শাহনুর চৌধুরী : ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালু এবং এর ব্যবহার নিয়ে কানাডায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামতের ঝড় বিষয়টিকে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। এই পাসপোর্টের পক্ষে যারা তারা গণপরিবহনে ভ্রমণ ও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়াসহ বিভিন্ন ইতিবাচক দিকের বিষয় তুলে ধরছে। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে এই পাসপোর্ট চালু হলে কানাডায় প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকারের বিষয়টি ক্ষুন্ন হবে এছাড়া সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টিও ব্যাহত হবে।

তবে এই বিতর্কের মধ্যেও বিভিন্ন প্রদেশে সরকার ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালুর ঘোষণা করছেন। ক্যুইবেকের প্রিমিয়ার ফ্রাসোয়া লেগু গত বৃহসস্পতিবার তার প্রভিন্সে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে শুধু জিম, বার ও রেস্টুরেন্টে এই পাসপোর্ট ব্যবহারের পরিকল্পনা থাকলেও এখন দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড উন্মুক্ত করে দেয়ায় এই পাসপোর্ট ব্যবহারের পরিধিও বাড়ানো হচ্ছে। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশে সংক্রমণের চতুর্থ ঢেউ ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে তিনি সবাইকে দ্রুত পূর্ণ ডোজ টিকা নিয়ে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট সংগ্রহ করার আহ্বান জানান। তার ওই আহ্বানের পরেই সেখানে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।

অন্যদিকে ম্যানিটোবা প্রদেশে ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন কার্ড ইস্যু শুরু হয়ে গেছে। ফুল ডোজ ভ্যাকসিনেশনের প্রমাণ হিসিবে ওই কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে। ম্যানিটোবা থেকে অন্য কোন প্রদেশে গিয়ে এই কার্ড প্রদর্শন করলে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে। এছাড়া কার্ডটি দেখিয়ে সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে বিশেষ সুবিধা গ্রহন করা যাবে।

এদিকে ক্যুইবেকের মন্ট্রিলে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে ১ সেপ্টম্বর থেকে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালুর আগে বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফা পরীক্ষার সময় মিডওয়ে টেভার্নে কিছু লোক জড়ো হয়ে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে অংশ নেয়া চার্লস লেনডি নামের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, গত ১৫ মাস ধরে আমরা একটা কঠিন সময় অতিবাহিত করেছি। এখন আমাদের ব্যবসা যখন আস্তে আস্তে আবার জমে উঠা শুরু করেছে তখন ভ্যাকসিন পাসপোর্টের নামে কাস্টমারদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হলে আমাদের ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। তিনি বলেন, ওই পাসপোর্ট চালু হলে আমাদের কাস্টমারদের সাথে দু’ধরনের আচরণ করতে হবে। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট ধারীরা অবাধে সবখানে যাতায়াত করতে পারবে। আর অন্যরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখবে। একই দেশের নাগরিকদের জন্য এ ধরনের দ্বৈত আরচণ আমাদের সংবিধান সমর্থন করে না।

বিক্ষোভ স্থলে যাতে কোন সহিংসতা বা অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর একজন সদস্য বলেন, প্রত্যেকেরই তাদের মতামত জানানোর অধিকার আছে। তবে করোনার ৪র্থ ঢেউ ঠেকাতে সরকারের ইতিবাচক সব সিদ্ধান্তই আমাদের মেনে নেয়া উচিত। ক্যুইবেকে ভ্যাকসিন পাসপোর্টের ৪র্থ দিনের পরীক্ষা আগামী সপ্তাহে মেজর জুনিয়র হকি লীগের একটি খেলার সময় নেয়া হবে বলে তিনি জানান।

ভ্যাকসিন পাসপোর্টের বিরোধীদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো সাইবার নিরাপত্তা। ভ্যাকসিন পাসপোর্টের অপব্যাবহার বা হ্যাকিংয়ের ফলে মানুষের ব্যাক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা অনিশ্চিত হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। অবশ্য এ বিষয়ে অভিজ্ঞ সরকারি বিশেষজ্ঞরা তাদের এই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ভ্যাকসিন পাসপোর্ট সম্পর্কে সাইবার নিরাপত্তার শঙ্কা যতটা না বাস্তবিক তার চেয়ে বেশি মানসিক। এই পাসপোর্টের মাধ্যমে কারো ব্যাক্তিগত কোন তথ্য চুরি বা তথ্যের সুরক্ষা অনিশ্চিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তারপরও ভ্যাকসিন পাসপোর্টের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এর মান উন্নয়নের জন্য কানাডিয়ান সাইবার সিকিউরিটি সেন্টারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেন্টারের নতুন দায়িত্ব নেয়া স্কট জোন্স বলেন, ভ্যাকসিন পাসপোর্টের মান এমন পর্যায়ে নেয়া হবে যাতে কানাডিয়ানরা এটি বিদেশেও ব্যবহার করতে পারে। প্রসঙ্গত কানাডার সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি কমিউনিকেশন্স সিকিউরিটির সাথে সাইবার নিরাপত্তা ও অবকাঠামো নিয়ে কাজের ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে জোন্সের। তাই ভ্যাকসিন পাসপোর্টের হ্যাকিং বা তথ্যের অপব্যবহার বন্ধ করতে তাকে নতুন দায়িত্ব দিয়েছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত সপ্তাহে ফেডারেল পাবলিক সার্ভিসের সব কর্মী ও কর্মক্ষেত্রে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন। তার ওই ঘোষণার বিরোধীতা করেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতারা। এখন ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালু ও এর ব্যবহার নিয়েও দু’পক্ষের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আগামী ২০ সেপ্টেম্বর দেশটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে উভয় পক্ষই নিজেদের মতো করে এই ইস্যুটি কাজে লাগাতে চাইছে। নির্বাচনী ফলাফলে এই ‘ভ্যাকসিন পাসপোর্ট’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র : রেডিও কানাডা