কৃষক

হাজার বছর ধরে পাতে খাবার তুলে দিতে
দানবীয় কর্মঠ দেহের ইস্পাতকঠিন পেশির বিস্তারে
পৌরাণিক চিরযোদ্ধার মতো এগিয়ে যাও
আদিগন্ত ফসলের ক্ষেতে আলপথ ধরে অদৃশ্য মায়ার টানে।
শত ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে তোমাকে দেখে
হেসে ওঠে থানকুনি লতা, ঘাস ফড়িং
ল²ীপেঁচা আর ডাল উজাড় করে ফুটে ওঠা ফুল।
শ্রমে আর সৃষ্টিশীলতায় মাতিয়ে তোলো শস্যপূর্ণ ধরিত্রী
ডানাময় ওম মেখে সাক্ষী থাকে প্রজাপতি
অথচ কতকাল হয়নি রান্না, অভুক্ত তুমি
তোমার খালিপেটে করাত চালিয়ে
নীল নিশানা তোলে কেউ আকাশ ছাপিয়ে।
নতুন ফসল আসবে বলে বুকে আশা বেঁধে রাখো
মহাজনেরা যেমন তাদের গোডাউনে শস্য মজুত রাখে।
অগ্রহায়ণে ধানের নৌকা ভেসে আসে ঢেউয়ের আদরে
নৌকোর সব ধান নিয়ে যায় মহাজন এসে
ফুল ফোটানোর যন্ত্রণা বুকে চেপে
তোমার গোপন কষ্টগুলো ঢেকে রাখ দুঃখের চাদরে।
মাজরা পোকা, শ্যামা পোকা যেমন তোমার কষ্টে
ফলানো ধানের গাছের রস চুষে চুষে খায়
তেমনি চিল, বাজপাখি নেকড়ে আর ইঁদুরেরা খুবলে নেয়
একে একে স্বপ্ন-বুকের পাঁজর-মেরুদন্ড-কোমল হৃদয় ও শরীর…
রোদের তাপে অনাবৃষ্টিতে ধীরে ধীরে শুকিয়ে
যাওয়া ধানের চারার মতো শুকিয়ে গেছে তোমার জীবনরস।
সমস্ত অবহেলা, তাচ্ছিল্য, বঞ্চনাকে ভ্রুক্ষেপ না করে
অনাহারি দিনগুলোকে পিছনে ফেলে
তবু তুমি জীবনের আদিটাকে রাখনি অনাবাদী।

কবিতা

কবিতা সে তো প্রেমেরই অনুবাদ
কাগজ আর কলমের গভীর অনুরাগ
অক্ষরগুলোতে লেগে থাকা স্বপ্নের পরাগ
ভালোবাসার অন্তরে হয়তোবা বিষাদ;
যেন কোনো অন্ধকারে জ্বলে ওঠা জোনাকপাখি।
কবিতা সেতো প্রেমিকার কাঁপা হাতে
ঝাপ্সা লেখা এক চিঠির অপঠিত লিপি।
কবিতা, সেতো হৃদয়ের প্রতিবেশি
শস্যের সবুজ ক্ষেত, স্রোতস্বিনী নদী,
ফসলের মাঠ আর রোদে ঝিলমিল দীঘি
সে তো সকালবেলার পাখির ডাকাডাকি
জীবনের জলছবি আঁকা
ছায়াবীথির পাশ দিয়ে বয়ে চলা গ্রামের
নদীর কোলেই মাথা রেখে শুয়ে থাকে কবিতা,
তন্ময় হয়ে শোনে তার জলের ঢেউ-এর সুর।
সে তো বাঁশ বাগানের মাথার উপরে ওঠা চাঁদ
সাঁওতাল পল্লী থেকে ভেসে আসা মাদলের শব্দ
ঘোর লাগা বর্ষায় মাঝি মাল্লার গান
সরষে ক্ষেতের হলুদে ডুব দেয়া স্কুলপড়ুয়া বালক,
হোস্টেলে থাকা সন্তানকে লেখা
মায়ের আদরমাখা চিঠির সুললিত ভাষা।
গ্রামের আলপথে নিজের মনে গেয়ে যাওয়া বাউলের গান
সে তো বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার ভাষণ।

গ্রীষ্মের টরন্টো

আমি কোলাহল থেকে দূরে সরে যাই
একটি ঘুমপাড়ানি গানের গুনগুন
নিঃসঙ্গ গ্রীষ্মের পথে
এক ঝাঁক হাঁস উড়ে আকাশ জুড়ে
মেঘের মধ্য দিয়ে হর্ন বাজিয়ে
আমি তাদের দিকে তাকাই না
তারাও আমার দিকে তাকায় না
প্রত্যেকে আমাদের নিজস্ব ভ্রমণ চালিয়ে যাই।
ডন ভ্যালির সরু নদীর পথে
গাছের ভিতর দিয়ে হাঁটছি
বাতাস গাছের মধ্যে দিয়ে ফিসফিস করে
যেন মৃদু পিয়ানো সঙ্গীত বাতাসে ভেসে আসে।
তারা আলতো করে দোলে
যেন সীমাহীন আনন্দের ঢেউ এসে দোল খায় প্রাণে
ঘন ম্যাপল পাতার ফাঁক গলে
অঢেল গনগনে শাদা রোদের তেজ ঝরে পড়ে
অজস্র বুনোফুলের ঘ্রাণে সবুজ লাবণ্যের ঢেউয়ে
সারাদিনের ক্লান্তি মুছে দিয়ে
হৃদয়কে দেয় আনন্দে রাঙিয়ে।
প্রবল ঘূর্ণিস্রোতের সাথে নির্জন নুড়ির একটি স্তূপ
লেক অণ্টারিওর পাড়ে আছড়ে পড়ছে,
যেন অতীত আছড়ে পড়ছে মনের চৌহদ্দিতে।
কী নিস্তব্দ চারিদিক, অথচ কী কোলাহল বুকের ভিতর!
বালুকাময় পায়ে স্রোতের দিকে তাকিয়ে হাঁটছি
আমার হৃদয় সবুজ চোখ দিয়ে আকাশের নীল পান করছি
স্বপ্নের মরীচিকা ধরার আশায়।
ভ্যানিলা-গন্ধযুক্ত সাঁঝের বাতাস
এবং চটচটে তাপে তৃপ্ত দীর্ঘশ্বাস
উষ্ণ উজ্জ্বল রোদে ভেজা ত্বক
এবং রাত পর্যন্ত দিনের আলো
ডন নদীর তীরে,
আমি একটা পুরনো গান গাই
যা চলে গেছে তা চলে গেছে।

চশমা

তুমি যেন আমার জীবনের চশমা
চশমার যেমন নাকের উপরে থাকতে থাকতে
মানুষের শরীরের অঙ্গ হয়ে যায়
তুমিও তেমন আমার ঠোঁটে ঠোঁটে
সোহাগে সোহাগে থেকে হয়েছো আমার অর্ধাঙ্গিনী।
যেমন কখনো কখনো মাথার উপরে রেখেই চশমাটা খুঁজি
আমার গায়ে মিশে থাকলেও আমিও তোমাকে
সেরকম কখনো কখনো খুঁজি।

তা ছাড়া আমিও চশমার মতো তোমার দিকে
তাকিয়ে থাকিনা, বরং তোমার ভেতর দিয়ে
তাকিয়ে আমি দুনিয়া দেখতে পাই, জীবন দেখতে পাই।
তোমার ভেতর দিয়ে দেখতে পাই
যতটুকু আলোয়
তার চেয়েও বেশি অন্ধকারে…
লাল রঙের শাড়িতে
তোমার রঙিন কাঁচের শরীরে
জীবন সুন্দর দেখায়।

অপেক্ষায় আছি

এতদিন কোথায় ছিলে,
তোমাকে দেখার আশায়,
আমি শুধু আমাদের মনের ছায়া দেখি,
আমি কালের সুচনা থেকে তোমাকে দেখার অপেক্ষায় আছি
তোমার অপেক্ষায় অনন্তকালের একটি ভাল অংশ কাটিয়েছি।
আমি উত্তর মেরুতে বরফসমুদ্রের নিচে তোমার অপেক্ষায়
তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি পর্দার আড়ালে, মুখোশের পিছনে,
আমার চোখের জল দ্বারা চিহ্নিত মানচিত্র নিয়ে হেঁটেছি
শতাব্দিপ্রাচীন অন্ধকারে, পাথরের ফুল মাড়িয়ে
আমি জনতার জোয়ারের ভিড়ে
তোমার মুখ খুঁজতে থেমেছিলাম,
আমি জলের দিকে প্রশিক্ষিত আমার দৃষ্টি নিয়ে
বাতিঘরের মতো দাঁড়িয়েছিলাম।
অপরিচিতদের মধ্যে তোমাকে টুকরো টুকরো দেখেছি
আমি প্রস্থান করেছি…
কেউ শুনতে পারেনি না আমার কান্না,
তোমার নাম উচ্চারণ।

হয়তো তোমার ট্রেন স্টেশনে থামেনি।
হয়তো আমি তোমাকে মিস করেছি।
জানি সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না
সময়ের পায়ে চুলকানি আছে
ট্রেনটি আমাকে ধরার আগে এটি ধরার দায়িত্ব আমার।
এটা একটা অপেক্ষার খেলা।
অপেক্ষার শেষ নেই কখনো
ভাঙা, বিদীর্ণ মনে আমি আছি অপেক্ষায়, অপেক্ষায়
হয়তো তুমি এই জন্মেই সব ভুলে পাখির মত ডানা ঝাপটে
উড়ে ফিরে আসবে তোমার সব রঙ নিয়ে।

সুন্দরবন

এ এক বিপন্ন সৌন্দর্যের নাম
যেন রাতে ম্রিয়মাণ আলোর
নিচে ফ্লাইওভারের এক পাশে দাঁড়িয়ে
ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক ভ্রæ পল্লবে রঙ মাখা
সেই এলোকেশী বনিতা,
খদ্দেরকে তুষ্ট করার জন্য যে
ছেনালের মতো শুধু হাসছে।
কোলাহলে যার বেঁচে থাকার
আওয়াজটাই শোনা যায় না
কেউই তার কথা শোনে না
মায়ের মত আগলে রাখে না।
বনবিবি, দক্ষিণরায়কে দেয়া পুজো
দরগায় দেয়া মানত ধুপ আগরবাতি
লোবানের ধোঁয়াটে গন্ধও ফেরাতে পারে না
সুন্দরী গেওয়া এবং গোলপাতা গাছের মুখে হাসি,
পারেনি উপশমের নরম প্রলেপ দিতে
সাইক্লোন সৃষ্ট ক্ষত পুষে রাখা বুকে।
গোলপাতার ঝোপে মায়ের সঙ্গে খেলতে থাকা
ব্যাঘ্র শাবক কি জানে ওদের বাক্য বোঝাই জীব
সেবার চিৎকৃত প্রতিশ্রুতির আড়ালে গোপন আস্তিন
বোঝাই রক্তলোলুপতার অন্তহীন আয়োজন।
কিংবা খালের জলে সদ্য ঠোঁটে মাছ
ধরা সারস বা বালুচরে হাঁ করে শুয়ে থাকা
কুমিরের দাঁত থেকে খাদ্যকণা খুঁটে নেওয়া
কতগুলো সুন্দর সাদা পাখির চোখে কি
খেলা করে জ্যোৎস্নার গাঙচিল না লোভের
হলুদ শিখা লেপ্টে দেওয়া শিকারির চোখ
তাকে তাড়া করে। বা রোদ পোহাতে
হেতালের ঝোপের ওপর বিড়ে পাকিয়ে শরীর এলিয়ে
দেওয়া শঙ্খচূড় কি এতসব খবর রাখে?
ঘুরেফিরে সেই তারা
যাদের লোভের হলুদ শিখা লেপ্টে
দেওয়া শিকারি চোখের চাবুক এসে
লাগে অবুঝ চিত্রা হরিণের বিহŸল চোখে।
মানুষ আর বন্যপ্রাণের নিঃশব্দ সংঘাত
মানুষ বনবিবি, দক্ষিণরায়কে পুজো দিয়েছে,
মানত করেছে দরগায় কিন্তু অবস্থা বদলায়নি।
প্রকৃতি, মানুষ, বন্যপ্রাণ সব নিয়েই এই বন সুন্দর।
যেখানে অন্যান্য বন্যপ্রাণের সঙ্গে বাঘও
লড়ছে মানুষের ভোগবাদের বিরুদ্ধে।

শিশুর কান্না

মধ্যরাতে পাশের বাড়ির ভেতর থেকে
একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে
জানালার ধারে শিশুটি হাত-পা ছেড়ে কাঁদছে,
কান্নার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।
হতে পারে তার পেটে গ্যাস হয়েছে,
অথবা ক্ষুধার যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছে।
কিন্তু হে স্বর্গদূত শিশু, আমার মনে হয়,
তুমি জীবনের অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ করছো,
যদিও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন তোমার নয়, তবুও
আমি তোমার স্পষ্টভাষার প্রশংসা করি।

কান্নারত শিশুর কণ্ঠস্বর আমাকে বিস্মৃতির
এক রূপ থেকে অন্য রূপে তলিয়ে দেয়,
যাই হোক–এটা চালিয়ে যাও, ছোট্ট অত্যাচারী!

শীঘ্রই তুমি কথা বলবে, আর ভাষা
তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
তুমি অস্পষ্ট, অসংলগ্ন জিনিস বলবে
এবং খারাপ রসিকতা করবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার সরব
প্রতিবাদ খুবই প্রত্যক্ষ, খুব কার্যকর,
এটা আমার মাথার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।