ইন্ডিয়ান?”

“না, বাংলাদেশী”, ফজল জবাব দিলো।
— ঢাকা? ভদ্র মহিলা আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
— হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি করে ঢাকার নাম জানলেন? ফজলের পাল্টা প্রশ্ন।
— আমি ঢাকায় অনেক দিন ছিলাম, ঢাকায় আমার জীবনের অনেক সুখময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
— সত্যি! ফজল অবাক হয়ে ভদ্র মহিলার দিকে তাকালো।
— হ্যাঁ, আমার নাম ডাক্তার মিসেস রহমান। বিয়ের আগে আমার নাম ছিল ডাক্তার ভিকি হিগিন্স। বিয়ের পর হলাম ডাক্তার ভিকি (ভিক্টোরিয়া) রহমান, হালকা স্বরে বললেন তিনি।
— বর্তমানে ডাক্তার রহমান কোথায় আছেন ? ফজলের এই প্রশ্নটার জন্য বোধহয় ডাক্তার মিসেস রহমান প্রস্তূত ছিলেন না।
মনে হলো কিছুটা হোঁচট খেলেন।
— মিস্টার মাহমুদ, সে এক লম্বা কাহিনী। তবে সে কথা আজ নয়, যদি কোনোদিন সময় হয় তখন বলবো। আমি এই শহর থেকে একটু দূরে চেরীহিল জেনারেল হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক্সের সিনিয়র রেজিস্ট্রার।
ফজলের হাতে একখানা কার্ড দিয়ে বললেন, “আমার ফ্লাট নাম্বার এবং ফোন নাম্বার লেখা আছে। সময় পেলে কফি খেতে আমার এখানে আসলে খুব খুশি হবো”।
— অবশ্যই আসবো। আমিও চেরীহিল শহরের “ফরেস্ট হলে” থাকি, ফজল বললো।
— ফরেস্ট হলে শুধুমাত্র ইউনিভার্সিটি ছাত্ররা থাকে। ওহ, তাহলে তুমি ছাত্র?
— জি হ্যাঁ, আমি সয়েল সায়েন্সে রিসার্চ করছি। কয়েক মাস হলো ঢাকা থেকে এসেছি।
— ভালোই হলো, তাহলে তোমার কাছ থেকে ঢাকার অনেক খবর শোনা যাবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাসটি ফরেস্ট হলের সামনে দাঁড়াল। ফজল ডাক্তার মিসেস রহমানকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে এবং তার পাউন্ডখানি নাহলে তার কি যে দূরঅবস্থা হতো সেটা কৃতজ্ঞতার সাথে আবার জানাল। তারপর গুড নাইট বলে বাস থেকে নেমে পড়লো।
হলে এসে ফজলের শুধু একটি কথাই তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। তাহলে ডাক্তার রহমান এখন কোথায়? কিন্তু প্রশ্নটির সমাধানের যখন সুযোগ নাই, তখন চুপ করে থাকাই উত্তম।

ফজল একদিন সময় মতো ফোন করে ডাক্তার মিসেস রহমানের ফ্ল্যাটে দেখা করলো। মিসেস রহমান তার সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমে ফজলকে বসালেন এবং সবিনয়ে অনুমতি নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। এই অবসরে ফজল ঘরখানার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। হঠাৎ করে কেউ ঢুকে পড়লে যে কোনো লোক ভাববে, এটা কোনো বাঙালির ঘর। দেয়ালের গায়ে তিনটি সুন্দর পেইন্টিং। শিল্পীর নাম পড়ে জানলো ঢাকার এক বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা। শো – কেসে বাংলাদেশের তৈরী নানা ধরনের সুভিনিয়ার। সবই রং বে-রংয়ের মাটির তৈরী। কলসি কাখে গায়ের বধূ চলছে পানি আনতে, লুঙ্গি পড়া, খালি গায়ে চাষী হাতে করে মাছের গোছা নিয়ে আসছে তার কুঁড়ের ঘরে। এমনি আরো নানাধরণের মাটির তৈরী মডেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে মিসেস রহমান একটা ট্রেতে করে কফি এবং কিছু ক্যাডবেরি চকলেট বিস্কিট নিয়ে আসলেন। কফি খেতে খেতে মিসেস রহমানের সাথে হালকা কথা শুরু হলো। একথা সে কথার মাঝখানে তিনি বলতে লাগলেন তার না বলা কাহিনী।

তিনি বললেন, “১৯৬৬ সালে আমিনের সাথে আমার প্রথম দেখা। আমি সবে ডাক্তারি পাস্ করে স্টকপোর্ট হাসপাতালে ঢুকেছি। আমিন তখন ওই হাসপাতালে সার্জারিতে কাজ করতো। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সেরা ছাত্র। আমাদের পরিচয় হওয়ার দেড় বছর পর আমরা বিয়ে করি। সে বছরই আমিন এফ,আর,সি,এস পাস্ করে। আমিনের পাস্ করার পরপরই আমরা ইংল্যান্ডে না থেকে সোজা ঢাকায় চলে গেলাম। ঢাকতেই আমিন প্রাকটিস শুরু করে দেয় এবং কিছু দিনের মধ্যে সে একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক হিসাব সুনাম অর্জন করে ফেলে। একাত্তরের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন সারা দেশের লোককে ভাবিয়ে তোলে, তখন আমিনকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। যদিও সে একজন ইংরেজ মেয়েকে বিয়ে করেছিল সে মনে-প্রাণে ছিল একজন খাঁটি বাঙালি”। খানিকক্ষণ থামলেন মিসেস রহমান, তারপর আবার বলা শুরু করলেন, “আমিন গোপনে গোপনে অন্যান্য ডাক্তারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতো।

কারো জানার উপায় ছিলো না, খুবই সতর্কতার সাথে ওরা এ কাজ করে যেত। পরে কি ভাবে জানি কথাটা পাক বাহিনীর কানে গেলো, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ওরা কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনতে পারিনি। একদিন বন্ধুদের অনুরোধে আমিন সিলেটের তামাবিল এবং ভারতের মেঘালয় বর্ডারের কাছে মুক্তি বাহিনীদের এক ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য সেখানে যোগ দিলো”। ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠলো, এক্সকুজ মি বলে তিনি উঠে টেলিফোনটা রিসিভ করলেন। কিছুক্ষণ আলাপ হলো, সম্ভবত তার হাসপাতালের সাথে। তারপর ফিরে এসে ফজলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আরেক কাপ কফি হয়ে যাক কি বলো?”

“আপত্তি নেই” ফজল জানালো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দু কাপ কফি নিয়ে ফিরে এলেন মিসেস রহমান। দুজনেই বসে আছে, কোনো কথা নেই। ফজল আঁচ করতে পারলো তিনি অসমাপ্ত কাহিনী নিজেই বলবেন। সুতরাং তাকে অনর্থক তাড়া দিয়ে কোনো লাভ নাই। হয়তোবা খানিকটা সময় নিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য।

কিছু বিরতির পর তিনি আবার শুরু করলেন তার কাহিনী, “আমিনের সিলেট যাওয়ার তিন দিন পর একটা টেলিফোন পেলাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে। জরুরি বার্তা, আমাকে তারা ডেকেছে কি নাকি তাদের দরকার আছে। আমি ব্যাপারটা ঠিক বুজতে পারলাম না। কয়েকজন বন্ধু -বান্ধবকে টেলিফোন করলাম। তারা উপদেশ দিলো ব্রিটিশ দূতাবাসের সাথে আলাপ করতে। সেখানে যোগাযোগ করতেই তাদের একজন বললেন যে, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। ভদ্রলোক আসার পরই আমি বুঝতে পারলাম তিনি এই ব্যাপারে কিছু একটা জানেন এবং আমার সাথে ক্যান্টনমেন্টে যাবেন। তার কথায় আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম। গাড়িতে উঠে দুজনে রওয়ানা দিলাম। ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি আসতেই তিনি আমাকে শুধু বললেন, আমি যেন কিছু দেখে মুষড়ে না পড়ি। আমাকে হয়তো কষ্টকর কিছু দেখতে হতে পারে। আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেলাম না, তবে বুকের ভিতরটা একটা অজানা ভয় ক্রমে দানা বেঁধে উঠতে লাগলো। বন্দুকধারী নানা সৈন্যের বাধা পার হয়ে আমরা একটা একতলা ব্যারাকের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। ভিতর থেকে একজন সামরিক অফিসার বের হয়ে এলেন এবং আমাদেরকে নিয়ে গেলেন একটা হল ঘরের ভিতরে। হল ঘরটির ভিতরে ঢুকতেই একটা ভয়ঙ্কর উৎকট গন্ধ ভেসে আসলো। বমি আসার মতো অবস্থা। এরই মধ্যে আমার নজরে পড়লো কয়েকটি লাশ সাজিয়ে রাখা হয়েছে সনাক্ত করার জন্য। প্রতি লাশই রক্তাত্ব, আর বিক্ষত। কোনোটাই ঢাকা নয়। আমি নিজে ডাক্তার হয়েও কখনো এরকম পরিস্থিতির সম্মুখন হইনি। আমার গা কাটা দিয়ে উঠলো। মাথাটাও ঘুরছিলো। দূতাবাসের ভদ্রলোক আমার একটা হাত আলগোছে ধরে নিলেন। আমি একটা আশ্রয় পেয়ে হাটতে শুরু করলাম। কয়েকটা লাশের পর আমিনের লাশ দেখলাম”।

তারপর চুপ করে গেলেন ডাক্তার মিসেস রহমান। ফজলের তো কোনো কথা বলার প্রশ্নই উঠে না। অনেকক্ষণ পরে তিনি
আবার মুখ খুললেন, “জানো, আমিন কেন মারা গেলো? আমিনের পিছনে আল-বদরের এবং মিলিটারির লোক বরাবরই লেগে ছিল। যখন তারা জানতে পারলো যে, আমিন সিলেটের তামাবিল এলাকায় “মুক্তি গ্রামে” গিয়েছে, তখনই তারা ভাবলো এটাই উপযুক্ত সময় আমিনকে শেষ করে দেওয়ার। তাদের এও ধারণা হলো যে মুক্তিযোদ্ধাদের আখরা সেখানেই, অতএব চালাও অপারেশন। আমিনকে তারাতো তো পেলোই সাথে সাথে সে গ্রামের অনেক নির্দোষ লোককে হত্যা করলো। কি অমানুষিক ঘটনা, তাই না!
আজ আমিন নেই ভাবতেও কষ্ট হয়। ওর কথা মনে হলে বুকটা ফেটে যায়। ওর স্মৃতিটুকু নিয়ে বেঁচে আছি। আমার কাছে সে দেবতা আর বাংলার জনগণের কাছে সে নেপথ্যের মুক্তিযোদ্ধা, এক কালজয়ী দেশ প্রেমিক”।

ফজল ডাক্তার মিসেস রহমানের মুখের দিকে তাকালো। তার দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। সে দেখতে পেলো, এই বয়ে যাওয়ার অশ্রুর সাথে তার মায়ের অশ্রু, বোনের অশ্রুর কোনো পার্থক্য নেই। অশ্রুর ভাষা তো মানুষের ভাষা। সাদা কালোর কোনো ভেদাভেদ নাই। নেই কোনো রঙের বাহার। অশ্রুর মাঝে একাকার হয়ে আছে শুধু বেদনা ও উচ্ছাস।

(পুনশ্চ: পাঠক, ধরে নিবেন গল্পের ঘটনাটি কয়েক বছর আগের- লেখক ), (নিউবারি পার্ক, ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড )
email :- quadersheikh @gmail com