আতোয়ার রহমান : বাসটা ফার্মগেটের সামনে এসে জ্যামে আটকা পড়ল, অধ্যাপিকা গাড়ি থেকে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। নগরীর সব পথ এখানে এসে মিশেছে। চারিদিকে ছূটাছুটি, ব্যস্ততা, হুড়াহুড়ি। পথচারী, ছাত্র, বখাটে, গার্মেন্ট কর্মী, প্রতারক, সাধু, পকেটমার, সমাজকর্মী, ছিনতাইকারী, সিনেমা হলের ব্লাকার, পাগল, পতিতা- এরকম নানা কিসিমের মানুষ আর নেড়িকুকুরের ভিড়বহুল কুশ্রী কোলাহলদীর্ণ জায়গাটা। খাবার হোটেল, কলেজ, কোচিং সেন্টার, সিনেমা হল, প্রসাধনী, কাপড়-চোপড়ের দোকান- সব মিলিয়ে এলাকাটা অনেক রাত পর্যন্ত খুব জমজমাট থাকে। রিকশা-ভ্যান, ট্যাক্সি-ট্রাক-দোতলা-একতলা বাস-এইসব যাবতীয় যানবাহনের উৎকট স্বরে হর্ণ বাজিয়ে নিত্য চলাচল। সব মিলিয়ে এক এলাহী কান্ড। ভিড়ের বাসে গাদাগাদি করে মানুষের ঘামের গন্ধ নিয়ে কুশ্রী আর অনিষ্টের কোলাহল একপাশে রেখে ওভারব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে সেটা যেখানে তেজগাঁও কলেজের দিকে গিয়েছে, সেখানে ব্যস্ত রাস্তায় হাতের ডানপাশে প্রতিদিন কলেজে যাওয়া আসার পথে এক কোনায় শিশুটিকে দেখেন অধ্যাপিকা। ওর নাম মনির। বয়স সাকুল্যে সাড়ে দশ। ময়লায় চুল জট বেঁধে আছে। চোখেপিচুটি। মুখে ময়লার ছোপ। গেঞ্জিটা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। এক পা সরু লাঠির মতো। ডান হাতের দুটো আঙুল কাটা। তার কপালের দিকে যে জায়গায় দুটো চোখ থাকার কথা, সেখানে দুটি লালচে গর্ত। একটা চোখ দিয়ে শুধু কাছের জিনিস ঝাপসা দেখতে পায়। অন্যরা তা বুঝতে পারে না, সেও এটা অন্যদের বুঝতে দেয় না। সারা শরীরে ফুসকুড়ি। গা থেকে আসছে দুর্গন্ধও। ডান কাঁধটা একপাশে ঝুলে থাকে। চার পাশে অফুরন্ত ধুলো। অন্ধ ছেলেটি একটি টিনের থালা হাতে এক টুকরো চটের ওপর বসে আছে, ঝাঁকাচ্ছে: ‘সাব, কিছু, কিছু দিয়া যান। সাব, সাব, সাব, কিছু দ্যান’।
বাটিতে দু-একটাসিকি আধুলির কয়েন। ঝাঁকানোর কারণে পয়সাগুলো ঝনঝন করে। অনেকেই তাকে পাশ কেটে দ্রæত চলে যায়। যখন ও পথচারীদের দিকে তাকিয়ে টিনের থালাটা নাড়িয়ে ভাঙা কণ্ঠে বলে দুদিনে কিছু খায়নি, তারা ওর দিকে চোখ কুঁচকে তাকায়, কোনো পেশাদারের মতো চোখের যোগাযোগ এড়িয়ে যায়, মুখ ফিরিয়ে চলে যায়।
শহরের মানুষগুলো কেমন যেন। আজকাল দান খয়রাত করতে চায় না, খুচরো টাকা পয়সা পকেটে রাখে না। তাদের চোখে আর দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালোবাসার দেখা মেলে না, দেখা মেলে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, ঘৃণা। কেউ কারও দিকে ফিরে তাকায় না। নিজেকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত।

অধ্যাপিকা ওর কষ্ট দেখে কেঁদে ফেলার উপক্রম। স¤প্রতি মারা যাওয়া তার প্রতিবন্ধী শিশু সিয়ামকে যেন খুঁজে পায় ওর মধ্যে। সিয়ামের সমবয়সী মনির। ওর জন্য কিছু একটা করার জন্য মনটা ছটফট করে। আহা বেচারা! যে বয়সে একটা শিশু মা-বাবার আদর সোহাগে, খোলা মাঠে খেলাধুলা আর খেলার সাথিদের সাথে হাসিঠাট্টায় দিন কাটায়, সে বয়সে শিশুটি দিনের পর দিন কী দুর্বিষহ কষ্টই না করছে, ভাবা যায়! অধ্যাপিকা ছেলেটার পাত্রে একটা মুদ্রা ফেলে, ঠং শব্দে ধন্যবাদ জানায় পাত্রটি।

পথচারীরা কখনও কখনও ওকে বাদাম, চানাচুর, পাউরুটি খেতে দেয়। টাকার চেয়ে খাবার পেলে বেশি খুশি হয় মনির। কারণ ওকে যে টাকা পয়সা দেওয়া হয় তা কখনোই সে নিতে পারে না, সেটা চলে যায় সুরুজের পকেটে। মনিরের সারাদিনের যা ‘ইনকাম’ তার সবটুকুই চলে যায় সুরুজের হাতে। ওর পোড়া কপালে জোটে শুধু একবেলার পচাবাসি খাবার।
কালেভদ্রে জীয়ল মাছের তরকারী দিয়ে সাদা গরম ভাত খায়। খিদার জ্বালায় সারাদিন অস্থির থাকে। খিদা ওর পেটে লবণ দেয়া কেঁচোর মতো থপ থপ করে মোচড় দেয়।
চার বছর বয়স থেকে দিনের পর দিন সে এ কাজটাই করছে এখানে বসে। সুরুজের সূত্রে ওভারব্রিজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে। এখন এটা শুধু মনিরের জীবন-জীবিকা নয়, এটা তার নেশা, তার প্রাণ। ব্রিজ থেকে সে নিজেকে আলাদা ভাবতে পারে না একটা মুহূর্তও। তবে কখনও কখনও সে কারওয়ানবাজার পার হয়ে পাশের শাহবাগ ওভারব্রিজেও চলে যায়। সর্দার যদি কখনও খবর পায় যে কোথাও বড় রকমের দান খয়রাতের ঘটনা আছে, তখন সে মনিরকে নিয়ে বাসে করে অনেক দূরেও চলে যায়।

মা বাবা কোথায় থাকে মনির তা জানে না। জানার কোনো আগ্রহও নেই। তবে ও ওর মনিবের কাছে অতীত বিষয়ে কিছুকিছু শুনেছে। যে ভিক্ষুক সর্দার সুরুজ ওকে প্রতিদিন সকালে তার দামি ধূসর লাল রঙের টয়োটা কারে করে এখানে এনে বসিয়ে দিয়ে যায়, আবার সন্ধ্যা হলে তাকে বেগুনবাড়ির পানির পাম্প এলাকায় দুদু মিয়ার বস্তির নিজ আখড়ায় ফিরিয়ে নেয়, সেই তার মনিব। যাওয়া আসার যে সময়টুকু কারে বসে থাকে সেটাই ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। ওই আখড়ায় অনেক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক বসবাস করে। সুরুজের মুখেই মনির নিজের অতীত শুনেছে। একদিন একজন আপাদমস্তক কালো বোরখাপরা মহিলা এগিয়ে যাচ্ছে-কারওয়ানবাজারের কাছে একটা কানাগলির শেষপ্রান্তে, নেড়িকুকুরগুলো অযথাই ঘেউ ঘেউ করছে, ঐ মহিলার কাছ থেকে সুরুজ তাকে কিনে নিয়েছে দুই হাজার টাকায়, তখন তার বয়স তিন মাস। ওই মহিলা সদ্যজাত মনিরকে হাতিরপুল কাঁচাবাজারের কাছের এক ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ভিক্ষুক সর্দার সুরুজ ভিক্ষুক কিনে নিজের কাছে আটকে রেখে ভিক্ষা করায়। এটা তার বাপ দাদার পুরনো ব্যবসা। তবে সুরুজ এটাকে এখন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মনিরকে দিয়েও একইভাবে ভিক্ষে করানো হয়। সুস্থ্ থাকলে রুজি রোজগার কম। তাই তাদের কাউকে সবসময় অসুস্থ্ করে রাখা হয়, পঙ্গু, নুলো করা হয়, হাত পা কাটা হয়। আবার কাউকে কাউকে ঘাড়ে, মাথায় আঘাত করে শরীর অচল বানিয়ে দেয়া হয়, বোবা বানানো হয়। কীভাবে হাত পাততে হয়, ভিক্ষে করতে হয় তার রীতিমত ট্রেনিং দেয়া হয়। সবাই এটা চট করে শিখে নিতে পারেনা, কিন্তু মনির পেরেছে।

ওভারব্রিজের প্রাণপুরুষ মনির।ওর মতো ‘ইনকাম’ এখানে কেউ করতে পারেনা।ছোট হওয়াতে সকলের মনযোগ কাড়ে। তাছাড়া পথচারীদের আবেগ অনুভূতিকে কাজে লাগাতে অন্যদের চেয়ে সে বেশি পটু। ওর স্পটটাও ভাল এবং এ নিয়ে এখানে প্রায়ই মারামারি হয়। এজন্য ওর ‘ইনকাম’ বেশি।মনিরের পাশেই অল্প দূরে ব্রিজের দেয়ালের গোড়ায় উরু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত খোলা রেখে গোদরোগের রোগী অনিল একটি সিসার বাটী হাতে বসে আছে, ঝাঁকাচ্ছে :‘কত টাকা কত পয়সা কত দিকে চলে যায়, আল্লার রাস্তায় দান করিলে আখিরাতে পাওয়া যায়’…। সর্দারের শিখিয়ে দেয়া বুলি একজন নিষ্ঠাবান শিষ্যের মত অনর্গল আওড়িয়ে যাচ্ছে।

একজন এসে তাকে কয়, তুই এখানে কেন? এখানে তো একটা চাচা বসতো। স্যার, আপনি ঠিকই ধরেছেন।আসলে হইছি কি স্যার, আমি ওনার মাইয়ারে বিয়ে করছি তো। জায়গাটা যৌতুক হিসেবে পাইছি।

ওভারব্রিজের এই কোনায় বসার জন্য প্রতিদিন মনিরকে ‘ট্যাক্স’ দিতে হয়, চল্লিশ টাকা। করোনাভাইরাস যেমন আমাদের জীবনে ওঁত পেতে থাকে জীবন উপড়ে নেবার জন্য, তেমনি ওর টাকা খাওয়ার জন্য পুলিশ থেকে ওয়ার্ড কমিশনারের লোক ওত পেতে থাকে। কিশোর প্রেমিক তার প্রথম প্রেমের ঘোর আমেজে যেমন তার প্রেমিকার পেছনে ঘুরঘুর করে, চাঁদাবাজরাও তেমনি টাকার জন্য মনিরের পিছনে সবসময় ঘুরঘুর করে। ওয়ার্ড কমিশনারের ক্যাশিয়ার স্বপন নির্দিষ্ট সময়ে এসে কুড়ি টাকা নিয়ে তা গুনতে গুনতে সিগারেটে টান দেয়। সিগারেটের ধোঁয়া মশা মারা কয়েল থেকে ওঠা ধোঁয়ার মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।তারপর সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে একসময় মিলিয়ে যায় পলায়নপর সাপের সরু ও কুচকুচে কালো লেজের মতো। একটু পরেই নীল জামার পুলিশটি মনিরের কাছে এসে দাঁড়ায়, শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে ওর টিনের থালায় তাকায়, বলে কুড়ি টাকা ফেল। ছেলেটার মুখ শুকিয়ে যায়। সকাল থেকে বৃষ্টির কারণে আজ কামাই নাই। সে টাকা দিতে ইতস্তত করে, পুলিশটি চিৎকার শুরু করে, খিদে পাওয়া বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, বন্দুকের নল দিয়ে মনিরের ঘাড়ে বাড়ি দেয়, কপালে আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। আশে পাশের লোকজন তাকে দ্রুত চ্যাংদোলা করে কাছেই আল রাজি হাসপাতালে নিয়ে যায়। মনিরের কপাল কেটে যায়, দুটো সেলাই দেয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যায় মনির।

সকলে দেখল সেপাইটি টাকা পয়সা গুনে নিয়ে পরিতৃপ্তির সাথে পশ্চিম দিকের সিঁড়ি বেঁয়ে একটি ছায়া মূর্তির মতো নিচে নেমে গেল। মনির অসহায়ভাবে কনস্টেবলের অপসৃয়মান শরীরের দিকে তাকিয়ে রইল। পুলিশটি বন্দুক নিয়ে কোথায় কী যুদ্ধ করেছে কেউ জানেনা। কিন্তু সে প্রতিদিন নিয়ম করে একই সময়ে এসে তার কাছ থেকে কুড়ি টাকা নিয়ে যায়, এর কোন ব্যত্যয় নেই। জিজ্ঞেস করলে মনিরকে একদিন বলেছিল এ টাকার ভাগ ওপর মহল পর্যন্ত যায়। চাঁদার এই শৃঙ্খল থেকে কবে নিস্তার পাবে, রাজ্যের প্রশ্ন ও হতাশা ভীড় করে মনিরের মনে।

রাজাবাজারের ছোট সরু গলিটি তেজগাঁ কলেজের পাশ ঘেঁষে ইন্দিরা রোডের যে জায়গায় এসে মিশেছে সেখানে একটা বিতিকিচ্ছিরি পাকিয়ে তোলা রিকশার জট।রাস্তা থেকে কাছের ওভারব্রিজটায় যেতে হলে ফুটপাথ দিয়ে যেতে হয়।কিন্তু রাস্তার পাশ বরাবর পুরো ফুটপাথটাতেই হকারদের রাজত্ব। পায়ে চলার রাস্তাটা দখল হতে হতে ক্রমশ চাষের জমির আলপথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর কর্পোরেশনের দয়ালু হাতে বসানো ফুটপাথের টালিগুলো আলগা হয়ে এখন হোঁচট খাওয়ার ফাঁদ। রাস্তায় নেমে যে লোকজন হেঁটে যাবে, সেখানে আবার বাস আর ট্রাকের সুপারসনিক গতি, কখন যে কাগজ হয়ে রাস্তার বুকে সেঁটে যাবে তার ঠিক নেই।

জট কেটে সামনে এগোতেই ফুটপাতে হকারের চিৎকার- ‘যেটা খুশি কুড়ি টাকা, নিয়ে জান কুড়ি টাকা, সার্ট প্যান্ট কুড়ি টাকা, সালোয়ার কামিজ কুড়ি টাকা’।
সামনে এগিয়ে ওভারব্রিজে উঠল ম্যাডাম। রাস্তার ওপাশে দূরে দেখা যায় কারওয়ান বাজার জামে মসজিদের সবুজ গম্বুজ। সিনেমা হলের কোনায় একজন ম্যাজিক দেখায়, লোকজন গোল হয়ে তা দেখে। উদগ্র কোলাহলের মধ্যে অদূরে খামার বাড়ির পার্কে মেরুদন্ড ভেঙে যাওয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ছায়ায় ভবঘুরে ছেলেরা ক্রিকেট খেলে।

অধ্যাপিকা আস্তে আস্তে আবর্জনার মতো গুটিসুটি বসে থাকা মনিরের কাছে যায়, হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,এই বাবু বলতো আমি কে? তোর নাম কী? চোখে না দেখলেও অধ্যাপিকার উপস্থিতি সে দ্রæত টের পেয়ে যায়। বলে, আপনি কলেজের ভালো ম্যাম।আমাকে আদর করেন, বেশি বেশি পয়সা দেন। আমার নাম মনির,ম্যাম।
অন্ধ মানুষ খুব স্পর্শকাতর হয়। তাদের শ্রবণশক্তি খুব প্রখর থাকে।কোন শব্দ হলেই তারা টের পেয়ে যায়। মনিরেরও শ্রবনশক্তি প্রখর।

আমি তোকে হাসপাতালে নিয়ে তোর চিকিৎসা করাতে চাই। তুই কী বলিস? তোকে আমি এই ভিক্ষার কাজ করতে দিতে চাইনা, আমার কাছে রাখতে চাই। তোকে লেখাপড়া শেখাতে চাই।
মনির সত্যি সত্যি খুশি হয়ে ওঠে। অনেকদিন পর মনিরের মুখে একটুখানি হাসি ঝিলিক দিয়ে যায়। কতো অসহায় অথচ ওর মুখের হাসি কতো অমলিন, উচ্ছল। বলে- কবে হাসপাতালে নিবেন, কন? আমারও বড় পড়বার শখ। চোখটা ভালো হলে লেখাপড়া করতাম।
অধ্যাপিকা বলেÑ তুই চাইলে আগামীকালই হতে পারে।
মনির এবার কোন কথা বলে না। অধ্যাপিকা জিজ্ঞেস করে-তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
হইতাছে। কিন্তু আপনার তো অনেক টাকা ক্ষতি হইবার পারে!
এবার অধ্যাপিকা মিষ্টি করে হাসে-বলে তাতে কোন সমস্যা নাই।

নিজের কানকে বিশ্বাস হয়না মনিরের। এ দুনিয়াতে এত ভালো মানুষও আছে, এটা ওর মাথায় আসে না। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, যেন সহসা আসা এক পশলা দুর্বার দখিন হাওয়া। এর অজানা মধুর আনন্দে মনিরের বুকের মধ্যে এক মৃদু শিহরন বয়ে গেল।
মাকে দেখিনি। এক ফোটাও পাইনি মায়ের আদর, একদিনের জন্যও মাকে জড়িয়ে ধরে শুতে পারিনি, আজ যেন এক জলজ্যান্ত মা হাজির হয়েছে আমার সামনে, স্বগোতক্তি করে মনির।
ঠিক আছে আগামীকাল আমি তোকে এখান থেকে নিয়ে যাব, হাসপাতালে ভর্তি করাবো। খবরদার তুই তোর সর্দারকে একথা একদম বলবিনা। তাহলে তোকে যেতে দেবে না।
হ্যাঁ, সর্দার জানলে আমাকে মেরে ফেলবে। ঠিক আছে ম্যাম, আমি বলবো না।
কথা শেষ করে অধ্যাপিকা পূর্বদিকের নামার সিঁড়িতে যায়। গেট বন্ধ। রাইফেল আর রবারের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে নীলজামার পুলিশ।

প্রধানমন্ত্রী যাবেন।
কড়া শব্দের বাঁশী বাজিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ছুটে যায় সুদৃশ্য হেলমেটধারী রাজকীয় মোটরবাইক।
তার পর শুন্য রাজপথ সুনসান। মিহি শিশি শব্দ তুলে ছুটে যায় প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির বহর। ব্রিজের গেট খুলে যায়।
সোমবার বিকেল; দোকানপাট ও অদূরে সুদৃশ্য এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের কাঁচে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া আগুন রঙ সূর্যের আলো ঠিকরে উঠছে, পার্কের সুউচ্চ গাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে হলুদ আভার আলো ওভারব্রিজের খসখসে পাটাতনের উপর, মনিরের চোখে মুখে। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে দক্ষিণ থেকে। অধ্যাপিকা ওকে একটি অটোরিক্সায় করে চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি করালেন। সকলে কানাঘুষা করতে লাগলো অপারেশনের খরচ কে দিবে। অধ্যাপিকার টাকা দেয়ার কথা শুনে আশ্বস্থ হলো। এক্স-রে করা হলো, অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরীক্ষা করা হলো। অবশেষে দীর্ঘ অপারেশন হলো, এবং সফল হলো সে জটিল অপারেশন। জ্ঞান ফিরে এলো মনিরের।

মনির ঠোঁট চাটলো এবং ওর ভিক্ষা করার প্লেটটি হাতের মৃদু ছোঁয়ায় পরখ করল আবার। ডান হাতটি কাঁপছিল তাই সে এটি পিঠের পেছনে বাম দিকে চাপিয়েছিল। সে নিঃশ্বাস ফেলল এবং একটা দমকা শ্বাস ছেড়ে দিল।

সুস্থ্ হলো মনির, এখন ও এক চোখ দিয়ে সব দেখতে পারে, অন্য চোখটা দিয়েও একটু ঝাপসা দেখতে পায়। মনির বিস্ময় ভরে চারদিক দেখে ভাবছিল একি! খুশিতে কেঁদে ফেলল। ইতিমধ্যে হাসপাতালের লোকজন জড়ো হয়ে গেল। সবাই এটাকে অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করল। সবাই মিলে মনিরকে হাসপাতালের এক কোণায় নিয়ে গেল। পানি দিয়ে ধুয়ে দিল তার শরীর।নতুন কাপড় দিল পরার জন্য। অধ্যাপিকা আঁচল দিয়ে ওর গাটা মুছিয়ে দিল পরম স্নেহে।নতুন সাজে সজ্জিত করা হলো তাকে, গায়ে সুগন্ধি দেয়া হলো। অধ্যাপিকা অবাক হয়ে মনিরের সাজগোজ দেখে। মনির অবাক বিস্ময়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে আর আনন্দে বিহŸল হয়ে বসে আছে। ওকে এভাবে দেখতে পেয়ে আনন্দে খুশিতে চোখ ছলছল করে উঠল অধ্যাপিকার।চশমা খুলে চোখ মুছে ফের কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরে হাসিমাখা মুখে অধ্যাপিকা মনিরকে বলে,

তুই আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?
হ্যাঁ, ম্যাম। একটা চোখ দিয়ে আমি সব দেখতে পাচ্ছি, আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।
স্নেহময়ী জননীর মতো মনিরের দিকে তাকিয়ে এক পশলা হাসলেন অধ্যাপিকা। আনন্দে মনিরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মনির বিস্ময়ে বিমোহিত হয়ে পড়ে।
ডাক্তার মনিরের পোষ্ট অপারেটিভ চেক আপ করেছেন। সব কিছু ঠিক আছে। রোগিকে রিলিজ করে দিয়েছেন। আপনি রিসিপশনের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে রোগীকে আজকেই নিয়ে যেতে পারেন।
নার্সের কথা শুনে অধ্যাপিকা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিসিপ্সনিস্টের কাঁচ ঘেরা রুমের জানালার কাছে গেলেন। বিলের পরিমান জানতে চাইলে তরুনী রিসিপ্সনিস্ট বলল, সার্জন নিজেই বিলের সব টাকা দিয়েছেন। আপনি রোগী নিয়ে যেতে পারেন। কোন সমস্যা নেই।
উনি কেন টাকা দিলেন! ওনাকে বলেন নি আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ওর চিকিৎসার টাকা আমি দিব।
বলেছি। কিন্তু স্যার শুনলেন না। তিনি নিজের যমজ পুত্র সন্তানের জন্মদিন পালন করবেন বলে রেখেছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই বড় অনুষ্ঠান করার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সে অনুষ্ঠান পালন না করে মনিরের চিকিৎসায় পুরো টাকাটা দান করেছেন!
আমিও তো অনেকদিন ধরে ওর চিকিৎসার জন্য টাকা জমা করেছি, ধার কর্জ করে টাকা জোগাড় করেছি।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর স্যার রোগী দেখতে ওর কাছে এসে কথা বলেছিলেন। তখন তিনি ঠিক করে ফেলেন ছেলেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে টাকাটা অসহায় কিশোর মনিরের চিকিৎসা ও পড়াশোনার কাজে দিয়ে দেবেন। তিনি তাই করলেন।
কাচের জানালা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল, এবং অধ্যাপিকা সার্জনের মহানুভবতায় বিস্ময়ে বিমুড় হয়ে গেলেন।
অধ্যাপিকা নিজেকে সামলাতে পারলেন না, চোখ পানি এল।
এমন মানুষ আজও আছেন সমাজের বুকে? অধ্যাপিকা চোখ বুজে বিড়বিড় করে বললৃ।
লেখকঃ গল্পকার