কামাল কাদের : ওয়েলস দেশটি যুক্তরাজ্যের একটি অঙ্গ রাজ্য। রেক্সহাম শহরটি রাজধানী কার্ডিফ শহরের তুলনায় অনেক ছোট। শহরটি রাজধানী থেকে বেশ কিছু দূরে। ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম যখন চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পেলো তখন ভাবলো ডাক্তারির “গুরুপ প্র্যাক্টিসে” চাকরিটা নিবে কিনা। আজকাল বিদেশী ডাক্তারদের যা অবস্থা, সে কথা ভেবে চাকরিটা গ্রহণ করবে বলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলো।

একদিন সময়মতো তল্পি-তোলপা নিয়ে রেক্সহ্যামে হাজির হলো। আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাট সব মিলিয়ে ডাক্তার সিরাজের কাছে শহরটিকে ভালোই লাগলো। আসার আগে যতটা নিরুত্সাহ বোধ করছিলো ততটা আর মনে হলো না। শহরের মাঝখানে একটা চত্বর রয়েছে, যেখানে স্থানীয় লোকদের শপিং সেন্টার। সেখানে, বুটস, টেস্কো, সেন্সবারি, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রের দোকান রয়েছে। বড় বড় সুপার মার্কেটগুলোতে বাজার করতে চাইলে ড্রাইভিং করে অনায়াসে কার্ডিফে এসে তা করা যায়। শহর থেকে কিছু দূরে একটা কারিগরী কলেজ এবং একটা জেনারেল হাসপাতালও রয়েছে।

শহরের হেলথ সেন্টারের ভিতরে রোগী দেখার চেম্বার। এ দেশে এ ব্যবস্থাকে “সার্জারি রুম” বলে থাকে। সকাল-সন্ধ্যায় রোগী দেখা, আর “কল” থাকলে বাড়িতে গিয়ে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিত্সা করা, এই হলো ডাক্তার সিরাজের কাজ। কিছুদিনের মধ্যেই ডাক্তার সিরাজ লক্ষ্য করলো যে, সে এই ছোট্ট শহরে এখানকার লোকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। যদিও সে বাদামী রঙের মানুষ, তবুও এখানকার জনগণ তাকে যে ভাবে গ্রহণ করছে তা দেখে সে অভিভূত হয়ে পড়েছে। দোকানে, বাজারে, রাস্তা -ঘাটে কেউ না কেউ বলছে, “গুড মর্নিং ডক্টর”, হাউ আর ইউ ডক্টর “আজকের দিনটি খুব ভালো, তাই নয় কি ডক্টর।” ইত্যাদি।

একদিন স্থানীয় পার্কে একটা বেঞ্চীতে সিরাজ বসেছিল। হঠাত করে একটা ছোট্ট মেয়ে তার মা’র হাত থেকে মুক্ত হয়ে সিরাজকে জড়িয়ে ধরে তার মাকে চিত্কার করে বলছে “মামী, মামী, লুক মাই ডক্টর”। প্রায়ই এরকম ঘটনা ঘটার ফলে সিরাজ মাঝে মাঝে ভাবে চাকরীটা নিয়ে সে ভালোই করেছে। অন্তত কালো – সাদার বিভেদটা লন্ডনের মতো এখানে এতটা প্রকট না।

শনিবার দিন। অন্যান্য দিনের মতো “সার্জারি” শেষ করে সিরাজ ঘরে ঢুকতেই ল্যান্ড লাইনের টেলিফোন খানা বেজে উঠলো। একান্ত অনিচ্ছাসত্তে¡ সে রিসিভারটা উঠালো।
– ডক্টর ইসলাম স্পিকিং, সিরাজ বললো। অপর পাশ থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের কান্নার শব্দ ভেসে এলো।

– ডক্টর ইসলাম হিয়ার, সিরাজ আবার বললো। সেই একই ধরণের কান্না আর কান্না। কচি কণ্ঠ। সিরাজ অবস্থাটা সিরিয়াস মনে করে সান্তনার সুরে বললো, “ডু নট ক্রাই, টেল মি ইওর প্রব্লেম!” মেয়েটি আশস্ত হয়ে ইংরেজিতে বললো “আমার নাম রোজি হক, আমার মা একনাগাড়ে অনেকগুলো ওষুধের বড়ি খেয়েছে, এখন সে অজ্ঞান অবস্থায় রয়েছে। আপনি কি দয়া করে আমাদের বাসায় আমার মাকে একটু দেখতে আসবেন? মেয়েটি যথারীতি নিজেকে সংযত করে কথাগুলো বলে গেলো।

– নিশ্চয় আমি আসব, তুমি তোমাদের বাড়ির ঠিকানাটা আমাকে বলতে পারো? সিরাজ রোজিকে জিজ্ঞাসা করলো।
বাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে সিরাজ অনিতিবিলম্বে রওয়ানা হয়ে পড়লো। দরজার কলিং বেল টিপার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজাটি খুলে গেলো। সে দেখলো, দরজার পাশে কিশোরী রোজি হক বিষন্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। রোজিকে দেখার মাত্রই সিরাজের চোখের সামনে পুরানো একটা মুখ ভেসে উঠলো। সেই একই মুখ, সেই মায়াবী চোখ, সে টোল খাওয়া চিবুক। এ কেমন করে হয়? সে নিজেকে নিজে বুঝা বার চেষ্টা করে, এটা তার মনের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
– “হাউ ডু ইউ ডু, ডক্টর?” রোজির কথায় সিরাজের চেতনা হয়। সিরাজ রোজির পেছনে পেছনে যেয়ে ঘরের সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠলো। রোজি একটা ঘর দেখিয়ে বললো, মা ওই ঘরে আছে।

সিরাজ ঘরে ঢুকেই চমকিয়ে উঠলো, এতো শাহানাজ, এক কালের তার অতি প্রিয় মানুষ। ছাত্র জীবনে সে ছিল তার ধ্যান -ধারণা। কত নিশিদিন কাটিয়েছে তারই তপস্যায়। আর আজ কিনা তাকে দেখবে এ অবস্থায়। এ যেন কল্পনার বাইরে। বিছানার ওপর হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। এ মুহর্তে সে একজন ডাক্তার, আর শাহানাজ তার রোগী। নাড়ী পরীক্ষা করতেই দেখে নাড়ী নিবু নিবু। পাশে কয়েকটি “ভ্যালিয়ামের” ওষুধের স্ট্রাইপ পড়ে আছে, যেগুলি সব শূন্য। সিরাজ তখনই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে ফোন করলো, “এখনই একটা রোগীকে ভর্তি করতে হবে, সাস্পেক্ট ওভারডোজ। এম্বুলেন্সের দরকার হবে না, সময় খুব অল্প তাই আমি নিজেই আমার গাড়িতে করে নিয়ে আসছি।” সিরাজ রোজিকে জিজ্ঞাসা করলো, “রোজি তোমার আব্বা কোথায়?”

– “সকাল বেলায় মা’র সাথে ঝগড়া করে বেড়িয়ে পড়েছে, যাবার সময়ে বলে গেছে আব্বা আর নাকি ফিরবে না এ বাসায়” কথাগুলি বলে রোজি আবার কেঁদে উঠলো। সিরাজ রোজিকে সান্তনা দিয়ে তাকেও সাথে করে তার গাড়িতে তুলে নিলো, ভাবলো এত বড়ো বাড়িতে মা-বাবার অনুপস্থিতিতে এতটুকুন মেয়েকে কি ভাবে একা রেখে যাওয়া যায়। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে শাহানাজকে ভর্তি করে রোজিকে সাথে করে সিরাজ তার বাসায় নিয়ে আসলো। সময় বুঝে সিরাজ রোজিকে জিজ্ঞাসা করলো,
“ব্যাপারখানা কি?” ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ও কিইবা বুঝে, তবুও ওর কথাবার্তায় সিরাজ ধারণা করতে পারলো যে, তার মা-বাবার সাথে ওরকম ঝগড়া-ঝাটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু আজকের মতো ঘটনা কখনো ঘটেনি। ঝগড়া শুরু হলেই মা সব সময় আব্বা কে বলতো, “ইউ অরে এ লায়ার”। কেন বলতো তা সে জানে না।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দুজনেই ডিনার সেরে ড্রয়ইং রুমে এসে বসলো। সিরাজ লক্ষ্য করলো রোজি মনোযোগের সাথে টেলিভিশনে কার্টুন দেখছে। ওকে আগের চাইতে কিছুটা রিলাক্স মনে হচ্ছে। সিরাজ তার নিজের সোফাটায় গা ছেড়ে বসলো। এরই মধ্যে সিনেমা, নাটকের মতো হু হু করে তার অতিত জীবনের ছবি ভেসে উঠা শুরু হলো। শাহানাজ কলেজের নামকরা সুন্দরী, তেজস্বনী বক্তা। এক ডাকে সবাই তাকে চেনে। অতি জটিল তত্ত¡ বা বিষয়, সহজে সুন্দর ভাষায় বুঝিয়ে বলাতে অদ্বিতীয়া। কলেজের শ্রোতারা তার বক্তিতায় মুগ্ধ হয়ে পড়তো। অনেক ছেলেই তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করতো। কিন্তু সে কাউকেই আমল দিতো না। উচ্চ আকাঙ্খা আর উচ্চভিলাসী মেয়ে। প্রথম চান্সই কলেজের সেক্রেটারি হতে তার বেগ পেতে হয়নি।

কলেজে প্রথম দেখা থেকে শাহানাজের প্রতি সিরাজের দুর্বলতা ছিল। সুযোগও মিলে গেলো। সে বছরই কলেজের ছাত্র সংসদের সেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গেলো। পাশাপাশি ছাত্র সংসদের কাজকর্মের ফলে দুজনের মেলামেশাটা গাড়ো হয়ে উঠলো। হঠাত করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সিরাজ খবর পেলো, শাহানাজের বিয়ে। পাত্র বিলাত ফেরত অটো-মোবাইল ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার শফিকুল হক। বিয়ে করে বৌকে নিয়ে আবার বিলাতে চলে যাবে। উচ্চ ভিলাসী আর উচ্চ আকাঙ্খী শাহানাজ এ বিয়েতে অমত করতে পারেনি। এদিকে সিরাজ নিশ্চল, নিশ্চুপ হয়ে নিজেকে পর্দা থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। তার আর কি বা করার ছিল। প্রতিবাদ করার কোনো ক্ষমতা ছিল না । ছাত্র ছিল, হাত পা বাঁধা ছিল, কোনো রকম ঝুঁকি নিতে সাহসে কুলায়নি। কার সাথে সে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবে? কোথায় সেই বিলাত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার জামাই, আর কোথায় সে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া ছাত্র। শুধু মনের ভিতরে ছিল একটা মানসিক জ্বালা, সে জ্বালা আজও বহন করে চলছে। দীর্ঘ দিন পরে শাহনাজকে এভাবে দেখতে পাবে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। পরে এক সময় দেশে থাকতে সে শুনেছিলো যে, শাহনাজের স্বামী অটো-মোবাইল ইঞ্জিনিয়ার ছিলো না, আসলে সে ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রিতে একটা গাড়ি বানাবার ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতো। শাহানাজের পরিবারের কাছে সে সত্য গোপন করে বিয়েটা করেছিল।

হঠাত রোজির ডাকে সিরাজের দিবা স্বপ্ন ভঙ্গ হলো, “ডাক্তার, তুমি না বলেছিলে দশটা বাজলে হাসপাতালে একটা ফোন করবে, মা কেমন আছে জানার জন্য। সেই কখন দশটা বেজে গেছে”। সিরাজ লাফ দিয়ে উঠে বললো, “হ্যাঁ, তাই তো।”
ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে সিরাজ ফোন করলো। ওপর থেকে সংবাদ এলো, “ডক্টর, গুড নিউজ। তোমার রোগী চোখ খুলেছে, আউট অফ ডেঞ্জার, বিপদ নেই, কিন্তু এখনও সে ক্লান্ত তার বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে কালকে ডিসচার্জ করা যাবে, কনসালটেন্ট তাই বলেছে”। খবরটা পেয়ে রোজি দারুন খুশি, ও বললো, “ডক্টর আপনি না থাকলে আমার মা মারাই যেত”।
সিরাজ বললো, “দূর বোকা, তা হয় নাকি, বুদ্ধিমতী মেয়ের মতো তুমি আমায় ফোন না করলে আমি কি কিছু জানতাম!”
“ওকে ডক্টর, আমিই জিতেছি।” সুন্দর মিষ্টি হেসে রোজি জানালো।
পরদিন সিরাজ রোজিকে সাথে করে হাসপাতালে গেলো। ইতিমধোই শাহনাজকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে জেনারেল ওয়ার্ডে নিয়ে এসেছে। ওয়ার্ডে সামনে রোজিকে ছেড়ে দিয়ে সিরাজ বললো, “রোজি, যাও তোমার মা’র সাথে দেখা করো গিয়ে”। রোজি প্রশ্ন করলো, “ডক্টর তুমি আমার সাথে আসবে না?”

– “আমি খুবই লজ্জিত রোজি, তোমার সাথে আসতে না পেরে, আমাকে এক্ষুনি একটা রোগী দেখতে যেতে হবে, খুবই আর্জেন্ট।” সিরাজ উত্তর দিলো।
– সত্যিই, তবে আর আপনাকে আটকাবো না। কিন্তু আমি বাসায় ফিরেই আপনাকে ফোন করবো, আর আপনাকে না পেলে আমি আবার কাঁদতে শুরু করবো।” রোজি অভিমানের সুরে বললো।
– ঠিক আছে, তবে তাই করো”, সিরাজ জানালো।
রোজি যতই ওয়ার্ডের ভিতর অগ্রসর হতে লাগলো সাথে সাথে, তার জুতার মর্মর শব্দ ক্রমশ কমে আসতে লাগলো, আর সেই সাথে সিরাজের বুকের ভেতরের পুরানো জ্বালাটা আবার জ্বলতে শুরু করলো, যে জ্বালা শুরু হয়েছিল সেই কবে, সেটা আবার নুতন করে সন্ধ্যা দীপের মতো জ্বলে উঠলো। শেষ
লেখক : কামাল কাদের (নিউবারি পার্ক, ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড),
email : quadersheikh@gmail.com