ঋতু মীর : ভুমিকা :
স্বাধীনতার এত বছর পড়ে পড়ন্ত বেলায় বাবাকে স্বাধীন ‘জয় বাংলা’ ছেড়ে কেন যেতে হবে? প্রথম লাইনে লেখকের এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রবল তৃষ্ণায় ‘চন্দ্রমুখী জানালা’ বইটিতে এক গভীর অনুভবে চোখ রাখি। মুক্তিযোদ্ধা বাবার দেশপ্রেমের চেতনায় গর্বিত ‘চন্দ্রমুখী জানালা’ উপন্যাসের নন্দিত লেখক ভজন সরকার। একজন মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগ, দেশের প্রতি হৃদয় নিঃসৃত আবেগ, যুদ্ধকালীন সময়, প্রিয়জন ছেড়ে দেশ মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাহিনীর সাথে ক্রমান্বয়ে আত্মস্থ হই। মনের গভীরে দাগ কাটে মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নের স্বাধীন দেশ ছেড়ে অন্য ভূমিতে উদ্বাস্তু হওয়ার দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা, আবেগ, অভিমান। নন্দিতা প্রকাশের এই বইটির প্রচ্ছদ করেছেন রাজিব রায়। কালো রঙ প্রচ্ছদে চন্দ্রালোকিত এক খোলা জানালা, বাইরের আকাশে পূর্ণ চাঁদ, এক মুক্তিযোদ্ধার দেহাবয়ব। চাঁদের আলো গায়ে মেখে সেই চন্দ্রিমায় তাকিয়ে আছেন আপন মগ্নতায়- “সদ্য স্বাধীন ‘জয়বাংলা’ তবে কি আজকের এই চাঁদের আলো! যে আলো তাঁর মত সংখ্যালঘুদের সারাজীবন চন্দ্রমুখী জানালা দিয়েই উপভোগ করতে হবে।” প্রচ্ছদের সাথে বইয়ের শিরোনামের যোগসূত্রতা নিঃসন্দেহে বইটির নামকরণের সার্থকতা এবং যৌক্তিকতাকেই প্রমাণ করেছে।

১।
গুলিতে ঝাঁঝরা, বেয়োনেট খোঁচানো সেই বীভৎস মৃতদেহটি হয়তো তাঁর বাবারই- এই খবরটা নাকি হাওয়ার বেগে তখন কলকাতায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। সদ্যজাত কন্যাকে দেখার অদম্য ইচ্ছায় লেখকের মুক্তিযোদ্ধা বাবা বর্ষার থই থই জল পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে সন্তানকে দেখতে যান। জনশ্রুতি অনুযায়ী কিছুক্ষণ পর বাড়ী থেকে বের হয়ে আসার পথেই নাকি রাজাকার এবং পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় এই খবরটা ছাপাও হয়। এই মৃত্যু সংবাদের প্রেক্ষিতে পরিবারের সবাই মৃতের আত্মার সদ্গতির জন্য গয়ায় ‘পিণ্ড’ দানের ব্যবস্থাও নাকি নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই সেই মুক্তিযোদ্ধা কলকাতায় মাতৃকুলের সবাইকে জানান দিতে যান যে, তিনি বেঁচে আছেন। সদ্য স্বাধীন একটা দেশ পাওয়ার উচ্ছ্বাসে তাঁর ধমনীর রক্ত তখন টগবগে। কলকাতার হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে চাকরীর প্রস্তাবটা নিজের বাবাকে তাৎক্ষনিক ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- “আপনিই না হয় ফিরে চলুন বাংলায়। ৬৫’র দাঙ্গায় হারানো পুরানো ঢাকার বনেদি পগোজ হাইস্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের চাকরীটাই আপনাকে আবার ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা যাবে” (পৃষ্ঠা-৮ )। স্বাধীন দেশের প্রতি পরম নির্ভরতা, আস্থা, সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন এবং অলিখিত এক অধিকারবোধের দৃঢ়তাই যেন সেদিন তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। চন্দ্রমুখী জানালা উপন্যাসে একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন ঝঞ্জা বিক্ষুদ্ধ জীবন, সন্তান সম্ভবা স্ত্রী, শিশু সন্তান, বাবা, মা আত্মীয় পরিজন বন্ধু, প্রতিবেশি সহ আরও অনেককে যুদ্ধের আশঙ্কাজনক অনিশ্চিত পরিবেশে ফেলে রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের সেই বর্ণনায় মন আতঙ্কে শিউরে ওঠে। ৯৫ পৃষ্ঠার এই বইটির বিক্রয় মূল্য ২৪০ টাকা। মোট ২১টি অধ্যায়ে স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পরে যুদ্ধের, সংগ্রামের সময়কে ফিরে দেখা, খতম ও নকশাল আন্দোলন, কলকাতার রিফিউজি, পাকিস্তানী মিলিটারীর টার্গেট হিন্দুসমাজ, রাজাকার বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মৃত্যু, বিজয়, স্বাধীনতার ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সদ্য স্বাধীন দেশের প্রতি ন্যায্য অধিকারবোধ, প্রাপ্য সম্মান, প্রত্যাশা আর বিপরীতে বঞ্চনা, গøানি, অসম্মান, বৈষম্যের অসংগতি এবং হতাশায় নিমজ্জনের কাহিনী লেখনীর সাবলীল স্বকীয়তায় ফুটে উঠেছে। সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য, রাজাকারদের অত্যাচার, হিন্দু সম্পত্তি দখল, বাসভুমি থেকে হিন্দু উচ্ছেদ এবং পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে কষ্টার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ ছেড়ে একসময় ভারতে ফিরে যাওয়ার কথাকাহিনীর এক টানটান চিত্র পাঠক মন ছুঁয়ে গেছে।

২।
মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনায় হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষ, হিন্দুদের ভিতরে চাপা আশঙ্কা, হিন্দু বাড়ীতে রাজাকারদের লুটপাট, ভয় ভীতি দেখিয়ে জমি, বাড়ীর দখল, হিন্দু যুবতী কন্যা বউদের শ্লীলতাহানি, জোরপূর্বক বিয়ে, নির্যাতন- এই সব ঘটনা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতায় উপস্থাপিত হয়েছে। বর্ষার জল, আউশ, জলি ধান কাটা এবং পাট কাটার পর ক্ষেতের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে থাকার জায়গার অভাব বিষয়গুলো যুদ্ধকালীন ধারাবাহিকতায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। “মৃত্যুরও তর সয়না যুদ্ধকালে’ (অধ্যায় ৬, পৃষ্ঠা ২৬) এ উল্লিখিত সারাজীবন লাঠির উপর ভর করে হাঁটা জীবন নির্বাহে অন্যের উপর নির্ভরশীল ছোট দাদুর মৃত্যু ঘটনা পাঠক মনকে সহসাই ভারাক্রান্ত করে তোলে। গোটা বাড়ী শোকে মুহ্যমান কিন্তু কান্নার রোল নেই। মৃত্যুও যেন ‘হাফ ছেড়ে’ বাঁচার বিষয়। বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিলে চলৎ শক্তিহীন এই মানুষটিকে যে পুড়েই মরতে হবে! তার চেয়ে এই মৃত্যুই যেন অনেক সহজ, অনেক স্বস্তির। সময়ের, পরিস্থিতির কারণে মৃতদেহ সৎকারের পরিবর্তে বস্তায় ধলেশ্বরী নদীর জলে দেহ নামিয়ে সাবধানতায় ক্ষীণ স্বরে “হরিবোল” বলার দৃশ্য বর্ণনায় পাঠক মন আদ্র এবং ঘটনার সাথে একাত্ম হয়ে ওঠে ।

৩।
“শালা মালাউনের বাচ্চাটা কোথায়?” হিন্দু মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে বাড়ীতে রাজাকারের আগমন, এবং পরিবারের পাঁচজন সবল সক্ষম মানুষকে বিনা প্রতিরোধে বন্দুকের বাটে আহত করে নৌকায় তুলে নেয়া, দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঠাকুমা –পিসিমার কান্নায় ভারী হয়ে ওঠা চারপাশের দৃশ্য বর্ণনা সত্যিই রোমহর্ষক। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পাকাপাকিভাবে অবস্থান, বাড়ীর সাথে যোগাযোগে বিচ্ছিন্নতা, মানিকগঞ্জ মহকুমা সদর, ঘিওর-তেরস্রী এলাকাতে মুক্তিবাহিনীর কম্যান্ড, অপারেশন, এবং জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া- এই অংশের সবটুকু বর্ণনাই প্রচন্ড স্মৃতি জাগানীয়া। পাকবাহিনীর গুলিতে নিথর দেহগুলো একে একে নদীতে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছিল। জলে দেহ পতনের শব্দ এবং পাকিস্তানী মিলিটারির অট্টহাসী- হৃদয় বিদারক এই ঘটনার বিবরণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জঘন্যতম নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে আছে। যুদ্ধের সময় দেশ, সংসার, ব্যবসা বাণিজ্য সব ফেলে শুধু প্রাণটা নিয়ে চলে আসতে হয়েছিল পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের। খোলা আকাশের নিচে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে থাকা মানুষের মধ্যে কেবল বিশৃঙ্খলা এবং নিয়ম ভাঙ্গার অনিয়ম। “শরণার্থীদের ভিড়ে ঠাসা কলকাতা রাত নামলেই নীরব হয়ে যায়। মানুষ নকশালদের ভয়ে ঘরে ফেরে আলো থাকতেই”-এমন এক পরিস্থিতিতে লেখকের মুক্তিযোদ্ধা বাবার প্রচন্ড ভীরের ট্রেনে উঠে পরা, শরণার্থীদের সাথে স্বাধীন ‘জয় বাংলা’ এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌতাত গল্প এবং ঠিক সেই সময়েই ট্রেনের কামরায় মিলিটারি জোয়ানদের আগমন, ছদ্মবেশী নকশাল সন্দেহে বাবাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং ট্রেনের শরণার্থীদের সম্মিলিত প্রতিবাদে সে যাত্রায় তাঁর বাবার প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার শ্বাসরুদ্ধ কাহিনী মনে দাগ কেটেছে।

৪।
ডিসেম্বর মাস। বর্ষার জল শুকিয়ে রাস্তাঘাট চলাচল উপযোগী। ভারত-পাকিস্তান বিরোধ তুঙ্গে, যে কোন সময়েই দুই দেশ ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় সাধারণ জনজীবন বিপর্যস্ত। পাকিস্তানের মিলিটারিসহ স্থানীয় আলবদর, রাজাকারদের গতিবিধি সীমিত। শান্তি কমিটির অফিস বন্ধ, বাঁশের উপর চাঁদ তাঁরা অঙ্কিত পাকিস্তানী পতাকার রঙও রোদে পুড়ে মলিন। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটি হিসেবে পরিচিত গ্রাম কুস্তায় পাকিস্তানী মিলিটারির বিশাল বহরের উপর আক্রমন, রাজাকার আলবদরদের গণপিটুনী, মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আক্রমনে গ্রাম মিলিটারি শুন্য এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ঘিওরকে মুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা -এই সব ঘটনা একে একে বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।

উপসংহার :
শুরুতে উত্থাপিত সেই প্রশ্নই যেন আবার ঘুরে ফিরে পাঠকের সামনে আসে- একজন মুক্তিযোদ্ধা কেন স্বাধীন দেশের মাটি ছেড়ে অন্য ভূমে আশ্রয় বা বসবাসের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হোল? ‘জয় বাংলা’ মানেই যে স্বাধীনতা, মুক্ত প্রাণের উচ্ছ্বাস! হিন্দু সংখ্যালঘুর তকমা আজীবন গায়ে সাঁটানো বলেই কি আজ সেই ‘জয় বাংলায়’ ফিরে যেতে তাঁর এত বাঁধা, এত অভিমান! বলতে দ্বিধা নেই, “চন্দ্রমুখী জানালা” পাঠককে স্বকীয়তা এবং সাবলীল গতিময়তায় বহুদুর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কেবল বলার জন্যই বলা নয়, একজন শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বিমুগ্ধ পাঠক হিসেবেই বইটির পর্যালোচনা প্রসঙ্গে কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হোল। প্রথমেই- মুদ্রণে অসাবধানতা জনিত কিছু ত্রুটি রয়েছে যা শব্দ এবং বাক্যের অর্থের বোধগম্যতায় বিভ্রান্তি তৈরি করেছে- যেমন, “স্বাধীনতার এত বছর পরে পড়ন্ত বেলায় বাবাকে স্বাধীন ‘জয় বাংলার’ ছেড়ে কেন যেতে হবে?” এখানে ‘বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলা’ হওয়া উচিত বলে মনে হয়েছে (পৃষ্ঠা ৭)। “বাবা জানেন বড়মাকে কোনো কথায় বশে আনা যাবে” (পৃষ্ঠা ৩০), “অখিল ঠাকুরের বোনই শুধু বিয়ে করে নাই” (পৃষ্ঠা- ২৪), “কোনো” এবং “বোনই”- এই দুই শব্দের ব্যবহার বাক্যের পূর্ণ অর্থ অনুধাবনে সমস্যা তৈরি করেছে। দ্বিতীয়তঃ ‘জয় বাংলা’- এই দুই শব্দ প্রজ্জ্বলিত মশাল মিছিলের সেই দীপ্ত শ্লোগান! কর্ণকুহরে ‘বাংলাদেশ’ নামটা শুনলেই দেহ মনে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। সেক্ষেত্রে দেশকে ‘জয় বাংলা’ উল্লেখ করায় আবেগ তাড়িত পাঠক মন অনেকবার হোঁচট খেয়েছে। তৃতীয়তঃ ঘটনার বিবরণে কখনো কখনো সময়ের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বারবার পিছনের অধ্যায় পুনঃ ফিরে দেখার কারণে পাঠের গতি এবং মনোযোগে বিঘ্ন ঘটেছে। এক্ষেত্রে অতীত ঘটনা বিশেষতঃ ইতিহাস বিশ্লেষণে “সময় স্তম্ভ” বা “Time bar” চিন্তায় রেখে অধ্যায়গুলো বিন্যস্ত হলে ঘটনার পরম্পরা অনুধাবন আরও সহজ হতো। শেষতঃ “স্বাধীনতার এত বছর পরে পড়ন্ত বেলায় বাবাকে স্বাধীন ‘জয় বাংলা’ ছেড়ে কেন যেতে হবে? (পৃষ্ঠা ৭)”- লেখকের এই প্রশ্নে পাঠক মনে প্রশ্ন জাগে- এখানে সময়ের হিসাবটা ঠিক পরিস্কার নয়। বইয়ের তথ্যানুযায়ী, লেখকের মুক্তিযোদ্ধা বাবা স্বাধীনতার ঠিক পরপরই ১৯৭২ সালে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। লেখকের দাদা মশায় যিনি ৬৫ সালের দাঙ্গার পরে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদিতার উত্থানের কারণে শঙ্কিত হয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসেন ভারতে। তথ্য বিচারে বলা যায়- স্বাধীনতার ঠিক পরপরই সেই মুক্তিযোদ্ধা ঠিক ‘পড়ন্ত বেলায়’ পৌঁছে যাননি বলেই ধারণা করা যায়। এক্ষেত্রে ‘পড়ন্ত বেলায়’ শব্দের ব্যবহার ঠিক কেন হোল তা যেমন পরিস্কার নয়, তেমনি এই চিন্তা যে স্বাধীনতার অনেক বছর পর “পড়ন্ত বেলা’র এক মুক্তিযোদ্ধার সেটাও কিছুটা ধোঁয়াশাই থেকে গেছে। এছাড়াও – পূর্ব পুরুষের নেয়া সিদ্ধান্তই কি একজন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাকে স্বাধীনতার ঠিক পর পরই দেশের মাটি ছেড়ে অন্য ভূমে চলে যেতে প্রভাবিত করেছে? এক্ষেত্রে অন্য অনেক কারণের সাথে ‘পারিবারিক’ সিদ্ধান্তও কি দেশ ত্যাগে বড় ভূমিকা রাখেনি? বলা বাহুল্য, আমরা হয়তো এক অচেতনতা থেকেই দেশ এবং দেশের চালিকা শক্তি ‘সরকার’ নামের ‘সিস্টেম’ কে নিজের মনোজগতের বোধে এবং অনুভবে একাকার করে ফেলি । দেশ এবং সরকারের তাত্তি¡ক পার্থক্য সুনির্দিষ্ট। প্রতিটা মানুষ নিজের দেশ মাতৃকার সন্তান, সরকারের নয়। দেশ মায়ের কাছে হিন্দু বা মুসলমান কোন সন্তানই অবহেলা বা অবমাননার পাত্র নয়। দেশের প্রতি অলিখিত এক অধিকারবোধ মানুষের জন্মগত। কাজেই সেই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেশ অভিমান, অভিযোগ, সমালোচনার অনেক উপরে। প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় কেবল ‘সরকার’ নামের রাজনৈতিক ‘ব্যবস্থা’কে। মত প্রকাশের সেই অধিকার সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার। চন্দ্রমুখী জানালায় বৈষম্য উল্লেখে সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্ন এবং সেইসাথে ‘কি হওয়া উচিৎ’ এমন উত্তর থাকলে পাঠক উপকৃত হোত। ‘চন্দ্রমুখী জানালা’র সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার দেশকে মুক্ত করে তারপর ছেড়ে চলে যাওয়া কি কেবল মনোজাগতিক দ্ব›দ্ব, অভিমান বা যন্ত্রণার আবেগ থেকে মুক্তির এক বিকল্প সমাধান? নাকি দেশ মাকে ছেড়ে যাওয়ার ভুল সিদ্ধান্তে অন্যরকম যন্ত্রণা, কষ্টের, গ্লানির ভারবাহী বোঝা বয়সের এই পড়ন্ত বেলায় বয়ে বেড়ানো। চন্দ্রমুখী জানালায় একজন মুকিযোদ্ধার ‘দেশ’ ছাড়ার সুনির্দিষ্ট কারণ, প্রমাণাদি বা স্বগতোক্তির প্রশ্ন-উত্তরে তা যেন কিছুটা উহ্যই থেকে গেছে।

পরিশেষেঃ
স্বাধীনতা ‘পাওয়া’ নয় ‘অর্জনের’! মুক্তিযোদ্ধা বাবার দেয়া উপহার হারিয়ে যাওয়া সেই চামড়ার পিওর লেদার জুতা জোড়ার মত তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও কি এমনি হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে? লেখক মনের এই প্রশ্ন ধরেই যে ‘চন্দ্রমুখি জানালা’ এগিয়ে গেছে, আজ পাঠকের দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণের এই পরিসরে উত্থাপিত প্রশ্নের সম্পূরক উত্তর খোঁজার তাড়না লেখকের কলমকে ভবিষ্যতে আবারও ছুটিয়ে নেবে নতুন কথাকাহিনিতে – এই আশাই করি। ‘চন্দ্রমুখি জানালা’ অগুনিত পাঠকের মন ছুঁয়ে সমাদৃত হোক ! শুভকামনা লেখক !
ঋতু মীর : শিক্ষক ও লেখক, টরন্টো, কানাডা