জৈবিক মানুষ

একটিবারও পিছু না ফিরে
আঁধারের সবটুকু রং গায়ে জড়িয়ে হেঁটে যাও –
নিষিদ্ধ ঋণাত্মক অক্ষের সমাধিতে,
কালো ঘোমটা ঢাকা অভ্যস্ত মুখের আলিঙ্গনে।

তোমার পথের পাশে অলক্ষ্যে নিত্য দাঁড়িয়ে থাকে
যে নির্বাক মূর্তি –
তার পাথর দৃষ্টিতে তুমি দেখনি
কোন বয়ে যাওয়া নদী, ঝরনা
কিংবা
ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের ভগ্নাবশেষ।

হে নির্বোধ পাথরপ্রতিমা,
বিভ্রান্ত তুমি কেন ফিরে যাও –
উপেক্ষিত যুগ্ম রেললাইন ধরে,
একাকী হেলিপ্যাডের অন্ত:স্থলে।

তোমার প্রশস্ত বুকে জমে আছে
কত বর্ণমালার হুড়োহুড়ি,
সেখানে নক্ষত্রপতনের মত লুটোপুটি খায় –
ষড়ঋতুর ঋতুময় অধ্যায়।

আত্মসম্মান বা আত্মাভিমান
যে দোষেই তাকে দোষারোপ করো না কেন,
তোমার ওই তোয়াক্কাহীন হেঁটে যাওয়া,
তাকে টেনে হিঁচড়ে বারবার ফেলে দিচ্ছে –
সংকুচিত রেললাইনের শীতার্ত সঙ্গমে।
তোমার বিশ্বাসের দাবানলে
আহত প্রতীক্ষা পুড়ে হয় ছাই –
ধুলো হয়ে যাওয়া হৃদিত হৃদয়।

কত মানুষ শুধুমাত্র
একজন মনের মানুষের অভাবে
মরে যায় –
তা বুঝতেও পারে না
জৈবিক জীবন্ত মানুষগুলি।

 

শকুনের চোখে প্রেম

তোমার শর্তসাপেক্ষ অবসরের প্রেমে –
আমি মগ্ন হই।

প্রতিমুহূর্তে ছুঁয়ে যাই –
একটুর জন্য না ছুঁতে পারা দিগন্তকে।
অমাবস্যার অবশ্যম্ভাবী চাঁদ এঁকে দিও
আমার কপালের বাঁকা টিপে।
ক্ষয়ে যাওয়া ভালোবাসায় পুড়ে ছাই-
বুকের গরাদ।
ধূসর পাগলামির ছিঁটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই-
তোমার শাব্দিক অধিকারে।

তোমার শর্তসাপেক্ষ অবসরের প্রেমে
আমি মগ্ন হই।

তোমার পরিপার্টি চুলে বিলি কাটে
আমার বিবাগী হাত,
বৃষ্টি ভেজা আঙ্গুলেরা
মাদকতায় বুদ হয় –
পুরুষকার পৌরুষের গভীরতায়।
এ ঠোঁটে একটু বিস্ফোরণ-
ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত।
কাল যখন না ছোঁয়ার মত করে ছুঁয়ে গেছো
আমার সমস্ত ঘুমন্ত গহীন আহ্লাদ,
তখন আমি আরও দু’পা এগিয়ে –
তোমার ঔরসের স্বপ্ন দেখেছি
আমার সারা আকাশ জুড়ে।

আমি ফিরব না আর কোনদিন
তোমার বুকের আঙিনায়।
তোমার চতুর্ভুজ দৃষ্টির প্রান্তিক প্রান্তরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে –
ত্রিভুজ ভবিতব্য ও বহুভুজ পূর্বপুরুষ।
তোমার মৃতপ্রায় স্বপ্নে বিভোর শরীরে –
বেদব্যাস এর জিহŸার বিভ্রান্তিতে দেবদাস হয়।

তোমার শর্তসাপেক্ষ অবসরের প্রেমে –
আমি মগ্ন হই।

যৌবন উজাড় করা
এক ঝাঁক ড্যাফোডিল ফুটেছে –
আমার বাগানে,
তার ঠিক মাঝখানে
ছোট্ট নরম পাখায় উড়ে বেড়াচ্ছে
এক দেবী শিশু।
আমার গর্ভে কান পেতে
তুমি একদিন শুনেছিলে
তার আগমনের প্রতিধ্বনি,
তোমার ভালোবাসার চিরন্তন চিহ্ন।

তোমার শর্তসাপেক্ষ অবসরের প্রেমে –
আমি মগ্ন হই।

তোমার ফিরে আসার পথ-
যতই দীর্ঘ হোক না কেন,
আমি আজীবন দাঁড়িয়ে থাকব –
তার শেষ প্রান্তে।
শকুনের চোখ খুঁজে ফেরে মৃত শরীর,
মৃতপ্রায় মনের দহন সে বোঝে না।
আমি তোমার জন্য –
উড়নচণ্ডী বা ভবঘুরে-
যে কোন কিছুই হতে পারি,
শুধু পথের শেষে গড়ে দিও –
আমাদের সংক্ষিপ্ত সংসার।
অস্থির, অবসন্ন, প্রত্যাখ্যাত বিকেলে-
অনাহুত এর মত অবহেলায় তলিয়ে যাচ্ছি আমি,
আমার রবাহুত, তুমি
লুকিয়ে যাচ্ছ
তোমার প্রিয়তমার অন্ধকার শরীরে।

শকুনের শহর

শরীর সর্বস্ব এ শহরে
শকুন শুধু মাংস খুঁজে ফেরে,
কিছু রুগ্ন, মাংসহীন মানুষ মৃতপ্রায় হলেও-
এখনো নিদারুণ বেঁচে আছে ছিটেফোঁটা মন নিয়ে।

এ শহরে মনের কারবার ঝাঁপ বন্ধ করেছে অনেক আগেই,
এখন শুধু শরীরে শরীর গন্ধ ছড়ায়,
আঙুলে আঙুল স্পর্শে জড়ায়,
আলিঙ্গন করে,
চুম্বনে চুক্তিবদ্ধ হয়।
এ শহর চোখে চোখ রাখেনি বহুকাল ধরে,
মন উঁচাটনে ছটফট করেনি –
সহস্র অভিমানী অনিদ্র রাত জুড়ে,
এ শহর কান্নায় ভেজেনি –
কোন ক্লান্ত দুপুর বা একাকী বিকেলে।

এ শহর আর তুচ্ছ পান্তা ভাত নিয়ে-
অপেক্ষা করে না প্রেমিকের পথ চেয়ে,
কিংবা সামান্য একটা ফুল ফুটলে গুঁজে দেয় না-
প্রেমিকার খোঁপায় গিয়ে /নিয়ে।

এ শহর অভিমানী হয় না,
সম্পৃক্ত হয় না, সমর্পিত হয় না।
এ শহর অপমানে মাথা নুইয়ে ফেলে না
বা উচ্চ রক্তচাপে উ™£ান্ত হয় না,
এ শহর অপমানে উপবাস থাকে না
কিংবা বোবা আঙ্গুল ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় না।

এ শহর শুধু মিথ্যে স্বপ্ন দেখায় –
জীবনবোধ পরিবর্তনের,
এ শহর শুধু মিথ্যে স্বপ্ন দেখায় –
মৃত মানুষের বেঁচে ওঠার।

কিছু রুগ্ন মাংসহীন মানুষ
আজও শকুনের মন খুঁজে ফেরে,
কিংবা ছিটেফোঁটা মন আছে বলেই হয়তো-
কিছু কিছু নামমাত্র মানুষ আজও
শকুনের প্রেমে পড়ে,
শকুনকে প্রেমিকের আসনে অধিষ্ঠিত করে।

সাদা পথ

বাস্তবে না হয় নাই এলে
অন্তত স্বপ্নে আসতে দোষ কি তোমার?
স্বপ্নে তো –
কোন কাঁটাতারের বেড়া থাকে না,
কোন আকাশের সীমানা থাকে না,
কোন জলসীমার বাধা নিষেধ থাকে না,
কোন লোক লজ্জার উৎপীড়ন থাকে না,
কোন সংসারের চোখ রাঙানিও থাকে না।

তবে একটু দয়া বা করুণা করে
স্বপ্নে আসতেও এত বাধা কোথায় তোমার!

তুমি না হয় আমার স্বপ্নেই থাকো
আমার নটরাজ হয়ে,
কিংবা নিঝুম মধ্যরাতে –
একজোড়া বন্ধুময় বালিশ হয়ে।
তুমি না হয় এক দোটানা চুম্বনে
ভরিয়ে রাখো আমার স্বপ্নময় সারাটা দিন,
তুমি না হয় একটু পাগলামি আর খুনসুটিতে
মাতিয়ে দাও সমস্ত ক্লান্ত ক্ষণ,
তুমি না হয় যাবার পথে
এক পলকের একটু দেখায়
লুকোচুরি খেলো সারাটা জীবন।
আমার নির্ঘুম রাতে যেটুকু অবশিষ্ট ঘুম
সেটুকু জুড়ে অন্তত তুমি দাপিয়ে বেড়াও
এক ব্যক্তিগত প্রিয়তমের মত।

অভিমান ফেলে এসেছি পথের শুরুতেই,
মধ্য পথে ভিড় করেছিল রাগেদের অন্তরায়,
এখন শুধু –
অভ্যাস নয়, ভালোবাসা নয়,
অস্তিত্বের সাথে মিশে তুমি হয়তো
আমার নিয়তি হয়ে গেছ।
আত্মসম্মান আর ভালোবাসার দোটানায়
বেহায়া প্রেম
পথের ধুলোয় মিলিয়ে যেতে যেতেও
জয়ী হয় বারবার।

কোন ছোট্ট অবকাশে
আমার ফেরবার পথটা
কেউ চিরতরে মুছে দিয়ে গেছে
সাদা কাগজের মত করে।

আমার বিস্ময়কেও বিস্মিত করে
তোমার নির্লিপ্ত আন্তরিক উপেক্ষা।

তোমাকে পাওয়া হয়নি কোনদিনও,
তবুও কেন তোমাকে হারানোর যন্ত্রণায়
আমি মরি বারংবার!
যে তোমাকে কোনদিনই কোনভাবেই
পাওয়া হয়নি বা হবে না আমার।
নিজের অজান্তেই আমি হয়ে গেছি সর্বস্ব সেই তোমার।

 

মনের ঘুন

তুমি অভিমান করলে,
সে মান ভাঙ্গাতে
এক অথৈ আকাশ জুড়ে চুরমার হয়ে
আমি ভেঙে পড়তেই পারি।

তোমার অনুরাগ হলে
সেই অনুরাগ আরো একটু উসকে দিতে
এক অগ্নিময় সমুদ্র
আমি বেবাক বায়বীয় করে দিতেই পারি।

শুধু ভয় হয়-
তুমি যদি আমাকে উপেক্ষা করো,
আর না বুঝে আমি
উপর্যুপরি অপেক্ষায় তোমাকে অতিষ্ঠ করি

একবার ভালো যখন বেসেছি –
তোমার প্রয়োজনে আজন্মকাল
তোমার কাছে আমি আসবোই,
কিন্তু আমি তোমার কাছে
উদ্বৃত্ত বা উপেক্ষিত হলে
ভালোবাসার শেকড়ে ধরবে ঘনিষ্ঠ ঘুন।

ভালোবাসার মুখাগ্নি

তোমার ক্ষণিক অবসরের প্রিয়তমা
একটু একটু করে হেঁটে চলেছে
মৃত্যুর পথ জুড়ে,
যে শরীর তুমি ছুঁয়ে ছিলে আনমনা আকাক্সক্ষায়
তা ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছে
জ্বলন্ত চিতার অভিমুখে,
তোমার প্রতিটি চুম্বন দগ্ধ হবে,
প্রতিটি দহনে রিক্ত হবে-
তোমার স্পর্শের সমস্ত অনুভব,
যে হৃদয় তোমাকে দিয়েছিল
প্রলম্বিত আক্ষেপের সমাধান সমীকরণ,
সে আজ শামুকের খোলসে
নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে
অসহায়, উপেক্ষিত, বেভুলা অক্টোপাসের মতো।

অভিকর্ষের প্রথম প্রহরে-
যাকে তুমি ভালোবাসি বলেছিলে,
উপেক্ষার শেষ প্রহরে –
তার চিতায় জ্বেলেছ ভালোবাসার শেষ মুখাগ্নি।

শোধ

আমি তো করিনি তোমায় কোন অপমান,
কেন টেনে নিলে তা নিজের গায়ে।
আমি শুধু ছিলাম আমার নিজের মতোই,
তুমি ঠেলে ফেলে দিলে তোমার পায়ে।
আমি তো তোমাকে চাইনি জীবনে
তুমিই আমাকে চেয়েছো,
কতবার ফিরায়েছি কত ছলনায়,
তুমি বুকে লুটায়ে পড়েছ।

সেদিন যা ছিল শুধু ধুকধুকানি,
নদী পাড়ে বিড়ম্বনা বৃষ্টি নিয়ে।
যাওয়া আর ফিরে আসা জীবন তরী,
শোধ আর প্রতিশোধের দৃষ্টি দিয়ে।

আমাকেও বেঁচে দাও খোলা বাজারে,
বুকের খাঁচার দুয়ার বন্ধ করে।
তুমি শুধু জয়ী হও জীবন ভরে,
আমার সমাধিটাকে মঞ্চ করে।