আতোয়ার রহমান : খোলা কবরস্থানের প্রশস্ত গেটের ভেতর দিয়ে যখন রাশেদ ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিল, তখন তার পায়ের পাতায় হেমন্তের শেষ বিকেলের শীতল হাওয়া লেগেছিল। প্রশস্ত পার্কিং লটে গাড়ি রেখে মোবাইল ফোনে থাকা অর্ডার নাম্বার মিলিয়ে নিয়ে অফিসের দিকে হাঁটছিল, গেটেই স্টেফানির স্মিত হাসিমুখে রাশেদকে হাত ইশারা করে ডাকল।
-হাউ আর ইউ রাশেদ, টুডে? থ্যাঙ্কস ফর মাই ফুড।
-আই আম ফাইন। ইঞ্জয় ইউর ফুড।

বার্চমাউন্ট রোডের এই প্রাচীন ‘পাইন হিল’ সেমেট্রিতে খাবার ডেলিভারি দিতে দিতে এর স্টাফ স্টেফানির সঙ্গে তার বেশ খাতির জমে উঠেছে। বিশেষ বন্ধু হয়ে উঠেছে স্টেফানি। সে এখানকার শেষ কৃত্য পরিচালক। সে শুধু শেষযাত্রাই নয়, শেষবারের মতো পরিপাটি সাজিয়ে তোলেন মৃতদের।
এখানে খাবার ডেলিভারি নিয়ে এলে এর ভেতরে একটু চক্কর মারা ওর রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশেদ আগে বহুবার এটার পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেছে আর জায়গাটার শান্ত, স্নিগ্ধ সৌন্দর্য নিয়ে ভেবেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছে কখনও গ্রীষ্মের উজ্জ্বল দিনে হাইড্রেনজিয়ার ঝকঝকে ফুটে থাকা অথবা হেমন্তের হাল্কা মিঠে রোদ্দুরে ওক, মেপলের লাল, হলুদ, কমলার অপার্থিব রঙবাহার।

রাশেদের ঔৎসুক্য টের পেয়ে স্টেফানি বলল,
-কবরস্থান ঘুরে দেখতে চাও, তোমার হাতে সময় আছে?
বিকেল বেলায় ডেলিভারির এই পিক আওয়ারে কবরস্থানের চারপাশে ঘুরতে মন চাইছিল না। কিন্তু এর শান্ত স্নিগ্ধ দৃশ্য ও অদৃশ্য সৌন্দর্যের কাছে হার মানল, স্টেফানিকে বলল,
-হ্যাঁ, আমার সময় আছে। চল ঘুরে আসি।
-বুঝলে রাশেদ মাঝে মাঝে কবরস্থানে ঘুরে বেড়ানো থেকে অনেক কিছু শেখার আছে,
স্টেফানি রাশেদকে বলল।

-ঠিক বলেছো। কবরস্থানে বেড়ানোর অভ্যেসটা আমার ছোটবেলা থেকেই। আমি বাংলাদেশে থাকতে আমার শহরের একটা ব্রিটিশ সেমেট্রিতে প্রায়ই ঘুরতে যেতাম। আমি বিভিন্ন সমাধিস্থল পরিদর্শন করতাম শুধুমাত্র পরিবার এবং অতীতের সাথে যোগসূত্র হিসাবে নয়, বরং আমি তাদের শান্ত, সুন্দর, শিক্ষামূলক, বিনোদনমূলক এবং সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। আমি যাদের ভালবাসি তাদের সাথে সংযুক্ত থাকার জন্য এটি একটি সহায়ক উপায় খুঁজে বের করে। তাছাড়া কবরস্থানগুলি একটি গুরুতর অনুস্মারক যে জীবনের একমাত্র নিশ্চিততা হল আমরা এটি ছেড়ে চলে যাব। কবরস্থানে এলে জীবনের মর্ম বুঝা যায়, ব্রন্মান্ডের সৃষ্টি রহস্য জানা যায়।
রাশেদের কথায় স্টেফানি মাথা ঝাঁকাল।

এরপর স্টেফেনিই ওকে টেনে নিয়ে গেল কবরখানার ভেতরে। জায়গাটা ঘুরে দেখতে দেখতে রাশেদ-স্টেফেনির চোখের হাল্কা সংকোচ বদলে গেল অপার মুগ্ধতায়। চোখজুড়নো নীল আকাশ, উঁচু, উঁচু গাছগুলোতে কচি পাতার সমারোহ, ছোট্ট পুকুরে জল টলটল করছে, তার ধারে একটা সুন্দর চার্চও দাঁড়িয়ে আছে পুরনো টরন্টোর গন্ধ মেখে। সবমিলিয়ে কী যে মন ভালো-করা শান্তি চারিদিকে। তবে রাশেদ সবচেয়ে অবাক হয়ে দেখে, বেশিরভাগ কবরের উপরে যে নামের ফলক, তার চারপাশ ঘিরে রঙবেরঙের মরশুমি ফুলের মেলা। চোখে পড়ে মৃতদের আত্মীয়স্বজন যত্ন করে পরিচর্যা করছে ফুলগাছগুলো।

প্রতিদিনের মতো আজো রাশেদ টরন্টো শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ক্যাসেটে বাংলা গান শুনে, গুনগুন সুর ভাজতে ভাজতে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। টরন্টো নগরীর বিভিন্ন সেমেট্রিতে খাবার দিতে দিতে তার মনের মধ্যে ভাবনা আসে সে যদি কখনো গ্রেটার টরন্টোর একমাত্র কবরস্থান থেকে, যা পার্শ্ববর্তী পিকারিং শহরে অবস্থিত, খাবারের অর্ডার পেত তা হলে খুব ভালো হত। কারন টরন্টো শহরের একমাত্র মুসলিম কবরস্থান পিকারিং-এ অবস্থিত। অর্ডারের খাবার দিতে কবরস্থানে যাবে। এই সুযোগে কবরস্থানটাও দেখা হবে।কভিডের সময় মারা যাওয়া বন্ধু খালেদের কবরটাও জেয়ারত করা হবে। কভিডের কারণে কবর দেয়ার সময় দূরে থাক, জানায়ায়ই উপস্থিত হতে পারেনি। এজন্য তার মনে অনেক কষ্ট।

হাজার হোক বয়স তো কম হলনা। চোখ বোজার সময় এসে গেছে। তখন তো এখানেই শেষ ঠিকানা হবে। কিন্তু এখান থেকে কোন অর্ডার সে এখন পর্যন্ত পায় নি। আবার ইচ্ছা করেও সে পিকারিং শহরে ডেলিভারি দিতে আসে না, কারণ এদিকে টিপস তেমন ভালো পাওয়া যায় না।

হঠাৎ করেই একদিন সুযোগ হয়ে গেল। সে পিকারিং গোরস্থান থেকে খাবারের অর্ডার পেল। এর প্রশস্ত গেটের ভেতর দিয়ে রাশেদ ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে প্রবেশ করল। কবরস্থানের স্টাফ ফয়সাল এর নামে খাবার অর্ডার করা হয়েছে। পার্কিং লটে গাড়িটি রেখে চারপাশে একনজর তাকালো। বিশাল কবরস্থান। জায়গাটার শান্ত, স্নিগ্ধ সৌন্দর্য আর পরিচ্ছন্নতায় মুগ্ধ হল। খাবার নেয়ার জন্য অফিস ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন ফয়সাল। হাসিমুখে খাবারের প্যাকেট টি তার হাতে দিয়ে অ্যাপে ডেলিভারি কনফার্ম করতে করতে রাশেদ ফয়সালকে বলেই বসল,
-একটা কবর খুঁজতে একটু হেল্প করবে’?
-কত নম্বর কবর?’ জিজ্ঞেস করে ফয়সাল।

-কত নম্বর তা জানিনা। তবে গত বছর কভিডের সময় কবর দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশি কানাডিয়ান। নাম খালেদ।
ফয়সাল গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে,
-এটা কোন জায়গাটা ঠিক খেয়াল পড়ছে না।
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে নেয় ফয়সাল। তারপর বলে,
-এই দিকটা ধরে খোঁজো তো, মনে হয় এ দিকেই কোথাও হবে।

মোটে ছ’টা বাজে, এখনও রোদ্দুর রয়েছে। চারিদিকে অনেক চেনা অচেনামুখ হাঁটছে। রাশেদ তাদের দলে ভিড়ল। সারি সারি কবরের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে তার চোখে পড়ে মৃতদের আত্মীয়স্বজন যত্ন করে পরিচর্যা করছে কবরগুলো। দেখে মনটা ভরে যায়।

হঠাৎ একটি কবরের পাশে থমকে দাঁড়ায় রাশেদ।বুকের ভিতরটা টিপ টিপ করতে শুরু করেছে। দেখে চমকে উঠল। কিছুটা সামনে এগোতেই চোখ খালেদের কবরের ছোট হেডস্টোনের উপর এসে পড়ল। এইতো কিছুদিন আগে রাশেদ কোডিড নাইনটিনে হারিয়েছে তার দীর্ঘদিনের এই বন্ধুকে। টরন্টোর বাঙালি সমাজে প্রথম এমন ঘটল যে বিপদের দিনে এক বিপর্যস্ত পরিবারের পাশে কেউ দাঁড়াতে পারল না। তখন শহরে শহরে লকডাউন। হাসপাতাল, ফিউনারেল হোমে যাওয়া বারণ। সেদিন নিজের বাড়ির আপাত নিরাপত্তা বলয়ে বসে থেকে বন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না, জানাজায় উপস্থিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। মানুষ যখন মরে, তখন যে সে কত একা, সেবারেই সে প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তবে কারোরই বাড়ি থেকে এত দূরে এবং এভাবে একা মরে যাওয়া কাম্য নয়। দেহ থেকে আত্মা ছিঁড়েখুঁড়ে বের হওয়ার মুহূর্তে তথা মরণ যন্ত্রণার সময় একজন তার প্রিয়জনদের কাছে পাওয়াই হয় তার শেষ ইচ্ছা। কিন্তু খালেদের সেই শেষ ইচ্ছা কেউ পূরণ করতে পারেনি।

চারপাশে উঁচু উঁচু আদ্যিকালের দাদামশাই সব গাছ। মাঝখানে সরু রাস্তা। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ এসে পড়ছে।

আকাশ যেন নীল সোয়েটার গায়ে দিয়েছে। আশপাশে রকমারি ফুল। একটি ফুল ছিঁড়ে এনে খালেদের কবরে রাখল। রাশেদ থমকে যায় কয়েক মিনিট। তারপর গুঁড়িয়ে যায় একটা নদীর বাঁধ। তার চোখের জলে বান। দুই গাল বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুতে ভিজে যায় নিচের সবুজ ঘাস। কবরের পাশে দাড়িয়ে হাত তুলে সে মোনাজাত করল, তার বন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করল।
এদিকে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। চারিদিকে নিস্তব্দতা। কোথাও কেউ নেই। কবরখানার নিশ্ছিদ্র নিরূপদ্রব স্তব্ধতার সাথে মিশে গেছে হেমন্ত শেষের নিবিড় হলুধাভ ধুসরতা। টুপটাপ পাতা ঝরে পড়ছে রাশেদের গায়ে। একসময় ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে এলো কবরস্থান পেরিয়ে। ভেজা চোখেই সে দিকে তাকালো রাশেদ।

এতক্ষণ এখানে অবস্থান তার কাছে অদ্ভুত, অবাস্তব মনে হয়, স্বপ্নের মতো মনে হয়।

সে আস্তে করে পার্কিং-লটে রাখা গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করতেই তার মনে হল যেন খালেদের কবরে তার একটি পা আটকে গেছে।কিছু একটা অদৃশ্য জিনিস যেন তাকে কবরের গায়ে একটা ছোট সুড়ঙ্গ ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সে রীতিমত ভয় পেয়ে গেল। আচমকা দৌড় দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সে গাড়িতে গিয়ে বসল। এক ঘোরের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সে গাড়ি চালাতে শুরু করল। মনে হল এক খন্ড কবর যেন তার পিছে পিছে ছুটে চলেছে। যেতে যেতে দেখতে পায় বা অনুভব করে কেউ একজন পিছু পিছু হেঁটে আসছে তার। রাশেদ দ্রুত ফিরে তাকায়, কিন্তু তাকালেই আর দেখতে পায় না। সে ভাবল, তার পেছন থেকে কিছু সরে গেছে। পিছন থেকে একটি হাত তার কাঁধ আঁকড়ে ধরল। কিন্তু যখন সে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল, তখন কিছুই ছিল না সেখানে। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।সে লক্ষ্য করল দূরে ঘূর্ণায়মান একটি সিঁড়ি আকাশের দিকে চলে গেছে, আর সাদা পশোকের এক অশরীরি শরির সেই সিড়ি পার হচ্ছে ডানায় উড়াল দিয়ে। রাশেদের গলা শুকিয়ে কাঠ।সে আচমকা ব্রেক কষে। সে কি স্বপ্ন না বাস্তবের মাঝে আছে তা বুঝতে পারে না। (সমাপ্ত)